কর্মী সম্মেলনে এক রাত

আগষ্ট মাসের ২৯ তারিখের পড়ন্ত বিকেলে গেলাম নওদাপাড়ায়; উদ্দেশ্য ‘আহলেহাদীছ আন্দালন বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত দুই দিনব্যাপী কর্মী সম্মেলনে যোগদান করা। আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী কমপ্লেক্স-এর পশ্চিম পার্শ্বস্থ জামে মসজিদে আছরের ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর শুরু হ’ল কাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠান। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হল। সম্মেলনে ‘আন্দোলন’-এর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সহ দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন মাসিক আত-তাহরীক-এর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন।

মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের জ্ঞানগর্ভ ও ওজস্বী উদ্বোধনী ভাষণ শ্রবণে হৃদয় জুড়িয়ে গেল। এরপর পর্যায়ক্রমে ভাষণ দেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলগণ ও বিভিন্ন যেলা থেকে আগত যেলা সভাপতি ও প্রতিনিধিবৃন্দ। রাতের খাবার শেষে মসজিদ ও অন্যান্য স্থানে ঘুমের ব্যবস্থা করে দেওয়া হ’ল। দু’পাশ্বের দু’টি মসজিদ এবং বাইরেও অনেক জায়গা পূর্ণ হয়ে গেছে কর্মীদের দ্বারা। গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে পড়েছেন সবাই। দেখে আমার দু’চোখে অশ্রু চলে আসল। এটাই তো ইসলামী ভাতৃত্ব, একেই বলে শান্তি। ভেবেছিলাম, হয়তো কেউ কোন রুমে গিয়ে ঘুমাবে, হয়তো অনেকের মশার কামড়ে ঘুম হবে না। অথচ বিছানা-পত্র ও বালিশ ব্যতিরেকে অনেকেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন মেঝেতে। তারা একমাত্র আল্লাহকে রাযী-খুশি করার জন্য সব সহ্য করছেন। তাদেরকে কেউ টাকা-পয়সা দেয় না। মসজিদে মসজিদে পিকনিক করার লোভ দেখায় না। উপরন্তু নিজের খরচে এসে সাধ্যমত দান করেন সংগঠনের ফান্ডে।

মনে প্রশ্ন জাগল, কে বলেছে এদেশে সঠিক তাওহীদপন্থী মানুষ নেই? কে বলেছে এদেশের মানুষের ঈমান নেই? বরং যারা ইসলামকে মন্দভাবে উপস্থাপন করে তারা ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না। তাই কাউকে বানায় জঙ্গি, কাউকে সন্ত্রাসী। ইসলামকে আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসের ধর্ম হিসাবে। আর তাদের ডাকে সাড়া না দিলে বলে এদেশে তাওহীদী জনতা নেই। ধিক ওদের। ওদের বলি, নওদাপাড়ায় এসে দেখে যাও, কত মানুষ সমবেত হয়েছে? যাদের দুনিয়াবী কোন স্বার্থ নেই। কেন তারা আসে? পরকালীন মুক্তির আশায় একমাত্র। তাদের কাছে তাওহীদ শিখে যাও। আজ সবাই যদি এক হয়ে ছহীহ হাদীছের আলোকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাওয়াত দিত; সরকারকে নছীহত করত, তাহ’লে একদিনের আলটিমেটামের কোন দরকার হ’ত না।

‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একদিনের তাওহীদী জনতার ঘোষণা দেয় না, আর একদিনের জন্য তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণও করে না। এসব ভাবতে ভাবতে তাহাজ্জুদ ছালাতের সময় হয়ে গেল। অনেকে তাহাজ্জুদ পড়ছে, আমিও পড়লাম। প্রশংসা করলাম ঐ আল্লাহ্র, যিনি সকল প্রসংশার একমাত্র মালিক। তাহাজ্জুদ পড়ে ভাবলাম, এই সংগঠন কত কিছুই না দিয়ে যাচ্ছে! দুর্গতদের জন্য ত্রাণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, ইয়াতীমদের প্রতিপালন ও তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করণ, সমাজ সংস্কারে সঠিক দাওয়াত সহ অনেক কর্মসূচী। অথচ আমরা সংগঠনকে কি দিলাম? পূর্বে ভাবতাম, আমাদের জন্য সংগঠন কি করেছে? আমার ভুল ভেঙ্গে গেল। যারা আত-তাহরীক পড়েন সকলকে বলছি, অন্তত একবার নওদাপাড়া আসেন। এখানকার কার্যক্রম দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে।

অতঃপর ফজর ছালাত পড়লাম। আমীরে জামা‘আত গুরুত্বপূর্ণ দরস পেশ করলেন। আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তাই দরস শুনে চলে আসি ছাত্রাবাসে। কিন্তু প্রাণ ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল আমীরে জামা‘আতের খুৎবা শোনার জন্য। তাই আবার নওদাপাড়ায় চলে আসলাম। প্রাণ জুড়ানো খুৎবা শুনলাম। ঈমান বেড়ে গেল বহুগুণ।

অবশেষে আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করি, হে আল্লাহ! জামা‘আতের উপর তোমার হাত থাকে, তাই তোমার নিজ অনুগ্রহে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’কে কবুল কর। আমরা যারা তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখি, তোমার হুকুম মানার জন্য এক আমীরের নেতৃত্বে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন-যাপন করছি, ক্বিয়ামতের মাঠে আমাদের সবাইকে তোমার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিয়ো। হে আল্লাহ! বিচারের কাঠগড়ায় আমাদের অপমানিত কর না। আমাদের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দাও, আমাদের জান্নাতবাসী কর-আমীন!!

* কে.এম.যাকারিয়া

চারুলিয়া, চুয়াডাঙ্গা।

 

আমি যেভাবে তাওহীদের দিশা পেলাম

সময়টি ছিল ২০০৭-এর মধ্যবর্তী কোন এক সময়। সঊদী আরবের দাম্মামে এক বাংলাদেশী প্রবাসী ভাইয়ের মেয়ের বিবাহের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। উল্লেখ্য, আমি ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে সঊদী আরবে আসি।

এদেশের মজলিসগুলিতে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ থাকে। আমি মজলিসে বসে আছি। হঠাৎ দেখি দাড়ি-টুপি ওয়ালা ও জুববা পরিহিত কিছু লোক টেপ রেকর্ডার এবং সাউন্ড বক্স নিয়ে রুমে প্রবেশ করছে। আমি কিছুটা বিস্ময়ের সাথে তাঁদের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ পর একজন লম্বা গোছের লোক সালাম দিয়ে মজলিসে প্রবেশ করলেন। জানলাম, তিনি শায়খ মতীউর রহমান মাদানী। আমি তখনও তাকে চিনি না; তাঁর পরিচয়ও জানি না। যাহোক কিছুক্ষণ পর তিনি বিবাহ-শাদীর সুন্নাত এবং বিদ‘আতের উপর বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন। মাঝখানে একটি কথা বললেন, আপনারা হয়তো কেউ কেউ অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে তো দেখি গান-বাজনার আয়োজন হয়, কিন্তু এখানে ওয়ায-নছীহত হচ্ছে? এখানে সমবেত মুসলিম ভাই-বোনদেরকে বিবাহের শারঈ দিকগুলি জানানোর জন্যই আমাদের আজকের এ আয়োজন। তাঁর এই কথা শুনে আমার চিন্তাশক্তিতে ধাক্কা লাগল। আমি মনোযোগ দিয়ে তার পুরো বক্তব্য শুনলাম।

আলোচনা শেষে সবাইকে ১টি বই ও ১টি করে সিডি দেওয়া হ’ল। আমাকে যে সিডিটি দেওয়া হয়, সেটি ছিল প্রচলিত বিদ‘আত-এর উপর শায়খ মতীউর রহমানের বক্তব্য। আমি পরদিন ঐ বক্তব্য শুনি।

দেশে থাকতে যদিও নিয়মিত ছালাত আদায় করতাম, ইসলামী আলোচনার মাহফিলে যেতাম; কিন্তু তাওহীদ, সুন্নাত, শিরক, বিদ‘আত ইত্যাদির উপরে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাই শায়খের আলোচনা শুনে প্রথমে একটু খটকা লাগল। ভাবতে লাগলাম, আমরা এতদিন থেকে যে বিশ্বাস পোষণ করে আসছি, যে আমল করে আসছি, তাতো দেখি ভুলে ভরা, ভিত্তিহীন। আমি সেই আলোচনা দীর্ঘ ৬/৭ মাস যাবৎ শুনলাম। ফলে আলোচনাটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। তারপর আমি চিন্তা করলাম, এই আলোচনা যেখানে হয়েছে নিশ্চয়ই সেখানে গেলে আরও অনেক বিষয়ের উপর ক্যাসেট বা সিডি পাওয়া যাবে। তখনও ইসলামিক সেন্টার সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা ছিল না। পরে যেভাবেই হোক এক জুম‘আর দিন ইসলামিক সেন্টারে গেলাম। দেখলাম, শায়খের মুখতাছারুল বুখারীর দরস চলছে। ক্লাস শেষ হ’লে শায়খকে কিছু আক্বীদা বিষয়ক প্রশ্ন করলাম। উত্তর জেনে নিয়ে আমি সেন্টারের নীচে চলে যাই। তখন পেছন থেকে এক ভাইয়ের ডাক শুনতে পেলাম। তিনি কাছে এসে বললেন, শায়খ আপনাকে ডেকেছেন। সেখানকার অন্য ভাইয়েরা আমাকে জানালো, শায়খ তাদেরকে বলেছিলেন, যে লোকটি আজকে ক্লাস শেষে প্রশ্ন করেছিল, তাকে নতুন দেখলাম, তার প্রশ্নগুলি ছিল আক্বীদা বিষয়ক। তার মাঝে জানার আগ্রহ আছে বলে মনে হয়। তাকে আমার নিকটে নিয়ে আসুন।

তারপর শায়খের সাথে আমার প্রথমবারের মত কথা হয়। তিনি আমার বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। কিভাবে এখানে এলাম তা বিস্তারিত তাকে জানাই। সেদিন ইসলামিক সেন্টারের দ্বীনী ভাইয়েরা আমার সাথে যে অমায়িক ব্যবহার করেছিলেন, তা ভোলার নয়। তারা আমাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। সত্যিই এমন আচরণ আমি অন্য কারো মাঝে লক্ষ্য করিনি। আমি সেদিন শায়খের ২৫/৩০ টা লেকচার এবং আক্বীদা সংক্রান্ত কিছু বাংলা পুস্তক নিয়ে আসি। শুরু হয় শায়খের আলোচনা শোনা ও বই পড়া। পাশাপাশি প্রতি জুম‘আয় শায়খের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া। ব্যস্ততার কারণে অন্য দিন যাওয়া সম্ভব হ’ত না।

এভাবে আমি হক পূর্ণভাবে চিনতে পারলাম। এদিকে আমার দেশে যাওয়ার সময় চলে এলো। চিন্তায় পড়ে গেলাম, যখন দেশে যাবো, তখন আমার মত আক্বীদাসম্পন্ন লোক কোথায় পাব? ঠিক সেই মুহূর্তে এক দ্বীনী ভাই আমার হাতে মাসিক আত-তাহরীক তুলে দিল। আমার হাতে প্রথম যেদিন আত-তাহরীক-এর সেই সংখ্যাটি এসেছিল, বুঝাতে পারব না আমার মনোভাব সেদিন কেমন হয়েছিল। ভাবছিলাম দেশেও কি এমন ছহীহ আক্বীদা ভিত্তিক পত্রিকার পাঠক রয়েছে? সেই থেকে আমি নিয়মিতভাবে আত-তাহরীক পড়ে যাচ্ছি। যখনই কোন ভাই ছহীহ আক্বীদা গ্রহণ করেন, তার হাতে আত-তাহরীক-এর একটি কপি তুলে দেই। এখনো নিয়মিতভাবে ইসলামিক সেন্টারে শায়খ মতীউর রহমান ছাহেবের ক্লাসে উপস্থিত থেকে কিতাবুত তাওহীদ, উসূলুছ ছালাছাহ, মুখতাছারুল বুখারী, তাফসীর, মুছত্বালাহুল হাদীছ, বুলূগুল মারাম ইত্যাদির উপরে ক্লাস করে যাচ্ছি।

পরিশেষে মহান আল্লাহ তা‘আলার একটি বাণী স্মরণ করে শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ‘হে নবী! তুমি যাকে চাও তাকে হেদায়াত দান করতে পারো না। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত দান করেন এবং হেদায়াত প্রাপ্তদের সম্পর্কে তিনি খুব ভাল করেই জানেন’ (ক্বাছাছ ৫৬)। আমার এভাবে হকের সন্ধান পাওয়া ও হেদায়াত লাভ করা আল্লাহর বিশেষ রহমত। তাই হেদায়াত লাভের জন্য আমাদেরকে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে হক চেনার ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দিন- আমীন!

* তালহা খালেদ

দাম্মাম, সঊদীআরব।






আরও
আরও
.