মহান আল্লাহ বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, ‘ইসলাম আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। এ আয়াতের আলোকে জগতে যত ধর্ম প্রচলিত আছে, ইসলাম ছাড়া সব ধর্মের প্রতি আল্লাহপাক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। এরপর আল্লাহপাক আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন তালাশ করবে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। এতদ্ব্যতীত আল্লাহপাক জগদ্বাসীকে ভীতি প্রদর্শন পূর্বক বলেছেন, ‘যারা কুফুরী করে এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাদের তরফ হ’তে পৃথিবীপূর্ণ স্বর্ণ বিনিময় করা হ’লেও তাদের তওবা কবুল করা হবে না। এরাই তারা যাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। এদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (আলে ইমরান ৩/৯১)। কাফির অর্থ অস্বীকারকারী। যারা ইসলামকে গ্রহণ করেনি, তাদেরকে কাফির বলা হয়ে থাকে। মৃত্যুর পর কোন মানুষের কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া আমরা সকলেই একথা বুঝি, জীবিত অবস্থায়ও কোন মানুষের পক্ষে পৃথিবীপূর্ণ স্বর্ণ প্রদানের যোগ্যতা নেই। তাহ’লে আল্লাহপাকের কথার তাৎপর্য আমরা এভাবে নিতে পারি, ইসলামকে অস্বীকারকারীর কোনভাবেই পরিত্রাণ নেই।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে। মহান আল্লাহ জগদ্বাসীকে যা জানাতে চেয়েছেন, তার সবই নবী করীম (ছাঃ)-কে জানিয়েছেন। আর নবী করীম (ছাঃ) ছাহাবীগণের সামনে আল-কুরআনের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন। ছাহাবীগণের যুগে এবং পরবর্তীতে তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনদের যুগে নবী করীম (ছাঃ)-এর সে শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছিল। আল্লাহপাকের সমুদয় বাণী পবিত্র কুরআনে সংরক্ষিত হয়েছে এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর বাণী, কর্ম ও আদর্শ হাদীছ গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বড়ই আফসোস, অন্যান্য জাতি আল্লাহপাকের আহবান ও স্ব স্ব নবী-রাসূলগণের দ্বীন প্রচার হ’তে যেমন দূরে রয়েছে, আমরা তদ্রূপ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও ইসলামের বিধান হ’তে অনেক দূরে রয়েছি।
যারা আল্লাহপাকের বাণী ও নবী করীম (ছাঃ)-এর বাণী ও আদর্শের সাথে কিছুটা পরিচয় লাভ করেছেন, তারা চোখ খুললেই সেসব বাণী ও আদর্শের বিপরীত আমল-আচরণ দেখতে পাবেন। নিম্নে সেগুলির মধ্য হ’তে কিছু নযীর তুলে ধরা হলো:
মহান আল্লাহ মুসলিম জাতির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে বিশেষত মুসলিম জাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। ঐক্য বজায় রাখার নিমিত্তে আল্লাহপাক পুনরায় বলেছেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের। যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ কর, তবে এর ফায়ছালার ভার আল্লাহ ও রাসূলের উপর ন্যস্ত কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর বিশ্বাস রাখ। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা’ (নিসা ৪/৫৯)। অথচ তারাবীহ ছালাতের রাক‘আত সংখ্যা নিয়ে বর্তমানে মুসলমানের মধ্যে চরম মতবিরোধ বিদ্যমান, যদিও এর ফায়ছালা নবী করীম (ছাঃ)-এর আমলে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাছাড়া ছালাতের অন্যান্য রুকনেও মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়।
মুসলিম জাতির ঐক্য বজায় রাখতে ও নাজাতের উদ্দেশ্যে নবী করীম (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা তা মজবুতভাবে অাঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। বস্ত্ত দু’টি হচ্ছে আল্লাহর বাণী আল-কুরআন ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’ (হাকিম, মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালেক, মিশকাত হা/১৮৬)। ঐক্য বজায় রাখার জন্য নবী করীম (ছাঃ) উপমা দিয়ে ছোট্ট একটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন, ‘দলচ্যুত ভেড়াকে নেকড়ে বাঘে খায়’ (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১০৬৭)। এত হুঁশিয়ারী ও এত সাবধান বাণীর পরও মুসলিম জাতির ঐক্যে চরম ফাটল ধরেছে। এক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতি বিভিন্ন মাযহাব ও ফের্কাবন্দীতে শতধাবিভক্ত হয়ে মহান আল্লাহর আদেশ ও নবী করীম (ছাঃ)-এর শাশ্বত বাণীর প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। এর ফলে পবিত্র কুরআনের আদেশ-নিষেধ পালনের প্রতি আর গুরুত্ব নেই। নবী করীম (ছাঃ)-এর তরীকাভুক্ত আমলও দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ নবী করীম (ছাঃ)-এর তরীকা বহির্ভূত আমল দ্বারা নাজাত লাভের যে সম্ভাবনা নেই একথা মনে হয় আর কোন মানুষের মনে উদয় হয় না। নবী করীম (ছাঃ)-এর তরীকা বহির্ভূত আমলের একটি উদাহরণ দেওয়া আবশ্যক মনে করছি।
আমরা সবাই জানি, ওযূ ছাড়া ছালাত হয় না’ (আবূদাঊদ, তিরমিযী, দারেমী, মিশকাত হা/৩০০)। ওযূ শুদ্ধ না হ’লে ছালাতও শুদ্ধ হবে না। বিশুদ্ধ হাদীছ মোতাবেক ওযূ করতে পূর্ণ মাথা একবার মাসাহ করতে হবে। অথচ অনেক আলেম ও অধিকাংশ মুছল্লীকে ওযূ করতে ৩ বারে মাথার ১/৩ অংশের বেশী মাসাহ করতে দেখা যায় না।
সূদকে আল্লাহপাক হারাম করেছেন এবং ব্যবসাকে হালাল করেছেন (বাক্বারাহ ২৭৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শর্ত সাপেক্ষে ব্যবসা করাকে একটি উত্তম ইবাদত বলে গণ্য করেছেন। শর্তগুলো- ব্যবসায়ী পণ্যে ভেজাল না দেওয়া, ওযনে কম না দেওয়া ও অধিক মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যশস্য দীর্ঘদিন ধরে গুদামজাত করে না রাখা। অথচ আমরা বাস্তবে এগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করতে দেখি। ভেজাল ছাড়া কোন পণ্য নেই বললেই চলে।
সূদদাতা, সূদ গ্রহণকারী, সূদের দলীল লেখক ও সাক্ষী সবাইকে সমান পাপী ঘোষণা করা হয়েছে (মুসলিম হা/২৮০৭)। সূদকে মারাত্মক পাপ জানা সত্ত্বেও সূদের সাথে জড়িত নয়, এমন ব্যক্তি বিরল। রেডিওতে প্রতিদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা, যৌতুকের বিরুদ্ধে নাটক, নাটিকা ও বক্তব্য শোনা যায়। অথচ ৮৫% মুসলিম অধ্যুষিত দেশে একবারও সূদ যে মারাত্মক পাপ ও এর পরিণতি যে ভয়ানক সে সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না।
মানুষ আজ যেমন সূদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়েছে, তদ্রূপ নিমজ্জিত হয়েছে গান-বাজনাতে। টিভি, ভিসিআর ইত্যাদি অত্যাধুনিক গান-বাজনার উপকরণ মুসলিম পরিবারের ঘরে ঘরে। এগুলোর অশালীন কথোপকথন ও নৃত্য যুবক-যুবতীদেরকে অবৈধ যৌন কাজে উৎসাহিত করে। এ ব্যাপারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। নইলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।
ইসলামে পর্দার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পর্দাপ্রথা একেবারে শিথিল। আধুনিক শিক্ষিত সমাজ পর্দা প্রথার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তারা পর্দার কুফল ও অসারতা সম্বন্ধে বক্তব্য দিয়ে থাকে।
আল্লাহপাক অপব্যয় করতে নিষেধ করেছেন। যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৭)। আজ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র অপব্যয়ের ছড়াছড়ি। ব্যক্তিগত অপচয়ের মধ্যে ধূমপান অন্যতম। ৮৫% মুসলিম পুরুষ এ অপব্যয়ের শিকার। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হ’তে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ধূমপান করা হারাম সাব্যস্ত হবে। আল্লাহপাক আহারে হারাম-হালাল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহপাকের এ নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে মুসলিম জনগণ অমুসলিম জনগণের সাথে মিশে গেছে। তাদের যে পরিণতি হবে, মুসলিম হ’লেও একই পরিণতি হবে।
ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল ঈমান। আমাদের ঈমানে ঘাটতির ফলে আমরা ইসলামের অধিকাংশ বিধান হ’তে দূরে সরে গেছি। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হ’লে আমরা নারী-পুরুষ একত্রে বল্গাহীন অবস্থায় বিচরণ করতে পারি না। হে আল্লাহ! একমাত্র আপনিই আমাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি হ’তে না ফিরালে আমাদের আর ইসলামী যিন্দেগীতে ফিরে আসা সম্ভব নয়। কারণ আপনি হেদায়েতের একমাত্র মালিক। আপনার হাতেই সবকিছুর চাবিকাঠি রয়েছে। তাই একমাত্র আপনার সমীপে আরয, আপনি মুসলিম জাতিকে নতুন করে হেদায়েত দান করুন। আমীন!
মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
সন্ন্যাসবাড়ী, বান্দাইখাড়া, নওগাঁ।