পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ ।
পঞ্চম দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় কুরআন লিপিবদ্ধ ছিল না। ছাহাবায়ে কেরাম তাঁর মৃত্যুর পরে কুরআন জমা করেছেন এবং লিপিবদ্ধ করেছেন। আর নিশ্চয়ই এটা উত্তম কাজ যা রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে করা হয়েছে। যদি ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানা বৈধ না হ’ত, তাহ’লে কুরআনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত।
জবাব : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশেই কুরআন লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে পাথর, খেজুর পাতা, হাড্ডি ইত্যাদিতে সংরক্ষিত ছিল। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোন সূরার মধ্যে কম-বেশী হওয়ার আশংকায় একত্রে জমা করার নির্দেশ দেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে অহী অবতীর্ণের সমাপ্তি ঘটেছে। সাথে সাথে কুরআন জমা করার প্রতিবন্ধকতাও দূরীভূত হয়েছে। এছাড়াও ইয়ামামার যুদ্ধে বহু সংখ্যক কুরআনের হাফেয শাহাদতবরণ করেছিলেন। এভাবে কুরআনের হাফেয শাহাদতবরণ করলে কুরআনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এই আশংকায় ছাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমতের ভিত্তিতে কুরআন সংকলন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যা ইজমায়ে ছাহাবা হিসাবে পরিগণিত। আর ইজমায়ে ছাহাবা একটি অকাট্য দলীল। হাদীছে এসেছে,
যায়েদ ইবনু ছাবেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধে বহু লোক শহীদ হওয়ার পর আবু বকর (রাঃ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। এ সময় ওমর (রাঃ) তাঁর নিকটে উপস্থিত ছিলেন। আবু বকর (রাঃ) বললেন, ওমর (রাঃ) আমার কাছে এসে বলেছেন, ইয়ামামার যুদ্ধের শহীদদের মধ্যে ক্বারীদের (হাফেয) সংখ্যা অনেক। আমি আশংকা করছি, এভাবে যদি ক্বারীগণ শহীদ হয়ে যান, তাহ’লে কুরআনের বহু অংশ হারিয়ে যাবে। অতএব আমি মনে করি যে, আপনি কুরআন সংকলনের নির্দেশ দিন। উত্তরে আমি ওমর (রাঃ)-কে বললাম, যে কাজ রাসূল (ছাঃ) করেননি সে কাজ তুমি কিভাবে করবে? জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটি উত্তম কাজ। ওমর (রাঃ) এ কথা বার বার বলতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ কাজের জন্য আমার বক্ষকে উন্মোচন করে দিলেন এবং এ ব্যাপারে ওমর (রাঃ) যা ভাল মনে করলেন আমিও তাই করলাম। যায়েদ (রাঃ) বলেন, তখন আবুবকর (রাঃ) আমাকে বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক। তোমার ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই। তদুপরি তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর অহি লেখক ছিলে। সুতরাং তুমি কুরআন মাজীদের অংশগুলিকে অনুসন্ধান করে একত্রিত কর। আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমাকে একটি পর্বত এক স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতেন, তাহ’লেও তা আমার কাছে কুরআন সংকলনের নির্দেশের চেয়ে কঠিন মনে হ’ত না। আমি বললাম, যে কাজ রাসূল (ছাঃ) করেননি সে কাজ আপনারা কিভাবে করবেন? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটি কল্যাণকর কাজ। এ কথাটি আবুবকর (রাঃ) বার বার আমার কাছে বলতে থাকলেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ কাজের জন্য আমার বক্ষকে উন্মোচন করে দিলেন, যেমন উন্মোচন করেছিলেন আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর বক্ষকে। এরপর আমি কুরআন অনুসন্ধানের কাজে লেগে গেলাম এবং খেজুর পাতা, প্রস্তরখন্ড এবং মানুষের বক্ষ থেকে আমি তা সংগ্রহ করতে থাকলাম...।[1]
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ ‘এটা (কুরআন) সংরক্ষণ ও পাঠ করার দায়িত্ব আমারই’ (ক্বিয়ামাহ্ ৭৫/১৭)। সুতরাং তিনিই ছাহাবায়ে কেরামের অন্তরে কুরআন সংকলনের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি জাগ্রত করার মাধ্যমে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন।
তৃতীয়ত: কুরআন জমা করার মাধ্যমে নতুন কোন ইবাদতের জন্ম দেওয়া হয়নি; বরং তা সংকলনের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির নিকটে আল্লাহর বিধান সহজভাবে পৌছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাথে সাথে তা সংরক্ষণের পথকে দৃঢ় এবং মুখস্থ করার পথকে সুগম করা হয়েছে। অতএব কুরআন সংকলনের মত প্রশংসনীয় কাজকে বিদ‘আতে হাসানার বৈধতার দলীল পেশ করা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়।
ষষ্ঠ দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় জুম‘আর একটি আযানই প্রচলিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে ওছমান (রাঃ) সর্বপ্রথম দ্বিতীয় আযান চালু করেন। ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধ না হ’লে ওছমান (রাঃ)-এর মত বিশিষ্ট ছাহাবী দ্বিতীয় আযান চালু করতেন না।
জবাব : হাদীছে এসেছে,
عَنِ الزُّهْرِىِّ قَالَ سَمِعْتُ السَّائِبَ بْنَ يَزِيْدَ يَقُوْلُ إِنَّ الأَذَانَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ كَانَ أَوَّلُهُ حِيْنَ يَجْلِسُ الإِمَامُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ عَلَى الْمِنْبَرِ فِيْ عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَبِىْ بَكْرٍ وَعُمَرَ رضى الله عنهما، فَلَمَّا كَانَ فِىْ خِلاَفَةِ عُثْمَانَ رضى الله عنه وَكَثُرُوْا، أَمَرَ عُثْمَانُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِالأَذَانِ الثَّالِثِ، فَأُذِّنَ بِهِ عَلَى الزَّوْرَاءِ، فَثَبَتَ الأَمْرُ عَلَى ذَلِكَ-
‘যুহরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সায়েব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবু বকর এবং ওমর (রাঃ)-এর যুগে জুম‘আর দিন ইমাম যখন মিম্বরের উপর বসতেন তখন প্রথম আযান দেওয়া হ’ত। অতঃপর যখন ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি জুম‘আর তৃতীয় আযানের নির্দেশ দেন। ‘যাওরা’ নামক স্থান থেকে এই আযান দেওয়া হয়। পরে এ আযানের সিলসিলা চলতে থাকে।[2]
উল্লিখিত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ)-এর যামানায় এবং ওছমান (রাঃ)-এর খিলাফতের প্রথম দিকেও জুম‘আর আযান একটিই ছিল। তারপর ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মসজিদে নববীর অনতিদূরে ‘যাওরা’ নামক বাজারে মানুষ ব্যস্ত থাকত। তদানীন্তনকালে মাইক এবং ঘড়ি না থাকার কারণে মানুষ আযান শুনতে পেত না এবং জুম‘আর ছালাতের সময় বুঝতে পারত না। এহেন প্রেক্ষাপটে ওছমান (রাঃ) একই সময়ে উক্ত বাজারে অতিরিক্ত একটি আযান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে মানুষ জুম‘আর সময় বুঝতে পারে। তবে বর্তমানে মাইক, ঘড়িসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে; ফলে আযান শুনা ও ছালাতের সময় বুঝতে পারার প্রতিবন্ধকতাও দূরীভূত হয়েছে। সাথে সাথে জুম‘আর অতিরিক্ত আযানের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে। কেননা ওছমান (রাঃ) কর্তৃক চালুকৃত উক্ত আযান যদি সকল মসজিদের জন্য অপরিহার্য হ’ত তাহ’লে তিনি নিজেই সকল মসজিদে জুম‘আর অতিরিক্ত আযান চালু করতেন। অথচ তিনি শুধুমাত্র ‘যাওরা’ নামক বাজারেই উক্ত আযান চালু করেছিলেন; অন্য কোন মসজিদে চালু করেননি। ওছমান (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালেও অন্য কোথাও উক্ত আযান চালু ছিল না। এমনকি মক্কাতেও নয়। অতএব ওছমান (রাঃ)-এর উক্ত নির্দেশ কখনোই সর্ব যুগের সকল মসজিদে জুম‘আর অতিরিক্ত আযান বৈধ হওয়ার দলীল হ’তে পারে না। কেননা ওছমান (রাঃ)-এর নির্দেশিত আযানটি একটিমাত্র স্থানে দেওয়া হ’ত। আর তাও ছিল ‘যাওরা’ নামক বাজার। সুতরাং বাজারে চালু হওয়া আযান কিভাবে সর্বযুগের সকল মসজিদে সুন্নাত বলে বিবেচিত হ’তে পারে?
সপ্তম দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের এমন কতগুলি আমলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন যা তিনি নিজে করেননি এবং করতেও বলেননি। যেমন- (ক) একদা প্রচন্ড শীতের কারণে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) অপবিত্র অবস্থায় গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করলে রাসূল (ছাঃ) তা স্বীকৃতি দিয়েছেন।[3]
(খ) প্রত্যেক ওযূর পরে বেলাল (রাঃ)-এর দুই রাক‘আত ছালাতকে রাসূল (ছাঃ) স্বীকৃতি দিয়েছেন।[4]
(গ) ছুটে যাওয়া ফজরের পূর্বের দুই রাক‘আত সুন্নাতকে ফরয ছালাতের পরপরই আদায় করাকে রাসূল (ছাঃ) স্বীকৃতি দিয়েছেন। যেমন- ক্বায়েস ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, একদা নবী করীম (ছাঃ) একজন লোককে ফজরের ফরয ছালাতের পর দু‘রাক‘আত ছালাত আদায় করতে দেখে বললেন, ফজরের ছালাত কি দু’বার? তখন লোকটি বলল, আমি ফজরের পূর্বে দু’রাক‘আত পড়িনি। তখন রাসূল (ছাঃ) চুপ হয়ে গেলেন’।[5]
অতএব ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানা বৈধ বলেই রাসূল (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের উল্লিখিত ভাল আমলগুলিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
জবাব : রাসূল (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের কিছু ভাল আমলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তেমনি তিনি ছাহাবায়ে কেরামের কতগুলি আমলকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, যা তাঁরা উত্তম আমল হিসাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه يَقُوْلُ جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوْتِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُوْنَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا أُخْبِرُوْا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوْهَا فَقَالُوْا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّيْ أُصَلِّى اللَّيْلَ أَبَدًا وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُوْمُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا فَجَاءَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّيْ لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّيْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّيْ وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ-
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিন জনের একটি দল রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাড়ীতে আসল। তারা রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। যখন তাদেরকে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানানো হ’ল তখন তারা এটিকে কম মনে করল। অতঃপর তারা বলল, রাসূল (ছাঃ) কোথায় আর আমরা কোথায়? তাঁর পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তারপর তাদের একজন বলল, আমি প্রতি রাতে জেগে ছালাত আদায় করব। অপর ব্যক্তি বলল, আমি প্রতিদিন ছিয়াম পালন করব, কখনো ছিয়াম ত্যাগ করব না। অপর ব্যক্তি বলল, আমি নারীর সংশ্রব থেকে দূরে থাকব এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, তোমরাই কি তারা, যারা এরূপ এরূপ মন্তব্য করেছ? সাবধান! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চাইতে আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং আমি সবচেয়ে বেশী পরহেযগার। কিন্তু আমি রাত্রের কিছু অংশে (নফল) ছালাত আদায় করি এবং কিছু অংশ ঘুমাই। কোন কোন দিন (নফল) ছিয়াম পালন করি এবং কোন কোন দিন ছিয়াম ত্যাগ করি। আর আমি বিবাহ করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে বিমুখ হবে (সুন্নাত পরিপন্থী আমল করবে), সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[6]
অত্র হাদীছে উল্লিখিত তিন জন ছাহাবীর কারো উদ্দেশ্যই খারাপ ছিল না। ছালাত আদায় করা, ছিয়াম পালন করা অবশ্যই ভাল কাজ। আরেকজন বিবাহ না করে সর্বদা আল্লাহর ইবাদত করতে চেয়েছিল, তার উদ্দেশ্যও ভাল ছিল। অথচ রাসূল (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের উল্লিখিত ভাল আমলগুলিকে স্বীকৃতি দেননি; বরং তাদেরকে সুন্নাত পরিপন্থী আমলকারী হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন এবং উম্মত থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার মত হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
সম্মানিত পাঠক! রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বলে গেছেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সে দু’টিকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হ’ল, আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’।[7] আর সুন্নাত হ’ল,
مَا نُقِلَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ وَعَلَى مَا جَاءَ عَنِ الصَّحَابَةِ أَو الخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ-
‘সুন্নাত হ’ল নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে যা বর্ণিত হয়েছে এবং যা ছাহাবায়ে কেরাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পক্ষ থেকে এসেছে’।[8]
অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা করতে বলেছেন ও যা তিনি নিজে করেছেন, তা করা সুন্নাত। আর যা তিনি করতে বলেননি এবং নিজেও করেননি। কিন্তু অন্য কাউকে করতে দেখলে তাকে নিষেধ করেননি, তাঁর এরূপ মৌনসম্মতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী যুগে সৃষ্ট কোন আমলই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না; বরং তা সুন্নাত পরিপন্থী আমল হিসাবে গণ্য হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বর্তমানে বেঁচে নেই যে, তিনি মৌনসম্মতি প্রদান করবেন! সুতরাং সুন্নাত পরিপন্থী কোন আমল ইসলামী শরী‘আতে জায়েয হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
বিদ‘আতের হুকুম
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির জন্য ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান অহী মারফত নাযিল করেছেন। সেই অহি-র বিধানই অভ্রান্ত জীবন বিধান যা পালনে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। পক্ষান্তরে মানুষ যখন তা অগ্রাহ্য করে এবং নিজেদের মন মত বিধান জারি করার মাধ্যমে বিদ‘আত সৃষ্টি করে, তখন তাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক সব কর্মই হারাম। যেমন- রাসূল (ছাঃ) প্রত্যেক জুম‘আর খুৎবায় বলতেন,
أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرَّ الْأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ-
‘সর্বোত্তম হাদীছ হ’ল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর সবচাইতে নিকৃষ্ট কর্ম হ’ল শরী‘আতের মধ্যে নতুন নতুন কাজের উদ্ভব ঘটানো। আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[9] নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে, وَكُلَّ ضَلاَ لَةٍ فِى النَّارِ ‘আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিয়ে যাবে’।[10] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ : قَامَ فِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ، فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيْغَةً، وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ، وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ، فَقِيْلَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ، وَعَظْتَنَا مَوْعِظَةَ مُوَدِّعٍ، فَاعْهَدْ إِلَيْنَا بِعَهْدٍ، فَقَالَ : عَلَيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا، وَسَتَرَوْنَ مِنْ بَعْدِيْ اخْتِلاَفًا شَدِيْدًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ، وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ، عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَالأُمُوْرَ الْمُحْدَثَاتِ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ-
ইরবায ইবনু সারিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মধ্যে দাঁড়ালেন এবং এক সারগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্য শুনে চক্ষুসমূহ হ’তে অশ্রু প্রবাহিত হল এবং অন্তরসমূহ ভীত-সন্ত্রস্ত হল। তখন বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাদেরকে বিদায়ী উপদেশ দিলেন (মনে হচ্ছে)। অতএব আপনি আমাদেরকে কি অছিয়ত করছেন? তিনি (রাসূল) বললেন, আমি তোমাদেরকে অছিয়ত করছি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার এবং আমীরের কথা শুনা ও তার আনুগত্য করার, যদিও সে হাবশী (কৃষ্ণকায়) গোলাম হয়। কারণ আমার পড়ে বহু ধরনের মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে আমার সুন্নাত ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে মাড়ির দাঁত দ্বারা মযবূতভাবে অাঁকড়ে ধরা। অতএব সাবধান! তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে) নতুন কাজ হ’তে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী’।[11]
আর এরূপ নব আবিষ্কৃত বিদ‘আত কর্ম সম্পাদনের ফলে ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় কঠিন দিনে, মাথার সন্নিকটে অবস্থানরত সূর্যের প্রচন্ড তাপদাহে মানুষ যখন পিপাসিত থাকবে এবং হাউযে কাউছারের পানি ব্যতীত কোন পানি থাকবে না। সেদিন তাদেরকে উক্ত পানি পান থেকে বঞ্চিত করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنِّيْ فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ، مَنْ مَرَّ عَلَىَّ شَرِبَ، وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا، لَيَرِدَنَّ عَلَىَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُوْنِيْ، ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَأَقُوْلُ إِنَّهُمْ مِنِّيْ فَيُقَالُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ فَأَقُوْلُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِيْ-
‘আমি তোমাদের পূর্বে হাউযের (হাউযে কাউছার) নিকটে পৌঁছে যাবে। যে আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করবে, সে হাউযের পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে সে কখনও পিপাসিত হবে না। নিঃসন্দেহে কিছু সম্প্রদায় আমার সামনে (হাউযে) উপস্থিত হবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। এরপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেওয়া হবে। আমি তখন বলব, এরাতো আমারই উম্মত। তখন বলা হবে, তুমি জান না তোমার (মৃত্যুর) পরে এরা কি সব নতুন নতুন কথা ও কাজ সৃষ্টি করেছিল। তখন আমি বলব, দূর হোক দূর হোক (আল্লাহর রহমত থেকে), যারা আমার পরে দ্বীনের ভিতর পরিবর্তন এনেছে’।[12]
সম্মানিত পাঠক! হাউযে কাউছারের পানি পান থেকে বিতাড়িত হওয়ার অন্যতম কারণ হ’ল বিদ‘আতী আমল করা। আর পানি পান থেকে বিতাড়িত হওয়ার অর্থই হ’ল জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। সুতরাং বিদ‘আতীদের পরিণাম জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদেরকে তা থেকে মুক্তি দান করুন। আমীন!
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. বুখারী হা/৭১৯১।[চলবে]
[2]. বুখারী হা/৯১৬, ‘জুম‘আ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১৪০৪।
[3]. আবুদাউদ হা/৩৩৪, ‘নাপাক অবস্থায় ঠান্ডার আশংকায় তায়াম্মুম করা’ অনুচ্ছেদ, সনদ ছহীহ।
[4]. তিরমিযী হা/৩৬৮৯; মিশকাত হা/১৩২৬; ছহীহ তারগীব হা/২০১।
[5]. আবুদাউদ হা/১২৬৭; ইবনু মাজাহ হা/১১৫৪; মিশকাত হা/১০৪৪, সনদ ছহীহ।
[6]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫, ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[7]. মুওয়াত্তা মালেক হা/৩৩৩৮, মিশকাত হা/১৮৬, অনুচ্ছেদ ঐ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত ১/১৩২ পৃঃ; সনদ হাসান।
[8]. আল-মাকাছেদ ইনদাল ইমাম শাতেবী ১/৪৮৩ পৃঃ।
[9]. মুসলিম হা/৮৬৭; মিশকাত হা/১৪১‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[10]. নাসাঈ হা/১৫৭৯।
[11]. আবুদাউদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫, সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ১/১২২ পৃঃ; আলবানী, সনদ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/৬৫৮৩-৮৪; মুসলিম হা/২২৯০; মিশকাত হা/৫৫৭১।