ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজনীয়তা কেন?
জান্নাতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এই পথ বড়ই দুর্গম ও কণ্টকাকীর্ণ। এ পথে চলতে গেলে বাধা আসে। কষ্ট পেতে হয়, বিষময় কাঁটার আঘাত সহ্য করতে হয়। নবী-রাসূল, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের আলোকিত জীবনের দিকে তাকালে এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। তারা এই পথে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, নিজেদের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই; আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাত লাভ করা। সুতরাং ফেরদাউসের রাজপথে চলতে হ’লে আমাদেরকেও দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। নিমেণ সংক্ষিপ্তাকারে ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজনীয়তা আলোকপাত করা হ’ল-
১. আল্লাহর নির্দেশ পালন :
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। জীবনের যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে হ’লেও সেই ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কেননা আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জান্নাত পিয়াসী বান্দাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। যুলুম-অপবাদ সহ্য করে তাকে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল যখন আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় দাওয়াতী কাজ শুরু করেন, তখন তাকে সহ্য করতে হয়েছিল অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এমনকি তাকে বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ১৬ রকমের অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। দ্বীনের পথে এসে ছাহাবীগণও সেই নির্যাতন ও কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা কখনো আল্লাহর দ্বীন থেকে সরে যাননি; বরং মযবূত ঈমান নিয়ে অহি-র নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন।
আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ، ‘হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে যা নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। যদি না দাও, তাহ’লে তুমি তাঁর রিসালাত পেঁŠছে দিলে না। আল্লাহ তোমাকে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করবেন’ (মায়েদা ৫/৬৭)। এই আয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে আমাদের সবাইকে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বিশুদ্ধ দ্বীনের দাওয়াত দিলে মানুষের পক্ষ থেকে অবশ্যই বাধা আসবে, যেমনভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে এসেছিল। তবে সেই বাধা-বিপত্তি থেকে আল্লাহ রক্ষা করবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَقَدْ أُخِفْتُ فِي اللهِ وَمَا يُخَافُ أَحَدٌ، وَلَقَدْ أُوذِيتُ فِي اللهِ وَمَا يُؤْذَى أَحَدٌ، وَلَقَدْ أَتَتْ عَلَيَّ ثَلَاثُونَ مِنْ بَيْنِ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ وَمَا لِي وَلِبِلَالٍ طَعَامٌ يَأْكُلُهُ ذُو كَبِدٍ إِلَّا شَيْءٌ يُوَارِيهِ إِبْطُ بِلَالٍ، ‘আমাকে আল্লাহর পথে যেভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়েছে, অন্য কাউকে সেরূপ ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়নি। আমাকে আল্লাহর পথে যেভাবে কষ্ট দেয়া হয়েছে, আর কাউকে সেভাবে কষ্ট দেওয়া হয়নি। আমার উপর দিয়ে ত্রিশটি দিন-রাত এমনভাবে অতিবাহিত হয়েছে যে, বিলালের বগলের মধ্যে রক্ষিত সামান্য খাদ্য ছিল আমার ও বিলালের সম্বল। তাছাড়া এতটুকু আহারও ছিল না, যা কোন প্রাণধারী প্রাণী খেয়ে বাঁচতে পারে’।[1]
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমন করার পর রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারতেন না। তিনি বলতেন, ‘আহা! যদি আমার কোন সৎকর্মশীল ছাহাবী আজকের রাতটুকু আমাকে পাহারা দিত! তিনি বলেন, আমরা এই চিন্তায় ছিলাম, হঠাৎ অস্ত্রের শব্দ শুনতে পেলাম। রাসূল (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তর এলো, আমি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি কি কারণে এসেছ? সা‘দ (রাঃ) বললেন, আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমার মনে শঙ্কা জাগ্রত হওয়ায় আমি তাঁকে পাহারা দিতে এসেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর জন্য দো‘আ করেন। তারপর তিনি এমন প্রশান্তির ঘুম দিলেন যে, আয়েশা (রাঃ) তাঁর নাক ডাকার আওয়াজ শুনতে পেলেন’।[2]
আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কত পেরেশানির মধ্যে দিনাতিপাত করতেন, এই হাদীছগুলোর মাধ্যমে তা কিছুটা হ’লেও অনুমান করা যায়। সুতরাং আল্লাহর দেওয়া এই জীবনকে তাঁর নির্দেশে তাঁরই পথে উৎসর্গ করা মুমিন বান্দার প্রধান কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، ‘বল, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ, সবই বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য’ (আন‘আম ৬/১৫২)।
২. রিসালাতের আমানত রক্ষা:
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে নবী-রাসূলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ক্বিয়ামত পর্যন্ত একদল হকপন্থী আলেম দ্বীনের হাতলকে মযবূতভাবে ধারণ করে থাকবেন এবং কুরআন-হাদীছের স্বচ্ছ সলিলে বিধৌত বিধান অনুযায়ী মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করতে থাকবেন। কেননা হকপন্থী মুখলেছ আলেমগণই নবীদের ইলমের ওয়ারিছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا، وَلَا دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ، ‘নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীদের ওয়ারিছ। আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসাবে কোন দীনার-দিরহাম রেখে যাননি; বরং তারা মীরাছ হিসাবে রেখে গেছে ইলম। কাজেই যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, সে যেন ইলমের একটি পূর্ণ অংশ লাভ করল’।[3]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘আলেম এবং তালেবুল ইলমদের আবশ্যকীয় কর্তব্য হ’ল- তারা শরী‘আতের কল্যাণকর দিকগুলো মানুষের সামনে বর্ণনা করবে এবং সেই পথে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। আর অকল্যাণকর বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরবে এবং তা থেকে সতর্ক করবে। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরে আর কোন নবী আসবে না এবং তাঁর মাধ্যমে নবুঅতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই নবীদের অবর্তমানে এই উম্মতের আলেমগণই নবীদের ওয়ারিছ। শরী‘আতের বিধি-বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে নবীদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত ছিল, আলেমদের জন্য সেই দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব’।[4] ফলে নবীগণ তাদের দাওয়াতী যিন্দেগীতে যেভাবে যুলুম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, প্রকৃত হকপন্থী আলেমগণ সেভাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাধার সম্মুখীন হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ যে আলেম যত সনিষ্ঠভাবে রাসূলের আদর্শের অনুসারী হবেন, তার বিপদটা তত ভারী হবে। ফলে তার ত্যাগ স্বীকারের মাত্রাটাও বেশী হবে।
একবার সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلَاءً؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মানুষের মধ্যে কারা সবচেয়ে বেশী বিপদাপদের সম্মুখীন হয়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلَاؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، ‘নবীগণ (সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন)। তারপর যারা নেককার, এরপর যারা নেককার (তাদের বিপদের পরীক্ষা)। মানুষকে তার দ্বীনদারীর অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। যার দ্বীন যত বেশী মযবূত হয়, তার পরীক্ষাটাও তত কঠিন হয়ে থাকে। আর সে যদি তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে, তাহ’লে তাকে সে অনুযায়ী পরীক্ষায় ফেলা হয়’।[5] সুতরাং বুঝা গেল, রাসূলের আদর্শ এবং অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠায় যার ঈমান যত বেশী মযবূত হবে, তাকে তত বেশী ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হ’তে হবে।
৩. ইসলামকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করা :
ইসলাম পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। এই দ্বীনকে দুনিয়ার সকল বাতিল ধর্মের উপর বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন,هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ، ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসূলকে হেদায়াত (কুরআন) ও সত্য দ্বীন (ইসলাম) সহ প্রেরণ করেছেন, যেন তাকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (তওবাহ ৯/৩৩; ছফ ৬১/০৯)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘এই আয়াত নাযিলের পর আমি মনে করতাম মূর্তিপূজার দিন শেষ হয়ে গেছে। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন, لَا يَذْهَبُ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ حَتَّى يُعْبَدَ اللَّاتُ وَالْعُزَّى...إِنَّهُ سَيَكُونُ مِنْ ذَلِكَ مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ يَبْعَثُ اللهُ رِيحًا طَيِّبَةً فَتُوُفِّيَ كُلُّ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ فَيَبْقَى مَنْ لَا خَيْرَ فِيهِ فَيَرْجِعُونَ إِلَى دِين آبَائِهِم، ‘লাত ও ‘উয্যা মূর্তিদ্বয়ের উপাসনা করা পর্যন্ত দিন ও রাত শেষ হবে না (অর্থাৎ ক্বিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত মূর্তিপূজা চলতে থাকবে)। অতঃপর যতদিন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, ততদিন এ অবস্থায় থাকবে। তারপর আল্লাহ একটি সুগন্ধময় বাতাস প্রেরণ করবেন, তাতে ঐ সকল লোকেদের মৃত্যু ঘটবে, যাদের অন্তরে সরিষা পরিমাণও ঈমান থাকবে। অতঃপর কেবলমাত্র ঐ সমস্ত লোকই অবশিষ্ট থাকবে, যাদের মধ্যে সামান্য পরিমাণও ঈমান থাকবে না। তখন তারা তাদের বাপ-দাদার ধর্মের দিকে ফিরে যাবে’।[6] এই হাদীছের মাধ্যমে বোঝা যায়, ক্বিয়ামত পর্যন্ত বাতিল ধর্ম বিদ্যমান থাকবে এবং হক্ব ও বাতিলের সংঘাত থাকবে। কাজেই দ্বীনদার মানুষের কর্তব্য হ’ল নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাকে সর্বদা সমুন্নত রাখা এবং ইসলামের সুমহান আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন,لا بد لكل جماعة مسلمة من العمل بحق لإعادة حكم الإسلام ليس فقط على أرض الإسلام بل على الأرض كلها، ‘প্রত্যেক মুসলিম জামা‘আতের অবশ্য কর্তব্য হ’ল ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযথভাবে কাজ করে যাওয়া। আর সেই কার্যক্রম শুধু ইসলামী ভূখন্ডে নয়; বরং সারা বিশ্বে ব্যাপৃত রাখা’।[7]
হকপন্থী জামা‘আতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ দ্বীনের দাওয়াত পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছে দিবেন এবং তাদের মাধ্যমেই
‘লুলস্নাহ (ছাঃ) বলেন, দিন ও রাত্ররাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যায়িত হবে। তিনি বলেছেন,لا يَبْقى على ظَهْرِ الأرضِ بَيْتُ مَدَرٍ ولا وَبَرٍ؛ إلا أَدْخَلَهُ اللهُ كَلِمَةَ الإسلامِ، بعِزِّ عزيزٍ وذُلِّ ذليلٍ: إِمّا يُعِزُّهُمُ اللهُ فيَجْعَلُهُم من أهلِها، أو يُذِلُّهُم فيَدِينُونَ لها، قلتُ: فيكونُ الدِّينُ كُلُّهُ للهِ، ‘ভূ-পৃষ্ঠে এমন কোন মাটির (বা ইটের) ঘর অথবা পশমের ঘর (অর্থাৎ তাঁবু) বাকী থাকবে না, সেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী প্রবেশ করাবেন না; সম্মানী লোকের ঘরে সম্মানের সাথে এবং অপমানিতের ঘরে অসম্মানের সাথে। তখন আল্লাহ যাদেরকে সম্মানিত করবেন, তাদেরকে ইসলামের অনুসারী করবেন। আর যাদেরকে তিনি অপমানিত করবেন, তারা ইসলামের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে। রাবী মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন, (একথা শুনে) আমি বললাম, তখন তো পুরো দ্বীনই আল্লাহর জন্য হয়ে যাবে’ (অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপর ইসলাম বিজয়ী হবে)।[8] মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা ছফে সেই ইসলামী বিজয়ের স্বরূপ আলোকপাত করেছেন। মুহাম্মাদ আলী ছাবূনী (রহঃ) এই সূরার তাফসীর করতে গিয়ে বলেন,لما بيَّن تعالى أن المشركين يريدون إِطفاء نور الله، أمر المؤمنين بمجاهدة أعداء الدين، ودعاهم إِلى التضحية بالمال والنفس والجهاد في سبيل الله، وبيَّن لهم أنها التجارة الرابحة لمن أراد سعادة الدارين، ‘মহান আল্লাহ তাঁর নূর নিভিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মুশরিকদের মনোবাসনার কথা বর্ণনা করে মুমিনদেরকে দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাদেরকে আল্লাহর পথে জিহাদ ও জান-মাল উৎসর্গ করতে বলেছেন। এরপর যারা দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করতে চায়, তাদের জন্য এটাকে (অর্থাৎ জান-মাল উৎসর্গ করাকে) লাভজনক ব্যবসা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন’।[9] সুতরাং আমাদের কর্তব্য হ’ল ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য সাধ্যমত নিজেদের জান-মাল, সময়-শ্রম উৎসর্গ করা এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠার ময়দানে আপতিত সকল বাধা-বিপত্তিকে ধৈর্যের মাধ্যমে মোকাবেল করা। কেননা দ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা ছাড়া প্রকৃত বিজয় হাছিল করা সম্ভব নয়।
৪. আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা :
মহান আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাওহীদে ইবাদত বা আল্লাহ দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আল্লাহ বলেন, شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ، ‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমরা প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি ও যার আদেশ দিয়েছিলাম আমরা ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। তুমি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহবান কর, তা তাদের কাছে অত্যন্ত কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। আর তিনি পথ দেখান ঐ ব্যক্তিকে, যে তাঁর দিকে প্রণত হয়’ (শূরা ৪২/১৩)। অত্র আয়াতে ‘দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা’-এর অর্থ হ’ল তাওহীদকে প্রতিষ্ঠিত করা, ‘হুকূমত প্রতিষ্ঠিত করা’ নয়।[10]
নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল সার্বিক জীবনে তাওহীদে ইবাদত প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত করার পথ আদৌ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না; বরং যুলুম-নির্যাতন সহ্য করে অবিচল ঈমানী শক্তি ও ত্যাগের সুমহান আদর্শ দিয়ে তাঁরা ধরার বুকে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সত্যনিষ্ঠ ছাহাবায়ে কেরাম মাক্কী ও মাদানী জীবনে ত্যাগ স্বীকারের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, ইতিহাসে তা নযীরবিহীন। তাইতো বিদ্যানগণ বলেছেন, দ্বীনের পথে অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকারের বদৌলতে মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে মক্কা বিজয় দান করেছিলেন। গতকাল যেই মুহাজিরগণ দ্বীন নিয়ে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে গিয়েছিল, তারাই আজকে বিজয়ী বেশে মক্কায় ফিরে আসল। মক্কা বিজয়ের কাহিনীতে মুসলিম জামা‘আতের জন্য উপদেশ রয়েছে যে, তারা যদি সমাজে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য একনিষ্ঠভাবে নিজেদের জান-মাল ও সময়-শ্রম উৎসর্গ করে এবং দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাহ’লে অচিরেই দুনিয়ার ও আখেরাতের বিজয় তাদের পদচুম্বন করবে।[11]
সুতরাং মুমিনের কর্তব্য হ’ল মানব রচিত সকল বিধান ছুঁড়ে ফেলে আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সার্বিক জীবন পরিচালনা করা এবং নবীগণের তরীকায় দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সংশোধ করে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। পাশাপাশি জান্নাতের পথে যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকা।
৫. দ্বীনের উপর অবিচল থাকা :
ইস্তিক্বামাত বা দ্বীনের উপর অবিচল থাকার জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হয়। আম্মার ইবনু ইয়াসির, বেলাল, খাববাব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীদের উপর আসা প্রবল নির্যাতনের পরেও দুর্বল এই মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশী দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা সরল পথ থেকে কখনও এক বিন্দুও বিচ্যুত হননি। শত যুলুম নির্যাতনের পরেও দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁরা। শি‘আবে আবু তালিবে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের নিদারুন কষ্টের পরেও তারা ছিল দ্বীনকে বিজয়ী করতে অবিচল। তাঁরা তাদের সমাজে ছিল সবচেয়ে তুচ্ছ, স্বল্পসংখ্যক ও দুর্বল। কিন্তু যখন সবাই জাহেলিয়াতের সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল, তখন এই দুর্বল মানুষগুলোই ছিল আলোকিত চিন্তার অধিকারী, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। মূলত বৈরী পরিবেশে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের আলোকিত পথে অবিচল থাকার শক্তিই হ’ল ইস্তিক্বামাত। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, أَعْظَمُ الْكَرَامَةِ لُزُومُ الِاسْتِقَامَةِ ‘(আল্লাহর কাছে) শ্রেষ্ঠ পদমর্যাদার জন্য প্রয়োজন ইস্তিক্বামাত’।[12] দ্বীনের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকার জন্যই ছাহবায়ে কেরাম আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।
আজকের এই পুঁজিবাদী সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে আক্রমণের স্বীকার হ’তে হবে। কেননা পশ্চিমারা চায়, বিশুদ্ধ ইসলাম যেন কখনই আবার ফিরে না আসতে পারে। তাই একে ধ্বংস করার জন্য তারা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছে। মুমিনদের দ্বীন ও আক্বীদাকে ধ্বংস করতে তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কুফরী মতবাদ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে অশ্লীলতা ও হারামের সয়লাব ঘটেছে। ফলে সেই সমাজে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখার চেয়েও কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে যাবতীয় কষ্ট সহ্য করে এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে হ’লেও ঈমানের উপর কায়েম-দায়েম থাকতে হবে।
ত্যাগ স্বীকারের জন্য ধৈর্য ধারণের গুণ অর্জন করা অবশ্যক। কেননা ইস্তিক্বামাত তথা দ্বীনের উপর অটল থাকার ব্যাপারে ধৈর্য বিশেষ গুরুত্ব রাখে। ছাহাবায়ে কেরাম যে ঈমান ও আমলের উপর অটল থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার বড় কারণ ছিল ধৈর্য। ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, وَجَدْنَا خَيْرَ عَيْشِنَا بِالصَّبْرِ، ‘আমাদের জীবনের কল্যাণ পেয়েছিলাম ধৈর্যের মাধ্যমে’।[13] আলী বিন আবী ত্বালিবকে একদা কেউ জিজ্ঞেস করল, হে আমীরুল মুমিনীন! ঈমান কাকে বলে? তিনি উত্তরে বললেন,الْإِيْمَانُ عَلَى أَرْبَعِ دَعَائِمَ : عَلَى الصَّبْرِ، وَالْعَدْلِ، وَالْيَقِيْنِ، وَالْجِهَادِ، ‘ঈমান চারটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) ধৈর্য (২) ন্যায়পরায়ণতা (৩) দৃঢ় বিশ্বাস (৪) জিহাদ’।[14] আলী (রাঃ) বলেন, ধৈর্যের সম্পর্ক ঈমানের সাথে তেমন, যেমন শরীরের সাথে মাথার সম্পর্ক। যদি মস্তিষ্ক কেটে দেওয়া হয় তাহ’লে শরীর অকেজো হয়ে যায়। ঠিক সেভাবে যদি ধৈর্য শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে ঈমানও শেষ হয়ে যায়।[15]
সুতরাং পশ্চিমা আদর্শ এবং বিজাতীয় মতবাদের ধূম্রজালে আমরা যেন নিজেদের আদর্শ ভুলে গিয়ে ঈমানহারা না হই, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ঈমান ও আক্বীদার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। শরীরে ময়লা লাগুক, আঘাত লাগুক; কিন্তু ঈমান যেন অক্ষত থাকে। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) সালাফদের উক্তি উল্লেখ করেছেন,كُنْ صَاحِبَ الِاسْتِقَامَةِ، لَا طَالِبَ الْكَرَامَةِ. فَإِنَّ نَفْسَكَ مُتَحَرِّكَةٌ فِي طَلَبِ الْكَرَامَةِ، وَرَبَّكَ يُطَالِبُكَ بِالِاسْتِقَامَةِ. ‘অবিচলতার সাথী হও, (মানুষের কাছে) সম্মান-মর্যাদা তালাশ করো না। কেননা তোমার অন্তর মর্যাদা পেতে চায়, কিন্তু তোমার রব ইস্তিক্বামাতের মাধ্যমে সেই মর্যাদা লাভ করতে বলেন’।[16]
সুতরাং দ্বীনের উপর অবিচলতা বা ইস্তিক্বামাত থাকার মাঝেই সম্মান-মর্যাদা এবং আল্লাহর সাহায্য নিহিত রেখেছেন। তাই দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তির জন্য দ্বীন ইসলামের অবিমিশ্র আদর্শের উপর অটল থাকতে হবে এবংত্মাসূল (ছাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী সেই আদর্শ বাস্তবায়নের আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এপথে যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য সর্বদা প্রস্ত্তত তাকতে হবে।
৬. হেদায়াতের পথে পরিচালিত হওয়া :
মুমিনের জীবনে সবচেয়ে বড় সেŠভাগ্যের ব্যাপার হ’ল হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া। যারা হেদায়াত লাভ করে ছিরাতে মুস্তাক্বীমে পরিচালিত হয়, তারাই দুনিয়া ও আখেরাতের সফল মানুষ। আর সেই হেদায়াত লাভের অন্যতম বড় উপায় হ’ল দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার করা। মহান আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوْا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ، ‘আর যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমরা আমাদের পথ সমূহের দিকে পরিচালিত করব। বস্ত্ততঃ আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘এই আয়াতে মহান আল্লাহ হেদায়াতকে জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। কেননা হেদায়াতের দিক থেকে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যারা উত্তমভাবে জিহাদ করে। আর আল্লাহ চার প্রকারের জিহাদ ফরয করেছেন, তা হ’ল- (১) নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ, (২) প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ, (৩) শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং (৪) পার্থিব মোহের বিরুদ্ধে জিহাদ। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে এই চার প্রকার জিহাদে আত্মনিয়োগ করবে, আল্লাহ তাকে তাঁর সন্তুষ্টির দিকে পথপ্রদর্শন করবেন। আর সেই সন্তুষ্টি তাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করবে’।[17] অন্যত্র তিনি বলেন,وَكُلٌّ مِنْهُمْ قَاتَلَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَجَاهَدَ إمَّا بِيَدِهِ أَوْ بِلِسَانِهِ، فَيَكُونُ اللهُ قَدْ هَدَاهُمْ، وَكُلُّ مَنْ هَدَاهُ فَهُوَ مُهْتَدٍ، ‘যারাই আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে এবং হাত ও যবানের মাধ্যমে জিহাদ করবে, আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। আর আল্লাহ যাকে সঠিক পথ দেখান, সে-ই তো হেদায়াতপ্রাপ্ত’।[18] সুতরাং বোঝা গেল- যারা তাদের জান-মাল, হাত-যবান বা বক্তব্য-লেখনীর মাধ্যমে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করবেন। সেজন্য ইমাম আওযাঈ ও ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলতেন, إِذَا اخْتَلَفَ النَّاسُ فِي شَيْءٍ فَانْظُرُوا مَا عَلَيْهِ أَهْلُ الثَّغْرِ، يَعْنِي أَهْلَ الْجِهَادِ، ‘লোকেরা যদি কোন বিষয়ে এখতেলাফ করে, তাহ’লে তোমরা দেখ- মুজাহিদরা কোন মতের উপরে আছে, (কেননা তারা তাদের প্রচেষ্টার কারণে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। ফলে তাদের সিদ্ধান্তই সঠিক হয়)’।[19]
ত্যাগের উপকারিতা
১. দ্বীনের দাওয়াত সম্প্রসারিত হওয়া:
নবী-রাসূল এবং তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারীদের ত্যাগপূত অবদানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছে। নূহ (আঃ) রাত-দিন সমানভাবে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন, অপবাদগ্রস্ত হয়েছেন, তবুও দাওয়াতের ময়াদান থেকে পালিয়ে যাননি। অপঃপর মহাপ্লাবনের গযবের পরে তাঁর বংশধর এবং ঈমানদান অনুসারীদের মাধ্যমে সারা বিশ্ব ব্যাপী তাওহীদের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছে।
এখানে সূরা বুরূযে আলোচিত আছহাবুল উখদূদের জনৈক ছোট্ট বালকের আত্মত্যাগের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। সে শিরক ছেড়ে তাওহীদবাদী ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করে। ফলে বাদশাহ যু-নুওয়াস বিন তুববা বিভিন্নভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক শক্তিতে সে বেঁচে যায়। পরে বালকটি বাদশাহকে বলে, আপনি আমাকে হত্যা করতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি আমার নির্দেশিত পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। বাদশাহ বললেন, সেটা আবার কি? বালক বলল, একটি ময়দানে শহরের লোকেদেরকে জমায়েত করুন। অতঃপর একটি কাঠের শুলীতে আমাকে উঠিয়ে আমার তুনির হ’তে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রাখুন। এরপর بِاسْمِ اللهِ رَبِّ الْغُلاَمِ، ‘বালকের পালনকর্তা আল্লাহর নামে’ বলে আমার দিকে তীর নিক্ষেপ করুন। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে আপনি আমাকে হত্যা করতে পারবেন। বাদশাহ তা-ই করল। তীর তার কানের নিমণাংশে গিয়ে বিধল। অতঃপর সে তীরবিদ্ধ স্থানে নিজের হাত রাখল এবং সাথে সাথে প্রাণত্যাগ করল। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত হাযার হাযার মানুষ সমস্বরে বলে উঠল, آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ، ‘আমরা বালকটির রবের উপরে ঈমান আলনাম’। এ সংবাদ বাদশাহকে জানানো হ’ল এবং তাকে বলা হ’ল, আপনি লক্ষ্য করেছেন কি? আপনি যে পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন, আল্লাহর শপথ! সে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিই আপনার মাথার উপর চেপে বসেছে। সকল মানুষই বালকের পালনকর্তার উপর ঈমান এনেছে।[20]
এই ঈমানদার বালকের কাহিনীর মাধ্যমে দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার ও আত্মোৎসর্গের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে। সে যদি শুধু দাওয়াতী কাজ করত, তাহ’লে হয়ত স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে সেই দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে যেত। কিন্তু তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে মূহুর্তেই হাযার হাযার মানুষ ঈমানের পথ খুঁজে পেয়েছিল। যারা বাদশাহর অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, কিন্তু তাওহীদকে বর্জন করেনি। দাওয়াতী কাজে ছাহাবায়ে কেরামের নিরলস পরিশ্রম এবং পরবর্তী যুগের মুহাদ্দেছীনে কেরামের ইলমী খেদমতের মাধ্যমে বিশ্বের আনাচে-কানাচে ইসলামের বিশুদ্ধ দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের এই বঙ্গদেশে এমনিতেই ইসলাম আসেনি; বরং কিছু ত্যাগী মানুষের নিরলস দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলাম আমাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে।
২. আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা:
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাওহীদ ভিত্তিক আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য ত্যাগ স্বীকারের কোন বিকল্প নেই। ছাহাবায়ে কেরাম যদি দ্বীনের জন্য হিজরত, জিহাদ ও দাওয়াতের ময়দানে ত্যাগ স্বীকার না করতেন, তাহ’লে হয়ত মদীনায় আদর্শ রাষ্ট্র গঠিত হওয়া সম্ভব হ’ত না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর অনুগ্রহে মাত্র দশ বছরে যে ইনছাফ ভিত্তিক আদর্শ সমাজের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খোলাফয়ে রাশেদার বিশ্ব নন্দিত সমাজ ব্যবস্থা। যে সমাজ ব্যবস্থা নির্যাতিত মানবতার কথা বলে। মাযলূমের হৃদয়ের ভাষা বোঝে। যেখানে স্বাধীন-কৃতদাস, ধনী-গরীব সবার জন্য সমান অধিকার সুনিশ্চিত হয়। ফলে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল জাগরণের ঢেউ। মানুষ দলে দলে আশ্রয় নিয়েছিল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। মানুষের দাসত্ব ছেড়ে তারা আল্লাহর দাসত্বে প্রণত হয়েছিল। সুতরাং আজকের দিনেও বান্দা যদি সমাজে অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাহ’লে এই নব্য জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিষা দূর হয়ে সাম্য-শান্তির রৌদ্রমাখা প্রভাতী সূর্যের উদয় হবে ইনশাআল্লাহ। কেননা নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও কুরবানীর মাধ্যমেই একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশ্ব নন্দিত মুজাদ্দিদ ও সমাজসংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ) [১১১৫হি./১৭০৩খ্রি-১২০৬হি./১৭৯২খ্রি] আরর ভূ-খন্ড থেকে শিরক ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটন করে নির্ভেজাল তাওহীদ ও ইসলামী তাহযীব-তামদ্দূনের যে ভীত গড়ে তুলেছিলেন, তার উপরেই ‘বিলাদুত তাওহীদ’ খ্যাত আধুনিক সঊদী আরব দাঁড়িয়ে আছে। এই মহান ইমামের অবদান আলোচনা করতে গিয়ে আব্দুল করীম আল-খত্বীব (১৯২১-২০০৮খ্রি.) বলেন, আল্লাহর দ্বীনের ঝান্ডাকে সমুন্নত ও সহযোগিতা করার সবচেয়ে বড় উপায় হ’ল ত্যাগ স্বীকার ও আত্মোৎসর্গ। সেকারণ ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ) ঈমান, ধৈর্য, ত্যাগ ও উৎসর্গের বর্মে সজ্জিত হয়ে সমাজ সংস্কার, দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানের অবতীর্ণ হয়েছিলেন’।[21] মাহমূদ শীছ খাত্ত্বাব বলেন,إن العودة إلى الإسلام بما فيه من تكاليف البذل والتضحية والفداء، يعيد إلينا مكانتنا بين الأمم، ويصون حقوقنا، ويجعل منا أمة لا تقهر أبدا. كما يعيد إلى بلادنا الأمن والاطمئنان، والرخاء والسعادة، ‘ইসলামের প্রকৃত অবস্থার দিকে ফিরে যেতে হ’লে ত্যাগ, আত্মবিসর্জন ও উৎসর্গের কষ্ট স্বীকার করতে হবে। যা অন্যান্য জাতিসমূহের মাঝে আমাদের (হারানো) মর্যাদা আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবে এবং আমাদের অধিকারগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। আমাদের মাঝে এক অপরাজেয় জাতির উত্থান ঘটাবে। ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও সুখ-শান্তি ফিরে আসবে’।[22]
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনছাফ ও সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন’ (নাহল ১৬/৯০)। যুহাইলী (রহঃ) বলেন, ‘নিজের মাঝে এবং সৃষ্টিকূলের মাঝে ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করার উপায় হ’ল ত্যাগ স্বীকার করা এবং ছোট-বড় সব ধরনের খেয়ানত থেকে বিরত থাকা’।[23] সুতরাং অহি-র আলোকে ইনছাফপূর্ণ আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
৩.সফলতার সোপন :
যে কোন সফলতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করা প্রয়োজন। একজন সফল শিক্ষার্থীর জীবনের পিছনে লুকিয়ে থাকে ত্যাগ স্বীকারের না বলা গল্প। কেননা সবাই শুধু তার সফলতার বাহ্যিক রূপ দেখে। কিন্তু তার নির্ঘুম রাতের অধ্যাবসয়ের গল্পটা তাদের কাছে গোপন থাকে। অনুরূপভাবে একজন মুমিনের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করা অপরিহর্য কর্তব্য। তবে মুমিনের কাছে পার্থিব সফলতা মূখ্য বিষয় নয়; বরং আখেরাতের সফলতাই তার মূল উদ্দেশ্য থাকে। আল্লাহ বলেন,فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ، ‘অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই-ই সফলকাম হবে। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন ধোঁকার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫)। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর ও দৃঢ় থাক এবং সদা প্রস্ত্তত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/২০০)। অত্র আয়াতে আল্লাহ মুমিনদেরকে ধৈর্যের মাধ্যমে ত্যাগ স্বীকার করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারের পরস্পর প্রতিযোগিতা করতে বলেছেন। আর যারা হক্ব ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে নিজেকে উৎসর্গ করবে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করবে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের মহান সফলতা।[24] মহান আল্লাহ আমাদেরকে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে দোজাহানের সফলতা হাছিলের তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
[চলবে]
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তিরমিযী হা/২৪৭২; ইবনু মাজাহ হা/১৫১; ইবনু হিববান হা/৬৫৬০।
[2]. মুসলিম হা/২৪১০; তিরমিযী হা/৩৭৫৬।
[3]. আবূদাঊদ হা/৩৬৪১; তিরমিযী হা/২৬৮২; মিশকাত হা/২১২, সনদ ছহীহ।
[4]. উছায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ৩/৬৬২।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩; দারেমী হা/২৮২৫; মিশকাত হা/১৫৬২, সনদ হাসান।
[6]. মুসলিম হা/২৯০৭; মিশকাত হা/৫৫১৯।
[7]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, ফিতনাতুত তাকফীর, পৃ. ১১।
[8]. আহামাদ হা/২৩৮৬৫; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৭০১; ছহীহাহ হা/৩।
[9]. মুহাম্মাদ আলী ছাবূনী, ছাফওয়াতুত তাফাসীর ৩/৩৫২।
[10]. বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: ‘মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব’ প্রণীত এবং ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইক্বামতে দ্বীন: পথ ও পদ্ধতি’ ও ‘তিনটি মতবাদ’ বই দু’টি।
[11]. সাঈদ বিন আলী ছাবেত, আল-জাওয়ানিবুল ইলামিয়্যাহ ফী খিতাবির রাসূল (ছাঃ), (সঊদী আরব: ওযারাতুশ শুঊনিল ইসলামিয়্যাহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪১৭হি.) পৃ. ৫১।
[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকিন ২/১০৬।
[13]. বুখারী, ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর নিষেধাজ্ঞার প্রতি ধৈর্যধারণ করা’ অনুচ্ছেদ।
[14]. শু‘আবুল ঈমান ১/১৮২; লালাকাঈ, শারহুস সুন্নাহ ২/৮২২-৮২৩।
[15]. শু‘আবুল ঈমান হা/৩৮; শারহুস সুন্নাহ ২/৮২২।
[16]. মাদারিজুস সালিকীন ২/১০৬।
[17]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩৯৩হি./১৯৭৩খ্রি.) পৃ. ৫৯।
[18]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বি‘ঈন, মুহাক্কিক্ব: মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম ইবরাহীম (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪১১হি./১৯৯১খ্রি.) খ. ৪, পৃ. ৯৯।
[19]. ইবনে তাইমিয়াহ, জামে‘উল মাসায়েল, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ আযীয শাম্স (মক্কা: দারু আলামিল ফাওয়ায়েদ, ১ম মুদ্রণ, ১৪২২হি.) খন্ড ৫, পৃ. ৮২। মাদারিজুস সালেকীন, ১/৫০৬।
[20]. ছহীহ্ মুসলিম হা/৩০০৫
[21]. আব্দুল কারীম আল-খত্বীব, আশ-শুবহাত (রিয়াদ: ইমাদাতুল বাহছিল ইলমী বিজামি‘আতি মুহাম্মাদ বিন সঊদ আল-ইসলামী, ১৪১১হি./ ১৯৯১খ্রি.), পৃ: ১২৭, ১৪২।
[22]. মাহমূদ শীছ খাত্ত্বাব, আহাম্মিয়্যাতুদ দাওয়াহ (মদীনা: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ১ম সংস্করণ, তা.বি), পৃ. ২৩।
[23]. আত-তাফসীরুল মুনীর ১৪/২২৪।
[24]. আত-তাফসীরুল ওয়াযেহ ১/৩২৯-৩৩০।