সময়টি ছিল ২০০৭-এর মধ্যবর্তী কোন এক সময়। সঊদী আরবের দাম্মামে এক বাংলাদেশী প্রবাসী ভাইয়ের মেয়ের বিবাহের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। উল্লেখ্য, আমি ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে সঊদী আরবে আসি।

এদেশের মজলিসগুলিতে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ থাকে। আমি মজলিসে বসে আছি। হঠাৎ দেখি দাড়ি-টুপি ওয়ালা ও জুববা পরিহিত কিছু লোক টেপ রেকর্ডার এবং সাউন্ড বক্স নিয়ে রুমে প্রবেশ করছে। আমি কিছুটা বিস্ময়ের সাথে তাঁদের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ পর একজন লম্বা গোছের লোক সালাম দিয়ে মজলিসে প্রবেশ করলেন। জানলাম, তিনি শায়খ মতীউর রহমান মাদানী। আমি তখনও তাকে চিনি না; তাঁর পরিচয়ও জানি না। যাহোক কিছুক্ষণ পর তিনি বিবাহ-শাদীর সুন্নাত এবং বিদ‘আতের উপর বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন। মাঝখানে একটি কথা বললেন, আপনারা হয়তো কেউ কেউ অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে তো দেখি গান-বাজনার আয়োজন হয়, কিন্তু এখানে ওয়ায-নছীহত হচ্ছে? এখানে সমবেত মুসলিম ভাই-বোনদেরকে বিবাহের শারঈ দিকগুলি জানানোর জন্যই আমাদের আজকের এ আয়োজন। তাঁর এই কথা শুনে আমার চিন্তাশক্তিতে ধাক্কা লাগল। আমি মনোযোগ দিয়ে তার পুরো বক্তব্য শুনলাম।

আলোচনা শেষে সবাইকে ১টি বই ও ১টি করে সিডি দেওয়া হ’ল। আমাকে যে সিডিটি দেওয়া হয়, সেটি ছিল প্রচলিত বিদ‘আত-এর উপর শায়খ মতীউর রহমানের বক্তব্য। আমি পরদিন ঐ বক্তব্য শুনি।

দেশে থাকতে যদিও নিয়মিত ছালাত আদায় করতাম, ইসলামী আলোচনার মাহফিলে যেতাম; কিন্তু তাওহীদ, সুন্নাত, শিরক, বিদ‘আত ইত্যাদির উপরে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাই শায়খের আলোচনা শুনে প্রথমে একটু খটকা লাগল। ভাবতে লাগলাম, আমরা এতদিন থেকে যে বিশ্বাস পোষণ করে আসছি, যে আমল করে আসছি, তাতো দেখি ভুলে ভরা, ভিত্তিহীন। আমি সেই আলোচনা দীর্ঘ ৬/৭ মাস যাবৎ শুনলাম। ফলে আলোচনাটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। তারপর আমি চিন্তা করলাম, এই আলোচনা যেখানে হয়েছে নিশ্চয়ই সেখানে গেলে আরও অনেক বিষয়ের উপর ক্যাসেট বা সিডি পাওয়া যাবে। তখনও ইসলামিক সেন্টার সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা ছিল না। পরে যেভাবেই হোক এক জুম‘আর দিন ইসলামিক সেন্টারে গেলাম। দেখলাম, শায়খের মুখতাছারুল বুখারীর দরস চলছে। ক্লাস শেষ হ’লে শায়খকে কিছু আক্বীদা বিষয়ক প্রশ্ন করলাম। উত্তর জেনে নিয়ে আমি সেন্টারের নীচে চলে যাই। তখন পেছন থেকে এক ভাইয়ের ডাক শুনতে পেলাম। তিনি কাছে এসে বললেন, শায়খ আপনাকে ডেকেছেন। সেখানকার অন্য ভাইয়েরা আমাকে জানালো, শায়খ তাদেরকে বলেছিলেন, যে লোকটি আজকে ক্লাস শেষে প্রশ্ন করেছিল, তাকে নতুন দেখলাম, তার প্রশ্নগুলি ছিল আক্বীদা বিষয়ক। তার মাঝে জানার আগ্রহ আছে বলে মনে হয়। তাকে আমার নিকটে নিয়ে আসুন।

তারপর শায়খের সাথে আমার প্রথমবারের মত কথা হয়। তিনি আমার বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। কিভাবে এখানে এলাম তা বিস্তারিত তাকে জানাই। সেদিন ইসলামিক সেন্টারের দ্বীনী ভাইয়েরা আমার সাথে যে অমায়িক ব্যবহার করেছিলেন, তা ভোলার নয়। তারা আমাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। সত্যিই এমন আচরণ আমি অন্য কারো মাঝে লক্ষ্য করিনি। আমি সেদিন শায়খের ২৫/৩০ টা লেকচার এবং আক্বীদা সংক্রান্ত কিছু বাংলা পুস্তক নিয়ে আসি। শুরু হয় শায়খের আলোচনা শোনা ও বই পড়া। পাশাপাশি প্রতি জুম‘আয় শায়খের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া। ব্যস্ততার কারণে অন্য দিন যাওয়া সম্ভব হ’ত না।

এভাবে আমি হক পূর্ণভাবে চিনতে পারলাম। এদিকে আমার দেশে যাওয়ার সময় চলে এলো। চিন্তায় পড়ে গেলাম, যখন দেশে যাবো, তখন আমার মত আক্বীদাসম্পন্ন লোক কোথায় পাব? ঠিক সেই মুহূর্তে এক দ্বীনী ভাই আমার হাতে মাসিক আত-তাহরীক তুলে দিল। আমার হাতে প্রথম যেদিন আত-তাহরীক-এর সেই সংখ্যাটি এসেছিল, বুঝাতে পারব না আমার মনোভাব সেদিন কেমন হয়েছিল। ভাবছিলাম দেশেও কি এমন ছহীহ আক্বীদা ভিত্তিক পত্রিকার পাঠক রয়েছে? সেই থেকে আমি নিয়মিতভাবে আত-তাহরীক পড়ে যাচ্ছি। যখনই কোন ভাই ছহীহ আক্বীদা গ্রহণ করেন, তার হাতে আত-তাহরীক-এর একটি কপি তুলে দেই। এখনো নিয়মিতভাবে ইসলামিক সেন্টারে শায়খ মতীউর রহমান ছাহেবের ক্লাসে উপস্থিত থেকে কিতাবুত তাওহীদ, উসূলুছ ছালাছাহ, মুখতাছারুল বুখারী, তাফসীর, মুছত্বালাহুল হাদীছ, বুলূগুল মারাম ইত্যাদির উপরে ক্লাস করে যাচ্ছি।

পরিশেষে মহান আল্লাহ তা‘আলার একটি বাণী স্মরণ করে শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ‘হে নবী! তুমি যাকে চাও তাকে হেদায়াত দান করতে পারো না। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত দান করেন এবং হেদায়াত প্রাপ্তদের সম্পর্কে তিনি খুব ভাল করেই জানেন’ (ক্বাছাছ ৫৬)। আমার এভাবে হকের সন্ধান পাওয়া ও হেদায়াত লাভ করা আল্লাহর বিশেষ রহমত। তাই হেদায়াত লাভের জন্য আমাদেরকে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে হক চেনার ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দিন- আমীন!

* তালহা খালেদ

দাম্মাম, সঊদীআরব।






আরও
আরও
.