ইসলামী
বিচারব্যবস্থায় শাস্তির কঠোরতা প্রসঙ্গে ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকায় ভিন্ন
শিরোনামে ইতিপূর্বে একটি সংক্ষিপ্ত লেখা লিখেছিলাম। সম্প্রতি সঊদী আরবে
একটি হত্যা মামলায় দোষী সাব্যাস্ত হয়ে ৮ জন বাংলাদেশীর শিরচ্ছেদের ঘটনায়
প্রসঙ্গটি আবার উঠে আসায় সেখানকার আলোচনাটি এখানে পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে।
বিষয়টি ছিল ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করায় নাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমানের
হত্যাকারী দুর্বৃত্ত রাজনের কি ধরনের শাস্তি হওয়া দরকার এ নিয়ে
শীর্ষস্থানীয় জনপ্রিয় এক বাংলা সামাজিক সাইটের সদস্যদের করা কিছু মন্তব্য
নিয়ে। যার নমুনা ছিল এমন- ‘না মরা পর্যন্ত গণধোলাই’...‘সবার সামনে গুলি করে
মারা কিংবা একবারে শিরচ্ছেদ’...‘ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা উচিৎ এবং
সেটি সকল টেলিভিশনে বাধ্যতামূলক লাইভ টেলিকাস্ট করা হোক। আমি প্রশাসনে
থাকলে সেটাই করতাম’....‘জনসম্মুখে ফাঁসি চাই। তার আগে মুক্ত
গণধোলাই’....‘মিজানকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেভাবে হত্যা করা হোক’...‘ডগ
স্কোয়াডে দিতে হবে এবং কামড় খাওয়াতে হবে না মরা পর্যন্ত’... ‘যতদ্রুত সম্ভব
মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করতে হবে’... ‘ট্রাকের
পিছনে দড়ি বেঁধে সারাদেশে ঘুরাতে হবে যাতে তার বীভৎস চেহারা দেখে কেউ এমন
কাজ করার আর চিন্তাও না করে। আমার ক্ষমতা থাকলে আল্লাহর কসম আমি তাই করতাম ঐ
ঘৃণ্য নরপশুদের’...‘প্রকাশ্য জনসম্মুখে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা উচিৎ যাতে
ভবিষ্যতে আর কোন নরপশুর জন্ম না হয়’...। আরো যে সব মন্তব্য রয়েছে তা ভাষায়
প্রকাশযোগ্য নয়।
উপরোক্ত মন্তব্যগুলো পড়লে স্পষ্টতঃই বোঝা যায় ঐ মর্মান্তিক ঘটনা মানুষের মনে কিরূপ তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। ফলে এমন কোন উচ্চতম শাস্তির কথা অবশিষ্ট নেই যা মন্তব্যদাতারা উল্লেখ করতে কসুর করেছেন। অথচ তাদের কেউই কিন্তু নিহত মিজানের আত্মীয় বা পাড়া-প্রতিবেশী নন। নিতান্তই অপরিচিত এসব লোকজন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব মন্তব্য করেছেন। একবার চিন্তা করুন, যে পরিস্থিতিতে একজন অনাত্মীয়-অপরিচিত ব্যক্তির অন্তরে নিহত ব্যক্তির জন্য এতটা প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয় সেখানে নিহত ব্যক্তির যারা একান্ত পরিবার-পরিজন তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে? কত তীব্র হতে পারে তাদের প্রতিক্রিয়া? অবশ্যই অবশ্যই বহুগুণ বেশি। নিশ্চয়ই তারা কামনা করবেন তাদের কল্পনায় ভাসা সর্বোচ্চ শাস্তিটাই।
উপরোক্ত ঘটনায় আরো লক্ষ্যণীয় যে, মন্তব্যদাতারা প্রত্যেকেই শিক্ষিত ও আধুনিক সুশীল সমাজের মানবতাবাদী প্রতিনিধি হিসাবে গর্ববোধ করেন এবং তাদের অধিকাংশেরই দাবী, হত্যাকারীর শাস্তি জনসম্মুখে প্রকাশ্যে কার্যকর করা হোক যাতে ভবিষ্যতে এমন কাজ করার কেউ চিন্তাও না করে। এক্ষণে এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবীর পিছনে এতগুলো লোকের যে স্বতঃস্ফূর্ত এবং কঠোরতম অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তা কি অবাস্তব, অস্বাভাবিক কিংবা আবেগীয় বলে উড়িয়ে দেয়া যায়?
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত প্রেক্ষাপট থেকেই চিন্তা করুন ইসলামী বিচারব্যবস্থার যৌক্তিকতা। সুস্পষ্টত:ই এটা প্রতিভাত হবে যে, মানবপ্রবৃত্তির যে স্বাভাবিক দাবী তার মাঝেই ইসলামী বিচারব্যবস্থার আপাত কঠোর শাস্তি নীতির প্রাসঙ্গিকতা নিহিত। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার চরম উন্নতির যুগে তুমুল উৎসাহের সাথে হরহামেশাই প্রচারিত হচ্ছে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা কি রকম বর্বর তার প্রকাশ্য কিংবা আকার-ইঙ্গিতের বিবরণ। যারা কিছুটা সংযমী তারাও আল্লাহর আইনকে কেবল মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার জন্য উপযোগী ছিল বলে পান্ডিত্যপূর্ণ মন্তব্য করে নিজেদেরকে আধুনিক জাহির করেন। অথচ কেতাদুরস্ত বিতর্কের বাইরে বাস্তবতায় এসে উপরোক্ত ঘটনায় এই তাদেরই স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কৃত্রিমতার খোলস ঠেলে ক্ষণিকের জন্য হলেও তারা বাস্তবতার আলোয় একাকার হয়েছেন। একই সাথে ইসলামের কঠোর বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকেও অবচেতনভাবে উচ্চকিত করেছেন।
প্রসঙ্গটি উঠেছে সম্প্রতি সউদী আরবে ৮ জন বাংলাদেশী নাগরিকের শিরচ্ছেদ নিয়ে। যে ঘটনাটি বাংলাদেশী মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখের বিষয় হল, এক্ষেত্রে আলোচনা উঠতে পারত এ ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া প্রসঙ্গে অথবা বড়জোর এ ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসৃত হয়েছিল কি না সে সম্পর্কে, অথচ মূল আলোচনা থেকে সরে গিয়ে ইসলামী আইন কেমন বর্বর, তা নিয়ে ক’দিন মাঠ সরগরম করেছে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ আন্তুর্জাতিক কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা এবং তাদের ধ্বজাধারীরা। আর সাথে সাথে ঝড় উঠেছে বাংলাদেশী প্রিন্ট মিডিয়াসহ বিকল্প মিডিয়া হয়ে উঠা সামাজিক সাইটগুলোতেও। রাজধানীর শাহবাগে মিছিল-মিটিংও করেছে কয়েকটি সামাজিক সংগঠন। ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে এবং ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার শিকার হচ্ছে। ইদানিং সঊদী আরবে কোন ঘটনা ঘটলেই তার সাথে ইসলামকে মিশিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার শোরগোল তোলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই মায়াকান্না যে তারই অংশ তা বলাই বাহুল্য। এসব শঠ মানবতাবাদীর কাছে ভিকটিমের চাইতে অপরাধীর অধিকার অনেক বেশী মূল্যবান। সমাজকে অপরাধমুক্ত করার চাইতে অপরাধ এবং অপরাধীকে প্রতিরক্ষা দেয়াই যেন তাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন এই শিরচ্ছেদের ঘটনায় তাদের তোলা কিছু প্রশ্ন যা নিম্নে আলোচিত হল।
(১) মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবী হল, এই বাংলাদেশীদের সাজা মওকুফের জন্য কি রাষ্ট্রীয়ভাবে সঊদী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা যেত না? এই দাবী যে কতটা অযৌক্তিক তা প্রশ্নেই সুস্পষ্ট। তারা কি আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না? অপরাধীকে শাস্তিদানের নীতিতে আস্থা রাখেন না? তবে কেন চাপ সৃষ্টি করতে হবে? ঐ দন্ডপ্রাপ্তরা কি নিরপরাধ ছিল? তারা তো অপরাধ করেই ধরা পড়েছে। এর জন্য প্রচলিত আইনেই তাদের বিচার হয়েছে এবং দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়ার পর দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছে। জেনে বুঝে যারা অপরাধ করেছে এবং শাস্তির যোগ্য হয়েছে তাদের সাজার বিপক্ষে কথা বলা বা সাজা মওকুফের দাবী তুলতে হবে কেন? আপনার পিতা বা সন্তান এমনভাবে নিহত হলে আপনার দরদ এভাবে উথলে উঠত? আপনি কি চিন্তা করেছেন, অপরাধীর প্রতি আপনার এই ‘দরদ’ নিহতের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অধিকারের প্রতি কিভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করল? এই তো কিছুদিন পূর্বে যখন প্রেসিডেন্ট যিল্লুর রহমান লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা নূরুল ইসলামের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিলেন, তখন নিহত নূরুল ইসলামের স্ত্রীর কথা কি মনে পড়ে? তিনি বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট কি পারবেন তাঁর স্ত্রী আইভীর খুনীদের ক্ষমা করতে?’ একই প্রশ্ন যদি আপনাকেও করা হয়, আপনার উত্তর কি হবে? নাকি দোষীরা ইসলামী আইনে শাস্তি পেয়েছে- এটাই আপনাদের মেকি দরদের মূল ঊৎস? এটাই আপনাদের অন্তর্জ্বালা?
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বড়জোর দাবী করতে পারত যে, বিচারিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসৃত হয়েছে কি না তা যাচাই করা। কিন্তু তা না করে অপরাধীদের সাজা মওকুফের যে হাস্যকর দাবী যারা তুলেছেন তার মাধ্যমে প্রকারান্তরে তারা নিজেরাই কি মানবাধিকার লংঘন করছেন না? দেশের বিচারালয়গুলোতে দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনার কারণে যখন শত শত খুনী অবলীলায় বেরিয়ে যেয়ে আবার অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। আর নিহতের পরিবারের আহাজারিতে গ্রাম-গঞ্জের আকাশ বাতাস মাতম করছে। তখন আপনাদের কানে ঠুলি পড়ে থাকে। যখন দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী হায়নাদের আগ্রাসনে লক্ষ-কোটি মানুষ নির্বিচারে মরছে, তখন আপনাদের ন্যয়ের কন্ঠ থাকে নিশ্চুপ। আর কয়েকজন সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত অপরাধ করে শাস্তি পেয়েছে তাতেই এত মায়াকান্না? ধিক, আপনাদের মানবতাবোধ! মাযলূমের কাছে, বিবেকের কাছে, মানবতার কাছে আপনারা নিজেদেরকে চরম মুনাফিক হিসাবে প্রমাণ করেছেন। আপনাদের এই মায়াকান্নার জন্য ন্যায়ের বাণী কখনোই ভূলুন্ঠিত হতে পারে না, কখনই নিহত মাযলূম ব্যক্তির ন্যয়বিচার পাবার অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে না।
(২) তারা প্রশ্ন তুলছেন, শিরচ্ছেদের মত অমানবিক প্রথা আধুনিক সমাজে কিভাবে বৈধতা পায়? এর উত্তরে বলতে হয়, একজনত মানুষকে ঠান্ডা মাথায় যে পদ্ধতিতেই হত্যা করা হোক না কেন, যে কোন বিবেচনায় তা ‘অমানবিক’ই বটে। তা ফাঁসির মাধ্যমেই হোক, ডার্ক রুমে ইঞ্জেকশন পুশ করেই হোক আর প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদের মাধ্যমেই হোক। কিন্তু সমাজের শান্তি-শৃংখলা রক্ষার্থে এই ‘অমানবিকতা’ আমাদেরকে স্বীকার করে নিতেই হয়। এমনকি বলতে হয় যে, মানবতা সংরক্ষণের জন্য এই ‘অমানবিকতা’র কোন বিকল্প নেই। তাই অনাদিকাল থেকেই মানবসমাজে মৃত্যুদন্ডের বিধান প্রচলিত রয়েছে এবং থাকবে। এক্ষণে অপরাধীর জন্য এতটুকুই করণীয় যে, যত কম কষ্ট দিয়ে সম্ভব তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা। মৃত্যদন্ডের আর যে কোন প্রক্রিয়ার চেয়ে শিরচ্ছেদ মোটেই অধিক যন্ত্রণাদায়ক নয়, বরং কম। কেননা এটা স্বতসিদ্ধ যে, মানুষের নার্ভ সিষ্টেম চালিত হয় ব্রেন থেকে। মস্তিষ্কে কোন অনুভূতি না পৌঁছানো পর্যন্ত সেই অনুভূতিটা মানুষ অনুভব করে না। সেই কারণে মস্তিষ্কই সবকিছুর মূল বিষয়। যখন মানুষ কোন আঘাত পায় সেটার অনুভূতিটা মস্তিষ্কে বহন করে নিয়ে যায় নার্ভ সিষ্টেম। আর সকল নার্ভ সিষ্টেম মানুষের ঘাড়ের স্পাইনাল কর্ডের ভিতর দিয়ে মস্তিষ্কে চলে গিয়েছে। এখন যদি কারো ঘাড়ের স্পাইনাল কর্ডে নার্ভ সিষ্টেম কাটা পড়ে, তখন মস্তিষ্ক পর্যন্ত সেই আঘাতের অনুভূতি পৌঁছতে পারে না বা মানুষ সেই অনুভূতি বুঝতে পারে না। সেই কারণে যদি কাউকে শিরচ্ছেদ করা হয় তখন তার কোন অনুভূতি মস্তিষ্কে যেতে পারে না। ফলে উক্ত ব্যক্তি কোন কিছুই অনুভব করতে পারে না। সুতরাং শিরচ্ছেদ দৃশ্যত: যত বিভৎসই মনে হোক না কেন, এটা কোন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর উদাহরণ নয়।
(৩) তারা বলেন, ‘জনসম্মুখে প্রকাশ্যভাবে শাস্তি কার্যকর করা মধ্যযুগীয় বর্বরতা। এ লোমহর্ষক এই দৃশ্য মানুষের মনে নেগেটিভ অবসেশন ও স্নায়ুবিক বৈকল্যের সৃষ্টি করে।’ যারা এই কথা বলেন তাদের উদ্দেশ্য কেবল ইসলামী আইনের বিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা যে ‘সভ্য’ সমাজ এই ধরণের যুক্তি দেয় সেই সমাজেই সভ্যতার নামে স্নায়ুবিক বৈকল্য সৃষ্টির জন্য হাযারো উপকরণ বিদ্যমান। মুভি-সিনেমা থেকে শুরু করে ছোট্ট দুধের শিশুর জন্য তৈরী গেমসেও পর্যন্ত সেখানে প্রতিনিয়ত ভায়োলেন্স শেখানো হয়, আর মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হরর সিনেমা ও উপন্যাসের নামে কোমলমতি শিশুদের আধিভৌতিক কল্পনার জগতে বিচরণ করানো হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিনই লেখালেখি করছেন। অথচ মানবাধিকারকর্মীদের নযর কেবল ইসলামী বিধানের প্রতি। মূলতঃ ইসলামী আইনে শাস্তি প্রদানের অর্থ কেবল অপরাধীর অপরাধের শাস্তি কার্যকর করা নয়। বরং সমাজকে অপরাধ থেকে বিরত রাখাই এর উদ্দেশ্য। এজন্য অপরাধীকে সকলের অগোচরে শাস্তি না দিয়ে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হয়, যেন এর মাধ্যমে জনমনে অপরাধের ভয়ংকর পরিণতির দৃষ্টান্তমূলক চিত্র অংকিত হয়ে যায়। রাষ্ট্র কর্তৃক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও মজলুমের অধিকার প্রতিষ্ঠার এ দৃশ্য যখন মানুষ স্বচক্ষে দেখবে তখন তাদের মধ্যকার অপরাধপ্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে। সমাজে নৈতিক শিক্ষার সাথে যদি এই শাস্তির ভীতি যোগ না করা হয় তবে অপরাধ কখনই দূর করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে গোপনে শাস্তি মূলতঃ অপরাধকে এবং অপরাধীকে সমাজের আড়াল করারই শামিল; যা আর যাই হোক সমাজ থেকে অপরাধ দূরিকরণে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে না, যেমনটি পারে প্রকাশ্য শাস্তি। সুতরাং এই আইনকে বর্বরতা আখ্যা দিয়ে যারা সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দেওয়ার আহবান জানায় তারা নিজেরাই যে প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার লংঘনকারী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
(৪) ১ জনের বদলে ৮ জনের মৃত্যুদন্ড-এ কেমন বিধান? এ ধরণের স্থুল প্রশ্নও তুলেছেন আমাদের মানবাধিকার কর্মীরা। এমনকি বিবিসিতেও তা প্রচারিত হয়েছে। মনে হচ্ছে সঊদী আরবে আইন-কানুন বলে কিছু নেই, শুধু ধরে ধরে মানুষ হত্যাই তাদের কাজ। এতে ইসলামী আইনের প্রতি তাদের বিদ্বেষের মাত্রা কোথায় পৌঁছিয়েছে, তা অনুমান করা যায়। নতুবা বিষয়টিকে একক অপরাধে ৮ জনের সমভাবে যুক্ত থাকার উপর বিচার না করে ১ঃ ৮ (১ জনের মৃতঃ ৮ জনের শাস্তি) -এর মত সরল সমীকরণ মিলানোর বালখিল্যতায় তারা নামত না। একজনের হত্যাকান্ডে ৮ জন ব্যক্তির সম্পৃক্ত থাকা কি অসম্ভব? যদি সম্পৃক্ত থাকে তাহলে সেই মোতাবেক ৮ জন কেন ৮০০ জনও যদি এই অপরাধে সম্পৃক্ত হয় তবুও তাদের প্রত্যেককে অপরাধের তারতম্য অনুযায়ী শাস্তি প্রদানই কি ন্যয়বিচারের দাবী নয়? এতে সংশয়ের কি আছে তা আমাদের কাছে অবোধগম্য।
এবারে আসুন দেখা যাক ইসলামী আইনে ক্বিছাছের মূল তাৎপর্য সম্পর্কে কুরআনে কী বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে ক্বিছাছ গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে, তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার ( বাক্বারাহ ১৭৮-১৭৯)।
পবিত্র কুরআনের কিসাস সংক্রান্ত আয়াতটি পড়লেই বুঝা যায় কুরআনের এই আইনটি কতটা মানবতাপূর্ণ এবং সামাজিক মানুষের অবস্থার সাথে কতটা সংগতিশীল। মানবাধিকারের দিকটি বিবেচনা করলে আয়াতে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়-
১. এই আয়াত নিহত ব্যক্তির অধিকার পুরোপুরিভাবে সংরক্ষণ করেছে। মাযলুম ব্যক্তিটির পরিবার যদি হত্যাকারীকে ক্ষমা না করে তবে পৃথিবীর কোন শক্তির যেমন ক্ষমতা নেই যে হত্যাকারীকে রক্ষা করবে, তেমনি যদি নিহতের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে রাষ্ট্রের সেখানে কিছুই বলার নেই।
২. এখানে হত্যাকারীর অধিকারও সংরক্ষিত হয়েছে। সে যদি নিজের ভুল বুঝতে পারে অথবা কোন কারণে অন্যায় বিচারের শিকার হয় তবে নিহতের পরিবারের কাছে তার মাফ চেয়ে নেয়ার অধিকার পুরোপুরি সংরক্ষিত রয়েছে। যদি সে নিহতের পরিবারকে যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে রক্তপণ দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারে তবে তাতেও রাষ্টের আপত্তি থাকে না।
পৃথিবী আর কোন আইনে বা বিচার-ব্যবস্থায় একইসাথে এভাবে হত্যাকারী ও নিহত উভয়ের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণের কোন বাস্তব নযীর কি কেউ দেখাতে পারবেন?
আয়াতের শেষে আল্লাহ এই আইন প্রয়োগের যৌক্তিকতা দেখিয়ে চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘হে বুদ্ধিমানগণ! ক্বিছাছের মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে জীবন, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।’ কি অসাধারণ কথা! একটি ক্বিছাছ বাস্তবায়ন তথা ১ জন হত্যাকারীর জীবন গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের আর ১০টা অপরাধীর অপরাধপ্রবণতাকে সহজাত প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। ফলে তা যেন আর ১০ জন ব্যক্তির জীবনকে অবচেতনভাবেই রক্ষা করে। এ জন্য সভা-সেমিনার, মিছিল-মিটিং, পুলিশ-র্যাব কোনকিছুরই প্রয়োজন হয় না। মানুষ নিজ থেকেই সমাজকে রক্ষার কাজে নিয়োজিত হয়ে যায়। এখানেই তো আল্লাহর বিধানের সৌন্দর্য ও যৌক্তিকতা।
সঊদী আরবের যত দোষই থাকুক না কেন, অন্তুতঃ ইসলামী বিচারব্যবস্থাকে যে তারা মূলসূত্র হিসাবে ধরে রেখেছে এজন্য তারা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। হ্যা, এ আইন বাস্তবায়নে অনেকসময় শিথিলতা প্রদর্শন করা হয়েছে বটে; যেমনটি ২০০৫ সালে এক বৃটিশ নাগরিকের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তবে যতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তাতেই সঊদী আরবের আইন-শৃংখলা অন্যান্য বহু দেশের তুলনায় যে অনেক গুণ উন্নত- নিতান্ত জ্ঞানপাপীও তা অস্বীকার করবে না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাজনৈতিক হানাহানিতে খুন, নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, ইভটিজিং- ইত্যাকার সামাজিক অপরাধের যেসব কাহিনী প্রতিদিন এ দেশের পত্র-পত্রিকাজুড়ে ভরে থাকে, সে দেশে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। ফলে সে দেশে কারাবন্দীর সংখ্যা আমেরিকার চেয়ে ৭০ গুণ কম, যার মধ্যে আবার অর্ধেকের বেশীই বিদেশী।
পরিশেষে বলা যায়, বৃটিশ আইন দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আর ইসলামী আইনে পরিচালিত সঊদী বিচারব্যবস্থার মধ্যে যদি তুলনা করা হয়, তবে আকাশ-পাতাল তফাৎটা বোঝার জন্য কোন পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না। এ দেশের বৃটিশ প্রবর্তিত বিচারব্যবস্থা যে ন্যয় প্রতিষ্ঠার চেয়ে যে অপরাধীদের রক্ষক হিসাবেই অধিক ব্যবহৃত হচ্ছে তা একেবারে ওপেন সিক্রেট। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলী খান বিচারব্যবস্থার এই নাজুক বাস্তবতা উল্লেখ করতে যেয়ে আক্ষেপ করে বলেন যে, ‘বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা একটি জুয়ার আড্ডায় পরিণত হয়েছে’। যে দেশের বিচারব্যবস্থার এই নোংরা হাল-হাকিকত উপলব্ধির পরও যাদের কন্ঠস্বর নীরব থাকে, তাদের মুখে সঊদী বিচারব্যবস্থাকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা আখ্যা দিয়ে বাগাড়ম্বর নিতান্তই হাস্যকর শোনায়। বরং চূড়ান্ত সত্য কথা হল, প্রকৃতঅর্থে আইনের শাসন চাইলে এবং বৈষম্যহীন, সুস্থ ও সুশৃংখল সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে, এই বিচারব্যবস্থা তথা ইসলামী আইনই হল একমাত্র সমাধান।
কেননা ইসলামী শাসনব্যবস্থাই হল প্রকৃত শাসনব্যবস্থা। ইসলামী আইনই হল প্রকৃত আইন। এ বিধান স্বয়ং আল্লাহ রাববুল আলামীনই মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন। এ বিধান মানুষের জন্য যে সকল নীতিমালা আবশ্যকীয় করে দিয়েছে তা সকলের জন্য সমানভাবে কল্যাণকর ও তাদের স্বাভাবিক চাহিদার অনুকূল। এ ব্যবস্থা সর্বকালের সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য ও মানব সমাজের শৃংখলাবিধানের সর্বাধিক উপযোগী বিধান। আপাত দৃষ্টিতে তা যত কঠোরই মনে হোক না কেন, তার অভ্যন্তরে মানবহৃদয়ের স্বাভাবিক দাবী এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির যে সুসমন্বয় ঘটেছে তার কোন বিকল্প নেই। তাই সমাজে প্রকৃত অর্থে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাইলে এবং রাষ্ট্র পরিচালনাযন্ত্র ন্যায়বিচারপূর্ণ কাঠামোয় উত্তীর্ণ করতে চাইলে এই বিচারব্যবস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে সমাজে। কেবল সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থেই নয় বরং মুসলিম হিসাবে ঈমান রক্ষার স্বার্থেও আমাদেরকে এ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। আমীন!!