আল্লাহ তা‘আলার আকার আছে, তিনি নিরাকার নন। তিনি শুনেন, দেখেন এবং তাঁর হাত, পা, চেহারা, চোখ ইত্যাদি আছে।
আল্লাহর হাত :
আল্লাহর আকার আছে, এর অন্যতম প্রমাণ হ’ল তাঁর হাত আছে। এ সম্পর্কে নিম্নে দলীল পেশ করা হ’ল-
(১) মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইহুদীদের একটি বক্তব্য এভাবে তুলে ধরেছেন, وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ يَدُ اللهِ مَغْلُوْلَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيْهِمْ وَلُعِنُوْا بِمَا قَالُوْا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوْطَتَانِ- ‘আর ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত রুদ্ধ; তাদের হাতই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এ উক্তির দরুণ তাদের প্রতি অভিশাপ করা হয়েছে; বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় হাত প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৬৪)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, تَبَارَكَ الَّذِيْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (মুলক ১)।
(৩) তিনি আরো বলেন, بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘আপনারই হাতে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আলে ইমরান ২৬)।
(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর’ (ফাতহ ১০)।
(৫) আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। ক্বিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আকাশ সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে’ (যুমার ৬৭)।
এ আয়াতের তাফসীরে ছহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, ইহুদীদের একজন বড় আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, يَا مُحَمَّدُ إِنَّا نَجِدُ أَنَّ اللهَ يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْأَرَضِيْنَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلَائِقِ عَلَى إِصْبَعٍ فَيَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ، فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ تَصْدِيْقًا لِقَوْلِ الْحَبْرِ. ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) এটা লিখিত পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা সপ্ত আকাশ রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবংযমীনগুলো রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, বৃক্ষরাজিকে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবং পানি ও মাটি রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, আর সমস্ত মাখলূককে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর। অতঃপর তিনি বলবেন, আমিই সবকিছুর মালিক ও বাদশা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহুদী আলেমের কথার সত্যতায় হেসে ফেলেন, এমনকি তার মাড়ির দাঁত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।[1]
(৬) ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَقْبِضُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْأَرْضَ وَتَكُوْنُ السَّمَاوَاتُ بِيَمِيْنِهِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ. ‘আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবীকে তাঁর মুঠোতে ধারণ করবেন এবং সমস্ত আকাশকে স্বীয় ডান হাতে গুটিয়ে নিয়ে বলবেন, আমিই একমাত্র বাদশাহ’।[2]
(৭) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لَيِتُوْبَ مُسِئُ النَّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِئُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا-
‘আল্লাহ তা‘আলা পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) প্রতি রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যাতে করে দিনের গুনাহগার তওবা করে। আর তিনি দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যাতে করে রাতের গুনাহগার তওবা করে’।[3]
(৮) শাফা‘আত সংক্রান্ত হাদীছে আছে, হাশরবাসী আদম (আঃ)-এর কাছে এসে বলবে, يَا أَدَمُ أَنْتَ أَبُو الْبَشَرِ، خَلَقَكَ اللهُ بِيَدِهِ، ‘হে আদম! আপনি মানুষের পিতা। আল্লাহ আপনাকে তাঁর নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন’।[4]
(৯) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا إِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ- ‘হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হ’তে তোমাকে কিসে বাধা দিল?’ (ছোয়াদ ৭৫)।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সবাই ঐক্যমত যে, আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাতই প্রকৃত। এখানে সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে কুদরতী হাত, অনুগ্রহ, শক্তি এসব অর্থ গ্রহণ করা যাবে না কয়েকটি কারণে। যেমন-
(ক) প্রমাণ ছাড়া প্রকৃত অর্থকে পরিবর্তন করে রূপকার্থ নেয়া বাতিল।
(খ) সূরা ছোয়াদের ৭৫নং আয়াতে হাতের সম্বন্ধ করা হয়েছে আল্লাহর দিকে দ্বিবচনের শব্দ দ্বারা (بصيغة الةثنية)। পক্ষান্তরে কুরআন এবং সুন্নাহর কোথাও নে‘মত ও শক্তির সম্বন্ধ আল্লাহর দিকে দ্বিবচন দ্বারা করা হয়নি। সুতরাং প্রকৃত হাতকে নে‘মত ও কুদরতী অর্থে ব্যাখ্যা করা শুদ্ধ ও সঠিক নয়।
(১০) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ قُلُوْبَ بَنِيْ آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ كَقَلْبٍ وَاحِدٍ يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ. ‘নিশ্চয়ই সকল আদম সন্তানের অন্তর সমূহ একটি অন্তরের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল সমূহের দু’টি আঙ্গুলের মাঝে অবস্থিত। তিনি যেমন ইচ্ছা তা পরিচালনা করেন’।[5]
(১১) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِّنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلاَيَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِيْنِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيْهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّيْ أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُوْنَ مِثْلَ الْجَبَلِ-
‘যে তার হালাল রোযগার থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করবে (আল্লাহ তা কবুল করবেন) এবং আল্লাহ হালাল বস্ত্ত ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তার দানকারীর জন্য তা প্রতিপালন করতে থাকেন যেরূপ তোমাদের কেউ তার অশ্ব-শাবককে লালন-পালন করতে থাকে। অবশেষে একদিন তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়’।[6]
(১২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَقُوْلُ اللهُ يَا آدَمُ فَيَقُوْلُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِيْ يَدَيْكَ قَالَ يَقُوْلُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ- ‘আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বলবেন, হে আদম! উত্তরে তিনি বলবেন, হাযির হে প্রতিপালক! আমি সৌভাগ্যবান এবং সমস্ত কল্যাণ আপনার হাতে। তিনি বলবেন, জাহান্নামীদেরকে বের করে দাও’।[7]
আল্লাহর পা :
আল্লাহ তা‘আলার পা মোবারক সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَيَزَالُ يُلْقَى فِيْهَا وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَّزِيْدٍ حَتَّى يَضَعَ فِيْهَا رَبُّ الْعَالَمِيْنَ قَدَمَهُ فَيَنْزَوِىْ بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ ثُمَّ تَقُوْلُ قَدْ قَدْ بِعِزَّتِكَ وَكَرَمِكَ- ‘জাহান্নামে (জাহান্নামীদের) নিক্ষেপ করা হ’তে থাকবে আর সে (জাহান্নাম) বলবে, আরো আছে কি? শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক তাতে পা রাখবেন। তাতে জাহান্নামের একাংশের সাথে আরেকাংশ মিশে যাবে। অতঃপর জাহান্নাম বলবে, তোমার প্রতিপত্তি ও মর্যাদার শপথ! যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে’।[8]
এতদ্ব্যতীত আল্লাহর পদনালীর বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَيَسْتَطِيْعُوْنَ- ‘সেদিন পায়ের নলা উন্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে (কাফিরদেরকে) আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য কিন্তু তারা তা করতে পারবে না’ (কলম ৪২)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
يَكْشِفُ رَبُّنَا عَنْ سَاقٍ فَيَسْجُدُ لَهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ وَّمُؤْمِنَةٍ فَيَبْقَى كُلُّ مَنْ كَانَ يَسْجُدُ فِى الدُّنْيَا رِيَاءً وَّسُمْعَةً فَيَذْهَبُ لِيَسْجُدَ فَيَعُوْدُ ظَهْرُهُ طَبَقًا وَّاحِدًا-
‘(ক্বিয়ামতের দিন) আমাদের প্রভু পায়ের নলা উন্মুক্ত করে দিবেন। অতঃপর সকল মুমিন পুরুষ ও নারী তাকে সিজদা করবে। কিন্তু বাকী থাকবে ঐসব লোক, যারা দুনিয়ায় সিজদা করত লোক দেখানো ও প্রচারের জন্য। তারা সিজদা করার জন্য যাবে, কিন্তু তাদের পৃষ্ঠদেশ একখন্ড তক্তার মত শক্ত হয়ে যাবে’।[9]
আল্লাহর চেহারা :
আল্লাহর চেহারা আছে, যা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
১. আল্লাহ বলেন, فَأَيْنَمَا تُوَلُّوْا فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ- ‘তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সে দিকেই আল্লাহর মুখমন্ডল রয়েছে’ (বাক্বারাহ ১১৫)।
২. অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَّيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার চেহারা ব্যতীত’ (আর-রহমান ২৬-২৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলার মুখমন্ডলের সাথে সৃষ্টির মুখমন্ডলের সাদৃশ্য স্থাপন করা যাবে না।
আল্লাহর চোখ :
আল্লাহ তা‘আলার আকারের অন্যতম দলীল হচ্ছে তাঁর চক্ষু আছে। এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীছ থেকে কতিপয় দলীল পেশ করা হ’ল-
(১) তিনি বলেন, تَجْرِيْ بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَنْ كَانَ كُفِرَ ‘যা আমার চোখের সামনে চালিত, এটা পুরস্কার তার জন্য, যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল’ (ক্বামার ১৪)।
(২) তিনি আরো বলেন, وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِيْ ‘যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্ব-হা ৩৯)।
(৩) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَيْسَ بِأَعْوَرَ، أَلاَ إِنَّ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ أَعْوَرُ الْعَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অন্ধ নন। সাবধান! নিশ্চয়ই দাজ্জালের ডান চোখ কানা। তার চোখটা যে একটি ফুলে যাওয়া আঙ্গুরের মতো’।[10] সুতরাং কুরআন হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃতই চোখ আছে। আর এটাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা যাবে না।
আল্লাহর হাসি ও আনন্দ :
আল্লাহ তা‘আলার আনন্দ প্রকাশ ও হাসি সম্পর্কিত বর্ণনা হাদীছে এসেছে। আল্লাহর আনন্দ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحاً بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِيْنَ يَتُوْبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتهِ بِأَرْضٍ فَلاَةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِيْ ظِلِّهَا وَقَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ : اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِيْ وَأَنَا رَبُّكَ! أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ-
‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবার কারণে ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক আনন্দিত হন, যে মরুভূমিতে রয়েছে, তার বাহনের উপরে তার খাদ্য-পানীয় রয়েছে, এসবসহ তার বাহনটি পালিয়ে গেল। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় এসে শুয়ে পড়ল। এভাবে সময় কাটতে লাগল। এমন সময় সে তার পাশেই তাকে দন্ডায়মান দেখে তার লাগাম ধরে ফেলল। অতঃপর অত্যধিক আনন্দে বলে ফেলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব। সে আনন্দের আতিশয্যে ভুল করে ফেলে’।[11]
আল্লাহ তা‘আলার হাসি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يَضْحَكُ اللهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى إِلَى رَجُلَيْنِ يَقْتُلُ أَحَدُهُمَا الْآخَرَ يَدْخُلاَنِ الْجَنَّةَ، يُقَاتِلُ هَذَا فِيْ سَبيْلِ اللهِ فَيُقْتَلُ، ثُمَّ يَتُوْبُ اللهُ عَلَى القَاتِلِ فَيُسْتَشْهَدُ-
‘আল্লাহ তা‘আলা দু’ব্যক্তির কর্ম দেখে হাসেন। এদের একজন অপর জনকে হত্যা করে। অবশেষে তারা উভয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। একজন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে নিহত হয়। অতঃপর হত্যাকারী আল্লাহর নিকট তওবা করে। এরপর সে শাহাদতবরণ করে’।[12]
মুমিনগণের আল্লাহ্কে দেখা :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল- আল্লাহর আকার আছে এবং প্রত্যেক জান্নাতবাসী ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্কে স্বীয় আকৃতিতে দেখতে পাবে। মহান আল্লাহ বলেন, وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ، ‘সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ২২, ২৩)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ঐ দিন এমন হবে যাদের মুখমন্ডলে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।[13] যেমন ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে, إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عِيَانًا ‘শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা চাক্ষুসভাবে দেখতে পাবে’।[14] অন্য হাদীছে এসেছে, লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ‘ক্বিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উত্তরে বললেন, পূর্ণিমা রাতে চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোন কষ্ট হয়? তারা বলল, না, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি আরো বললেন, যখন আকাশ মেঘশূন্য ও সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে তখন সূর্য দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? উত্তরে তাঁরা বললেন, জ্বী না। তখন তিনি বললেন, এভাবেই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে।[15]
ছহীহ মুসলিমে ছুহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, জান্নাতীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের জন্য আমি আরো কিছু বৃদ্ধি করে দিই তা তোমরা চাও কি? তারা উত্তরে বলবে, আপনি কি আমাদের মুখমন্ডল উজ্জ্বল করেননি, আমাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করেননি এবং আমাদেরকে জাহান্নাম হ’তে রক্ষা করেননি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর পর্দা সরে যাবে। তখন ঐ জান্নাতীদের দৃষ্টি তাদের প্রতিপালকের প্রতি পতিত হবে এবং তাতে তারা যে আনন্দ পাবে তা অন্য কিছুতেই পাবে না’। এই দীদারে বারী তা‘আলাই হবে তাদের নিকট সবচেয়ে প্রিয়। এটাকেই অতিরিক্ত বলা হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন, لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ، ‘সৎ কর্মশীলদের জন্য রয়েছে জান্নাত এবং তার চেয়েও বেশী’ (ইউনুস ২৬)।[16]
যারা আল্লাহ্কে দেখার বিষয়টি অস্বীকার করে তাদের দলীল হ’ল নিম্নোক্ত আয়াত, وَلَمَّا جَاءَ مُوْسَى لِمِيْقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ قَالَ رَبِّ أَرِنِىْ أَنْظُرْ إِلَيْكَ، قَالَ لَنْ تَرَاِنِىْ، ‘মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হ’ল, তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁর সাথে কথা বললেন, তিনি তখন বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দাও, আমি তোমাকে দেখব, তখন আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে আদৌ দেখতে পাবে না’ (আ‘রাফ ১৪৩)।
এখানে আল্লাহ لَنْ تَرَانِىْ দ্বারা না দেখার কথা বলেছেন। আর আরবী ব্যাকরণে لَنْ শব্দটি চিরস্থায়ী অস্বীকৃতি বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এই আয়াতকে দলীল হিসাবে নিয়ে মু‘তাযিলা সম্প্রদায় বলে থাকে যে, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত মু‘তাযিলাদের জবাবে বলে থাকেন, এখানে আল্লাহ لَنْ تَرَانِىْ দ্বারা দুনিয়াতে না দেখার কথা বলেছেন, আখিরাতে নয়। কারণ কুরআন-হাদীছের দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়ামতের দিন মুমিন বান্দাগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে। মূসা (আঃ) আল্লাহকে দুনিয়াতে দেখতে চেয়েছিলেন। অথচ দুনিয়ার এই চোখ দ্বারা আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তা‘আলার আকার সম্পর্কে ইমামগণের মতামত :
(১) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত-এর সাথে সৃষ্টজীবের ছিফাতকে যেন সাদৃশ্য করা না হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের মধ্যে দু’টি ছিফাত হচ্ছে- তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টি। রাগ ও সন্তুষ্টি কেমন একথা যেন না বলা হয়। এটাই হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কথা। তাঁর রাগকে শাস্তি এবং সন্তুষ্টিকে যেন নেকী না বলা হয়। আমরা তাঁর ছিফাত সাব্যস্ত করব। যেমনভাবে তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। তিনি একক ও অদ্বিতীয়, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি ও তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি এবং কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়। তিনি জীবিত, সবার উপর ক্ষমতাবান। তিনি শুনেন, দেখেন, সব বিষয় তাঁর জানা। আল্লাহর হাত তাদের সবার হাতের উপর। আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মত নয় এবং তাঁর মুখমন্ডল সৃষ্টির মুখমন্ডলের মত নয়।[17]
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) আরো বলেন, وله يد ووجه ونفس كما ذكره الله تعالى في القرآن فما ذكره الله تعالى في القرآن من ذكر الوجه واليد والنفس فهو له صفات بلا كيف ولا يقال إن يده قدرته أو نعمته لأن فيه إبطال الصفة وهو قول أهل القدر والاعتزال ولكن يده صفته بلا كيف وغضبه ورضاه صفتان من صفات الله تعالى بلا كيف. ‘তাঁর (আল্লাহর) হাত, মুখমন্ডল এবং নফস রয়েছে। যেমনভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁর মুখমন্ডল, হাত ও নফসের যে কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো তাঁর গুণ। কিন্তু কারো সাথে সেগুলোর সাদৃশ্য নেই। আর একথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর কুদরত বা নে‘মত। কেননা এতে আল্লাহর গুণকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। আর এটা ক্বাদারিয়া ও মু‘তাযিলাদের মত। বরং তাঁর হাত তাঁর গুণ কারো হাতের সাথে সাদৃশ্য ব্যতীত। আর তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টি কারো রাগ ও সন্তুষ্টির সাথে সাদৃশ্য ব্যতীত আল্লাহর দু’টি ছিফাত বা গুণ।১৮
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলার অবতরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যে রাত্রের তৃতীয় অংশে সপ্ত আকাশে নেমে আসেন, এ নেমে আসাটা কেমন, কিভাবে নামেন, এটা বলার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। কেমন করে নামেন এটা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।১৯
আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের সাথে মানুষের অর্থাৎ সৃষ্টির গুণের সাদৃশ্য হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা জানেন। কিন্তু সৃষ্টির জানা তাঁর মত নয়। তাঁর ক্ষমতা-শক্তি সৃষ্টির ক্ষমতার মত নয়। তাঁর দেখা-শুনা, কথা বলা, মানুষের বা সৃষ্টির দেখা-শুনা বা কথা বলার মত নয়।২০
সুতরাং কুরআন-হাদীছে যেভাবে আল্লাহর গুণাবলী বর্ণিত আছে ঠিক সেভাবেই বলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, ‘তিনি আরশের উপর সমাসীন’। সেটাই আমাদেরকে বলতে হবে।
ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, ইমাম মালেককে জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহ তা‘আলাকে কি ক্বিয়ামতের দিন দেখা যাবে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ! দেখা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ‘কোন কোন মুখমন্ডল সেদিন উজ্জবল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ২২-২৩)।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার আকার আছেন। তিনি নিরাকার নন। কারণ যার আকার আছে তাকেই দর্শন সম্ভব। কিন্তু নিরাকারকে নয়।
[চলবে]
হাফেয আব্দুল মতীন
এম.এ (শেষ বর্ষ), দাওয়াহ ও উছূলুদ্দীন অনুষদ, আক্বীদা বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. বুখারী হা/৪৮১১, ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[2]. বুখারী হা/৭৪১২।
[3]. মুসলিম হা/২৭৫৯; ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫।
[4]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭২।
[5]. মুসলিম হা/২৬৫৪ ‘ভাগ্য’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩।
[6]. বুখারী, হা/১৪১০ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[7]. বুখারী, হা/৩৩৪৮ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[8]. বুখারী হা/৭৩৮৪ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়।
[9]. বুখারী হা/৪৯১৯ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[10]. বুখারী, হা/৩৪৩৯ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়।
[11]. মুসলিম, হা/২৭৪৭ ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১।
[12]. বুখারী, হা/২৮২৬ ‘জিহাদ ও সিয়ার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৮।
[13]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১৪শ’ খন্ড, পৃঃ ২০০।
[14]. বুখারী হা/৭৪৩৫ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়।
[15]. বুখারী হা/৭৪৩৭ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪।
[16]. মুসলিম হা/১৮১ ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮০।
[17]. আল-ফিক্বহুল আবসাত্ব, পৃঃ ৫৬।
১৮. আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৩০২।
১৯. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃঃ ৪২; শারহুল ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৬০।
২০. আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৩০২।