কুরআন নিয়ে চিন্তা করব কিভাবে? (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৫. কুরআনের উপমা-উদাহরণ নিয়ে চিন্তা করা :

মানুষকে কোন উদাহরণ দিয়ে বুঝালে সে খুব ভালোভাবে সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। কোন কথা সোজাসাপটা বললে মানুষ যতটা না উপলব্ধি করতে পারে, একই কথা উদাহরণ দিয়ে বুঝালে তদপেক্ষা অধিক উপলব্ধি করতে পারে। এজন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য উদাহরণ-উপমা দিয়েছেন, যেন আকলভেদে সকল পর্যায়ের মানুষ তার বাণীর মর্ম অনুধাবন করতে পারে। আল্লাহর উপস্থাপিত এই দৃষ্টান্ত ও উদারহণকে বলা হয় ‘আমছালুল কুরআন’ (أَمْثَالُ ‌الْقُرْآنِ) ‌বা কুরআনের দৃষ্টান্ত সমূহ। যেমন আল্লাহ বলেছেন,وَلَقَدْ ‌ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ- ‘আমরা এই কুরআনে মানুষের জন্য সকল প্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (যুমার ৩৯/২৭)। অর্থাৎ মানুষ যেন এই দৃষ্টান্ত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। যেমন অন্যত্র তিনি বলেন,وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ- ‘আর আমরা এইসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য বর্ণনা করি যাতে তারা চিন্তা করে’ (হাশর ৫৯/২১)। বোঝা গেল যে, আল্লাহ মানবজাতিকে উপদেশ দেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে অসংখ্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন এবং সেগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এগুলো থেকে শিক্ষা লাভ করা সম্ভব হয় না। সেজন্য সালাফগণ ‘আমছালুল কুরআন’ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন। এখানে সংক্ষেপে দু’টি দৃষ্টান্ত পেশ করা হ’ল-

(১) আল্লাহ বলেন,ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا رَجُلًا فِيهِ شُرَكَاءُ مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ- ‘আললাহ (তোমাদের জন্য) একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। (যেমন) একটি গোলামের মালিক অনেকজন, যারা নানা মতের। আরেকটি গোলামের মালিক মাত্র একজন। এই দুই গোলামের অবস্থা কি সমান? আললাহর জন্যই সকল প্রশংসা। কিন্তু তাদের অধিকাংশ এটা জানে না’ (যুমার ৩৯/২৯)। অত্র আয়াতেও আল্লাহ দু’জন ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন। যাদের একজন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে নিরাপত্তা লাভ করেছেন। অপরজন বহু উপাস্যের ইবাদত করতে গিয়ে দিকভ্রান্ত হয়েছে। জ্ঞান ও নিরাপত্তার দিক থেকে এই দু’ব্যক্তি কি সমান? মূলত বহু উপাস্যের গোলাম ও এক আললাহর গোলাম কখনোই এক নয়।

* এমফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

(২) আললাহ বলেন, مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ، إِنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ، وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ- ‘যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সার ন্যায়। সে (নিজের নিরাপত্তার জন্য) ঘর তৈরী করে। অথচ ঘর সমূহের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো সবচেয়ে দুর্বল। যদি তারা জানত। আল্লাহকে ছেড়ে তারা যা কিছুকে আহবান করে, আল্লাহ তা জানেন। তিনি মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। মানুষের জন্য আমরা এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে থাকি। অথচ তা কেউই বুঝে না জ্ঞানীরা ব্যতীত’ (আকাবূত ২৯/৪১-৪৩)। এখানে মহান আল্লাহ মুশরিকদের পূজিত মূর্তি-প্রতিমাগুলোকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করেছেন। মাকড়সার জাল যেমন অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার কারণে বাতাসের ঝাপটা থেকে মাকড়সাকে রক্ষা করতে পারে না, ঠিক তেমনি তাদের মূর্তিগুলো তাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না। অবশেষে পূজারী ও পূজিত উভয়কে দুর্বল আখ্যা দিয়ে বলে দিলেন, যারা আল্লাহর মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে না, কেবল তারাই আল্লাহকে ছাড়া অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ করতে পারে।

এভাবে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য উপমা দেওয়া হয়েছে, যাতে বান্দার চিন্তার দিগন্ত উন্মোচিত হয় এবং সে আল্লাহর কালামের মর্ম ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। সালাফগণ কুরআন পাঠের প্রাক্কালে যখনই কোন উপমা ও দৃষ্টান্ত পেতেন, সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন। সেই উপমার মর্ম অনুধাবনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতেন। আর বুঝতে না পারলে কান্নাকাটি করে বলতেন, ‘হায়! আমি এখনো জ্ঞানী হ’তে পারিনি’। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘জ্ঞানীরা ব্যতীত কেউ তা (কুরআন) বুঝতে পারে না’ (আনকাবূত ২৯/৪৩)[1]

৬. কুরআনে বর্ণিত কাহিনী নিয়ে চিন্তা করা :

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নবী-রাসূলের কাহিনী এবং পূর্ববর্তী মানুষের ঘটনা-প্রবাহ আলোকপাত করেছেন, যেন মানুষ এগুলোর বিষয়বস্ত্ত অনুধাবন করে শিক্ষা ও উপদেশ লাভ করতে পারে। কারণ মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী নবীদের কষ্টভোগ ও ধৈর্য ধারণের কাহিনী বর্ণনা করে তাঁর রাসূলের হৃদয়কে দৃঢ় করেছেন। যেমন সূরা হূদে মহান আল্লাহ ছয় জন নবী-রাসূলের কাহিনী বর্ণনা করে বলেন,وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ ‌مَا ‌نُثَبِّتُ ‌بِهِ ‌فُؤَادَكَ وَجَاءَكَ فِي هَذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ، ‘বিগত রাসূলগণের বৃত্তান্ত সমূহ থেকে আমরা তোমার নিকট বিবৃত করলাম। যার দ্বারা আমরা তোমার চিত্তকে দৃঢ় করতে চাই। এর মাধ্যমে তোমার নিকটে এসে গেছে সত্য এবং বিশ্বাসীগণের নিকটে উপদেশ ও শিক্ষণীয় বাণী সমূহ’ (হূদ ১১/১২০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ، ‘অতএব এদের কাহিনী বর্ণনা কর যাতে তারা চিন্তা করে’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫-১৭৬)

কুরআনে এমন কোন কাহিনী বর্ণিত হয়নি, যেখানে আমাদের জন্য কোন শিক্ষণীয় বিষয় নেই। একটু চিন্তা করলেই নিজের জন্য কোন না কোন উপদেশ আমরা লাভ করতে পারি। যেমন- সূরা ইউসুফে আলোচিত আযীযে মিসরের স্ত্রী ও সূরা ক্বাছাছে বর্ণিত শু‘আইব (আঃ)-এর দুই মেয়ের বিপরীতমুখী কাহিনীতে বড় ধরনের শিক্ষা রয়েছে। বিশেষ করে বর্তমানের ফেৎনার পরিবেশে। অধুনা সমাজে রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের উপস্থিতি অহরহ। পুরুষের ভিড় ঠেলে বুক উঠিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া নারীদের সংখ্যা কম নয়। আবার নিজেকে গুটিয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটা-চলা নারী যে নেই- এমনটিও নয়। কোন পুরুষ যদি রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে বের হন, তবে তিনি দুই ধরনের নারীই দেখতে পাবেন।

১. সে সকল নারী, যাদের অবস্থা ইউসুফ (আঃ)-এর যুগের আযীযে মিসরের স্ত্রীর মতো, যে নারী ইউসুফ (আঃ)-কে ব্যভিচারের দিকে আহবান করে বলেছিল, هَيْتَ لَكَ ‘কাছে এসো!’ (ইউসুফ ১২/২৩)। বর্তমান যুগের অধিকাংশ নারী আযীযে মিসরের স্ত্রীর রোগে আক্রান্ত। তারা টাইটফিট জামায় সজ্জিত হয়ে এবং গায়ে সুগন্ধি মেখে রাস্তায় নামে, শপিংয়ে বের হয়। তাদের অবস্থা ও দেহের অঙ্গভঙ্গি যেন আযীযে মিসরের স্ত্রীর কণ্ঠ হয়ে বলছে, هَيْتَ لَكَ ‘কাছে এসো!’।

২. সে সকল নারী, যাদের অবস্থা মাদায়েনে বসবাসকারী শু‘আইব (আঃ)-এর দুই মেয়ের মত, যাদের মূসা (আঃ) সাহায্য করেছিলেন। যারা পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে নিজেদেরকে ঢিলেঢালা কাপড়ে আড়াল করে বাইরে বের হয়। তাদের অবস্থা যেন শু‘আইব (আঃ)-এর দুই মেয়ের কণ্ঠ হয়ে বলছে, لَا نَسْقِي حَتَّى يُصْدِرَ الرِّعَاءُ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ ‘আমরা পানি পান করাতে পারছি না যতক্ষণ না রাখালরা সরে যায়। অথচ আমাদের পিতা অতিশয় বৃদ্ধ’ (ক্বাছাছ ২৮/২৩)

প্রথম দলের নারীদের সাথে সেইরূপ আচরণ করতে হবে, যে আচরণ ইউসুফ (আঃ) আযীযে মিসরের স্ত্রীর সাথে করেছিলেন। অর্থাৎ নিজের চোখ ও লজ্জাস্থানকে হেফাযতের সর্বোচচ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

আর দ্বিতীয় দলের নারীদের সাথে সেই আচরণই করতে হবে, যে আচরণ মূসা (আঃ) মাদায়েনের দুই নারীর সাথে করেছিলেন। অর্থাৎ তাদের প্রয়োজনে শারঈ গন্ডির ভিতরে থেকে এগিয়ে যেতে হবে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

৭. কুরআনের আহবান নিয়ে চিন্তা করা :

কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল এর আহবান নিয়ে ভাবা। কারণ আল্লাহ মুমিন বান্দাদের কোন আদেশ-নিষেধ করার আগে তাদেরকে সেণহভরে ডাক দেন, তারপর নির্দেশনা প্রদান করেন। অনুরূপভাবে কাফের-মুশরিকদেরও আহবান করে আল্লাহ তাদের বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক-সাবধান করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, যখন তুমি আল্লাহর কিতাবে এই আহবান শুনবে, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ‘হে ঈমানদারগণ!’ তখন তোমান কান সেই দিকে নিবিষ্ট কর। কেননা এটাই তোমার জন্য সর্বোত্তম নির্দেশনা, যার মাধ্যমে তোমাকে কল্যাণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং অকল্যাণ থেকে নিবৃত্ত করা হয়েছে’।[2]

বান্দা যখন কুরআনের আহবান নিয়ে চিন্তা করবে, তখন তার মনে হবে যেন আল্লাহ তাকে আহবান করে কথা বলছেন। ফলে সে আল্লাহর কালামকে আরো গভীরভাবে অনুভব করবে এবং উপভোগ করবে এক অপার্থিব সুখ। মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব আল-কুরাযী (রহঃ) বলেন,مَنْ ‌بَلَغَهُ ‌الْقُرْآنُ ‌فَكَأَنَّمَا ‌كَلَّمَهُ ‌اللهُ وَإِذَا قَدَّرَ ذَلِكَ لَمْ يَتَّخِذْ دِرَاسَةَ الْقُرْآنِ عَمَلَهُ بَلْ يَقْرَؤُهُ كَمَا يَقْرَأُ الْعَبْدُ كِتَابَ مَوْلَاهُ الَّذِي كَتَبَهُ إِلَيْهِ لِيَتَأَمَّلَهُ وَيَعْمَلَ بِمُقْتَضَاهُ ‘কুরআন যার কাছে পৌঁছেছে, তার সাথে যেন স্বয়ং আল্লাহ কথা বলছেন। আল্লাহ যদি কারো ভাগ্যে এটা নির্ধারণ করেন, তিনি কুরআন অধ্যয়নকে স্রেফ আমল হিসাবে গ্রহণ করবেন না; বরং তিনি এমনভাবে কুরআন পাঠ করবেন- যেভাবে গোলাম তার মনিবের চিঠি পাঠ করে, যেই চিঠিটা মনিব তাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছে যেন সে এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং এর চাহিদা অনুযায়ী আমল করে’।[3]

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,‌إذا ‌أردتَ ‌الانتفاعَ ‌بالقرآن فاجمعْ قلبك عند تلاوته وسماعه، وألْقِ سمعَك، واحضُرْ حُضورَ من يخاطبه به من تكلم به سبحانه منه إليه؛ فإنه خطابٌ منه لك على لسان رسوله، ‘যদি তুমি কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হ’তে চাও, তবে কুরআন তেলাওয়াতের প্রাক্কালে ও শ্রবণের সময় তোমার হৃদয়কে নিবিষ্ট কর। কান পেতে থাক। যে সত্তা এই কুরআনের মাধ্যমে কথা বলেছেন তার সামনে সম্বোধিত ব্যক্তির মতো উপস্থিত থাক। কেননা তিনি রাসূলের যবানে এর মাধ্যমে তোমাকেই সম্বোধন করেছেন’।[4] সালম আল-খাওয়ায (রহঃ) নিজেকে সম্বোধন করে বলেন,‌يَا ‌نَفْسُ، ‌اقْرَئِي ‌القُرْآنَ ‌كَأَنَّكِ ‌سَمِعْتِيْهِ مِنَ اللهِ حِيْنَ تَكَلَّمَ بِهِ، فَجَاءتِ الحَلَاوَةُ، ‘হে আত্মা! কুরআন এমনভাবে পাঠ কর, যেন তুমি আল্লাহর কাছ থেকেই তা শ্রবণ করছ। তবেই তেলাওয়াতের স্বাদ পাওয়া যাবে’।[5]

বান্দা যখন এই অনুভূতিতে তেলাওয়াত করবে যে, আমি আমার সৃষ্টিকর্তার কালাম আমার যবান দিয়ে পাঠ করছি, তাঁর কথামালা আমি আমার কণ্ঠে উচ্চারণ করছি। এই অনুভূতি তার হৃদয়ে যদি মযবূত হয়, তবে তার মনে হবে আল্লাহ যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই কুরআন নাযিল করেছেন। ফলে তার তেলাওয়াতের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ مِنْ ‌أَحْسَنِ ‌النَّاسِ ‌صَوْتًا بِالْقُرْآنِ، الَّذِي إِذَا سَمِعْتُمُوهُ يَقْرَأُ، حَسِبْتُمُوهُ يَخْشَى اللهَ ‘মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কণ্ঠের তেলাওয়াতকারী সেই ব্যক্তি, যার তেলাওয়াত শুনে তোমাদের মনে হবে যে, সে আল্লাহ ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত (হয়ে তেলাওয়াত করছে)’।[6] ইসহাক্ব ইবনে ইবরাহীম (আঃ) বলেন,كَانَتْ قِرَاءتُهُ [الفُضَيْلِ] حَزِيْنَةً، شَهِيَّةً، ‌بَطِيئَةً، ‌مُتَرسِّلَةً، ‌كَأَنَّهُ يُخَاطِبُ إِنْسَاناً، وَكَانَ إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيْهَا ذِكْرُ الجَنَّةِ، يُرَدِّدُ فِيْهَا، ‘ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) দুঃখভরা কণ্ঠে, প্রবল অনুরাগ নিয়ে এবং ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। মনে হ’ত যেন তিনি কোন মানুষকে সম্বোধন করে কিছু বলছেন। যখন জান্নাতের আলোচেনা আসত, তখন সেই আয়াত বারবার তেলাওয়াত করতেন’।[7]

আমরা কুরআন অনুধাবনে ব্যর্থ কেন?

কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ছিল সালাফে ছালেহীনের নিত্যদিনের আমল। তাদাববুর বা চিন্তা-ভাবনা ছাড়া তারা কুরআন তেলওয়াতের কথা কল্পনাই করতে পারতেন না। এজন্য যখনই তারা কুরআনের সামনে বসতেন, তাদের চেহারার রং পাল্টে যেত। শোনা যেত শুধু কান্নার আওয়াজ, কুরআনের বাণী কেড়ে নিত তাদের ঘুম। কিন্তু আমরা কেন সালাফদের মতো কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত হ’তে পারি না? কেন কুরআনের আয়াত আমাদের অন্তরজগতে কোন প্রভাব ফেলে না? কেনইবা তাদাববুরে কুরআন থেকে আমরা নিত্যদিন গাফেল থাকি? অথচ মালিক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেছেন,أقسم لكم، لا يؤمن عبد بهذا ‌القرآن إلا صدع قلبه، ‘আমি তোমাদেরকে কসম করে বলতে পারি, যে বান্দা কুরআনের প্রতি ঈমান রাখে, কুরআনের মাধ্যমে তার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হবেই’।[8] কিন্তু আমাদের অন্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় না কেন? এর কারণ উল্লেখ করে শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, اعلم أنك كلما حجبت عن فهم كلام الله فإنما ذلك من معاصٍ تراكمت على قلبك، وإلا لو كان قلبك نقياً وصافياً لرأيت أن كلام الله تعالى أعظم الكلام، ‘মনে রাখবেন! যদি আল্লাহর কালাম অনুধাবন করতে আপনার অসুবিধা হয়, তাহ’লে সেটা আপনার হৃদয়ে পুঞ্জীভূত পাপের কারণেই হয়েছে। কারণ আপনার হৃদয়টা যদি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকে, তাহ’লে দেখতে পাবেন আল্লাহর কালাম কতই না মহান’।[9]

অতএব যিনি নিজের হৃদয়কে পাপের ময়লা থেকে পরিষ্কার রাখতে পারেন, তিনি যথাযথভাবে কুরআন অনুধাবন করতে পারেন, এর অমিয় স্বাদ আস্বাদন করতে পরেন। ফলে কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়ার জন্য তাকে অন্যের আবেগঘন কুরআন তেলাওয়াত শুনতে হয় না, ক্বারীর কান্না শুনে অন্তর নরম করা লাগে না; বরং হৃদয় নিজেই বিনম্র হয় কুরআনের বাণীতে।

কুরআন অনুধাবন করতে না পারার আরেকটি কারণ হ’ল নিয়মিত কুরআনের জন্য সময় বরাদ্দ না রাখা। আমরা অনেকেই কুরআন তেলাওয়াতে খুবই অনিয়মিত। আবার অনেকে তেলাওয়াত করলেও অনুধাবনের মানসিকতা নিয়ে তেলাওয়াত করি না। ফলে শুধু শব্দ তেলাওয়াত করা হয়, কিন্তু আয়াতের তাৎপর্য ও মর্মের গভীরে প্রবেশ করা হয় না। ফলশ্রুতিতে কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। পাপ থেকে বিরত থাকার যথার্থ প্রচেষ্টা থাকে না। হাসান ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন,‌مَنْ ‌لَمْ ‌يَرْدَعْهُ الْقُرْآنُ وَالْمَوْتُ، ثُمَّ تَنَاطَحَتِ الْجِبَالُ بَيْنَ يَدَيْهِ، لَمْ يَرْتَدِعْ، ‘কুরআনের তেলাওয়াত ও মৃত্যুর স্মরণ যাকে গুনাহ থেকে বিরত রাখতে পারে না, তার সামনে একটার সাথে আরেকটা পাহাড় ধাক্কা লাগলেও সে আর বিরত হবে না’।[10] সুতরাং জীবনকে বরকতমন্ডিত ও আখেরাতমুখী করার জন্য নিয়মিত কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। কুরআন অনুধাবনের নিমিত্তে একটা সময় নির্ধারণ করা কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদের চিন্তা-ভাবনা করে কুরআন তেলাওয়াত করার এবং তদনুযায়ী আমল করে সার্বিক জীবন পরিচালনা করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!


[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাত ১/১৩৮।

[2]. সুনানু সাঈদ ইবনে মানছূর হা/৫০, ১/২১১, সনদ যঈফ।

[3]. গাযালী, ইহয়াউ ‘উলূমিদ্দীন ১/২৮৫; তাফসীরে ছা‘আলাবী (আল-জাওয়াহিরুল হাস্সান ফী তাফসীরিল কুরআন) ২/৪৫২।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১/৩।

[5]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৮/১৮০।

[6]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৩৯, সনদ ছহীহ।

[7]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৮/৪২৮।

[8]. ইবনু রজব হাম্বলী, আয-যিল্লু ওয়াল ইন্কিসার, পৃ.২৯৮।

[9]. ওছায়মীন, আল-লিক্বাউশ শাহ্রী, ৩১/২।

[10]. খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ৮/৩১০।






ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মসজিদের আদব - হাফীযুর রহমান, নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর
শরী‘আহ আইন বনাম সাধারণ আইন : একটি পর্যালোচনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মুহাসাবা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
কুরআন নিয়ে চিন্তা করব কিভাবে? - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এলাহী তাওফীক্ব লাভ করবেন কিভাবে? - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (২য় কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
কুরআনের আলোকে ভূমি জরিপ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানবাধিকার ও ইসলাম (৬ষ্ঠ কিস্তি) - শামসুল আলম
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (শেষ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.