ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট দেওয়ার পূর্বেই তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয় সে কোথায় যাবে। অতঃপর গিয়ারে দেওয়ার সাথে সাথে গাড়ী লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলতে থাকে। লক্ষ্য নির্ধারণ না করে গাড়ী ছাড়লে এক্সিডেন্ট অবশ্যম্ভাবী। গাড়ী চালকের এই ভূমিকার সাথে রাষ্ট্র চালকের তুলনা করা চলে। ব্যক্তি হৌক বা দল হৌক চালকের ভূমিকায় যিনি বা যারা থাকবেন, তাদেরকে প্রথমে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় তার নেগেটিভ কারণ ছিল হিন্দুদের অত্যাচার থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা। আর পজেটিভ কারণ ছিল ইসলামী বিধান অনুযায়ী শাসিত একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর ড্রাইভারের সীটে বসা ব্যক্তিগণ তাদের ঘোষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হ’লেন এবং ‘ইসলাম’ তাদের একটি পলিটিক্যাল স্ট্যান্ট হয়ে দাঁড়ালো মাত্র। কথায় কথায় ইসলামের দোহাই দিলেও ইসলামের উল্লেখযোগ্য কোন বিধান তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করেননি। লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ায় পাকিস্তানের চলমান গাড়ী মাত্র ২৪ বছরের মাথায় এক্সিডেন্ট করে ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেল। অথচ তাদের নেতারাই একসময় গর্ব করে বলতেন, ‘পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই এসেছে’। এর উপরে জনগণের আবেগ সৃষ্টি করার জন্য বলতেন, ‘পাকিস্তান ইসলামের নামে সৃষ্ট। এর রক্ষক স্বয়ং আল্লাহ’। এই নিখাদ সত্যগুলির পিছনে লুকিয়ে ছিল নেতাদের স্বার্থপরতা, দায়িত্বহীনতা, বিলাসিতা ও লক্ষ্যহীন মানসিকতা। তবুও বলব, পাকিস্তানীদের একটি ঘোষিত লক্ষ্য ছিল, ‘ইসলাম’। যা জনগণের মুখে মুখে ফিরতো।

১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক পাক-ভারত যুদ্ধের শুরুতে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানের ইসলামী আবেগপূর্ণ গুরুগম্ভীর রেডিও ভাষণ যারা স্বকর্ণে শুনেছিলেন, মনে হয় আজও তাদের কানে সে ভাষণের ঝংকার ধ্বনি শুনতে পাবেন। তাদের প্রাণে সে ভাষণের আবেগ অনুভব করবেন। সমস্ত দেশ সে ভাষণের সাথে একাট্টা হয়ে গিয়েছিল। ঐ ছোট বেলায় আমরা তরুণ ছেলেদের মাঠে জড়ো করে লেফট-রাইট করেছি। ভারতীয় যুদ্ধ বিমান উড়তে দেখলেই আকাশে তীর-গুলতি দিয়ে ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়ে মেরেছি। অর্থাৎ রাষ্ট্রনেতার সাথে প্রজা সাধারণের হৃদয়ের আবেগ একাকার হয়ে সেদিন যে মহাশক্তির উত্থান ঘটেছিল, তার কাছে পরাজয় ঘটেছিল বিশাল ভারতের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর। আমরা নির্দ্বিধায় বলব, সেই বিপদের দিনে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যের একমাত্র সেতুবন্ধন ছিল ‘ইসলাম’। একে অস্বীকারকারী ব্যক্তি দিবসে সূর্য না দেখা চামচিকা ছাড়া কিছুই নয়। আজকের ন্যায় তখনও এদেশে হিন্দুরা বসবাস করত। তারাও তখন আগ্রাসী ভারতের বিরুদ্ধে একাট্টা ছিল। তাদের দেশপ্রেমে কোন খাদ ছিল বলে শোনা যায়নি। মুসলমান প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাই-ভাই হিসাবে তারা একত্রে সামাজিক জীবন যাপন করত। দাদা-কাকা, পিসি-মাসী ইত্যাদি স্নেহমাখা আহবান এখনো কানে শুনতে পাই। হিন্দু-মুসলিম দুই প্রতিবেশী কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে কাউকে কখনো বাদ দিত বলে জানতাম না। একে অপরের বিপদে সর্বদা এগিয়ে যেত। ‘পাকিস্তানী’ বলে গর্ব করতে সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে কখনো সংকোচ দেখিনি। অবশ্য স্বার্থপর দুষ্টমতি লোকদের কথা স্বতন্ত্র।

পক্ষান্তরে আজকে যদি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞেস করি, বাংলাদেশের জাতীয় লক্ষ্য কি? এদেশের জাতীয় ঐক্যের মানদন্ড কি? তখন মুজিবপন্থীরা বলবেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’; জিয়াপন্থীরা বলবেন ‘জাতীয়তাবাদ’; ইসলামপন্থীরা বলবেন ‘ইসলাম’। যারা কোন পন্থী নয়, তারা বলবেন চাই দু’মুঠো ভাত। ফলে সরকার আসছে আর যাচ্ছে, দেশের কোন উন্নতি নেই। জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য নেই। নেই কোন জাতীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক লক্ষ্য। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সে দল তার নিজের মত করে শিক্ষা ও প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে চায়। কিন্তু বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়ে সে দলটি সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে তার মেয়াদকাল অতিবাহিত করে। পরবর্তী সরকার এসে একইভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলে। এভাবে একটি দেশ জাতীয়ভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।

বর্তমান জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে দেশপ্রেমিক জনগণ আশায় বুক বেঁধেছিল। এখনো যে তারা সম্পূর্ণ হতাশ হয়েছে, তা নয়। কিন্তু আশানুরূপ কিছু না পেয়ে অনেকে মুষড়ে পড়েছেন। আমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবো না। বরং সরকার ও প্রশাসনে যারা আছেন, তাদের সুমতি ও হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করব।

আমরা বলব, জোট সরকারকে সবার আগে জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। তাঁরা কোন্ মত-পথের উপরে দেশ পরিচালনা করবেন, সে বিষয়ে আগে নিজেরা পরিষ্কার হ’তে হবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে Anti-Indian ও Pro-Indian দু’টি ধারা এ দেশে কাজ করে। বর্তমান জোট সরকার ১ম ধারার সমর্থকদের এবং বিগত সরকারের যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আবেগ সঞ্জাত। বলা চলে এগুলি কোন আদর্শিক সমর্থন নয়। বরং এক প্রকার নেগেটিভ সমর্থন। আর নেগেটিভ সমর্থন মূলতঃ স্থায়ী কোন সমর্থন নয়। যা মস্তিষ্কে আঘাত করলেও হৃদয়ে রেখাপাত করে না।

বিদ্যমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি নয়, দল প্রতিনিধিরা সংসদে প্রবেশ করেন। যাদের অধিকাংশ সংসদকে ব্যবহার করেন তাদের ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে। যারা জাতীয় সংসদের বৈঠকে যোগদানের চাইতে ও সংসদীয় কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত করার চাইতে সচিবালয়ে তদ্বিরের কাজেই সময় ব্যয় করেন বেশী। ভোটে নির্বাচিত হওয়ার অহংকারে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। ভোটাররা যেন তাদের পাঁচ বছর লুটপাটের লাইসেন্স দিয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরোধী হওয়ায় দুই দলের ঝগড়ার ক্ষেত্র হিসাবে জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করা হয়। অতএব এটা নিশ্চিত যে, দলতন্ত্রের দ্বারা কখনোই জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদে বসে ঠান্ডা মাথায় কোন বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াও বর্তমান পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। ‘বহু সত্যে’র ধারণা (Plurality of truth) মানব সমাজে বিশৃংখলা বৈ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় না। কেননা মানব রচিত কোন বিধান আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কখনোই সার্বজনীনতায় রূপ নিতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধানের মধ্যেই সার্বজনীন সত্য পাওয়া সম্ভব। যা দলমত নির্বিশেষে সকলের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু বর্তমানে কোন দলই তাকে উদারভাবে গ্রহণ করতে পারছে না স্ব স্ব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে।

আমরা মনে করি বাংলাদেশের জাতীয় সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হ’ল ইসলাম। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইসলামের ব্যাপক ও উদার Concept ভিত্তিক একটি কল্যাণমুখী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সেই লক্ষ্যে সর্বাগ্রে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। নিঃসন্দেহে সেই শিক্ষাব্যবস্থা হ’তে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে। প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদ কিংবা ইসলামের নামে কোন মাযহাবী বা মারেফতী সংকীর্ণতাবাদ সেখানে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। বর্তমানের সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার অন্ধ গলিপথ থেকে বেরিয়ে জনগণকে ইসলামের উদার ও আলোকোজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ইসলামী খেলাফতের স্বর্ণোজ্জ্বল দিনগুলি ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হ’লে ইনশাআল্লাহ আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত হব। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]


[1]. ৫ম বর্ষ, ১১তম সংখ্যা আগষ্ট ২০০২।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
নির্বাচনী যুদ্ধ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রসঙ্গ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রশিক্ষণের মাস রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নারীর উপর সহিংসতা : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
গাযায় গণহত্যা ইহূদীবাদীদের পতনঘণ্টা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হানাহানি কাম্য নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সার্বভৌমত্ব দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংবিধান প্রণয়ন প্রসঙ্গে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চরিত্রবান মানুষ কাম্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শান্তি ও সহিষ্ণুতার ধর্ম ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কবিতা
নারী শিক্ষা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.