জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন! পাটগ্রাম, লালমণিরহাট ১৬ই জানুয়ারী শনিবার : অদ্য সকাল পৌনে ১১-টায় লালমণিরহাট যেলার পাটগ্রাম থানাধীন বুড়িমারী ইউনিয়নের মুহাম্মাদীপাড়া আহলেহাদীছ জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ কালে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব উপরোক্ত কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল দুস্থ মানুষের নিকটে আমরা সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সেই সাথে তাদেরকে ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন শান্তির জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার আহবান জানিয়েছি। তিনি সকলকে আল্লাহর বিধান মেনে দেশের সুনাগরিক হওয়ার আহবান জানান। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ লালমণিরহাট যেলা সভাপতি মাওলানা শহীদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুব সংঘে’র নেতৃবৃন্দ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম, বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, জয়পুরহাট যেলা সভাপতি মুহাম্মাদ মাহফূযুর রহমান, রংপুর যেলা সভাপতি মাস্টার খায়রুল আযাদ, রাজশাহী মহানগর ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুবীনুল ইসলাম, গাইবান্ধা-পশ্চিম যেলার সাংগঠনিক সম্পাদক আলতামাসুল ইসলাম, ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য ও ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর গবেষণা সহকারী আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ‘যুবসংঘ’-এর সাধারণ সম্পাদক ইহসান এলাহী যহীর ও আহলেহাদীছ যুবসংঘের ‘কর্মী’ আব্দুল্লাহ আল-মামূন। এছাড়াও ছিলেন পাটগ্রাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্জ আনোয়ারুল ইসলাম (৬১), শ্রীরামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব মূসা আলী (৫০), অধ্যাপক রেযাউল করীম প্রধান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। শীতবস্ত্র বিতরণ : এখানে ১৩ নং ছিট খড়খড়িয়া, ১৪ নং ছিট লথামারী মুহাম্মাদীপাড়া, ১৫নং ছিট খাড়খড়িয়া রহমতপুর, ২০নং ছিট ডাঙ্গিরপাড়া লথামারী প্রভৃতি এলাকার শীতার্ত অসহায় দুস্থ মানুষের মাঝে উন্নত মানের ‘কম্বল’ সমূহ বিতরণ করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও তাঁর সাথীবৃন্দ। অতঃপর স্থানীয় দায়িত্বশীলদের নিকট ‘সুয়েটার’ সমূহ রেখে আসেন, যাতে তারা ১৩টি ছিটমহলের হকদার ভাই-বোনদের তালিকা করে তাদের হাতে সেগুলি দ্রুত পৌঁছে দেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি উফারমারা গ্রামের ১০৫ বছরের বৃদ্ধ বাবুর উদ্দীনকে ২০০০/= টাকা নগদ অনুদান প্রদান করেন এবং জানুয়ারী’১৬ থেকে ঐ পরিমাণ টাকা তাকে প্রতিমাসে অনুদান প্রদান করবেন বলে জানান। উল্লেখ্য যে, উক্ত বৃদ্ধ হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। ১১ বছরের পুত্র আব্দুর রঊফ তাকে নিয়ে বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করে। বৃদ্ধের স্ত্রী পাগ©র্লনী এবং কনিষ্ঠ পুত্র আব্দুল মালেকের বয়স মাত্র ৯ বছর। আমীরে জামা‘আত তাদেরকে অবশ্যই নিকটস্থ স্কুল বা মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। অতঃপর এই দুস্থ পরিবারকে সাহায্য করার জন্য তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তাদের জন্য সরকারী ভাতার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। নেতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে সাড়া দেন এবং এ সপ্তাহের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দেন। জমি দান : মুহাম্মাদীপাড়া আহলেহাদীছ জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লী জনাব আসাদুয্যামান ও তার বড় ভাই যাফিয়ার রহমান (দুলাল) আমীরে জামা‘আতকে সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাস্তার ধারে খোলামেলা স্থানে প্রায় ২ বিঘা জমির একটি প্লট দেখান। যেখানে তাঁরা একটি মসজিদ ও মাদরাসা করতে চান এবং এ ব্যাপারে আমীরে জামা‘আতের সহযোগিতা কামনা করেন। আমীরে জামা‘আত তাদের আহবানে সাড়া দেন এবং সাধ্যমত চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। দহগ্রাম রওয়ানা ও শীতবস্ত্র বিতরণ : অতঃপর মুতাওয়াল্লীর বাড়ীতে দুপুরের আতিথেয়তা গ্রহণ শেষে আমীরে জামা‘আত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর তিন বিঘা করিডোর অতিক্রম করে সরাসরি ৯ কি.মি. দূরে আঙ্গরপোতা সীমান্তে বিজিবি ফাঁড়ি পর্যন্ত চলে যান। ফেরার পথে বঙ্গেরবাড়ী স্কুল মাঠ পরিদর্শন করেন। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছিটমহল বিনিময় চুক্তি শেষে আগমন করেছিলেন। অতঃপর বিকাল ৩-২০ মিনিটে দহগ্রাম গুচ্ছগ্রামে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। এই সময় তাঁর সাথে লালমণিরহাট যেলা ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীলবৃন্দ ছাড়াও ছিলেন পাটগ্রাম মহিলা ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক জনাব রেযাউল করীম প্রধান ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এখানে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, আপনারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করুন। কুরআন ও হাদীছ মেনে জীবন যাপন করুন। সবকিছুর বিনিময়ে পরকালীন পাথেয় হাছিলে সচেষ্ট থাকুন। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সর্বদা আপনাদের পাশে থাকবে ইনশাআল্লাহ। মেহের আলীর সাথে পরিচয় : এখানে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ১৪৫ বছরের বৃদ্ধ মেহের আলীর সাথে পরিচিত হন। ৮৭ বছর বয়সী তার ছোট ভাই বলেন, আমরা জন্মগতভাবেই ‘আহলেহাদীছ’। আমীরে জামা‘আত তাদেরকে ২০ কপি ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বিতরণের জন্য উপহার দেন। কুলাঘাট রওয়ানা : দহগ্রাম থেকে বিকাল ৩-৫০ মিনিটে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত লালমণিরহাট সদর থানার অন্তর্ভুক্ত কুলাঘাট ইউনিয়নের বাঁশপেচাই ও ভেতরকুটি ছিটমহলে শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি ১৯৯৭ সালে তাঁর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কাকিনার বাজার আহলেহাদীছ জামে মসজিদে মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও ক্বছর করেন। অতঃপর সন্ধ্যা ৭-টায় তিনি লালমণিরহাট শহরে পৌঁছেন। কিন্তু আমীরে জাম‘আতের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে লালমণিরহাট পুলিশ প্রশাসন তাঁকে ফিরে যেতে অনুরোধ করে। ফলে তিনি রাত সাড়ে ৭-টায় লালমণিরহাট শহর থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ফেরৎ রওয়ানা হন। ইতিপূর্বেই সেখানে বিতরণের জন্য কম্বল ও সোয়েটার সহ শীতবস্ত্র সমূহ পৌঁছানো হয়েছিল। ফলে তিনি লালমণিরহাট যেলা সংগঠনকে সেগুলি উপস্থিত হকদারগণের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দেন এবং সকলকে সালাম পাঠান। রাতেই বেশী অংশ বিতরণ করা হয়। পরদিন বাকী অংশ প্রদান করা হয়। ফেরার পথে গোবিন্দগঞ্জ ও বগুড়ায় সফরসঙ্গী তিনজনকে নামিয়ে দেন এবং নওগাঁ হয়ে রাত ২-টায় রাজশাহী মারকাযে পৌঁছে যান। ফালিল্লাহিল হাম্দ। ছিটমহল সমূহে আহলেহাদীছের অবস্থান : প্রায় সকল ছিটমহলেই অল্প বিস্তর ‘আহলেহাদীছ’ রয়েছেন। তবে উপরে বর্ণিত ১৩টি ছিটমহলে আহলেহাদীছের জামে মসজিদ সমূহ রয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় এই যে, বুড়িমারী ইউনিয়নের উফারমারা গ্রামের ১০৫ বছরের বৃদ্ধ বাবুরুদ্দীন, পিতা : মৃত- বাহুই মুহাম্মাদ একজন জন্মগত ‘আহলেহাদীছ’। একইভাবে দহগ্রাম ইউনিয়নের গুচ্ছ গ্রামের ১৪৫ বছরের বৃদ্ধ মেহের আলী একজন জন্মগত ‘আহলেহাদীছ’। এতেই বুঝা যায় যে, ছিটমহলগুলোতে বহু পূর্ব থেকেই আহলেহাদীছের বসবাস রয়েছে। আহলেহাদীছ জামে মসজিদ সমূহ : লালমণিরহাট যেলার পাটগ্রাম উপযেলাধীন ছিটমহল সমূহে আহলেহাদীছ জামে মসজিদ-এর সংখ্যা মোট ১৩টি। (১) বুড়িমারী ইউনিয়ন, ১৪নং কারীবাড়ী ছিটমহল, মুহাম্মাদী পাড়ায় ২টি। (২) শ্রীরামপুর ইউনিয়ন, ১৮নং ছিটমহল, সালাফীপাড়ায় ১টি। (৩) উক্ত ইউনিয়নের ইসলামপুর ডাঙ্গিরপাড়া ২০নং লথামারী ছিটমহল, ১টি। (৪) পাটগ্রাম ইউনিয়ন, বেংকান্দা হানীফার বাড়ী ছিটমহল, ১টি। (৫) ঐ, মুছল্লিটারী ৩১নং ছিটমহল, ২টি। (৬) ঐ, বাংলাবাড়ী ছিটমহল, ১টি। (৭) কুচলিবাড়ী ইউনিয়ন, পানবাড়ী (পাবনা পাড়া), ১টি। (৮) দহগ্রাম ইউনিয়ন, গুচ্ছগ্রাম ছিটমহল, ১টি। (৯) ঐ, সরদার পাড়া ছিটমহল, ১টি।(১০) বাউরা ইউনিয়ন, চৌদ্দবাড়ী ছিটমহল, ১টি। (১১) জোংড়া ইউনিয়ন, সরকারের হাট ছিটমহল, ১টি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হওয়া সত্ত্বেও বিগত ৬৮ বছর এই ছিটমহলগুলি ভারতের আওতাধীন ছিল। চুরি-ডাকাতি ও অত্যাচার-নির্যাতন এদের নিত্য সঙ্গী ছিল। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর বাংলাদেশের বেরুবাড়ী ইউনিয়ন ভারতকে দিয়ে দেওয়া হ’লেও তার বিনিময়ে ভারতের তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রথমে ১ঘণ্টা করে, পরে ৬ঘণ্টা করে করিডোর খুলে দেওয়া হ’ত। বর্তমান সরকারের আমলে গত ৩১শে জুলাই’১৫ শুক্রবার এক চুক্তি বলে ভারত এটি ২৪ঘণ্টা উন্মুক্ত করে দিতে সম্মত হয়। সেই সাথে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ১১১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ৫১টি ছিটমহলের অধিবাসীদেরকে ভারত বা বাংলাদেশের যেকোন একটির নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সাথে মুক্ত হয় ১৬২টি ছিটমহলের ৫২ হাযার বন্দী মানুষ। ফালিল্লাহিল হাম্দ। ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে ৫৯টি লালমণিরহাটে, ৩৬টি পঞ্চগড়ে, ১২টি কুড়িগ্রামে ও ৪টি নীলফামারীতে। যেগুলির অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহারে ৪৭টি এবং জলপাইগুড়িতে ৪টি। যেখানকার মোট জনসংখ্যা ৪৪ হাযার।




আরও
আরও
.