আমাদের বক্তব্য হ’ল, বাহ্যিক ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য নয়, মূল হ’ল হৃদয়ের বিশ্বাস। আর সেটার খবর কেবলমাত্র আল্লাহই জানেন। বর্তমানে জন্মগতভাবে, আদমশুমারী অনুযায়ী এবং সামাজিক পরিচিতির কারণে মানবজাতি বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত। যেমন মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহূদী, হিন্দু ইত্যাদি। কিন্তু এসব ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম সম্বন্ধে কতটুকু জানে, বিশ্বাস করে এবং পালন করে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। এর কারণ হ’ল-

(১) বর্তমানে মানবজাতি পাশ্চাত্যের আধুনিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। যে সংস্কৃতি মানবজাতির সমস্ত কর্মকান্ড এবং   চিন্তা-চেতনা থেকে সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়েছে বা অপ্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। কেননা ধর্ম এবং আধুনিক চিন্তাধারাকে বৈষম্যমূলকভাবে পরস্পর বিরোধী ভাবা হয়।

(২) অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, দলীয়, গোত্রীয় ইত্যাদি সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা মূলতঃ বস্ত্তগত ও ইন্দ্রিয়তৃপ্তি অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

(৩) পিউ রিসার্চ সেন্টারের সার্ভে অনুযায়ী পাশ্চাত্য সমাজের ও পাশ্চাত্য ভাবধারার অধিকাংশ মানুষের জীবনে ধর্ম কোন প্রভাব রাখে না। তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মত দেখে এবং তথ্য- যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারের কারণে তারা এখন নিজ ধর্মের বাইরে অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্য সম্পর্কে আগের তুলনায় অধিকতর অবগত হচ্ছে।

(৪) সংখ্যা গণনার দিক থেকে যদিও বর্তমানে বিশ্বে ১৯০ কোটি মুসলমান আছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কতজন প্রকৃত বিশ্বাসী মুসলিম সেটা বলা মুশকিল। কেননা এদের অধিকাংশই ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলে না। অনেকে কুরআনের কোন কোন আয়াত বা বিষয় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে। অনেকে রাসূল (ছাঃ)-এর কোন কোন সুন্নাত সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। আলেম নামে সমাজে পরিচিতদের মধ্যেও বিশাল একটা অংশ এমন আছেন, যারা বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত বিশ্বাস ও আমল অনুসরণ করেন এবং তা প্রচার করেন।

(৫) অনেক মুসলিম ও ইসলামী দাওয়াতী প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে কুরআনের বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ ও অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য বিভিন্ন দেশের অমুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে বিতরণ করে যাচ্ছেন এবং সব রকম মিডিয়াতে সেগুলি পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মের অনেকেই কুরআনের এইসব অনুবাদ ও অন্যান্য ইসলামিক সাহিত্য পড়ছে এবং কেউ কেউ হয়ত কুরআনকে ও রাসূল (ছাঃ)-কে সঠিক মনে করছে, যদিও বাহ্যিকভাবে তারা বিভিন্ন ধর্মের লেবেলে পড়ে আছে।

মোটকথা পেরেনিয়ালিস্টরা যে সূরা বাক্বারাহ-এর ৬২ নং আয়াত এবং এ জাতীয় অন্যান্য আয়াত বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে সেগুলিকে ইহূদী, খ্রিষ্টান, ছাবেঈ বা অন্যান্য বিশ্বধর্মের বৈধতার প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে থাকে, তার সবই অপব্যাখ্যা। বাহ্যিক ধর্মীয় পরিচয় কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃত বিশ্বাসের পরিচয় বহন করে না। রাসূল (ছাঃ) আগমনের পর থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রকৃত বিশ্বাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস এবং তদনুযায়ী আল্লাহ, আখেরাত ও অন্যান্য আবশ্যক বিশ্বাস ও তদনুযায়ী আমল। এরূপ বিশ্বাস ও কর্ম নিয়ে যারা মারা যাবে, তারাই বিশ্বাসী হিসাবে মারা যাবে এবং বিশ্বাসী হিসাবে পুনরুত্থিত হবে। এর বাইরে অন্য কোন ধরনের বিশ্বাস কুরআন এবং সুন্নাহ অনুযায়ী স্বীকৃত বা বৈধ নয়।

চতুর্থত : কুরআন মাজীদে আল্লাহ ইসলামকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। এবং ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম। আর আহলে কিতাবগণ (শেষনবীর উপর ঈমান আনার ব্যাপারে) মতভেদ করেছে তাদের নিকট ইল্ম এসে যাবার পরেও কেবলমাত্র পরস্পরে বিদ্বেষবশত। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, সত্বর আল্লাহ তাদের হিসাব গ্রহণ করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। পেরেনিয়ালিস্টরা এই আয়াতগুলি এককভাবে ব্যাখ্যা করে বলে থাকে যে, ‘ইসলাম’ শব্দটি আনুগত্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যে কোন বিশ্ব ধর্ম অবলম্বন করে আল্লাহর আনুগত্য অর্জনের চেষ্টা করা যায়। তার মানে তাদের মতে এখানে ‘ইসলাম’ কেবল মাত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত করে না।

পেরেনিয়ালিস্টদের কথিত আনুগত্যের ব্যাখ্যা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে পাওয়া যায়। যেমন ‘তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১৩২)। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং (এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ) শোনার পর তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (আনফাল ৮/২০)। এবং ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)

এখানে দেখা যাচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করতে হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা আবশ্যক। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করতে হ’লে কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনীত কুরআন ও সুন্নাতের পথ তথা একমাত্র ইসলাম অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। সারকথা, পেরেনিয়ালিস্টদের দাবী অনুযায়ী যে কোন বিশ্ব ধর্ম অবলম্বন করে আল্লাহর আনুগত্য অর্জন করা যাবে। অথচ এটি সম্পূর্ণরূপে কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। 

পঞ্চমত : পেরেনিয়ালিস্টরা দাবী করে যে, সব বিশ্বধর্মের ধর্মাবলম্বীরা একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে। যদিও প্রতিটি ধর্মের ইবাদতের ধরন এবং ঈশ্বরের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন। তার মানে পেরেনিয়ালিস্টরা বলতে চায় যে খ্রিষ্টানদের ঈশ্বর যাকে তারা ‘তিনের মধ্যে এক’ হিসাবে ধারণা করে অর্থাৎ পিতা গড, পবিত্র আত্মা গড, ছেলে গড- এই তিন মিলে এক গড, আর ইসলামের সম্পূর্ণ একক আল্লাহ, একই ঈশ্বর। খ্রিষ্টানরা তাদের যে ঈশ্বরের ইবাদত করে, মুসলমানরাও সে একই আল্লাহর ইবাদত করে। কিন্তু এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, খ্রিষ্টানদের ঈশ্বর আর মুসলমানদের আল্লাহর স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘তুমি বল! হে অবিশ্বাসীগণ! আমি ইবাদত করি না তোমরা যাদের ইবাদত কর এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি, আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যাদের ইবাদত কর এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি’ (কাফিরূন ১০৯/১-৫)

এই আয়াতগুলিতে আল্লাহর হুকুমে রাসূল (ছাঃ) অবিশ্বাসীদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, রাসূল (ছাঃ) যে আল্লাহর ইবাদত করেন, অবিশ্বাসীরা সে আল্লাহর ইবাদত করে না। বুঝা গেল, পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে সব বিশ্বধর্মের ধর্মাবলম্বীরা একই ঈশ্বরের ইবাদত করে বলে যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তা সঠিক নয়।

ষষ্ঠত : পেরেনিয়ালিস্টরা আরও বলে থাকে যে, আল্লাহই বিভিন্ন ধর্ম সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে তারা সূরা হুজুরাতের ১৩নং আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হ’তে পার’। তাঁরা এও বলে যে, আজ বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই ইসলাম বহির্ভূত অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। যদি কেবলমাত্র ইসলামকেই আল্লাহ কবুল করেন তাহ’লে তো ৮০ শতাংশ মানুষকে অনন্তকালের জন্য জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে হবে এবং সেটা হবে আল্লাহর দয়া, ক্ষমা ও শানের পরিপন্থী। তাই অন্যান্য বিশ্বধর্মের অনুসারীদেরও আল্লাহ নাজাত দিবেন।

এর জবাবে আমরা বলব- (১) আল্লাহ তো পেরেনিয়া-লিস্টদের মতো করে জাহান্নামের হিসাব করবেন না। এই ২০ শতাংশ ও ৮০ শতাংশ কেবলমাত্র বাহ্যিক ধর্মীয় পরিচয়, এই সংখ্যাগুলি থেকে প্রকৃত বিশ্বাসীর সংখ্যা জানা যায় না। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কারা বিশ্বাসী হিসাবে মারা যেতে পারে সে সম্পর্কে উপরে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে।

(২) আল্লাহ কোন কোন মানুষকে বিশ্বাস অর্জনের বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৎপথ অবলম্বন করে, সে তার নিজের মঙ্গলের জন্যেই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, সে তার নিজের ধ্বংসের জন্যেই সেটা হয়। বস্ত্ততঃ একের বোঝা অন্যে বহন করে না। আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৫)

এই আয়াতের শেষাংশে দেখা যাচ্ছে যাদের কাছে কোন রাসূল পৌঁছায়নি, কোন এলাহী ম্যাসেজ পৌঁছায়নি, তাদেরকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না। অর্থাৎ তারা নাজাত পেয়ে যাবে। এ বিষয়টি এটাও ইঙ্গিত করে যে, এই জাতীয় মানুষ পৃথিবীতে থাকবে। কারা সেই সকল মানুষ তা নিয়ে বিভিন্ন স্কলারলি ব্যাখ্যা আছে। যেমন- (ক) যারা অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বা শিশু অবস্থায় মারা যায়। তারা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা বোঝার সক্ষমতা অর্জন করেনি। (খ) এমন কোন গোষ্ঠী বা গোত্র যারা কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বা গহীন অরণ্যে বা দুর্গম স্থানে বা প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করে এবং যাদের কাছে নবী-রাসূল ও কুরআনের বার্তা পৌঁছায়নি। হয়ত তারা তাদের নিজস্ব কোন বিশ্বাসের উপর বলবৎ আছে। (গ) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মানুষ, যারা রাসূল ও কুরআনের বার্তা বুঝতে অক্ষম। (ঘ) অতীতের এমন কোন সময় যখন কোন নবী-রাসূল আগমন করেনি এবং সেই সময়ের মানুষ কোন নবী বা রাসূল পাননি। (ঙ) এমন কোন মানুষ বা মানুষের দল, যাদের কাছে কোন কারণে নবী-রাসূল ও কুরআনের বার্তা পৌঁছায়নি এবং সেই বার্তার সন্ধান করার মত তাদের কোন উপায় বা সক্ষমতা ছিল না। (চ) বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে এমন কিছু মানুষ যারা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা পায়নি নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে। (ছ) হয়ত এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে নবী-রাসূল ও কুরআনের ভুল বার্তা পৌঁছেছে এবং সেটা সঠিক করার সুযোগ তাদের ছিল না। (জ) হয়তবা এমন কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে মুসলমানরা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের ব্যর্থ পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুসলমানদের এই ব্যর্থতার কারণে তারা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত থেকেছে। চূড়ান্ত বিচারে আল্লাহই জানেন কারা কারা প্রকৃতই রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা থেকে বঞ্চিত থেকেছে এবং তার ফলে নাজাত পেয়েছে।

(৩) নিশ্চিতভাবে অবিশ্বাসী হয়ত তাকেই বলা যাবে, যার কাছে নবী-রাসূল ও কুরআনের বার্তা পৌঁছেছে, তার চিন্তাশক্তি কর্মক্ষম, তার যৌক্তিক চিন্তা করার ক্ষমতা বিদ্যমান, তবুও সে রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তাকে বা এর কোন অংশকে অস্বীকার করেছে। এ জাতীয় অবিশ্বাসীরা কোন অবস্থাতেই আল্লাহ, রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনতো না। সকল সত্য তাদের কাছে স্পষ্ট হওয়ার পরও তারা তাদের অবিশ্বাসে অটল থাকত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যদি আমরা তাদের প্রতি ফেরেশতা নাযিল করতাম ও তারা মৃতদের সাথে কথোপকথন করত এবং সকল বস্ত্ত তাদের চোখের সামনে জীবিত করে সমবেত করে দিতাম তবুও তারা ঈমান আনতো না, আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মূর্খ’ (আন‘আম ৬/১১১)

তাই দেখা যাচ্ছে, যারা অনন্তকাল ধরে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে তারা এমন সব মানুষ, যারা যদি পৃথিবীতে অনন্ত জীবনও লাভ করত, তবুও অনন্তকাল ধরেই অবিশ্বাসীই থাকতো।

উপরের আলোচনায় দেখা গেল, সকল বিশ্ব ধর্মকে বৈধতা দেওয়ার জন্য পেরেনিয়ালিস্টরা যেসব যুক্তির অবতারণা করেছে কুরআনের কোন কোন আয়াতের বিচ্ছিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে সেগুলি কুরআনের সামগ্রিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। 

উপসংহার

এই প্রবন্ধে পেরেনিয়ালিজম মতবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এই মতবাদটি পাশ্চাত্যের ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ একাডেমিয়ার স্কলাররা ব্যাপকভাবে প্রচার করছে তাদের গবেষণা, লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে। ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজে পেরেনিয়ালিজম মতবাদটি এক প্রকার গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। মতবাদটির মূল কথা হ’ল, সব বিশ্বধর্মের প্রদর্শিত পথই সঠিক এবং এটাই কুরআনের শিক্ষা, ইসলামের মধ্যপন্থা এবং ইসলামের ঐতিহ্যগত অবস্থান। তারা মনে করে যে, শুধু ইসলামই সঠিক এবং অন্যান্য সকল বিশ্বধর্ম ভ্রান্ত- এই ধারণাটি চরমপন্থী, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, জঙ্গীবাদী ও সাম্প্রদায়িক, যা মানবতা বিরোধী এবং শান্তির প্রতি হুমকি। পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেইসব আয়াতকে তাদের মতবাদের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে। আমরা ‘কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআন’ দিয়ে করার নীতি অনুসরণ করে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, পেরেনিয়ালিস্টদের বক্তব্যগুলি বিভ্রান্তিকর। জন্মগতভাবে বা আদমশুমারী অনুযায়ী মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়  বহন করে বটে,  কিন্তু  এই  পরিচয়গুলি  সব  সময় তাদের প্রকৃত বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিশেষ করে আধুনিক মানুষ অনেকাংশই ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক রেখে তাদের জীবন পরিচালনা করে থাকে। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস এবং সেই সূত্র ধরে আল্লাহর প্রতি, আখেরাতের প্রতি ও অন্যান্য আবশ্যিক বিষয়সমূহের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা এবং তদনুযায়ী সৎকাজ করা। এগুলি যে করবে সে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এর বাইরে অন্য কোন বিশ্বাসের ফরমুলার গ্রহণযোগ্যতা কুরআন বা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। যার কাছে রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা পৌঁছেছে এবং সে তার চিন্তাশক্তি দ্বারা উক্ত বার্তা বুঝেছে, তার জন্য রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। অন্যথায় সে অবিশ্বাসী হিসাবে পরিগণিত হবে। যাদের কাছে রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা পৌঁছায়নি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে, তাঁরা আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। যে অবিশ্বাসীরা অনন্তকাল ধরে জাহান্নামে থাকবে তারা এমন অবিশ্বাসী যে, সমস্ত সত্য তাদের সামনে উদ্ভাসিত হ’লেও তারা কখনই বিশ্বাস আনয়ন করত না, অনন্তকাল ধরে পৃথিবীতে বেঁচে থাকলেও অনন্তকাল ধরেই অবিশ্বাসী থাকতো। চূড়ান্ত বিচারে, আল্লাহই মানুষের অন্তরের বিশ্বাসের খবর রাখেন এবং তিনি তাঁর সূক্ষ্ম এবং ন্যায়সঙ্গত বিচারে ঠিক করবেন কে তাঁর কাছে বিশ্বাসী হিসাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, আর কে অবিশ্বাসী হিসাবে। সবশেষে পেরেনিয়ালিস্টদের কাছে আহবান, আপনারা কুরআনের যে আয়াতগুলিকে আপনাদের দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করেন, সেই আয়াতগুলির সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলি মিলিয়ে দেখুন এবং তার আলোকে আপনাদের মনোনীত আয়াতগুলি পুনঃবিবেচনা করুন। ইনশাআল্লাহ আপনারা সঠিক বুঝ পেয়ে যাবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া

প্রফেসর (অবঃ), লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা; কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অফ পেট্রোলিয়াম এ্যান্ড মিনারেলস্, সঊদীআরব; সুলতান ক্বাবূস ইউনিভার্সিটি, ওমান।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
কিভাবে নিজেকে আলোকিত করবেন? - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের গুরুত্ব ও উপায় - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৫ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
জুম‘আর কতিপয় বিধান - মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৪র্থ কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর উপর নির্যাতন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৯ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত - মুযাফফর বিন মুহসিন
পলাশীর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ও আমাদের শিক্ষা - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
আরও
আরও
.