[দিনাজপুরের
কৃতি সন্তান প্রফেসর ড. আফতাব আহমদ রহমানী (১৯২৬-১৯৮৪) রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগ (১৯৬২) এবং আরবী বিভাগের (১৯৭৮) প্রতিষ্ঠাতা
সভাপতি। তিনি ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস’-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও ঢাকা
থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘তর্জুমানুল হাদীছ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ৪ঠা জুন
১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা কাফী ছাহেবের মৃত্যুর পর জুলাই ১৯৬০
থেকে নভেম্বর ১৯৬১ পর্যন্ত তিনি এককভাবে এবং ডিসেম্বর ১৯৬২ থেকে
আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ পর্যন্ত মাওলানা আব্দুর রহীম এম.এ.বিএলবিটি-এর সাথে
যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি
এবং ১৯৭০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন থেকে আরেকটি পিএইচ.ডি ডিগ্রী
অর্জন করেন। তাঁর পিএইচ.ডি থিসিসটির শিরোনাম ছিল, ''The life and works of
Ibn Hajar al-Asqalani : accompanied by a critical edition of certain
sections of Al-Sakhawi's Al-Jawahir wa Al-Durar'' যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ কর্তৃক ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. রহমানীর
‘প্রগতি ও সংকট’ শীর্ষক নিবন্ধটি মাসিক ‘তর্জুমানুল হাদীছ’ পত্রিকার ৯ম
বর্ষ ৭ম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬০-এ সাময়িক প্রসঙ্গ তথা সম্পাদকীয় কলামে
প্রকাশিত হয়। বৈশ্বিক অশান্তি ও অনৈতিকতার স্রোতে নিমজ্জিত সমাজ ব্যবস্থার
ভঙ্গুর চিত্র ফুটে উঠেছে অত্র নিবন্ধে। এথেকে উত্তরণের উপায় যে পূর্ণরূপে
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, তাঁর সাহসী ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে এ
নিবন্ধে। প্রবন্ধটি ৬০ বছর পূর্বে লিখিত হ’লেও বর্তমান জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এর আবেদন প্রাসঙ্গিক। সেকারণ প্রাচীন বানানরীতি ও
সাধু ভাষা অক্ষুণ্ণ রেখে হুবহু তা মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর পাঠকবৃন্দের জন্য
পত্রস্থ করা হ’ল- সম্পাদক।]
আধুনিক জগত জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে অভাবনীয় উন্নতি লাভ করিয়াছে। জ্ঞানরাজ্যের পরিধি ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করিতেছে, প্রকৃতির অনুদ্ঘাটিত বহুবিধ রহস্যের দ্বার একের পর এক উদ্ঘাটিত হইয়া চলিয়াছে। মানুষের জীবন যাত্রার শতবিধ অসুবিধা দূরীভূত করিয়া সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম ও আয়াস এবং শান্তি ও সমৃদ্ধির সহস্র উপকরণ এখন তাহার হাতের মুঠায় আসিয়া গিয়াছে। ধরণীর বুকে এই অর্জিত সাফল্য মানুষকে এখন আকাশের দিকে অগ্রসর হওয়ার উৎসাহ ও অনুপ্রাণনায় উদ্দীপিত করিয়া তুলিয়াছে। চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহে মানবীয় আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখাও শুরু হইয়া গিয়াছে।
কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানে এই অপরিসীম প্রগতি মানুষকে কোথায় লইয়া চলিয়াছে? আরাম-আয়াস এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সহজলভ্য উপকরণের বিপুল সম্ভার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোক-উদ্ভাসিত তথ্যাবলী সত্যই কি মানুষকে সামগ্রিকভাবে অনাবিল শান্তি এবং প্রকৃত পরিতৃপ্তির সন্ধান দিতে পারিয়াছে?
সকলের মুখ হইতেই দ্বিধাহীন কণ্ঠে, অকুণ্ঠ ভাষায় জওয়াব আসিবে এক দ্ব্যর্থহীন ‘না’। জ্ঞান রাজ্যের বহু বিস্তৃত পরিধি এবং বিজ্ঞানের নবাবিষ্কৃত সহস্রবিধ তথ্যাবলী ও দ্রব্যসম্ভার মানুষের মনে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির আগুনকেই প্রজ্বলিত করিয়া তুলিয়াছে। বিশ্বজগত ও প্রকৃতি রাজ্যের স্রষ্টা ও নিয়ামক, মানুষের চরম ও পরম প্রভু আল্লাহ রাববুল আলামীনের উপর মানুষ বিশ্বাস হারা এবং পরম সত্তার চরম কেন্দ্র হইতে বিচ্যুত হইয়া দিগভ্রান্ত পথিকের ন্যায় মরীচিকার পশ্চাতে ছুটিয়া মরিতেছে। সুখ ও শান্তির আশায় এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষের দল দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় যেদিকেই ধাবিত হয়- সীমাহীন বালুকার উপর বিকীরিত সূর্যরশ্মির প্রাচন্ডিক প্রখরতা তাঁহাকে জ্বালাইয়া পুড়াইয়া ছারখার করিয়া দেয়।
সঙ্কট কেন?
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উক্ত প্রগতি মানুষকে শান্তির পরিবর্তে এই সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্তে কেন এবং কেমন করিয়া নিক্ষেপ করিল?
এই প্রশ্নের জওয়াব পাশ্চাত্যের বিখ্যাত সমাজ তত্তববিদ P.A. Sorokin এর নিকট হইতে শোনা যাক। তিনি তাঁহার বিখ্যাত পুস্তক The Crisis of Our Age গ্রন্থে বলেন, ‘ন্যায় ও অন্যায়, সত্য ও অসত্যের উপর মানুষের যদি দৃঢ় আস্থা না থাকে, সে যদি পরম সত্তা আল্লাহর উপরই বিশ্বাস হারাইয়া ফেলে, নৈতিক বাধ্যবাধকতার কোন মূল্যই যদি তাঁহার নিকট না থাকে এবং সর্বোপরি দৈহিক ক্ষুধার অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা যদি তাহার মনে প্রাধান্য বিস্তার করিয়া বসে, তাহা হইলে অপর মানুষের প্রতি তাঁহার আচরণ কিসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হইবে? অদম্য ভোগ লালসাই তখন তাহার প্রভু সাজিয়া বসিবে। এই পরিস্থিতিতে সমস্ত যুক্তি যৌক্তিকতা এবং নৈতিক চাপ এমনকি মানব সুলভ সাধারণ জ্ঞানটুকুও সে তখন খোয়াইয়া বসে। অপরের স্বার্থ, কল্যাণ এবং অধিকারের সীমালঙ্ঘনের কার্যে কোন্ বস্ত্ত তাহাকে নিরত রাখিবে?
জৈব ক্ষুধার পরিতৃপ্তির জন্য তাহার অগ্রগতিকে কে রোধ করিবে?... এইরূপ ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মানুষের সমবায়ে গঠিত সমাজের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি দাঁড়াইবে পারস্পরিক সংগ্রাম- দ্বন্দ্বের পর দ্বন্দ্ব; ব্যক্তির সহিত ব্যক্তির, পরিবারের সহিত পরিবারের, শ্রেণীর সহিত শ্রেণীর, জাতির সহিত জাতির বিরামহীন, আপোষহীন সংগ্রাম’।
সঙ্কট ও সমস্যার ভয়াবহতা :
এই সংগ্রাম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে যেমন অশান্তি বিক্ষুব্ধ করিয়া রাখিয়াছে, তাহার সমষ্টি জীবনকেও তেমনি বিষায়িত করিয়া তুলিয়াছে। শান্তি যেন ধরা বক্ষ হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিয়াছে। সঙ্কটের পর সঙ্কট মানবজীবনকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছে। মানুষের দেহ ও মন উভয়ই সাঙ্ঘাতিকভাবে আক্রান্ত, একটি অঙ্গও এই ক্ষয়িষ্ণু রোগের অপ্রভাব হইতে মুক্ত নয়, হৃদযন্ত্রের প্রতিটি অংশ, শিরা-উপশিরা, ধমনি-উপধমনী, মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা আজ বিকলিত ও বিকারগ্রস্ত। উহার পরিণতির ভয়াবহতা আমাদের চোখের সম্মুখে দেদীপ্যমান। পুনঃ মিঃ পি এ, সরোকিনের ভাষায় বলিতে হয়,
We are in the midst of an enormous conflagration-burning every thing into ashes. In a few weeks millions of human lives are uprooted, in a few hours century old cities are demolished, in a few days kingdoms are erased. Red human blood flows in broad streams from one end of the earth to the other. Ever expanding misery spreads its gloomy shadow over larger and larger areas. The fortunes, hapiness and comport of untold millions have disappeared, peace, security and safety have vanished, prosperity and well being have become in many countries but a memory; freedom a mere myth. Western culture is covered by a blackout. A great tornado sweeps over the whole mankind (The Crisis Of Our Age, p. 14-15).
‘আমরা এক সর্বগ্রাসী দাবানলের মধ্যে অবস্থানরত। এই দাবানল সমস্ত পোড়াইয়া ভস্মে পরিণত করিয়া দিতে উদ্যত। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ধ্বংস লীলায় লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান ধরাবক্ষ হইতে নির্মূল, কয়েক দিবসেই রাজ্যের পর রাজ্য বিধ্বস্ত এবং কয়েক ঘণ্টায় শতাব্দী-প্রাচীন শহর জনপদ ধূলিসাৎ হইয়া যাইতেছে। পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মানুষের দেহ-ক্ষরিত রক্ত স্রোতের প্রশস্ত রক্তিম নদী প্রবাহিত, ক্রমবিস্তারশীল অভাব ও দারিদ্র্য বৃহৎ হইতে বৃহত্তর ইলাকায় উহার কৃষ্ণছায়া প্রসার-কার্যে রত। সুখ, শান্তি এবং সৌভাগ্য কোটি কোটি গৃহ হইতে চিরতরে নির্বাসিত, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিহ্ন। কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বহু দেশেই অতীতের অস্পষ্ট স্মৃতিতে পর্যবসিত, স্বাধীনতা এক পুরা কাহিনীতে পরিণত, পাশ্চাত্য কৃষ্টি ঘোর তমসায় সমাচ্ছন্ন। সমগ্র মানব জাতি এক মহা ঘূর্ণিবাত্যার কবলে নিপতিত’!
উপায়, কর্তব্য ও দায়িত্ব :
নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যের এই ঘোর অমানিশায় আশার আলোক কোথায়? জল, স্থল ও নভোমন্ডলে ব্যাপ্ত প্রায় সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের আশঙ্কিত মহাবিধ্বস্তির কবল হইতে রক্ষার উপায় কি? বিভিন্ন মহল হইতে সঙ্কট ত্রাণের বহুবিধ নোস্খার বিবরণ ও প্রচারণা শ্রুতিগোচর হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে জটিলতার গ্রন্থি ক্রমেই বাড়িয়া চলে।
পাকিস্তান ইসলামের যে মহা জ্যোতি-প্রভা নূতনভাবে প্রজবলিত করিয়া এই সূচিভেদ্য অাঁধার অপসারণের দায়িত্ব গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিয়াছিল- তাহা মিথ্যা ছিল না। দুনিয়ার অন্য কোন মতবাদ নয়- একমাত্র ইসলামই দুনিয়াকে শেফা ও রহমতের আবে হায়াত রোগমুক্তি এবং শান্তি ও কল্যাণের সঞ্জীবনী অমৃতের দ্বারা রোগজীর্ণ, জ্বরগ্রস্ত ও বিকলাঙ্গ দুনিয়ার হতাশ মানব সমাজকে নব জীবনের নূতন আশায় উদ্দীপিত করিয়া তুলিতে পারে।
কিন্তু পাকিস্তানীদের ভিতর পাশ্চাত্যের অভিশপ্ত কৃষ্টির ক্রমপ্রসারতা এবং স্বীয় ঐতিহ্য ও তমদ্দুনের প্রতি ক্রমবর্ধমান উপেক্ষা উক্ত আশার বাস্তবায়নের সম্ভাবনাকে মিথ্যায় পর্যবসিত অথবা সুদূর পরাহত করিয়া রাখিতেছে। জাগ্রত খাঁটি পাকিস্তানী এবং ইসলামপন্থী মুসলমানদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়ার সময় অতিক্রান্ত হইয়া যাইতেছে।
[পাকিস্তান জন্মের মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই কিভাবে নেতারা লক্ষ্যচ্যুত হয়েছিলেন, লেখাটিতে তার নমুনা পাওয়া যায়। নেতারা সর্বদা জনগণের বিপরীত চলেন, তার বাস্তব প্রমাণ রয়েছে এতে। বাংলাদেশের জনগণ তারাই, যারা পাকিস্তান এনেছিল বড় স্বপ্ন নিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের নেতাদের কর্তব্য, তাদের জনগণের প্রাণের দাবী, দেশে পূর্ণভাবে ইসলাম কায়েম করা (স.স.)]