ভূমিকা :

বর্তমান ইরাক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। এখানে মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। পশ্চিমা হায়েনারা বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করে চলেছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ধ্বংস করে যাচ্ছে হাযার হাযার বাড়ি-ঘর ও স্থাপনা। কেউ বলছে না মানবতার কথা। সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থের বলি হয়ে অকাতরে জীবন দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। পুরো জনপদকে করে তুলেছে অশান্ত। অথচ এই ইরাকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলমানগণ। পারসিকদের সাথে যুদ্ধ করে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেছিলেন। জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তি, নিরাপত্তা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি। পারসিকদের পরাজিত করতে মুসলমানদের যে সকল যুদ্ধ করতে হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল কাদেসিয়ার যুদ্ধ। এটা ছিল ইতিহাস পরিবর্তনকারী এক যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে এটা ছিল সর্ববৃহৎ যুদ্ধ।

কাদেসিয়ার পরিচয় :

কাদেসিয়া কূফা নগরীর দক্ষিণে ফোরাত নদীর পূর্ব দিকে মরু উপত্যকায় অবস্থিত একটি স্থানের নাম। এই এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় এর নাম হয় ‘কাদেসিয়া যুদ্ধ’। পারসিক রাজা কিসরাগণ সেখানে ‘মাউল ইরাক’ নামে একটি শহর গড়ে তোলেন।

যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময়কাল :

কাদেসিয়া যুদ্ধ ১৫ হিজরী সনের ১৩-১৬ শা‘বান মোতাবেক ১৬ থেকে ১৯ নভেম্বর ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলমান ও রুস্তম ফাররাখযাদের নেতৃত্বে পারসিক খ্রিস্টানের মধ্যে সংঘটিত হয়।[1] তবে ইবনু কাছীর (রহঃ) তারিখ উল্লেখ ছাড়াই বলেছেন, এটা ১৪ হিজরী সনে সংঘটিত হয়েছিল।[2]

মুসলিম সৈন্য সংখ্যা :

এ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য ছিল ত্রিশ হাযার বা তার চেয়ে কিছু বেশী।[3] পরে সিরিয়া থেকে ছয় হাযার সৈন্য এসে মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগদান করলে সর্বসাকুল্যে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ছত্রিশ হাযারে।[4] এর মধ্যে সত্তর (৭০) জনের বেশী বদরী ছাহাবী ছিলেন। ছয়শর অধিক ছাহাবী ও তাঁদের প্রায় সাতশত সন্তান এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[5]

মুসলিম সেনাপতিবৃন্দ :

এ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)। যুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন খালিদ ইবনু আরফাতাহ (রাঃ)। ডান বাহুর সেনাপতি ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু মু‘তাম (রাঃ) ও বাম বাহুর অশ্বারোহী দলের সেনাপতি ছিলেন শুরাহবীল ইবনু সামত্ব (রাঃ)। আর পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মুগীরা ইবনু শু‘বাহ (রাঃ)।[6] হাশেম ইবনু উতবা বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) ছিলেন সিরিয়া থেকে আগত  সৈন্যদের সেনাপতি। তিনি যুদ্ধের তৃতীয় দিন ইরাকী বাহিনীকে সাহায্যের জন্য আসেন। কা‘কা‘ ইবনু আমর তামীমী (রহঃ) তাঁকে নেতৃত্বে দানে সাহায্য করেন।

অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) ছিলেন যুদ্ধের পতাকাবাহী। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি কাদেসিয়ার যুদ্ধের দিন ইবনু উম্মে মাকতূমকে বর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। তখন তাঁর হাতে ইসলামের ঝান্ডা ছিল।[7]

পারসিক সেনাপতি :

পারস্য বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন রুস্তম ফাররাখযাদ। তাদের সৈন্য সংখ্যা দুই লাখেরও অধিক ছিল।[8]

পারসিক বাহিনীর অন্যান্য সেনাপতিগণ :

অগ্রগামী বাহিনীর দায়িত্বে ছিল বাহমান হাযুওয়াই যুল হাজেব। যার সাথে আঠারটি হাতি ছিল এবং সেগুলোর উপর বহু সংখ্যক বাক্স ও তীরন্দায সৈন্য ছিল। জালীয়ানুস মূল বাহিনীর কাছাকাছিতে থাকা দক্ষিণ বাহুর দায়িত্বে ছিল। দক্ষিণ বাহুর দায়িত্বে ছিল হুরমুযান। তার সাথে আটটি হাতি এবং সেগুলোর উপর কিছু বাক্স ও সৈন্য ছিল। বীরযান ছিল বাম বাহুর নেতৃত্বে, যা মূল বাহিনীর কাছাকাছি অবস্থান করছিল। অপরদিকে বাম বাহুর সেনাপতি ছিল মেহরান। তার সাথে সাতটি হাতি ছিল। এগুলোর উপরও বাক্স ও সৈন্য ছিল।

যুদ্ধের পটভূমি :

মুসলিম সৈন্যদের বড় একটা অংশ ইরাকে অবস্থান করছিল। ইরাকের ভূমি স্বাধীন করার জন্য তারা পারসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এ যুদ্ধগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘জিসর’-এর (সেতুর) যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর কিছুদিন পরেই সংঘটিত হয় বুওয়াইবের যুদ্ধ। যাতে পারসিকরা পরাজয় বরণ করে এবং মুসলমানগণ বিরাট বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়। অন্যভাবে বলা যায়, জিসরের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি বুওয়াইবের যুদ্ধে জয় লাভ করার মাধ্যমে দূর হয়ে যায়।

এদিকে বুওয়াইবের যুদ্ধে পরাজিত ও ক্ষতিগ্রস্ত পারসিক বাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে এবং তারা সম্রাট ইয়াযদাজারদ-এর দরবারে উপস্থিত হয়। সম্রাট মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাদের প্রধান সেনাপতি হিসাবে রুস্তমের নাম ঘোষণা করেন। এরপর ইয়াযদাজারদ সৈন্যদের সামনে তাদের অতীত উজ্জ্বল ও গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উদ্দীপনা জাগানিয়া বক্তব্য প্রদান করেন। সেই সাথে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধের ঘোষণা দেন। এরূপ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) পারস্য বিজয়ের কথা চিন্তা করলেন। সাথে সাথে ভৌগলিকভাবে পূর্ব দিক থেকে ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে উত্থিত সকল ষড়যন্ত্র ধূলিসাৎ করে সারা পৃথিবীতে ইসলামী আক্বীদা প্রতিষ্ঠার সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। ফলে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) আলী (রাঃ)-কে মদীনার দায়িত্ব অর্পণ করে নিজেই সৈন্যবাহিনী নিয়ে মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞজনেরা তাঁকে মদীনায় অবস্থান করে রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের মধ্য হ’তে কাউকে সেনাপতি নির্বাচন করার পরামর্শ দিলেন।

ইবনুল আছীর বলেন, খলীফা ওমর (রাঃ) মদীনা থেকে বের হয়ে ছারার নামক ভূমিতে অবতরণ করলেন এবং সেখানে সৈন্য সমাবেশ করলেন। লোকেরা তখনও জানত না যে, তিনি মদীনায় অবস্থান করবেন, নাকি লোকদের সাথে যুদ্ধে যাবেন। ছাহাবীগণ তাঁকে সরাসরি কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতেন না। সেজন্য প্রথমে ওছমান (রাঃ) বা আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর কাছে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতেন। তাঁরা দু’জন সক্ষম না হ’লে আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হ’ত। ওছমান (রাঃ) তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি লোকদের জমা করে সকল বিষয়ে বর্ণনা করলেন। অতঃপর ইরাকে যাওয়ার বিষয়ে তাদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। সাধারণ সেনারা বলল, আপনি আমাদের সাথে চলুন। এরপর তিনি তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বললেন, তোমরা প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর। আমি বিজ্ঞজনদের সাথে পরামর্শ করে বের হব। অতঃপর তিনি জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণকে আহবান করলেন। সাথে সাথে মদীনার দায়িত্বে রত আলী ইবনু আবি ত্বালিব, অগ্রগামী সেনা ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম ও আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা সকলে উপস্থিত হ’লে তিনি তাঁদের সাথে পরামর্শ করলেন। তারা একটি বিষয়ে একমত হ’লেন যে, সেনাপতি হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একজন ছাহাবীকে নির্বাচন করা হোক এবং খলীফা মদীনায় অবস্থান করে সৈন্য পরিচালনার দিক-নির্দেশনা প্রদান করবেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) সেনাদের  ডেকে বললেন, আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম। কিন্তু বিজ্ঞ পরামর্শদাতাগণ আমাকে উক্ত সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন আমি মদীনায় অবস্থান করে রাসূল (ছাঃ)-এর একজন ছাহাবীকে সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করতে চাই। তোমরা এ ব্যাপারে আমাকে পরামর্শ দাও। লোকেরা সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর নাম উল্লেখ করে তাঁকে সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। ফলে ওমর (রাঃ) সা‘দ (রাঃ)-কে প্রধান সেনাপতি নির্বাচন করলেন। কেননা তিনি জ্ঞান-গরিমায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।[9]

সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) প্রথম সারির ছাহাবী ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী, প্রথমদিকে হিজরতকারী এবং জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ছাহাবী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি আমার মামু। সম্মানের ক্ষেত্রে আমার মামুর মত আর কার মামু আছে’? কেননা তিনি ও রাসূল (ছাঃ)-এর মা আমেনা একই বনু যোহরা গোত্রের ছিলেন। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) তাকে মামু বলতেন।[10] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, ওহোদের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার তূণীর এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘হে সা‘দ আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য উৎসর্গীত হেŠন! তুমি কাফেরদের বিরুদ্ধে তীর নিক্ষেপ কর’।[11] তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য দো‘আ করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তার দো‘আ কবুল কর এবং তার তীর নিক্ষেপ সুনিপুণ কর’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হে আল্লাহ! তুমি তার তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দো‘আ কবুল কর’। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘হে আল্লাহ! সা‘দ যখন দো‘আ করবে তুমি তার দো‘আ কবুল কর’।[12] সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) যখনই দো‘আ করতেন, তাঁর দো‘আ কবুল করা হ’ত।[13]

যুদ্ধের কারণ :

(১) ইরাক থেকে মুসলিম শক্তিকে হঠানোর উদ্দেশ্যে পারস্যের জোটগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়া : যখন মুসলমানগণ বিরাট বাহিনীকে পরাস্ত করে হীরা, আইনুত তামার ও আনবারের মত শহরগুলো পদানত করে ফেললেন, তখন পারসিকরা ভাবল নিজেরা বিচ্ছিন্ন থেকে ইসলামী শক্তিকে বাধা দেওয়া যাবে না। ফলে তারা সাসানী সাম্রাজ্যের সম্রাট ইয়াযদাজারদ ইবনু শাহরিয়ারের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হ’ল। এভাবে পারস্যের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হ’ল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে ইরাক থেকে হটিয়ে দেওয়ার দূরভিসন্ধি অাঁটল।[14]

(২) ইরাকের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করা : ইরাকের ইসলামী খেলাফতের মর্মমূলে আঘাত করার জন্য পারস্য সেনাপতি রুস্তম ইরাকের গোত্র প্রধানদের গোপনে ডেকে তাদেরকে ইসলামী খেলাফতের অবাধ্য হ’তে ও এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে উত্তেজিত করেন। ফলে হীরা সহ খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ও মুছান্না ইবনু হারেছাহ কর্তৃক বিজিত অঞ্চল সমূহে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা দেখা দিল। এভাবে তারা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে মুসলমানদের ক্রুদ্ধ করে তুলল।[15]

সেনাপতি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিয়ে এবং এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রতি আহবান জানিয়ে পারস্য সম্রাটের নিকট একদল বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ প্রতিনিধি পাঠালেন। তারা মাদায়েনে গিয়ে তাদেরকে হিকমত ও সুন্দর উপদেশ দানের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু কোন ফলাফল ছাড়াই বৈঠক শেষ হ’ল। ফলে কাদেসিয়ার যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল।

যুদ্ধের ঘটনা :

খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করলেন। সা‘দ (রাঃ) ক্বিদ্দীস ভবনের নিকটে কাদেসিয়ার উপযুক্ত স্থানে সৈন্য সমাবেশ করলেন। মুসলিম সেনাবাহিনী এ স্থানে এক মাস যাবৎ অবস্থান করল। কিন্তু শত্রু বাহিনীর সাক্ষাৎ পেল না। অবশেষে তারা ধারণা করল যে, হয়ত আর কোন যুদ্ধ হবে না। কিন্তু এক মাস পর পারস্য বাহিনী সেনাপতি রুস্তমের নেতৃত্বে সেখানে এসে যথাস্থানে অবস্থান নিল।

পারসিক সেনাপতি রুস্তম মুসলিম সেনাপতি সা‘দ (রাঃ)-এর কাছে এ মর্মে প্রস্তাব পাঠালেন যে, আলাপ-আলোচনা ও কিছু প্রশ্নের জওয়াব দেওয়ার জন্য একজন বিজ্ঞ লোক পাঠান হোক। রুস্তমের উদ্দেশ্য ছিল এভাবে কালক্ষেপণ করে যুদ্ধ ব্যতীত মুসলিম সৈন্যদের বিরক্ত ও ক্লান্ত করে তোলা। ফলে মুসলমানেরা দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলবে এবং অবশেষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে যাবে। সেনাপতি সা‘দ (রাঃ) এটাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার মুখ্য সুযোগ মনে করে একে একে তিনজন বিজ্ঞ প্রতিনিধিকে রুস্তমের কাছে প্রেরণ করলেন। ইতিপূর্বে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য হীরা এবং ছালুবায় লোক পাঠিয়েছিলেন। তারা সংবাদ পাঠাল যে, পারস্য সম্রাট তার বিশাল বাহিনী দিয়ে রুস্তমকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তখন সা‘দ (রাঃ) এ খবর জানিয়ে খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকট পত্র লিখলেন। উত্তরে ওমর (রাঃ) লিখলেন যে, তাদের এ ধরনের সংবাদ তোমাকে যেন কখনই বিচলিত এবং চিন্তিত না করে। বরং তুমি সর্বদা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাঁর উপরই ভরসা করবে। আর সেনাপতি রুস্তমের কাছে একজন বিজ্ঞ ও সচেতন লোক পাঠাবে, যে তাকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এ দাওয়াতকে তাদের মধ্যে দুর্বলতার কারণ বানাবেন এবং তাদের ঐক্যে চিড় ধরাবেন’। অতঃপর রুস্তম যখন তার সৈন্য নিয়ে কাছাকাছি স্থানে অবতরণ করেন, তখন সা‘দ (রাঃ) খলীফার নিকট সব জানিয়ে পত্র লিখলেন। যাতে শত্রু পক্ষের ঘোড়াসমূহ এবং তেত্রিশটি হাতির উল্লেখ ছিল।[16] এরপর সা‘দ (রাঃ) একদল বিজ্ঞ ছাহাবীকে রুস্তমের কাছ পাঠালেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নু‘মান ইবনু মুকারিন, ফুরাত ইবনু হিববান, হানযালা, উত্বারেদ, আশ‘আছ, মুগীরা ইবনু শু‘বা, আমর ইবনু মা‘দীকারিব প্রমুখ। তাঁরা রুস্তমকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিলেন। তখন রুস্তম তাঁদেরকে বললেন, তোমরা এখানে কি জন্য এসেছ? তারা বললেন, আমরা এখানে এসেছি আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণের জন্য এবং এদেশ দখল করে আপনাদের নারী ও সন্তানদের বন্দি ও সম্পদসমূহ গ্রহণ করার জন্য। আর এ বিষয়ে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। অবশ্য রুস্তম ইতিপূর্বে স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, আকাশ থেকে যেন একজন ফেরেশতা এসে পারস্য বাহিনীর সকল অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে অর্পণ করলেন এবং রাসূল (ছাঃ) তা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর হাতে সমর্পণ করলেন।[17]

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) রিবঈ ইবনু আমের, হুযায়ফা ইবনু মিহছান ও মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ)-কে আলাদা আলাদাভাবে রুস্তমের কাছে পাঠান। রিবঈ ইবনু আমের (রাঃ) যখন স্বীয় জীর্ণ-শীর্ণ মোটা পোশাক পরে অস্ত্র নিয়ে তাঁর ছোট ঘোড়াটির উপর আরোহণ করে রুস্তমের দরবারে প্রবেশ করলেন এবং ঘোড়ার পদাঘাতে ঘরে বিছানো গালিচা ফেটে গেল। তখন তারা বলল, অস্ত্র রেখে প্রবেশ কর। রিবঈ ইবনু আমের (রাঃ) বললেন, আমি স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি। আপনারা ডেকে পাঠিয়েছেন বলেই এসেছি। যদি আপনারা আমাকে এ অবস্থায় ভিতরে প্রবেশ করতে দেন, তাহ’লে প্রবেশ করব, অন্যথায় ফিরে যাব। তখন সৈন্যরা রুস্তমকে তার কথা বললে তিনি প্রবেশের অনুমতি দিলেন। রিবঈ (রাঃ) তার বর্মের উপর ভর দিয়ে প্রবেশ করার কারণে অধিকাংশ গালিচা ছিঁড়ে গেল। অতঃপর তারা বলল, তোমরা এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছ? তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এখানে আসার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে আমরা তাঁর ইচ্ছায় লোকদেরকে মানুষের দাসত্ব থেকে বের করে আল্লাহর দাসত্বে, সংকীর্ণ পৃথিবীর মোহ হ’তে প্রশস্ত জান্নাতের দিকে, খ্রিস্টান ধর্মের অত্যাচার থেকে বের করে ন্যায় ও ইনছাফের ধর্ম ইসলামের দিকে নিয়ে যেতে পারি। তিনি আমাদেরকে তাঁর সত্য দ্বীন সহ প্রেরণ করেছেন মানবজাতির কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য। যারা এ ধর্ম গ্রহণ করবে, আমরা তাদেরকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করব এবং তাদেরকে নিরাপদে রেখে ফিরে যাব। আর যারা এ ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করতে থাকব, যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেন।

তারা বলল, আল্লাহকৃত ওয়াদা (موعود الله) কি?

তিনি বললেন, ইসলাম অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যারা মারা যাবে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত এবং যারা বেঁচে থাকবে তাদের জন্য বিজয়।

রুস্তম বললেন, আমি তো তোমাদের বক্তব্য শুনলাম, আমরা কি এ বিষয়টিকে বিলম্বিত করতে পারি না? যাতে আমরা উভয় পক্ষ ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।

তিনি বললেন, হ্যাঁ করা যায়। তবে কয়দিন চান, একদিন না দু’দিন?

তিনি বললেন, না। বরং আমাদের বিজ্ঞ ও জ্ঞানীদেরকে অবহিত না করা পর্যন্ত।

রিবঈ (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের জন্য এই সুনণাত চালু করেননি যে, আমরা শত্রুদেরকে তিনদিনের বেশী অবকাশ দিব। বরং আপনার এবং তাদের বিষয় ভেবে দেখুন ও তিনটির যেকোন একটি বেছে নিন। ইসলাম গ্রহণ, জিযিয়া প্রদান অথবা যুদ্ধ।[18]

রুস্তম রিবঈ ইবনু আমের (রাঃ)-কে বললেন, আপনি কি তাদের সরদার?

রিবঈ (রাঃ) বললেন, না। তবে মুসলমানগণ একটি দেহের মত। তাদের সব থেকে নিম্নস্তরের ব্যক্তি উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের রক্ষা করে (নেতৃত্ব দিতে পারে)।

অতঃপর পারসিক সেনাপতি রুস্তম গোত্রপতিদের সমবেত করে বললেন, তোমরা কি কখনও এ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম ও বাগ্মিতাপূর্ণ কথা শুনেছ? তারা বলল, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আপনি কি এ লোকটির প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন এবং নিজের ধর্ম ত্যাগ করে এই কুকুরের ধর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছেন (وتدع دينك إلى هذا الكلب)? আপনি কি তার পোশাকের প্রতি লক্ষ্য করেছেন? রুস্তম বললেন, তোমাদের জন্য ধ্বংস হোক, তোমরা তার পোশাকের প্রতি লক্ষ্য করো না; বরং তার সুচিন্তিত মতামত, প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য এবং নীতির প্রতি লক্ষ্য কর। আরবরা অনাড়ম্বর কাপড় পরে, কম ভক্ষণ করে। কিন্তু বংশমর্যাদা রক্ষা করে।[19]

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, রুস্তম যখন রিবঈ ইবনু আমেরের সাথে কথা বলে মুসলমানদের দৃঢ় মনোবলের কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি অন্য মুসলমানদের মতামত জানার উদ্দেশ্যে আর একজন বিজ্ঞ ব্যক্তিকে পাঠাবার জন্য সা‘দ (রাঃ)-এর কাছে পত্র লিখলেন। সা‘দ (রাঃ) পত্র পেয়ে মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ)-কে পাঠালেন। রুস্তম মুগীরা (রাঃ)-কে তার প্রচন্ড রাগ প্রদর্শন করে বললেন, তোমাদের দৃষ্টান্ত হ’ল মাছির মত। যে মধু দেখে আমাদের ভূমিতে প্রবেশ করে বলল, যে আমাকে মধুর কাছে পৌঁছে দিবে তাকে দুই দিরহাম দেওয়া হবে। অতঃপর যখন সে মধুতে পড়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হ’ল, তখন সে মুক্ত হওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করল। কিন্তু সে কোন রক্ষাকারী না পেয়ে বলা শুরু করল, যে আমাকে রক্ষা করবে তার জন্য চার দিরহাম রয়েছে। তিনি আরো বললেন, তোমাদের উদাহরণ ঐ দুর্বল শৃগালের মত, যে ফলের বাগানের একটি গর্তে প্রবেশ করল এবং আল্লাহ যতদিন চাইলেন ফল খেয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকল। বাগানের মালিক এসে দেখল যে, এটি একটি দুর্বল প্রাণী। তাই তার প্রতি দয়া করে তাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু যখন তার বসবাস দীর্ঘায়িত হ’ল এবং ফল ভক্ষণ করে স্বাস্থ্য ভাল হ’ল এবং নাদুস-নুদুস হয়ে উঠল, তখন সে বাগানের অনেক কিছুই নষ্ট করতে শুরু করল। ফলে বাগানের মালিক তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে লোকজন নিয়ে বাগানে আসল এবং রাখালদের সহযোগিতা কামনা করল। এ দিকে শৃগাল পলায়ন করার জন্য পথ খুঁজে না পেয়ে যে সুড়ঙ্গ দিয়ে বাগানে প্রবেশ করেছিল সেই গর্তে প্রবেশ করল। কিন্তু সে অতি মোটা হয়ে যাওয়ায় বের হ’তে পারল না। শিশুরা তাকে বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হ’ল। ফলে তারা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল।

এভাবেই তোমরা আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কৃত হবে। অবশ্য আমি জানি, হে আরব সম্প্রদায়! ক্ষুধার তাড়না তোমাদেরকে এদেশে আসতে বাধ্য করেছে। তোমরা আমাদেরকে প্রাসাদ নির্মাণ ও শত্রুদমন থেকে ব্যস্ত রেখেছ। অতএব তোমরা ফিরে যাও, আমরা যব ও খেজুর দিয়ে তোমাদের বাহন ভরে দিব এবং তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে দিব। তোমরা ফিরে যাও, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।

মুগীরাহ বিন শু‘বা (রাঃ) বললেন, ক্ষুধার তাড়নার কথা বলবেন না। আপনি যা বললেন, তার থেকেও আমরা কষ্টে ছিলাম। জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ ছিল, যে তার চাচাতো ভাইকে হত্যা করে চাচার সকল সম্পদের মালিক হ’ত এবং তা ভক্ষণ করত। আমরা মৃত প্রাণী, তাদের রক্ত ও হাড় খেতাম। এভাবে আমাদের জীবন চলছিল। এরই মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মধ্যে একজন নবী পাঠালেন এবং তাঁর উপর কিতাব নাযিল করলেন। তিনি এই কিতাবের মাধ্যমে আমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর প্রতি নাযিলকৃত অহি-র প্রতি আহবান জানালেন। অতঃপর আমাদের কেউ তাঁকে বিশ্বাস করল এবং কেউ তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করল। এরপর তিনি বিশ্বাসীদের সাথে নিয়ে মিথ্যুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন। অতঃপর আমরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর দ্বীনে প্রবেশ করলাম। অবশেষে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি সত্যবাদী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। এরপর তিনি আমাদেরকে বিরোধীদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বললেন, যারা এপথে যুদ্ধ করে নিহত হবে, তাদের জন্য রয়েছে সুখময় জান্নাত। আর যারা জীবিত থাকবে তারা রাজ্য পরিচালনা করবে এবং বিরোধীদের উপর সফলকাম হবে। এখন আমরা আপনাকে আহবান জানাচ্ছি যে, আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনুন এবং আমাদের ধর্মে প্রবেশ করুন। আপনি যদি এটা মেনে নেন, তাহ’লে এ রাজ্য আপনারই থাকবে। এখানে আপনার প্রিয় ব্যক্তি ব্যতীত কেউ প্রবেশ করবে না। তবে যাকাত ও গণীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ প্রদান করবেন। আর ইসলাম গ্রহণ না করলে, জিযিয়া দিয়ে নিরাপদে বাসবাস করবেন। আর যদি এর কোনটাই গ্রহণ না করেন, তাহ’লে আল্লাহ যতদিন না আমাদের মধ্যে ফায়ছালা করবেন, ততদিন যুদ্ধ চলতে থাকবে।[20]

সব কথা শুনে রুস্তম বললেন, তোমরা তো আমাদের প্রতিবেশী। তোমাদের সাথে আমরা ভাল আচরণ করে থাকি। তোমাদের বিপদ-আপদে সাহায্য করে থাকি। অতএব তোমরা দেশে ফিরে যাও। আমাদের দেশের সাথে বাণিজ্য করতে তোমাদের কোন বাধা দিব না। মুগীরা বিন শু‘বা (রাঃ) বললেন, আমরা দুনিয়ার কোন কিছুই চাই না। আমাদের একান্ত চাওয়া-পাওয়া হ’ল পরকাল।[21]

এরপর রুস্তম বললেন, আমরা অবশ্যই তোমাদের হত্যা করব। মুগীরা বললেন, আপনারা আমাদের হত্যা করলে আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব। আর আমরা আপনাদের হত্যা করলে আপনারা জাহান্নামে যাবেন। অতঃপর রুস্তম সূর্যের নামে কসম করে বললেন, আমরা অবশ্যই তোমাদের হত্যা করব। তখন মুগীরা (রাঃ) বললেন, অচিরেই জানা যাবে কে কাকে হত্যা করে।

অতঃপর রুস্তম মুগীরা বিন শু‘বা (রাঃ)-কে বললেন, আমি তোমাদের কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ, তোমাদের আমীরের জন্য এক হাযার দীনার এবং কাপড় ও বাহন দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি। তোমরা আমাদের দেশ থেকে ফিরে যাও। মুগীরা (রাঃ) বললেন, এটা খুব দূরে নয় যে, আমরা আপনাদের রাজ্যকে দুর্বল করে দিব, শক্তিশালীদের হীনবল করব এবং আপনাদের এদেশ আমাদের হয়ে যাবে। অতঃপর আপনারা নীচু হয়ে আমাদেরকে জিযিয়া দিবেন এবং আপনারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের দাসে পরিণত হবেন’। এ কথা শুনে তারা চিৎকার দিয়ে বলল, তোমাদের সাথে আমাদের কোন সন্ধি হবে না।[22]

এরপর মুগীরাহ বিন শু‘বা (রাঃ) রুস্তমকে বললেন, তাহ’লে আপনারা নদী পার হয়ে আসবেন, না আমরা নদী পার হয়ে যাব? রুস্তম বললেন, বরং আমরা নদী পার হয়ে গিয়ে যুদ্ধ করব। এরপর তারা পার হয়ে না আসা পর্যন্ত মুসলমানগণ  অপেক্ষা করলেন। তারা যখন পার হয়ে আসল তখন মুসলমানগণ তাদের উপর হামলা করে পরাস্ত করলেন।[23]

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! একটু চিন্তা করে দেখুন, মুসলমানগণ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য পাঁচ বারেরও অধিক একাধিক ব্যক্তিকে রুস্তমের সাথে আলোচনা করার জন্য পাঠিয়েছেন। সুতরাং ইসলামের যুদ্ধনীতির শান্তিপূর্ণ দিকটি ফুটে ওঠে।

যুদ্ধের পূর্বে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি বাহনে আরোহণ করতে অক্ষম হয়ে গেলেন। ফলে তিনি যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন খালিদ ইবনু আরফাত্বাহ (রাঃ)-কে এবং নিজে ক্বিদ্দীস ভবনের ছাদে উঠে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও ইবনু আরফাত্বাহকে নির্দেশনা দিতে থাকলেন।

অপরদিকে রুস্তম তার সৈন্যদের কয়েকটি স্তরে বিন্যস্ত করলেন এবং সার্বিক সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য গোয়েন্দা বিভাগকে সতর্ক করলেন। এটা ছিল চারদিন ব্যাপী কঠিন একটি যুদ্ধ। আরবরা এদিন প্রথম রাতে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। যা ছিল তাদের রীতিবিরুদ্ধ।

যুদ্ধের প্রথম দিন : আরমাছ

‘রমছ’ (رمث) শব্দের অর্থ হ’ল মিলে যাওয়া। যেহেতু এ দিনে বিশাল দু’দল সৈন্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে একে অপরের মধ্যে মিশে গিয়েছিল, সেজন্য এদিনকে ‘আরমাছ’ ((أرماث বলা হয়। এ দিনে যুদ্ধের কোন ফলাফল আসেনি। তবে মুসলমানগণ এ দিনে তেত্রিশটি হাতির দল দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। যেগুলিকে সেনাপতি রুস্তম তিনভাগে ভাগ করেছিলেন। যাদের মধ্যে একটি সাদা হাতিও ছিল। মূল বাহিনীতে ছিল আঠারটি হাতি, দক্ষিণ বাহুতে আটটি এবং বাম বাহুতে ছিল সাতটি।

যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে সা‘দ (রাঃ) সূরা আনফাল পাঠের নির্দেশ দিলেন। জিহাদের সূরা পাঠ করা হ’লে মুসলমানদের হৃদয় ও চোখ আনন্দে ভরে গেল এবং তারা প্রশান্তি লাভ করলেন। এ সূরা পাঠ শেষ হ’লে সেনাপতি সা‘দ (রাঃ) বললেন, যোহর ছালাত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করবে। ছালাত শেষে আমি চারটি তাকবীর ধ্বনি দিব। আমি তাকবীর দিলে তোমরাও তাকবীর দিয়ে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করবে। যখন দ্বিতীয় তাকবীর শুনবে, তোমরা তাকবীর দিয়ে যুদ্ধের পোশাক পরবে। আমি তৃতীয় তাকবীর দিলে তোমরা তাকবীর দিয়ে ঘোড়াগুলোকে প্রস্ত্তত করবে। আর চতুর্থ তাকবীর দিলে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং বলবে,لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ ‘লা হাওলা ওয়া লা-কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ (নেই কোন ক্ষমতা নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত)’।[24]

যুদ্ধের পূর্বে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) আরবের বিজ্ঞ ব্যক্তি, সুবক্তা, সুপরামর্শদাতা ও কবিদের একত্রিত করলেন। অতঃপর তাদেরকে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী সৈন্যদের সামনে গিয়ে উৎসাহপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার আহবান জানালেন। তারা গিয়ে সৈন্যদের সামনে বক্তব্য প্রদান ও কবিতা আবৃত্তি করার মাধ্যমে তাদেরকে উদ্দীপিত করে তুললেন।[25]

(১) ক্বায়েস বিন হুবায়রাহ আল-আসাদী বললেন, হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর প্রশংসা কর, যিনি তোমাদেরকে যে পথের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং যার দ্বারা পরীক্ষা করেছেন সেজন্য। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদেরকে বেশী করে দিবেন। তোমরা আল্লাহর নে‘মত সমূহ স্মরণ কর এবং তার সন্তুষ্টি লাভে মনোনিবেশ কর। তোমাদের সামনে রয়েছে জান্নাত নতুবা গণীমত। আর এ ভবনের পিছনে তৃণবিহীন প্রান্তর, নির্জন মরুভূমি, শুষ্ক পাত্র এবং দুর্গম এলাকা ছাড়া কিছুই নেই।[26]

এরপর (২) গালেব আল-আসাদী দাঁড়িয়ে বললেন, হে লোক সকল! তোমাদেরকে আল্লাহ এ যুদ্ধের জন্য নির্বাচন করায় তোমরা তাঁর প্রশংসা কর। তোমরা তাঁর কাছে চাও। তিনি  তোমাদের বেশী বেশী দিবেন! তোমরা প্রার্থনা কর তিনি কবূল করবেন। হে অস্ত্রসজ্জিত সৈন্যগণ! ঘোড়ায় আরোহণ করা অবস্থায় আজকে তোমাদের কেউ দুর্বল করতে পারবে না। আর তোমাদের সাথে যা (তরবারী) আছে, তা তোমাদের অবাধ্য হবে না। আগামী দিন লোকেরা কি আলোচনা করবে তা চিন্তা কর। কারণ তোমাদেরকে দিয়ে তাদের আগামীকাল শুরু হবে। আর তোমাদের পরবর্তীদের প্রশংসা করা হবে’। অতঃপর (৩) ইবনু হুযায়েল আসাদী দাঁড়িয়ে বললেন, হে সৈন্যগণ! তোমরা তরবারীকে রক্ষাকারী হিসাবে গ্রহণ কর এবং তাদের বিরুদ্ধে কাল দুর্গের ন্যায় হয়ে যাও। তাদের জন্য নেকড়ের ন্যায় ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন হয়ে যাও। চিৎকার ধ্বনিকে বর্ম পরাও, আল্লাহর উপর আস্থাশীল হও এবং চক্ষু অবনমিত রাখ। যখন তরবারী উন্মুক্ত হয়, তখন তা অনুগত হয়ে যায়। আর তোমরা তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করবে। কেননা পাথর এমন কিছু ঘটাবে যা লোহা ঘটাতে পারে না।

ইবনু হুযায়েলের বক্তব্য শেষ হ’লে (৪) বিশর বিন আবী রুহম জুহানী দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন, হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর প্রশংসা কর এবং কাজের মাধ্যমে তোমাদের কথাগুলোকে সত্যে পরিণত কর। তোমাদের হেদায়াতের জন্য তোমরা তো আল্লাহর প্রশংসা করেছ এবং তাঁর একত্ববাদ ঘোষণা করেছ। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তোমরা তার বড়ত্বও বর্ণনা করেছ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছ। অতএব তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে অন্য সব কিছু থেকে সহজভাবে গ্রহণ করবে। কেননা দুনিয়া তার কাছে আসে, যে তাকে তুচ্ছ মনে করে। তোমরা তার দিকে ধাবিত হয়ো না। কারণ তা পলায়ন করবে। আর তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন।

বিশর ইবনু আবী রুহম বক্তব্য শেষ করলে (৫) আছেম ইবনু আমের তামীমী দাঁড়িয়ে বললেন, হে আরব সম্প্রদায়! তোমরা তো আরবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তোমরা অনারবদের থেকে তাদেরকে রক্ষা করেছ। তোমরা জান্নাত লাভের ঝুঁকি নিয়েছ, আর তারা দুনিয়া প্রাপ্তির ঝুঁকি নিয়েছে। অতএব তোমাদের কাছে দুনিয়া যেন কখনও পরকালের উপর গুরুত্ব না পায়। তোমরা আজকের দিনে এমন ঘটনা সংঘটিত করো না, যা পরবর্তীতে আরবদের জন্য কলঙ্কজনক হয়ে থাকবে।

এরপর (৬) রিবঈ বিন আমের (রাঃ) তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে ইসলামের হেদায়াত দান করেছেন এবং এর উপর ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আর অশেষ নে‘মত দেওয়ার কথা বলেছেন। ধৈর্যধারণের মধ্যেই রয়েছে প্রশান্তি। তোমরা ধৈর্যধারণে নিজেদের অভ্যস্ত কর, তাহ’লে ধৈর্যশীল হ’তে পারবে। তোমরা অস্থিরতার অভ্যাস করো না, তাহ’লে ধৈর্যহারা হবে।[27]

অপরদিকে পারস্য বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিল। তারা তাদের সৈন্যদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করল। এরপর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তৃতীয় বার তাকবীর দিলে গালিব বিন আব্দুল্লাহ আযদী দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য সামনে বের হ’লেন। তাকে দেখে শত্রুপক্ষের হুরমুয এগিয়ে আসল। গালিব তাকে ধরাশায়ী করে সা‘দ (রাঃ)-এর কাছে বন্দি করে আনলেন। এরপর তুলায়হা আসাদী সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের কতিপয় বড় বড় নেতাকে হত্যা করলেন।[28]

অতঃপর সা‘দ (রাঃ) ক্বিদ্দীস ভবনের ছাদের উপর থেকে চতুর্থ তাকবীর দিয়ে ব্যাপক যুদ্ধের ঘোষণা করলেন। ফলে উভয়পক্ষ তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হ’ল। মুসলিম সৈন্যরা যুদ্ধ করছে, আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য এবং পারস্যবাসী ও কিসরার সন্তানদের অগ্নিপূজা থেকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইবাদতের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। অপরদিকে পারস্য বাহিনী যুদ্ধ করছে সম্রাট ইয়াযদাজারদ ও তাঁর সন্তানদের জন্য, যারা আল্লাহকে ছেড়ে আগুনের পূজা করে  তাদের রক্ষা করার জন্য।

এদিকে পারস্য বাহিনীর হাতি স্কোয়াড বনু আসাদ গোত্রের উপর হামলা করল। ইতিপূর্বে আরবের ঘোড়াগুলোর কখনও যুদ্ধে হাতি দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে ঘোড়াগুলো ভড়কে গেল। এতে বনু আসাদের কাতার সমূহের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হ’ল। এই সুযোগে পারস্য বাহিনী তাদের উপর হামলা জোরদার করল এবং হাতিগুলো ঘুরে ঘুরে হামলা করতে থাকল। সেনাপতি সা‘দ (রাঃ) উপর থেকে এ দৃশ্য অবলোকন করে কা‘কা‘ (রাঃ)-এর ভাই আছেম ইবনু আমরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আছেম ছিলেন তামীম গোত্রের। যারা ঘোড়া এবং উট পরিচালনার কৌশল খুব ভাল করেই জানত।

ইবনু জারীর বলেন, সা‘দ (রাঃ) আছেমকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বললে তিনি বনু তামীমকে বললেন, হে বনু তামীম! তোমরা কি উট এবং ঘোড়ার মালিক নও? এসব হাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোন কৌশল কি তোমাদের জানা নেই? তারা বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! আমাদের জানা আছে। অতঃপর তিনি তাঁর কওমের কিছু তীরনদায ও কিছু অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী ব্যক্তিকে ডেকে বললেন, হে তীরন্দায দল! তোমরা তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে হাতির উপরে থাকা সৈন্যদের পরাস্ত কর। আর হে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ! তোমরা হাতির পিছনে গিয়ে হাওদা কেটে ফেল। তিনি বনু আসাদকে সাহায্যের জন্য বের হ’লেন। তখনও হাতি পা দিয়ে বনু আসাদ গোত্রকে পিষ্ট করছিল। আছেমের সাথীরা হাতির পিছন দিক থেকে এসে তাদের হাওদা এবং বাক্সের রশিগুলো কেটে ফেলল। এতে হাতিগুলোর চিৎকার বেড়ে গেল। সেদিন এমন কোন হাতি ছিল না যার হাওদাজ বিচ্ছিন্ন করা হয়নি এবং তাদের উপরে থাকা লোকদের হত্যা করা হয়নি। মুসলিম সৈন্যরা আবার সামনে ফিরে আসল এবং বনু আসাদের উপর আপতিত বিপদ দূর করতে সক্ষম হ’ল। সূর্যাস্ত পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকল। পারস্য বাহিনী তাদের ঘাঁটিতে ফিরে গেল। ঐদিন সন্ধ্যায় বনু আসাদের পাঁচশত লোক শহীদ হয়।[29]

আরমাছ (أرماث)-এর দিন মুসলমানের জন্য খুবই দুর্বিষহ ছিল। কিন্তু তারা অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেয়। দিনের শেষ অবধি ক্লান্তিহীনভাবে বীরত্বের সাথে তারা শত্রুদের মুকাবিলা করে হস্তিবাহিনীর বিপর্যয় থেকে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।

যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন : আগওয়াছ (أغواث)

‘আগওয়াছ’ (أغواث) ‘গাওছ’ (غوث) শব্দের বহুবচন, অর্থ সাহায্য। যেহেতু হাশেম বিন উতবা বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ছয় হাযার সৈন্য সিরিয়া থেকে সাহায্যকারী হিসাবে আগমন করে, যার প্রথম দলে এক হাযার সৈন্য নিয়ে তিনি কা‘কা‘ বিন আমর তামীমীকে পাঠিয়ে দেন। এজন্য এই দিনকে গাওছ (غوث) তথা সাহায্য প্রাপ্তির দিন বলা হয়। শহীদগণের জন্য খননকৃত (উযায়েব ও আয়নুশ শামস এর মধ্যবর্তী স্থানে) কবরে দাফন করার জন্য এবং আহতদের চিকিৎসা কেন্দ্রে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানগণ এ দিনের সূচনা করে। যখন শহীদ ও আহতদের উযায়েবের দিকে নিয়ে যাওয়া হচিছল, তখনই কা‘কা‘ ইবনু আমর (রাঃ) সিরিয়া থেকে আগমন করলেন।

এ দিনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এই যে, এদিন হস্তী বাহিনীর সমাবেশ ঘটেনি। কারণ প্রথম দিন সকল হাতির উপরে বেঁধে রাখা বাক্স ও হাওদাজ মুসলমান সৈন্যরা কেটে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে পারসিক সৈন্যরা হাতির উপর নতুন বাক্স ও হাওদাজ স্থাপন করতে ব্যস্ত ছিল।

কা‘কা‘ ইবনু আমর যখন যুদ্ধের ময়দানে পৌছলেন তখন মুসলমান সৈন্যরা পারসিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তিনি মুসলমান সৈন্যদের হৃদয় থেকে ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক দূর করে তাদের মধ্যে সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করলেন। কৌশল হিসাবে তিনি তার সাথে থাকা সৈন্যদের একশ’ জনকে আলাদা আলাদা দলে ভাগ করলেন এবং প্রত্যেক দলকে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরা তার কমান্ড অনুযায়ী একশ’ জন করে তাকবীর দিয়ে ময়দানে প্রবেশ করল। তাদের তাকবীর শুনে অন্যান্য সৈন্যরাও তাকবীর ধ্বনি দিতে শুরু করল। এতে মুসলমান সৈন্যদের মনে শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পেল এবং পারস্য বাহিনী হীনবল হয়ে পড়ল। এভাবে কা‘কা‘ ইবনু আমরের পরিচালনায় সিরিয়া থেকে আগত সাহায্যকারী বাহিনী তাদের সকলকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল।[30]

এরপর কা‘কা‘ ইবনু আমর কাতার থেকে সামনে এসে বললেন, হে পারস্য বাহিনী! তোমাদের কে আছে যে আমার সাথে লাড়াই করবে? এ কথা শুনে সেনাপতি যুল হাজেব বাহমন জাযুওয়াইহ এগিয়ে আসল। কা‘কা‘ বললেন, তুমি কে? সে বলল, আমি বাহমান জাযুওয়াইহ্। তখন তিনি বললেন, হে আবু ওবায়েদের হত্যাকারী ও জিসরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী! এরপর দু’জনে যুদ্ধে লিপ্ত হ’লেন। কা‘কা‘ নিমেষেই তাকে খতম করে দিলেন। কা‘কা‘ আবার বললেন, কে আছে আমার সাথে যুদ্ধ করবে? তখন পারস্য সেনাপতি বীরযান ও বান্দুওয়ান ছুটে আসল। এ দৃশ্য দেখে মুসলিম সেনা হারেছ বিন যুবইয়ান সামনে অগ্রসর হ’লেন। কা‘কা‘ বীরযানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিমিষেই তার দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। আর হারেছ বান্দুয়ানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হ’লেন এবং তিনিও ক্ষণিকের মধ্যে বান্দুয়ানের দেহ থেকে মস্তক আলাদা করে দিলেন। কা‘কা‘ বলা শুরু করলেন, হে মুসলমানগণ! তোমরা তরবারী দিয়ে তাদের মুকাবিলা কর। কেননা এর মাধ্যমে লোকদের হত্যা করা যায়। অতঃপর লোকেরা তার উপদেশ গ্রহণ করে যুদ্ধে লিপ্ত হ’ল। কা‘কা‘ ইবনু আমর এ দিন ত্রিশজন সৈন্যকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহবান করেন এবং তাদের সকলকে হত্যা করতে সক্ষম হন। আবুবকর (রাঃ) বলেন, সে সৈন্যদল পরাজিত হবে না, যাদের মধ্যে কা‘কা‘ ইবনু আমর থাকবেন।[31]

এরপর মুসলমান সৈন্যরা হস্তিবাহিনীর অনুপস্থিতিকে কাজে লাগাল। তাদের উটগুলোকে কালো পোষাক পরিয়ে দিল এবং বড় বড় হাওদাজ তৈরী করে সেগুলোর উপর স্থাপন করল এবং দশজন করে তার উপর আরোহণ করল। এ দৃশ্য দেখে পারস্য বাহিনীর ঘোড়াগুলো ভয়ে পিছিয়ে গেল।[32]

আবু মেহজান ছাক্বাফী গাওছের দিন অত্যন্ত বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তিনি মূলতঃ পারসিক মুসলিম ছিলেন। তিনি অতিরিক্ত মদ্যপান সত্ত্বেও যুদ্ধ বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন। ইবনু সীরীন বলেন, আবু মেহজান মদ্যপানের অপরাধে প্রায়ই বেত্রাঘাতের শাস্তি ভোগ করতেন। যখন অতি মাত্রায় মদপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন তাকে বেঁধে উম্মে ওয়ালাদ যাবরার দায়িত্বে আটক রাখা হ’ল। আবু মেহজান কাদেসিয়ার যুদ্ধের দিনে মুসলমানদের নিহত হ’তে দেখে আফসোস করে বললেন, আমার দুঃখের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, মুসলমানদের ঘোড়াগুলোকে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে, অথচ আমাকে আবদ্ধ অবস্থায় সকাল করতে হচ্ছে...। তখন তিনি সেনাপতি সা‘দ (রাঃ)-এর স্ত্রী সালমার কাছে পত্র মাধ্যমে সংবাদ পাঠালেন যে, আবু মেহজান আপনাকে বলছে, আপনি যদি তাকে মুক্ত করে দেন এবং এই [সা‘দ (রাঃ)-এর] ঘোড়ার উপর আরোহণ করতে দেন ও তার কাছে অস্ত্র প্রদান করেন, তাহ’লে আবু মেহজান শাহাদত বরণ না করলে সবার আগে আপনার কাছে ফিরে আসবে। অতঃপর যাবরা তার শিকল খুলে দিয়ে উক্ত ঘোড়াটি ও তরবারীটি দিয়ে দিলেন। তিনি ঘোড়ায় আরোহণ করে নিমিষেই সৈন্যদের সাথে মিলিত হ’লেন এবং তাকবীর ধ্বনি দিয়ে শত্রুদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হ’লেন। অতঃপর যাকেই সামনে পাচ্ছিলেন তাকেই হত্যা করে বীরদর্পে সামনের দিকে এগোতে থাকেন। এদিকে সা‘দ (রাঃ) আবু মেহজানকে ছাদের উপর থেকে দেখছিলেন, আর অবাক হয়ে ভাবছিলেন যে, কে এই অশ্বারোহী? যুদ্ধ শেষে আবু মেহজান কয়েদখানায় ফিরে এসে ঘোড়া ও অস্ত্র ফেরত দিলেন এবং তার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হ’ল। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) যখন তার পূর্ণ বিবরণ জানতে পারলেন, তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, মদ পানের জন্য তোমাকে আর কখনও বেত্রাঘাত করব না। তখন আবু মেহজান বললেন, আল্লাহর কসম! আমি আর কখনও মদ পান করব না।[33]

সালমা (রাঃ)-এর উৎসাহ :

সালমা ছিলেন অন্যতম মুসলিম সেনাপতি মুছান্না ইবনু হারেছা (রাঃ)-এর বিধবা স্ত্রী। পরে সা‘দ (রাঃ) তাকে বিয়ে করেন। সা‘দ (রাঃ) স্বীয় নিতম্ব ও দু’হাটুতে প্রচন্ড ব্যথা পাওয়ায় ক্বিদ্দীস ভবনের ছাদের উপর থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। যখন সালমা দেখলেন যে, মুসলমান সৈন্যগণ আহত হচ্ছেন এবং ঘোড়াগুলো পশ্চাদপসরণ করছে, তখন বললেন, হায় মুছান্না! আজকে সেই মহাবীর মুছান্না আর নেই। অর্থাৎ মুছান্না থাকলে মুসলমানদের এ অবস্থা হ’ত না।  এ কথা শুনে সা‘দ (রাঃ) রেগে গিয়ে তাকে চপেটাঘাত করলেন। কারণ সা‘দ (রাঃ) তো কাপুরুষতার জন্য ছাদে অবস্থান করছিলেন না! সালমা মূলতঃ তাঁকে উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন। শুধু সালমা নয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল নারী এভাবে তাদের যোদ্ধাদের উৎসাহিত করছিল এবং আহতদের সেবা করছিল।[34]

যুদ্ধের তৃতীয় দিন : ‘আ‘মাস’ (اعماس)

এ দিনের নাম ‘আ‘মাস’ (اعماس) বা কঠিন যুদ্ধ।[35] এ নাম রাখার পিছনে কারণ হ’ল এ দিনটি উভয় দলের জন্য খুবই বিপজ্জনক ছিল। এ রাতকে বলা হয় ‘হারীর’ (هرير) তথা মিউমিউ করে কান্না অর্থাৎ আহতদের চিৎকারের রাত। আ‘মাসের দিন মুসলমানগণ প্রথম যে কাজটি করেন তা হ’ল শহীদদের কাফন-দাফন সম্পন্ন করা এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পক্ষান্তরে পারসিক বাহিনীর নিহতরা দু’কাতারের মধ্যে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়েই থাকল। আল্লাহ এর মাধ্যমে মুসলমানদের সম্মান ও পারসিকদের অপমান করলেন।[36]

এদিকে কা‘কা‘ ইবনু আমর কৌশল অবলম্বন করলেন এভাবে যে, তিনি কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে তাঁর বাহিনী নিয়ে ময়দানের বাইরে অবস্থান নিলেন। সকাল হ’লে বেশ ক’টি একশ’ জনের টিম তৈরী করে প্রত্যেক দলকে তাকবীর দিয়ে ময়দানে প্রবেশ করতে বললেন। একটির পর একটি টিম এভাবে তাকবীর দিয়ে প্রবেশ করতে থাকল। তাদের তাকবীর শুনে অন্য সৈন্যরাও তাকবীর দিতে লাগল। কা‘কা‘র ভাই আছেম একই পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। হাশেম ইবনু উতবা সিরিয়া থেকে সাহায্য নিয়ে আসলে তিনিও কা‘কা‘র পদ্ধতি অনুসরণ করে যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করলেন। এতে মুসলিম বাহিনীর মাঝে নতুন সাহায্য প্রাপ্তির আনন্দ জেগে উঠল এবং তারা নতুনভাবে উৎসাহিত হন।[37]

এ দিনে পারসিক বাহিনী আবার হাতি নিয়ে ময়দানে প্রবেশ করল। তারা মুসলমানদের অনেক ক্ষতি করে ফেলল। সা‘দ (রাঃ) পারসিক নও মুসলিমদের নিকট হাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কৌশল জানতে চাইলেন। তারা বলল, এদের পরাস্ত করতে হ’লে তাদের চোখ ও শুঁড়ে আঘাত হানতে হবে। সা‘দ (রাঃ) নির্দেশনা দিয়ে কা‘কা‘ ও আছেম ইবনু আমরের কাছে লোক পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, তাদের দু’জনকে বল, তারা যেন সাদা হাতির চোখে আঘাত হেনে তাকে পরাস্ত করে। আর হাম্মাল ও রুবাইবিল-এর কাছে লোক পাঠিয়ে বললেন, তাদের দু’জনকে বল, তারা যেন আজরাব হাতিকে করতলগত করে। তারা সাদা হাতিকে হত্যা করতে সক্ষম হ’লেন এবং আজরাব হাতিকে করতলগত করলেন। এ অবস্থায় হাতিদ্বয় শূকরের মত চিৎকার শুরু করল এবং আজরাব হাতি পিছনে পলায়ন করে আতীক নদীতে ঝাঁপ দিল। এ দৃশ্য দেখে অন্যান্য হাতিগুলো তার অনুকরণ করে পারসিক বাহিনীর কাতার ভেদ করে আতীক নদী পাড়ি দিল। আর যারা এদের উপরে ছিল তারা সকলে নিহত হ’ল। অন্য বর্ণনায় আছে, কা‘কা‘ ও আছেম পার্শ্বে আত্মগোপন করে থাকলেন এবং সুযোগ পেয়ে এক সাথে সাদা হাতির দু’চোখে বর্শা ঢুকিয়ে দিলেন। এতে হাতি তার মাথা নিচু করে ফেলল। আর তার চালকেরা নিচে পড়ে গেল। সুযোগ মত কা‘কা‘ তার শুঁড় কেটে ফেললেন এবং চালকদের হত্যা করলেন।[38]

হস্তিবাহিনী পলায়ন করলে মুসলিম সৈন্যরা পারসিক বাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হ’ল। তরবারীর মাধ্যমে এ দিন এত কঠিন এবং ভয়াবহ যুদ্ধ হ’ল যে, কাদেসিয়ার অন্য কোন দিনে এমনটা হয়নি। আ‘মাসের দিনে দু’দল সৈন্যই কঠিন বিপদের মুহূর্তেও সীমাহীন ধৈর্যের পরিচয় দেয়।[39]

রাত হ’ল কিন্তু যুদ্ধ থামল না। দু’দলের সেনাপতিদের মাঝে কোন আলোচনাও হ’ল না। মুসলমানগণ এশার ছালাত আদায় করে অস্ত্র নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আহতদের কষ্ট জড়িত শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দ শুনা যাচ্ছিল না। এ রাতে মুসলমানগণ তিন ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করেন। ১. পদাতিক বাহিনী, যারা বর্শা ও তরবারী নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। ২. তীরন্দায বাহিনী এবং ৩. অশ্বারোহী বাহিনী, যারা পদাতিক বাহিনীর সামনে থেকে যুদ্ধ করছিলেন।[40]

এ রাতের যুদ্ধ সকাল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হ’ল। সা‘দ (রাঃ) নিজ সৈন্যদের সংবাদ জানার আশায় এবং তাদের সার্বিক নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষায় সারা রাত ছালাত ও দো‘আর মধ্যে অতিবাহিত করলেন।[41]

৪র্থ দিন : বিজয়

সকাল বেলার দিগন্ত বিস্তৃত আলোতে যুদ্ধের ময়দান স্পষ্ট হয়ে গেল। সেনাপতি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর চোখে যুদ্ধের ময়দান ভেসে উঠল। তিনি লক্ষ্য করলেন তারা সামনে অগ্রসর হয়েছে এবং তারা আনন্দে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছেন। তারা আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির দৃঢ় প্রত্যাশা করেছিলেন। ফলে এ রাতে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের দশ হাযার সৈন্যকে হত্যা করতে সক্ষম হন।

কা‘কা‘ ইবনু আমর (রাঃ) বিজয়ের প্রাক্কালে কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি সৈন্যদের সামনে গিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ পর আবার অবস্থার অবনতি হ’তে পারে। অতএব তোমরা কিছুক্ষণ ধৈর্য ধারণ কর এবং হামলা চালিয়ে যাও। কেননা ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য লাভ করা যায়। কা‘কা‘র বক্তব্য শুনে চৌকস সৈন্যদের একটি দল তাঁর পাশে সমবেত হ’ল। তারা রুস্তমের মূল বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল এবং তার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হ’ল। যুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হ’ল। হরমুযান ও বীরযান তাদের স্থান হ’তে অপসারিত হ’ল। মুসলমানগণ কাফিরদের মূল বাহিনীর উপর শাণিত হামলা চালালো। এরই মধ্যে প্রচন্ড ঝড় এসে রুস্তমের তাঁবুকে নদীতে নিক্ষেপ করল। কা‘কা‘ ও তাঁর সাথীরা রুস্তমের আসনে গিয়ে আঘাত হানলেন। কিন্তু রুস্তম ঝড়ের সময় স্থান ত্যাগ করায় প্রাণে বেঁচে যান।[42]

এদিকে রুস্তম বোঝা ওয়ালা একটি গাধার পাশে আত্মগোপন করলেন। হিলাল বিন আলক্বামাহ তামীমী গাধাটির পাশে তাকে লুকিয়ে থাকতে দেখে ছুটে আসলেন তার দিকে। তাকে হামলা করতে গিয়ে হিলাল গাধার উপর থাকা বোঝা কেটে ফেলে দিলেন। বোঝার নিচে পড়ে রুস্তমের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেল। আত্মরক্ষার্থে রুস্তম আতীক নদীতে ঝাঁপ দিলেন। হেলাল নদীতে গিয়ে তার উপর হামলা করে তার পা ধরে নদীর কিনারায় নিয়ে আসলেন। অতঃপর তরবারী দিয়ে তার কপালে আঘাত করে তাকে হত্যা করলেন। এরপর হিলাল রুস্তমের সিংহাসনে আরোহণ করে চিৎকার দিয়ে বলা শুরু করলেন, কা‘বার রবের কসম! আমি রুস্তমকে হত্যা করেছি (قََتَلْتُ رُسْتُمَ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ)।[43]

অন্যতম পারসিক সেনাপতি জালিয়ানুস তাদের প্রধান সেনাপতিকে নিহত হ’তে দেখে সৈন্যদের ময়দান ত্যাগ করে আতীক নদী পার হয়ে মাদায়েনের পথে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিল। কিন্তু তারা নদী পার হ’তে পারল না। মুসলিম সৈন্যরা বর্শা ও তীর দ্বারা তাদের কুপোকাত করতে লাগল। এভাবে তারা পারসিক বাহিনীর হাযার হাযার সৈন্যকে  নদীতেই হত্যা করল।

সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) যুহরাহ ইবনু হুওয়াই তামীমীর নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে জালিয়ানুসের বিরুদ্ধে পাঠালেন। যুহরা নদী তীরের সন্নিকটে তাকে পেয়ে হত্যা করলেন।[44]

অবশিষ্ট পারসিক সৈন্যরা পলায়ন করে মাদায়েন থেকে সাহায্যের জন্য আগত সৈন্যদের সাথে মিলিত হ’ল। ঐ দলের সেনাপতি ছিলেন নুখারেজান। তিনি সকল সৈন্যকে ঐক্যবদ্ধ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন। নুখারেজান দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানালে একজন মুসলিম সেনা যুহায়ের ইবনু সুলায়েম বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে নিমেষেই তাকে হত্যা করেন। এরপর মুসলিম বাহিনী দ্বিতীয় বারের মত পারসিকদের উপর হামলা করল। এতে তাদের কিছু সৈন্য নিহত হ’ল এবং কিছু পলায়ন করে রাজধানী মাদায়েনে গিয়ে আশ্রয় নিল।

যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ফলাফল :

চার দিন ও তিন রাত প্রচন্ড যুদ্ধ চলার পর কাদেসিয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

১. এ যুদ্ধকে যুগান্তকারী যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়। মাত্র ছত্রিশ হাযার মুসলিম সৈন্য দুই লক্ষ সুসজ্জিত পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে।

২. এ যুদ্ধের ফলে অত্র অঞ্চল ইরাকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং সেখানে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সকল বাধা দূরীভূত হয়। যুদ্ধের পর চার হাযার পারসিক সৈন্য সরাসরি ইসলাম গ্রহণ করে। এছাড়া বিভিন্ন গোত্র ও ইরাকে বসবাসরত ধর্মযাজক দাহকানগণ দলে দলে সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়।

৩. এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পরবর্তীতে পারস্যের রাজধানী মাদায়েন (১৬ হিজরীর ছফর মাসে) এবং জালাওলা ও হুলওয়ান (১৬ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে) বিজয়ের দার উন্মুক্ত হয়।[45]

৪. খালিদ ইবনু ওয়ালীদ ও মুছান্না ইবনু হারেছা কর্তৃক বিজিত ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা ইতিপূর্বে পারস্য নেতাদের প্ররোচনায় মুসলমানদের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল। কিন্তু কাদেসিয়ায় বিজয়ের ফলে তারা নানা ওযর-আপত্তি পেশ করে মুসলমানদের কাছে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলমানগণ তাদের ক্ষমা করে দেন। এভাবে পুরো ইরাকে শান্তি কায়েম হয়।[46]

৫. কাদেসিয়ার যুদ্ধে মুসলমানগণ বহু গণীমত লাভ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল পারস্যের বড় পতাকা (দারফাশ কাবিয়ান)। এটি তারা নেকড়ে বাঘের চামড়া দিয়ে তৈরী করেছিল। যার দৈর্ঘ্য বার হাত এবং প্রস্থ আট হাত। যার উপরে মণি-মুক্তা, ইয়াকূত পাথর ও জহরত দিয়ে নকশা করা ছিল।[47]

উপসংহার :

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্তি হ’ল তাদের ঈমানী শক্তি। তারা ঈমানী বলে বলীয়ান হয়ে যুদ্ধ করে বলেই অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে। যুদ্ধ নয় শান্তিই মূলত ইসলামী জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ময়দানে গিয়েও তারা মুশরিকদের বার বার শান্তির প্রস্তাব দিয়েছেন। খায়বারের দিন রাসূল (ছাঃ) সেনাপতি আলী (রাঃ)-কে বলেছিলেন, ‘হে আলী! তুমি তাদেরকে প্রথমে আল্লাহর পথে আহবান করবে। কেননা আল্লাহ যদি তোমার মাধ্যমে একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তাহ’লে সেটা তোমার জন্য লাল উট প্রাপ্তির চেয়েও উত্তম হবে’।[48] আল্লাহ আমাদের সকলকে শান্তির পথে আহবান করার তাওফীক দান করুন-আমীন!

আব্দুর রহীম

শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী ।


[1]. বালাযূরী, ফুতূহুল বুলদান ১/২৫১; খলীফা ইবনু খাইয়াত্ব, তারীখ, পৃঃ ১৩২; মাসঊদী, মুরূজুয যাহাব ২/৩২৮

[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৯/৬১৩ (দারুল হিজর); তারীখু ইবনে জারীর ত্বাবারী, ৩/৪৭৯

[3]. তারীখু ত্বাবারী ২/৩৮৪

[4]. ঐ, ৩/৫৪২-৫৪৩, ৩/৪৮৭ ও ৪৯০; ইবনুল আছীর, আল-কামিল ২/৩১১

[5]. ঐ, ৩/৪৯০

[6]. সামী আব্দুল্লাহ মাগলূছ, আত্বলাসুল খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), পৃঃ ৭২

[7]. ইবনু হাজার, আল-মাতালিবুল আলিয়া হা/৪০৩৪; আবু ইয়া‘লা হা/৩১১০; আহমাদ হা/১২৩৬৬

[8]. তারীখু ত্বাবারী ২/৩৯৪

[9]. তারীখু ত্বাবারী, ৩/৪৭৯; ইবনুল আছীর, আল-কামিল ২/২৯৯

[10]. হাকেম হা/৬১১৩; তিরমিযী হা/৩৭৫২; মিশকাত হা/৬১১৮

[11]. বুখারী হা/২৯০৫; মুসলিম হা/২৪১২; মিশকাত হা/৬১০৩

[12]. হাকেম হা/৪৩১৪, ৬১২২; বাযযার হা/১২১৩; আবু নু‘আইম, মা‘রিফাতুছ ছাহাবা হা/৫০৭

[13]. সৈয়ূতী, আল-খাছায়েছুল কুবরা ৩/৬৮

[14]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৪৭৭-৪৭৮

[15]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/৬১৩

[16]. ঐ, ৭/৩৮

[17]. ঐ, ৭/৪৫

[18]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫২০; আল-বিদায়াহ ৯/৬২২

[19]. মাহমূদ শাকের, আত-তারীখুল ইসলামী ৩/১৭০; আবুল হাসান নদভী, সীরাতুননবী ১/১১৩; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৯/৬২৩; দারুল হিজর; মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্দালভী, হায়াতুছ ছাহাবা ১/২৫০

[20]. ইবনু হিববান, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়াহ ওয়া আখবারুল খুলাফা ১/৪৫২; তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৭৪; আল-বিদায়াহ ৯/৬২৩

[21]. ঐ, ৭/৪৬; আল-কামিল ২/২৯৭; তবে ছাহাবী মুগীরার স্থানে যুহরার কথা উল্লেখ আছে।

[22]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৪৯৬; আল-বিদায়াহ ৭/৪৮; হায়াতুছ ছাহাবা ১/২৬১

[23]. আল-বিদায়াহ ৭/৪০, দারুল ফিকর; তারীখু ত্বাবারী ৩/৪৯৬

[24]. আল-কামিল ২/৪০৯

[25]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৩৩

[26]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৩৩-৫৩৪

[27]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৩৫; সুলায়মান হিময়ারী, আল-ইকতেফা ২/৪৬৮; আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম ফী-তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম ৪/১৭২

[28]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৩৫; আল-মুনন্তাযাম ৪/১৭২

[29]. ঐ ২/৪১২

[30]. ঐ, ৩/৫৪৩; ইবনু হাজার, আল-ইছাবা ৪/১৭৪

[31]. ঐ ৩/৫৪৩; আল-কামিল ২/৩০৬-০৭; ইবনু খালদূন ২/৫৩৩

[32]. ইবনু খালাদুন ২/৫৩৩; আল-কামিল ২/৩০৬

[33]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক ৯/২৪০; তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৪৫-৫৪৭

[34]. ঐ ৩/৫৭৫; আল-বিদায়াহ ৭/৪৪

[35]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব ২/৬২৮

[36]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৫১

[37]. ঐ, ৩/৫৫২

[38]. ঐ, ৩/৫৫৫-৫৫৬; আল কামিল ২/৩৩৩

[39]. তারীখু ত্বাবারী ২/৫৫৭

[40]. ঐ, ৩/৫৫৯ ও ৫৬৪

[41]. আল-কামিল ২/৩৩৪

[42]. ডঃ মুহাম্মাদ সাইয়েদ ওয়াকীল, জাওলাতুন তারীখিয়্যাহ ফী আছরিল খুলাফায়ির রাশিদীন, পৃঃ ১২৮

[43]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৬৪; আল-কামিল ২/৩১৩; তারীখু ইবনে খালদূন, ২/৫৩৫; আল-বিদায়াহ ৭/৪৬

[44]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৫৬৫; আল-কামিল ২/২৫

[45]. ঐ, ৪/৫, ৭, ৮, ২৩ ও ২৪ পৃঃ

[46]. আল-বিদায়াহ ৭/৪৭

[47]. মাসউদী, মুরূজুয যাহাব ২/৩২৮ ও ৪১৭

[48]. বুখারী হা/৩৭০১; মুসলিম হা/২৪০৬; মিশকাত হা/৬০৮০






আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৭ম কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইলম অন্বেষণও শিক্ষাদানের গুরুত্বও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
আদল : মানব জীবনের এক মহৎ গুণ - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
নারী-পুরুষের ছালাতের পার্থক্য : বিভ্রান্তি নিরসন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
বিতর্কের ক্ষেত্রে করণীয়-বর্জনীয় - আসাদ বিন আব্দুল আযীয
পরকালে পাল্লা ভারী ও হালকাকারী আমল সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বায়তুল মাক্বদিস মুসলমানদের নিকটে কেন এত গুরুত্ববহ? - ড. মুখতারুল ইসলাম
ইসলামী গান ও কবিতায় ভ্রান্ত আক্বীদা - মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ
আরও
আরও
.