জগতের মানুষ নানাবিধ ফেৎনায়
জর্জরিত। রাজনৈতিক ফেৎনার পর বড় ফেৎনা হচ্ছে ধর্মীয় ফেৎনা। ধর্মীয় ফেৎনা
আবহমান কাল হ’তে চলে আসছে। সম্ভবতঃ প্রলয়কাল পর্যন্ত তা চলবে। ফেৎনায়
ফেৎনায় জগৎটা ভরে গেছে। আর এজন্য জগত হ’তে শান্তি যেন উধাও হয়ে গেছে। জগতে
শান্তি স্থাপনের চেষ্টা থাকলেও ফেৎনার মোকাবিলায় তা যেন অতি ক্ষীণ ও
ম্রিয়মাণ। মহান আল্লাহ জগতের মানুষকে ফেৎনা হ’তে দূরে থাকার জন্য বলেছেন,
‘ফেৎনা হত্যা অপেক্ষা জঘন্য’ (বাক্বারাহ ১৯১, ২১৭)। এ আয়াতের মর্ম
বুঝতে অসুবিধা নেই। তথাপি বলি, মানুষ হত্যা করা মারাত্মক পাপ। ফেৎনা
সৃষ্টি করা সে পাপ হ’তেও অধিক মারাত্মক। কলহ-বিবাদ, বিশৃঙ্খলা,
যুলুম-অত্যাচার, অশান্তি, অস্থিতিশীলতা সবই ফেৎনার অন্তর্ভুক্ত।
আধুনিক বিশ্বে মানুষের অনেক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তন্মধ্যে কথা বলার অধিকার ও ধর্মের অধিকার অন্যতম। যদিও মহান আল্লাহর নিকট একমাত্র ইসলামই প্রকৃত ধর্ম, তথাপি জগতে মানুষের পালিত ধর্মের অভাব নেই। ধর্মের বাণী একজন আরেক জনকে শোনাতে পারে, এতে দোষের কিছুই নেই। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী ‘একটি কথা জানা থাকলে তা অপরকে জানাও’ (বুখারী, মিশকাত হা/১৯৮)। কিন্তু জোর করে কাউকেও ধর্মান্তরিত করা যাবে না। যদি জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করা হয়, তাহ’লে ফেৎনার উদ্ভব হবে। তাই ইসলাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে, ‘ধর্মে জোর-জবরদস্তি নেই’ (বাক্বারাহ ২৪৬)।
ধর্মের কথা বলার অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনে স্বীকৃত হ’লেও অবস্থা ভেদে মনে হয়, তা যেন পুরাপুরি স্বীকৃত নয়। এজন্য একজন আরেকজনকে প্রাণখুলে ধর্মের আহবান জানাতে পারে না। বর্তমানে ধর্মের আহবানে মারাত্মক ফেৎনার সৃষ্টি না হ’লেও অতীতে যে হয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের সকলেরই কমবেশী জানাশোনা আছে। তবুও কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অহি প্রাপ্তির পর তা প্রচারের জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রচার কার্য শুরু করেন, তৎক্ষণাৎ প্রচন্ড ফেৎনা শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের পালিত শিরকী আমল-আক্বীদার পরিবর্তে তিনি যখন তাওহীদী আমল-আক্বীদার কথা প্রচার করেন, তখনই চরম সংঘর্ষ লেগে যায়। তাঁকে জীবনের তেইশ বছর ধরেই ধর্মীয় ফেৎনার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। দ্বীন প্রচারের আগে তিনি মক্কাবাসীর নিকট অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁর চরিত্রগত গুণাবলীর জন্য তারা তাঁকে ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তাঁর আসল নাম হারিয়ে গিয়ে আল-আমীন নামে সমাদৃত হ’তেন। অথচ এহেন ব্যক্তির সত্য দ্বীন প্রচারে ফেৎনার উদ্ভব হয়েছিল। তিনি যদি আল্লাহ প্রেরিত সত্য দ্বীন প্রচারে ব্রতী না হ’তেন, তাহ’লে মক্কাবাসীর সাথে তাঁর কোনই ফেৎনা হ’ত না। মক্কায় দ্বীন প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি তায়েফ গিয়েছিলেন। সেখানকার ঘটনা আরো মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। তিনি তায়েফবাসী কর্তৃক চরমভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন। ধর্মীয় ফেৎনার কারণেই তাঁকে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা নগরী ত্যাগ করে জীবনের শেষ দশটি বছর মদীনাতে অতিবাহিত করতে হয়েছিল। সেখানেও মক্কাবাসী তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। তিনি শুধু একাই মক্কা নগরী ত্যাগ করেননি, তাঁর ছাহাবাদেরকেও মক্কা ত্যাগ করে মদীনাতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
জন্মভূমি ত্যাগ করা অতীব কষ্টকর। নিজ দেশ, স্বজন, পরিচিত পরিবেশ সব ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন স্থানে, নতুন পরিবেশে হিজরত সহজ নয়। এজন্য হিজরতের গুরুত্ব অত্যধিক। প্রিয় জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে ধর্মের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ এ কাজ করেছিলেন। তাঁদের কাছে ইহাকালীন সুখ-শান্তি হ’তে পরকালীন সুখ-শান্তি অনেক গুণ বেশী আকর্ষণীয় ছিল। মদীনাতেও তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে দিন কাটাতে পারেননি। ধর্মীয় ফেৎনার কারণে তাঁদেরকে অশেষ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল।
এ সভ্যতার যুগেও মানুষের ভুল আমল-আক্বীদার বিপরীতে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সঠিক দ্বীন প্রচার করতে গেলে চরম ফেৎনায় পড়তে হয়। যাঁরা সঠিক দ্বীনি কথা বলতে বাধা সৃষ্টি করে, তারা নিঃসন্দেহে তৎকালীন মক্কা ও তায়েফবাসীদের দোসর বৈকি?
মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ, ফরয ছালাতের পরে জামা‘আতবদ্ধ মুনাজাত, শুক্রবারের দু’আযান, মীলাদ, ক্বিয়াম, শবেবরাত, কুলখানী, চেহলাম, কুরআনখানী, ঈদে মীলাদুন্নবী ইত্যাদি হাযারো বিদ‘আতের বিরুদ্ধে কথা বললে একশ্রেণীর মানুষের গা জ্বালা করে। তারা দ্বীনের আসল বিষয় মেনে নিতে রাযী নয় বরং দ্বীন বাহির্ভূত বিদ‘আতী অনুষ্ঠান করে পকেট গরম করতে ও লোক দেখানো আমল করতে অধিক পসন্দ করে। এজন্য সঠিক দ্বীনি কথা বললে ঐ সকল মানুষের গাত্রদাহ হয়। অথচ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কথা সকলকেই অবনত মস্তকে মেনে নিতে হবে। নইলে নাজাতের আশা করা বৃথা।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের ফলে অনেক পথভোলা মানুষ সঠিক দ্বীনের পথ পেয়েছেন। এ আন্দোলন চালু থাকলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনীত দ্বীন যথাযথভাবে কায়েম হবে বলে বিশ্বাস। হে আল্লাহ! আপনার প্রিয় বান্দা ও রাসূল (ছাঃ)-এর প্রবর্তিত দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে কবুল করুন। আমীন!
মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
সাং সন্ন্যাসবাড়ী, বান্দাইখাড়া, নওগাঁ।