ভূমিকা : সিজদায় গমনকালে আগে হাত নাকি হাঁটু রাখতে হবে এ বিতর্ক নতুন কিছু নয়। অনেকে দাবী করেন যে, সিজদায় যাওয়ার সময় আগে হাঁটু রাখা সুন্নাত। হাত আগে রাখা সুন্নাতের খেলাফ। অথচ আগে হাত রাখা সম্পর্কিত হাদীছগুলি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। আগে হাঁটু রাখার দাবীর পক্ষে কতিপয় দলীল পেশ করা হয়ে থাকে। নিম্নে এগুলির পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হ’ল।-
দলীল-১ :
عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا سَجَدَ وَضَعَ رُكْبَتَيْهِ قَبْلَ يَدَيْهِ، وَإِذَا نَهَضَ رَفَعَ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ -
‘ওয়ায়েল বিন হুজর
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে দেখেছি, যখন তিনি
সিজদা করতেন তখন হাত রাখার আগে হাঁটু রাখতেন। আর যখন উঠতেন তখন হাঁটুর
পূর্বে হাত উঠাতেন’।[1]
তাহক্বীক্ব : সনদ যঈফ। শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এর সনদকে যঈফ বলেছেন।[2] হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) এ হাদীছের রাবী শারীক (রহঃ)-কে মুদাল্লিস বলেছেন।[3]
দলীল-২ :
عَنْ أَنَسٍ قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَبَّرَ ثُمَّ انْحَطَّ بِالتَّكْبِيرِ فَسَبَقَتْ رُكْبَتَاهُ يَدَيْه-
‘আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখলাম, তিনি তাকবীর দিলেন এবং হাত রাখার আগে হাঁটু রাখলেন’।[4]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। এর সনদে আলা বিন ইসমাঈল রয়েছেন যিনি অপরিচিত।[5] অপর বর্ণনাকারী হাফছ বিন গিয়াছ (রহঃ) হ’লেন সমালোচিত রাবী। ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) তাকে মুদাল্লিস বলেছেন।[6] তিনি অন্যত্র বলেন, ‘তিনি ছিক্বাহ, ফক্বীহ, তার হিফয কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।[7] অন্যান্য ইমামগণও তাকে মুদাল্লিস রাবী বলেছেন।[8] ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, ‘তিনি তাদলীস করতেন। এতে কোন সন্দেহ নেই’।[9]
দলীল-৩ :
عَنْ سَعْدٍ قَالَ: كُنَّا نَضَعُ الْيَدَيْنِ قَبْلَ الرُّكْبَتَيْنِ، فَأُمِرْنَا بِالرُّكْبَتَيْنِ قَبْلَ الْيَدَيْنِ
‘সা‘দ
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘আমরা হাঁটুর পূর্বে দু’হাত রাখতাম।
আমাদেরকে দু’হাতের পূর্বে দু’হাটু রাখতে আদেশ করা হয়েছিল’।[10]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি নিতান্তই যঈফ। (১) শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেছেন, ‘এর সনদ অত্যন্ত যঈফ। যঈফ রাবীগণ ধারাবাহিকভাবে এই সনদে রয়েছেন’।[11]
তিনি আরো বলেছেন, ‘সনদটি খুবই দুর্বল। ইসমাঈল বিন ইয়াহইয়া বিন সালামাহ
হ’লেন পরিত্যক্ত রাবী। যেমনটি আত-তাক্বরীব গ্রন্থে আছে। আর তার পুত্র
ইবরাহীম যঈফ’।[12] (২) হাফেয যাহাবী (রহঃ) বলেছেন, ‘ইবরাহীম বিন ইসমাঈল বিন
ইয়াহইয়া বিন সালামাহ বিন কুহাইল-তাকে আবূ হাতেম এবং অন্যরা বর্জন করেছেন।
আবূ যুর‘আহ তার দুর্বল হওয়ার প্রতি ইশারা করেছেন’।[13] (৩) ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) তাকে যঈফ বলেছেন।[14] অপর রাবী ইসমাঈল সম্পর্কে ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, ‘তিনি মাতরূক’ তথা পরিত্যক্ত রাবী।[15]
শায়খ আব্দুর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সা‘দ বিন আবী
ওয়াক্কাছের হাদীছটি দ্বারা আগে হাত রাখাকে রহিত বলে দাবী করা বাতিল। কেননা
হাদীছটি যঈফ’।[16]
দলীল-৪ :
عَنِ الْأَسْوَدِ أَنَّ عُمَرَ كَانَ يَقَعُ عَلَى رُكْبَتَيْهِ-
‘আসওয়াদ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত যে, ‘নিশ্চয়ই ওমর (রাঃ) তার হাঁটুদ্বয়ের উপর পতিত হ’তেন।[17]
জবাব : হাদীছটি
যঈফ। কেননা এখানে দু’জন রাবী রয়েছেন যারা মুদাল্লিস। এর সনদে আ‘মাশ আছেন।
যিনি আস্থাভাজন বর্ণনাকারী হ’লেও মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। ইমাম দারাকুৎনী[18], ইমাম নাসাঈ[19] ও ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) প্রমুখ ইমামগণ তাকে মুদাল্লিস রাবী বলেছেন।[20] মোদ্দাকথা, আ‘মাশ একজন ছিক্বাহ ও মুদাল্লিস রাবী। অপর রাবী ইবরাহীম নাখঈও একজন প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস রাবী।[21]
দলীল-৫ :
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ يَضَعُ رُكْبَتَيْهِ إِذَا سَجَدَ قَبْلَ يَدَيْهِ، وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذَا رَفَعَ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ-
‘ইবনে
ওমর (রাঃ) তার হাঁটুদ্বয়কে হস্তদ্বয়ের পূর্বে রাখতেন, যখন সিজদায় যেতেন।
আর (সিজদা হ’তে) উঠতেন তখন তার হস্তদ্বয়কে উত্তোলন করতেন হাঁটুদ্বয়ের
পূর্বে’।[22]
তাহক্বীক্ব : এটি
যঈফ। (১) শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এটি মুনকার বা পরিত্যাজ্য। কেননা এতে
ইবনে আবী লায়লা আছেন। তার নাম হ’ল মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান। তিনি বাজে
স্মৃতির অধিকারী।[23] আরো অনেকেই তার সমালোচনা করেছেন। তারা তাকে দুর্বল ও ‘শক্তিশালী নন’ বলেছেন।[24]
দলীল-৬ :
أنا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، أَنَّ الْحَجَّاجَ بْنَ أَرْطَاةَ، أَخْبَرَهُمْ قَالَ: قَالَ إِبْرَاهِيمُ النَّخَعِيُّ حُفِظَ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَّ رُكْبَتَيْهِ، كَانَتَا تَقَعَانِ إِلَى الْأَرْضِ قَبْلَ يَدَيْهِ -
‘আমাদেরকে হাম্মাদ বিন সালামাহ
সংবাদ প্রদান করেছেন যে, নিশ্চয়ই হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্ব তাদেরকে খবর
দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইবরাহীম নাখঈ বলেছেন, আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ হ’তে
স্মরণ রাখা হয়েছে যে, তাঁর হাতের আগে হাঁটুদ্বয় যমীনে লাগত’।[25]
জবাব : এটি দু’টি কারণে যঈফ। (১) হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্বের তাদলীসের কারণে। ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) তাকে মুদাল্লিস রাবী বলেছেন।[26] ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, ‘ইবনুল মুবারক বলেছেন, হাজ্জাজ তাদলীস করতেন’।[27]
(২) এটি বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত। কেননা ইবরাহীম নাখঈ (রহঃ) ইবনে মাস‘ঊদ
(রাঃ)-এর যুগ পাননি। তিনি কার নিকট থেকে শুনেছেন সেটিও উল্লেখ করেননি। ইবনে
হাজার (রহঃ) বলেছেন, ‘হাকেম উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাদলীস করতেন। আবূ
হাতেম বলেছেন, তিনি আয়েশা (রাঃ) ব্যতীত আর কোন ছাহাবীকে পাননি’।[28]
দলীল-৭ :
عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، قَالَ: كَانَ أَصْحَابُ عَبْدِ اللهِ، إِذَا انْحَطُّوا لِلسُّجُودِ وَقَعَتْ رُكَبُهُمْ قَبْلَ أَيْدِيهِمْ -
‘আবূ ইসহাক্ব হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আব্দুল্লাহর শিষ্যগণ যখন সিজদা করতেন তখন তাদের হাঁটু হাতের পূর্বে পড়ত’।[29]
জবাব : বর্ণনাটি
যঈফ। অত্র সনদে হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্ব রয়েছেন যার সম্পর্কে উপরে আলোচনা
করা হয়েছে। তার উস্তাদ হ’লেন আবূ ইসহাক্ব আস-সাবীঈ। তিনিও তাদলীস করার দোষে
অভিযুক্ত। হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ)[30] এবং শায়েখ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) তাঁকে মুদাল্লিস রাবী বলেছেন।[31]
দলীল-৮ :
عَنْ إِبْرَاهِيمَ أَنَّهُ سُئِلَ عَنِ الرَّجُلِ يَضَعُ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ، فَكَرِهَ ذَلِكَ وَقَالَ: هَلْ يَفْعَلُهُ إِلَّا مَجْنُونٌ -
‘ইবরাহীম
নাখঈ হ’তে বর্ণিত যে, তাকে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’ল- যে তার
হাঁটুদ্বয়ের পূর্বে তার হাত দু’টি রাখতেন। তিনি এটি অপসন্দ করলেন এবং
বললেন, স্রে্রফ পাগলই এমনটি করে’।[32]
তাহক্বীক্ব : এটি মাক্বতূ‘ বর্ণনা। যা স্বয়ং কোন দলীল নয়। তাছাড়া এখানে মুগীরা (রহঃ) তাদলীস করেছেন।[33]
দলীল-৯ :
عَنْ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلٍ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَذَكَرَ حَدِيثَ الصَّلَاةِ، قَالَ: فَلَمَّا سَجَدَ وَقَعَتَا رُكْبَتَاهُ إِلَى الْأَرْضِ قَبْلَ أَنْ تَقَعَ كَفَّاهُ-
‘আব্দুল জাববার বিন ওয়ায়েল হ’তে, তিনি তার পিতা হ’তে
বর্ণনা করেছেন যে, নিশ্চয়ই নবী করীম (ছাঃ), অতঃপর তিনি ছালাতের হাদীছটি
বর্ণনা করলেন। তিনি বলেন, যখন তিনি (মুহাম্মাদ ছাঃ) সিজদায় যেতেন তখন তার
হাঁটুদ্বয় তার কব্জিদ্বয়ের আগে যমীনে পড়ত’।[34]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি
যঈফ। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর ত্রুটি হ’ল, আব্দুল জাববার বিন ওয়ায়েল
এবং তার পিতার মাঝে ইনক্বিত্বা‘ রয়েছে। কেননা তিনি তার থেকে কিছুই শ্রবণ
করেননি। যেমনটি ইবনে মাঈন ও বুখারী (রহঃ) প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেছেন। অন্য
সনদে শাক্বীক্ব আছেন। আর তিনি হ’লেন মাজহূল। দুর্বলতা থাকার পাশাপাশি এই
হাদীছটি ছহীহ হাদীছ বিরোধী।[35]
দলীল-১০ :
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِرُكْبَتَيْهِ قِيْلَ يَدَيْهِ-
‘আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ সিজদা করবে তখন যেন সে হাতের পূর্বে হাঁটুদ্বয় রাখে’।[36]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) স্বয়ং এর রাবী আব্দুল্লাহ বিন সাঈদকে যঈফ বলেছেন (ঐ)। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেছেন, ‘এর সনদটি খুবই দুর্বল। এই আব্দুল্লাহ মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত’।[37] এতদ্ব্যতীত আরো অনেকেই তাকে দুর্বল বলেছেন।
দলীল-১১ :
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، يَرْفَعُهُ أَنَّهُ قَالَ: إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فليبْتدئْ بِرُكْبَتَيْهِ قَبْلَ يَدَيْهِ، وَلَا يَبْرُكْ بُروكَ الْفَحْلِ-
‘আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ সিজদা করবে তখন সে তার হাতের পূর্বে হাঁটুদ্বয় রাখবে। আর সে ষাঁড়ের অনুরূপ বসবে না’।[38]
তাহক্বীক্ব : এর সনদ খুবই দুর্বল। ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) বলেছেন, ‘এমনটি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ আল-মাক্ববুরী। তাছাড়াও তিনি যঈফ’।[39] হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, ‘এর সনদ যঈফ’।[40]
উপরোক্ত ১১টি দলীলের তাহক্বীক্ব দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সিজদায় যাবার সময়ে আগে হাঁটু রাখার হাদীছগুলি ছহীহ নয়। বরং সেগুলি সবই যঈফ। সুতরাং আগে হাত রাখাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার দলীলসমূহ
সিজদায় যাওয়ার প্রাক্কালে আগে হাত রাখার পক্ষে কতিপয় গ্রহণযোগ্য হাদীছ নিম্নে তাহক্বীক্বসহ তুলে ধরা হ’ল।-
(1) عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلَا يَبْرُكْ كَمَا يَبْرُكُ الْبَعِيْرُ، وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ-
(১)
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন
তোমাদের কেউ সিজদা করবে তখন সে যেন উটের ন্যায় হাঁটু গেড়ে না দেয়। বরং সে
যেন তার হস্তদ্বয়কে তার হাঁটুদ্বয়ের পূর্বে রাখে’।[41]
(2) عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّهُ كَانَ يَضَعُ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ، وَقَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْعَلُ ذَلِكَ-
(২) ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, নিশ্চয়ই তিনি হস্তদ্বয়কে তার হাঁটুদ্বয়ের আগে রাখতেন এবং তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) অনুরূপ করতেন।[42]
(3) عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا سَجَدَ يَضَعُ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ-
(৩) ইবনে ওমর হ’তে বর্ণিত যে, ‘নিশ্চয়ই নবী করীম (ছাঃ) যখন সিজদা করতেন তখন তার হস্তদ্বয়কে স্বীয় হাঁটুদ্বয়ের পূর্বে রাখতেন’।[43]
(4) عَنِ ابْنِ عُمَرَ، رَفَعَهُ قَالَ: إِنَّ الْيَدَيْنِ تَسْجُدَانِ كَمَا يَسْجُدُ الْوَجْهُ، فَإِذَا وَضَعَ أَحَدُكُمْ وَجْهَهُ فَلْيَضَعْ يَدَيْهِ، وَإِذَا رَفَعَهُ فَلْيَرْفَعْهُمَا-
(৪)
ইবনে ওমর হ’তে বর্ণিত যে, ‘রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ সিজদা
করবে তখন সে যেন তার হাত দু’টিকে আগে রাখে। আর যখন উঠবে তখন হাত দু’টিকে
উপরে তুলবে’।[44]
ইমামদের মতামতসমূহ : এ সম্পর্কে ইমামদের মতামতসমূহ নিম্নে পেশ করা হ’ল।-
(১)
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,وادّعى أَنه نَاسخ لتقديم الْيَدَيْنِ، وَكَذَا
اعْتَمدهُ أَصْحَابنَا، وَلَا حجَّة فِيه لِأَنَّهُ ضَعِيف ظَاهر الضعْف،
بيّن الْبَيْهَقِيّ وَغَيره ضعفه، وَهُوَ من رِوَايَة يَحْيَى بن سَلمَة،
وَهُوَ ضَعِيف باتفاقهم- ‘দাবী করা হয়েছে যে, এটি (আগে হাঁটু রাখার হাদীছ)
আগে হাত রাখাকে মানসূখ করেছে। আমাদের সাথীগণও এর উপর নির্ভর করেছেন। অথচ এ
ব্যাপারে কোন দলীল নেই। কেননা এটি যঈফ। এর দুর্বলতা প্রকাশ্য। বায়হাক্বী ও
অন্যরা এটি বর্ণনা করেছেন এবং একে দুর্বল বলেছেন। এটি ইয়াহইয়া বিন
সালামাহ-এর বর্ণনা হ’তে এসেছে। আর তিনি বিদ্বানদের ঐক্যমতে যঈফ’।[45]
(২)
আব্দুর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) বলেন,أَنَّ دَعْوَى النَّسْخِ بِحَدِيثِ
سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ بَاطِلَةٌ فَإِنَّ هَذَا الْحَدِيثَ ضَعِيفٌ
‘নিশ্চয়ই সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছের হাদীছটি দ্বারা আগে হাত রাখাকে রহিত দাবী
করা বাতিল। কেননা হাদীছটি যঈফ’।[46]
(৩)
ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ) বলেছেন,وَفَرْضٌ عَلَى كُلِّ مُصَلٍّ أَنْ يَضَعَ
إذَا سَجَدَ يَدَيْهِ عَلَى الْأَرْضِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ وَلَا بُدَّ،
‘প্রত্যেক মুছল্লীর জন্য সিজদায় গমনকালে যমীনের উপর আগে হাত রাখা
সন্দেহাতীতভাবে ফরয’।[47] তিনি আরো বলেন, ‘যদি কেউ আগে হাঁটু রাখার হাদীছকে দলীল হিসাবে উল্লেখ করেন তাহ’লে আমরা বলব যে, এতে কোন দলীল নেই’।[48]
(৪) ইমাম ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন,
وَعَنْ أَحْمَدَ رِوَايَةٌ أُخْرَى أَنَّهُ يَضَعُ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ. وَإِلَيْهِ ذَهَبَ مَالِكٌ؛ لِمَا رُوِيَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ وَلَا يَبْرُكْ بُرُوْكَ الْبَعِيْرِ- رَوَاهُ النَّسَائِيّ-
‘আর আহমাদ হ’তে অন্য
আরেকটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যে, নিশ্চয়ই তিনি হাঁটুদ্বয়ের পূর্বে হস্তদ্বয়
রাখতেন। ইমাম মালেক (রহঃ) এ মতের পক্ষে গিয়েছেন। কেননা আবূ হুরায়রা (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ
فَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ وَلَا يَبْرُكْ بُرُوْكَ
الْبَعِيْر، ‘যখন তোমাদের কেউ সিজদা করবে তখন সে যেন তার হাঁটুদ্বয়ের আগে
হস্তদ্বয় রাখে। আর সে যেন উটের ন্যায় হাঁটু গেড়ে না দেয়’। এই হাদীছটি ইমাম
নাসাঈ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।[49]
উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সিজদায় যাওয়ার প্রাক্কালে আগে হাত দেয়াই সুন্নাত। আগে হাঁটু রাখার কোন ছহীহ হাদীছ নেই। সেজন্য সিজদায় গমনকালে আগে হাত রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছহীহ হাদীছের উপরে যথাযথ আমল করার তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. আবূদাঊদ হা/৮৩৮; তিরমিযী হা/২৬৮।
[2]. আছলু ছিফাত ২/৭১৫; ইরওয়া হা/৩৫৭।
[3]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, রাবী নং ৫৬।
[4]. দারাকুৎনী হা/১৩০৮; বায়হাক্বী হা/২৬৩২।
[5]. তানক্বীহুত তাহক্বীক্ব হা/৮১২; আছলু ছিফাত ২/১৭৬।
[6]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ৯।
[7]. তাক্বরীবুত তাহযীব, জীবনী নং ১৪৩০।
[8]. আল-মুখতালিত্বীন, জীবনী নং ১২; আল-মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ১৩; আত-তাবঈন লি-আসমাইল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ১৬; আসমাউল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ১১।
[9]. আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, আল-ইলাল ওয়া মা‘রিফাতুর রিজাল হা/১৯৪১।
[10]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ হা/৬২৮।
[11]. আছলু ছিফাত ২/৭১৮।
[12]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ হা/৬২৮-এর টীকা দ্রঃ।
[13]. আল-মুগনী ফিয-যু‘আফা, জীবনী নং ৩৬।
[14]. তাকরীবুত তাহযীব, জীবনী নং ১৪৯।
[15]. তাহযীবুত তাহযীব, জীবনী নং ৬০৭; আত-তাক্বরীব, জীবনী নং ৪৯৩।
[16]. তুহফাতুল আহওয়াযী ২/১২১।
[17]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৭০৪।
[18]. আল-ইলালুল ওয়ারিদাহ, মাসআলা নং ১৮৮৮।
[19]. যিকরুল মুদাল্লিসীন পৃঃ ১২৫।
[20]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ৫৫।
[21]. ইবনুল ইরাক্বী, আল-মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ২; ইবনে হাজার, তাবাকাতুল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ৩৫।
[22]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৭০৫।
[23]. ইরওয়া হা/৩৫৭।
[24]. আব্দুর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ), তুহফাতুল আহওয়াযী হা/১৯৪ এর আলোচনা দ্রঃ; ইমাম নাসাঈ (রহঃ), আয-যু‘আফাউল মাতরূকীন, জীবনী নং ৫২৫; ইবনে হিববান (রহঃ), আল-মাজরূহীন, রাবী নং ৯২১; ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ), আয-যু‘আফাউল মাতরূকীন, জীবনী নং ৩০৭২; ইবনে হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, রাবী নং ৫০৩; ইমাম দারাকুৎনী (রহঃ), সুনানে দারাকুৎনী হা/৯৩৬।
[25]. শারহু মা‘আনিল আছার হা/১৫২৯।
[26]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ১১৮; আল-ফাৎহুল মুবীন, পৃঃ ১৩৭।
[27]. আত-তারীখুল কাবীর, জীবনী নং ২৮৩৫; আয-যু‘আফাউছ ছগীর, জীবনী নং ৭৬।
[28]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, জীবনী নং ৩৫।
[29]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৭১১।
[30]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, রাবী নং ৬৬।
[31]. সিলসিলাহ ছহীহাহ হা/১৭০১।
[32]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৭০৭।
[33]. ত্বাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন, রাবী নং ১০৭।
[34]. আবূদাঊদ হা/৮৩৯; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৯১১।
[35]. ইরওয়া হা/৩৫৭; যঈফ আবূ দাঊদ হা/১২১।
[36]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৬৩৫।
[37]. ছহীহ আবূদাঊদ হা/৭৮৯, ৩/৪২৮।
[38]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৭০২।
[39]. মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/৩৫০৪।
[40]. ফাৎহুল বারী ২/২৯১।
[41]. আবূদাঊদ হা/৮৪০; নাসাঈ হা/১০৯১; নাসাঈ কুবরা হা/৬৯২; মিশকাত হা/৮৯৯, সনদ হাসান।
[42]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ হা/৬২৭। শায়খ
আলবানী (রহঃ) একে ছহীহ বলেছেন। হাফেয ইবনে হাজার একে ওয়ায়েলের (আগে হাঁটু
রাখার হাদীছটির) উপর প্রাধান্য দিয়েছেন, ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৬২৭-এর টীকা
দ্রঃ।
[43]. দারাকুৎনী হা/১৩০৩; ইরওয়া হা/৩৫৭, ২/৭৭।
[44]. আবূদাঊদ হা/৮৯২; নাসাঈ হা/১০৯২; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক্ব হা/২৯৩৪; আহমাদ হা/৪৫০১, আলবানী বলেছেন, হাদীছটি ছহীহ মাওকূফরূপে এবং মারফূ‘ হিসাবে। দেখুন : ইরওয়া হা/৩১।
[45]. খুলাছাতুল আহকাম হা/১২৮৫।
[46]. তুহফাতুল আহওয়াযী ২/১২১।
[47]. আল-মুহাল্লাহ বিল-আছার, মাসআলা নং ৪৫৬।
[48]. আল-মুহাল্লাহ বিল-আছার, মাসআলা নং ৪৫৬।
[49]. আল-মুগনী ১/৩৭০; আশ-শারহুল কাবীর ১/৫৫৪।