সৃষ্টির সেরা মানুষ। দৈহিক গঠনে
সেরা, জ্ঞানে সেরা। বুদ্ধিতে সে অন্যান্য সব জীবকে তার নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
হিংস্র পশু বাঘ ও বিষধর সাপকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। স্থলচর প্রাণীর
মধ্যে বৃহত্তম প্রাণী হাতিকে সহজেই বশীভূত করে। আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে
বৃহত্তম প্রাণী জলচর তিমি শিকার করে সে ভক্ষণ করে। জলে, স্থলে ও আকাশে
সর্বত্র মানুষের অবাধ বিচরণ। কবির ভাষায়, বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের
মুঠোয় পুরে। একথা এখন সত্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের কোথায় কি আছে, ভূগর্ভে
এবং মহাসাগরের অথৈ পানির নীচে কোথায় কোন সম্পদ লুক্কায়িত রয়েছে, তাও আজ
মানুষের নখদর্পণে। অতি ক্ষুদ্রাকৃতি মোবাইল ফোনের সাহায্যে সে বিশ্বের এ
প্রান্ত হ’তে অপর প্রান্তের খবরাখবর নিমিষে অবগত হচ্ছে। মানুষ এখন সময় ও
দূরত্বকে জয় করার সাথে সাথে আরো বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করতে চলেছে।
মানুষ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান বিকাশের পথ প্রসারিত করেছে। দ্বীনি জ্ঞানের জন্য মক্তব, মাদরাসা ও ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছে। মানুষের দ্বীনি জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন দেশে আলেম ও ওলামার সংখ্যাও অগণিত।
কিন্তু বড়ই আফসোস! এত জ্ঞানের অধিকারী হয়েও মানুষ আল্লাহ পাকের আদেশ-নিষেধ মানার ব্যাপারে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। আমি মানুষের এ অজ্ঞতার কারণ বুঝে উঠি না। আল্লাহ প্রদত্ত বিধান না মেনে মানুষ নিজ খেয়াল-খুশীমত ইবাদত-বন্দেগী করে চলেছে। নিজ হাতে মাটি দিয়ে গড়া মূর্তিকে উপাস্য জ্ঞানে তারই নিকট নতশিরে প্রাণের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া আবেদন-নিবেদন করছে বিশ্বের একটা মোটা অংকের মানুষ। অথচ মাটির মূর্তিটির নিজকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, যে চলতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কারো ভাল কিংবা মন্দও করতে পারে না, সে কি করে মানুষের উপাস্য হ’তে পারে? বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের এ অনর্থক আরাধনাকে কটাক্ষ করে লিখেছেন,
রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী।
অথচ এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মোতাবেক ইবাদত-বন্দেগী করেননি। এভাবে রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বের কোটি কোটি জ্ঞানী ব্যক্তি আল্লাহ পাকের নির্দেশিত পথে ইবাদত-বন্দেগী না করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ইবাদত-বন্দেগী করে নাজাত লাভ করতে চায়। এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। কেননা পথ সঠিক না হ’লে গন্তব্যে পৌঁছা যায় না।
আল্লাহ পাকের নির্দেশিত পথের কিছু বিবরণ দেওয়া আবশ্যক মনে করছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক বিশ্ব মানবের নাজাতের জন্য যে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন, একমাত্র সেটিই নাজাতের প্রকৃত পথ। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআন দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা জিব্রীল আমীনের মাধ্যমে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। এ গ্রন্থের যারা অনুসারী একমাত্র তাদেরই নাজাত লাভের সম্ভাবনা রয়েছে, অন্য কারো নয়। কেননা আল্লাহ পাকই সেকথা জগদ্বাসীর উদ্দেশ্যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম’ (আলে ইমরান ১৯)। এরপর আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীনের তালাশ করবে তা হ’তে কিছু গ্রহণ করা হবে না। পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হবে’ (আলে ইমরান ৮৫)। ইসলামকে যারা গ্রহণ করেনি, আল্লাহ পাকের ভাষায় তারাই কাফির। খাছ কাফিরদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাকের ঘোষণা, ‘যারা কুফুরী করে এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাদের পক্ষ হ’তে পৃথিবীপূর্ণ স্বর্ণ বিনিময় করা হ’লেও তাদের তওবা কবুল করা হবে না। এরাই তারা যাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি। এদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (আলে ইমরান ৯১)। আল্লাহ পাকের উপরি উক্ত বাণীর সাথে অনেক লোকের বিশেষ অবগতি থাকা সত্ত্বেও কেন যে তারা সে বাণীর আলোকে কাজ করে না, আমি তা বুঝে উঠি না।
এখন আমি মুসলিমদের সম্বন্ধে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। তা হ’ল আমরা আল্লাহ পাকের আদেশ-নিষেধ মানি না এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শেরও অনুকরণ করি না। আমাদের জাতীয় কবি নযরুল ইসলাম তাই দুঃখ করে বলেছেন, ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান? আল্লাহ মুসলিম জাতির ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ১০৩)। আল্লাহ পাক শুধু এ কথা বলেই শেষ করেননি। জীবনে চলার পথে মানুষে মানুষে মতবিরোধ হ’তেই পারে। এ মতপার্থক্য নিরসনে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও তদীয় রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের। যদি কোন বিষয়ে তোমরা মতভেদ কর, তবে এর ফায়ছালার ভার আল্লাহ ও রাসূলের উপর ন্যস্ত কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমান এনে থাক। আর এটাই তোমাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা’ (নিসা ৫৯)। ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিম্নের বাণীটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেন, ‘দেহের কোন স্থানে কাঁটা বিধলে তার বিষব্যাথা সমস্ত শরীরে অনুভূত হয়, তেমনি মুসলিম জাতি একটি দেহের ন্যায় (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৫৩)। বিশ্বের কোন এক মুসলিমের বিপদে সকল মুসলিমকে অগ্রসর হ’তে হবে বিপদাপন্ন মুসলিমকে উদ্ধার করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণীর আলোকে আমরা কি এ কাজ করি? করি না। কারণ আমাদের ঐক্যের বাঁধন একেবারে শিথিল। যখন থেকে মুসলিমরা বিভিন্ন মাযহাবী আদর্শের অনুগত হয়েছে, তখন থেকে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে। মাযহাব তাই মুসলিম জাতির জন্য চরম অভিশাপ। আমাদের সামনে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ মওজূদ রয়েছে। জীবন চলার পথে এবং দ্বীনের কাজে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিশুদ্ধ হাদীছ সমুজ্জ্বল দিশারী হিসাবে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা বিচ্ছিন্নভাবে চলি, তা বুঝে উঠ না।
মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
সন্ন্যাসবাড়ী, বান্দাইখাড়া, নওগাঁ।