
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে খুলাফায়ে রাশেদীনের স্বর্ণযুগ শেষ হওয়ার পর থেকে মন্দের ভাল হিসাবে হ’লেও উমাইয়া, স্পেনীয়, আববাসীয়, ফাতেমীয় এবং ওছমানীয়দের ইসলামী খেলাফত বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত বহাল ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়ি দিয়ে কামাল পাশার নেতৃত্বে যার পতন ঘটে। এভাবে ১৯২৪ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকদের হাতে ওছমানীয় খেলাফতের পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনার ব্যাপক উন্মেষ ঘটে। যা পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্টভাবে বারি সিঞ্চন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেখানে স্বাধীন ও বাধাহীন পরিবেশে ইসলামী খেলাফত বা ইসলামী হুকুমত কায়েম হবার বুকভরা স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তানী জনগণ। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানহীন ও দুনিয়াসর্বস্ব চতুর নেতাদের ধূর্তামির নীচে সরল-সিধা সাধারণ জনগণের পবিত্র আকাংখা সমূহ একে একে পিষ্ট হ’তে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোষিত লক্ষ্যের সাথে বেঈমানী করার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন নেতৃবৃন্দ। দেশটি দু’টুকরো হয়েছে। মূল নেতারা মর্মান্তিকভাবে বিদায় হয়ে গেছেন চিরতরে।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই ভূখন্ডে একই ভাব-ভাষার ও একই আবহাওয়াগত পরিবেশে এত ঘনবসতিসম্পন্ন বিপুল সংখ্যায় মুসলমানের বাস পৃথিবীর কোন দেশে নেই। আমাদের সাধারণ ঐক্যের একটিই মাত্র আদর্শিক সেতুবন্ধন হ’ল ‘ইসলাম’। এই বরকতময় ও পবিত্র বন্ধনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আমরা ইচ্ছা করলে সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর একটি প্রশাসন উপহার দিতে পারি। কেননা এটা সকল জ্ঞানী ব্যক্তি স্বীকার করে থাকেন যে, ইসলাম একটি বিশ্বজনীন জীবনাদর্শের নাম, যা আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য প্রেরিত হয়েছে। যার মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক বিধি-বিধানসমূহের মৌলিক ও চিরস্থায়ী হেদায়াত সমূহ পেশ করা হয়েছে। ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত না হ’লে মানুষ ইসলামের কল্যাণ বিধান সমূহের সুফল হ’তে বঞ্চিত হয়। যা ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ হয়। আমরা যার বাস্তব শিকারে পরিণত হয়েছি।
‘খেলাফত’ অর্থ প্রতিনিধিত্ব। ইসলামী খেলাফত হ’ল : আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বান্দাদের উপরে আল্লাহর রাসূলের প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থার নাম। খেলাফতের আমীর আল্লাহর বিধান সমূহকে আল্লাহর বান্দাদের উপরে প্রয়োগ করে থাকেন আল্লাহর বান্দাদের সম্মতিক্রমে। যা খেলাফতের অধীনে বসবাসরত মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের জন্য হয়ে থাকে সমভাবে কল্যাণকর।
ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সকল যুগে প্রধান অন্তরায় ছিলেন চার শ্রেণীর লোক। তারা হ’লেন : তারা হ’লেন : ধর্মনেতা, সমাজনেতা, রাজনৈতিক নেতা ও অর্থনৈতিক নেতাগণ। আজও এদের বাধা বিদ্যমান রয়েছে। তবুও একটি সহজ পন্থা আমরা বর্তমান জোট সরকারের নিকটে পেশ করতে পারি। সেটি এই যে, তারা সকলে একমত হয়ে বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। এ বিষয়ে তারা বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী ‘গণভোট’ নিতে পারেন। ইনশাআল্লাহ গণভোটে তারা বিজয়ী হবেন।
অতঃপর ইসলামী সংবিধান রচনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ দিবেন। সেই কমিটিতে ‘আহলেহাদীছ’ ‘হানাফী’ সকলের প্রতিনিধি থাকবেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্যদের প্রতিনিধিও গ্রহণ করতে পারেন তাদের বিষয়ে পরামর্শ নেবার জন্য। বিশেষজ্ঞদের প্রণীত এ সংবিধানের কপি তারা প্রকাশ করবেন ও তার উপরে জনগণের লিখিত পরামর্শ আহবান করবেন। অতঃপর প্রণীত ইসলামী সংবিধান দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের নিকট এবং লিখিত মতামত প্রেরণকারীদের নিকট পাঠাবেন। অতঃপর সকলের মতামতের সারাংশের উপর পুনরায় তাদের লিখিত মতামত নিবেন। অতঃপর তারা সহ শীর্ষস্থানীয় ওলামা ও রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের সমাবেশে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী গৃহীত উক্ত খসড়া সংবিধান জাতীয় সংসদে পেশ করবেন। অতঃপর সেখানে পাশ হবার পর তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করবেন। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তাদের বেশীর বেশী এক বছর সময় লাগবে।
উল্লেখ্য যে, এই কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছেন মরহূম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (শাসনকাল : ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ হ’তে ৩০শে মে ১৯৮১) ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’-কে সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ (শাসনকাল : ১১ই ডিসেম্বর ১৯৮৩ হ’তে ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯০) ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণার মাধ্যমে। তাছাড়া এবারের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সহ সকল দলই ‘ইসলামের পরিপন্থী কোন আইন করবেন না’ বলে জাতির নিকটে ওয়াদা করেছেন। অতএব এই অনুকূল পরিবেশে জাতীয় সংসদে দুই তৃতীয়াংশের অধিক আসনের অধিকারী চারদলীয় জোট সরকারের জন্য ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসই হবে তাদের সবচাইতে বড় ও স্মরণীয় কীর্তি। এর মাধ্যমে তারা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের তাবৎ মুসলিম উম্মাহর দো‘আ পাবেন। এটি ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মুসলিম দেশে একটি ‘মডেল’ হিসাবে গৃহীত হবে। পরবর্তীতে ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’র সদস্য দেশ সমূহের মাধ্যমে বিশবব্যাপী একটি বৃহত্তর ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠিত হবার পথ সুগম হ’তে পারে। এর ফলে আল্লাহর রহমতে মুসলমানদের হারানো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি আবারো ফিরে আসবে। ইসলাম সহজেই বিশ্বশক্তি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। ইসলামী শাসনের কল্যাণ স্পর্শে জগৎ সংসার ধন্য হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]
[1]. ৫ম বর্ষ, ১২তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০০২।