বিশিষ্ট
ব্যবসায়ী ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান মৃত্যুবরণ করেছেন।
গত ১লা জুলাই বুধবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিজ বাসভবনে তিনি মৃত্যুবরণ
করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। এদিন বাদ এশা ঢাকার গুলশান আজাদ
মসজিদে তাঁর জানাযা ছালাত অনুষ্ঠিত হয় এবং বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
১৯৭২ সালে ব্যবসায়ী দাদা খান বাহাদুর ওয়ালিউর রহমান এবং পিতা খান বাহাদুর মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণে মাত্র ৫ জনকে সাথে নিয়ে ব্যবসায় নামেন লতিফুর রহমান। শুরু থেকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজের মেধা, স্বকীয়তা, নৈতিকতা ও পরিশ্রম দিয়ে ট্রান্সকম গ্রুপ গড়ে তোলেন। বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। যার বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ সাড়ে তিন হাযার কোটি টাকার বেশী। গ্রুপটিতে এখন প্রায় ১৭ হাযার কর্মী আছেন। আর পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন আরও লাখ খানেক মানুষ।
তাঁর মৃত্যুতে সমসাময়িক ব্যবসায়ী মহল থেকে তার ব্যাপারে অনেক শিক্ষণীয় মন্তব্য উঠে এসেছে। যেমন :
(১) স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, তিনি নিজেকে বড় করার চেয়ে প্রতিষ্ঠানকে বড় করে তোলার প্রতি ছিলেন বেশী আগ্রহী। এ কারণে নিজে কখনো পাদপ্রদীপে থাকতে চাইতেন না। সবসময় আড়ালে থেকে প্রতিষ্ঠানকে বড় করেছেন।
(২) এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে আজাদ বলেন, ব্যবসার প্রয়োজনে কখনো অনৈতিক সুবিধা তিনি যেমন নেননি, দেনওনি। পত্রিকা প্রকাশের পরামর্শ চাইতে গেলে লতিফুর রহমান তাকে বলেছিলেন, বিজ্ঞাপনের জন্য কাউকে অনুরোধ করা যাবে না। পত্রিকায় বস্ত্তনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশিত হ’লে বিজ্ঞাপন এমনিতেই আসবে।
(৩) বিকেএমইএ-এর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণের পরিশীলতা সারা জীবনই আমাকে ভাবিয়েছে। কখনো তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। এত স্নেহ করতেন যে মাঝে মাঝে বিব্রতই হ’তাম। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, নীতিনিষ্ঠতা ও আদর্শ অনুসরণ করে দেশের ব্যবসায়ীরা আরও এগিয়ে যাবেন, এটাই আমার চাওয়া।
(৪) অ্যাপেক্স গ্রুপ-এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী লিখেছেন, লতিফুর রহমানের চরিত্রের একটি অসামান্য দিক ছিল সততা। এক নম্বর হওয়ার ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না। তার সঙ্গে আমি অনেক ভ্রমণ করেছি। তিনি কাউকে খরচ করতে দিতেন না। সব সময় নিজেই আগে বিল দিয়ে দিতেন। নীচু মানসিকতা বা কৃপণতা তাঁর মধ্যে একেবারেই ছিল না। ক্ষমতা বা টাকা অনেক সময় মানুষের মধ্যে দম্ভ ও অহমিকার জন্ম দেয়। লতিফুর রহমানের মধ্যে তা বিন্দুমাত্র ছিল না।
(৫) অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, তার যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে বেশী মনে থাকবে সেটি হ’ল, মানুষের সঙ্গে তাঁর অসাধারণ ব্যবহার। তিনি মানুষের মাঝে কখনো কোন ভেদাভেদ করতেন না। সবার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতেন।
(৬) ঢাকা চেম্বার-এর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি যে প্রকল্পই নেন, তাতে সফল হন কীভাবে? জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রথমেই ব্যবসাটি বোঝার চেষ্টা করি। ব্যবসাটি চালু পর্যন্ত আমি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকি। চালু হয়ে গেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য পরিচালকদের হাতে ছেড়ে দিই। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাঁরাই স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করেন।
(৭) সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান লিখেছেন, যতবার তার মুখোমুখি হয়েছি ততবারই তার বিনয়াবনত আচরণে মুগ্ধ হয়েছি। একজন মানুষ এত কিছুর কর্ণধার হয়েও কীভাবে নিরহংকার ও বিনয়ী থাকতে পারেন এর অন্যতম দৃষ্টান্ত লতিফুর রহমান। সততা বজায় রেখে কীভাবে ব্যবসায় সফল হ’তে হয় এরও অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। সব কিছুর চেয়েও তার বড় অর্জন মনে করি ট্রান্সকম গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মীদের অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন।
(৮) ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবূবুর রহমান বলেন, লতিফুর রহমান বিপুল অর্থ আয় করেননি। তবে তিনি যেটা আয় করেছেন, সেটা হ’ল ভাবমূর্তি।
(৯) লতিফুর রহমানের মালিকানাধীন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আমার লেখালেখির কারণে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ থেকে বাদ দেন। কিন্তু এ নিয়ে লতিফুর রহমান আমাকে কখনোই কিছু বলেননি। এমনকি রসিকতার ছলেও নয়।
(১০) প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, লতিফুর রহমান সব সময় আগে সালাম দিতেন। একদিন তিনি হঠাৎ অফিসে এলেন। একজন সাধারণ কর্মচারীকে সালাম দিলেন। আগে সালাম দিতে না পারায় ঐ কর্মচারী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
(১১) প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, লতিফুর রহমান ছিলেন একজন আদর্শ সংবাদপত্র-উদ্যোক্তা। তিনি সব সময় প্রথম আলোকে বড় স্বপ্ন দেখতে, বড় পরিকল্পনা করতে, বড় কাজে হাত দিতে উৎসাহ জুগিয়ে যেতেন। বিপুল বিনিয়োগের চাপ সামলাতেন। সম্পাদকীয় স্বাধীনতার প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম আস্থা ও বিশ্বাস। মতি ভাই (মতিউর রহমান) বহুদিন বক্তৃতায় বলেছেন, তিনি প্রথম আলোর সম্পাদক আর মাহফুজ আনাম, ডেইলী স্টারের সম্পাদক হ’লেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন সম্পাদক। আমরা যারা প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে জড়িত, তারা একবাক্যে এই কথাকে সমর্থন দেব। মালিকপক্ষ থেকে কোনদিন সামান্যতম হস্তক্ষেপও করা হয়নি। কোন দিন কাগজে কী ছাপা হবে বা হয়েছে, তা নিয়ে তারা কথা বলেননি। জনাব লতিফুর রহমান এবং ট্রান্সকম সব সময়েই থেকেছেন নক্ষত্রের দূরত্বে। কিন্তু কর্মীদের এবং পত্রিকার ভালোর জন্য যে সমর্থন, সহযোগিতা ও বরাদ্দ দরকার, তা সব সময়ই নিজের থেকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন।
তিনি বলতেন, আপনাদের প্রত্যেকের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান আছে, পসন্দ-অপসন্দ আছে। কিন্তু যখন আপনি কাগজে লিখবেন, তখন আপনি নিরপেক্ষ। রিপোর্ট হ’তে হবে বস্ত্তনিষ্ঠ ও দলনিরপেক্ষ। তিনি বারবার মনে করিয়ে দিতেন সততার কথা। প্রথম আলোর কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যেন অসততার কোন অভিযোগ না ওঠে।
লতিফুর রহমান যদিও কোনদিন জানতেও চাননি প্রথম আলোয় কী ছাপা হবে না হবে। ঐ দায়িত্বটা সম্পাদকের হাতে দিয়ে তিনি থাকতেন নক্ষত্রের দূরত্বে, কিন্তু ঝড়-ঝাপটা সবচেয়ে বেশী পড়ত গিয়ে বড় গাছটার ওপরে।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি ও তাঁর পরিবার ছিল সৌজন্যের প্রতিমূর্তি। আমরা কেউ কোন দিন তাঁকে আগে সালাম দিতে পারিনি। আমাদের অফিস সহকারীরাও তাঁকে আগে সালাম দিতে পারেননি। তিনি আগে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেন। হোলি আর্টিজানে তার সবচেয়ে প্রিয় নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন মারা যাওয়ার দিন রাত ১২-টায় আমি গুলশানে তাঁর বাড়িতে গেলাম। তাঁরা আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, আসুন, ডাইনিং টেবিলে বসুন। তারপর সোজা নিয়ে গেলেন খাবার টেবিলে। আলো জ্বেলে আবার খাবার দেওয়া হ’ল। আমার মনে আছে, তিনি আমার প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছিলেন। আমরা তো সেই মর্মান্তিক প্রসঙ্গে তুলতে পারছিলাম না। শোকস্তব্ধ ঐ রাতেও তিনি নিজে গেটের বাইরে এসে আমাদের বিদায় দিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন।
২০১৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ঢাকাস্থ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত এক উদ্যোক্তা-উন্নয়নবিষয়ক অনুষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশ্যে লতিফুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মীই একেকজন উদ্যোক্তা। পুঁজি বা টাকা হয়তো আপনার নয়, হ’তে পারে এটা প্রতিষ্ঠানের। যদি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা বলে বিশ্বাস করেন, উদ্যোগী মনোভাব আপনার মধ্যে আসবে। আর যদি ভাবেন আমি একজন নিছক কর্মচারী, বেসরকারী চাকরী করি, আমার দায়িত্ব হ’ল ৯-টার সময় অফিসে যাওয়া আর ৫-টার সময় বাড়ি ফেরা, তাহ’লে আপনি নিজে যেমন সফল হ’তে পারবেন না, তেমনি আপনার সম্ভাবনার দিকগুলোও অজানা থেকে যাবে। আমরা যাঁরা ব্যবস্থাপক বা চাকরিদাতার ভূমিকায় আছি, এখানে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। কর্মীর উদ্যোগী মনোভাব কাজে লাগাতে আমরা তাঁকে কতটা কর্তৃত্ব বা স্বাধীনতা দিচ্ছি?
আমার অনেক সহকর্মী ৩০-৪০ বছর ধরে আমার সঙ্গে আছেন। তার মানে হয়তো তাঁরা এমন কিছু পেয়েছেন, যে সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য হ’ল, আমরা পদ অনেক সময় দেই, কিন্তু কর্তৃত্ব কতটুকু দেই, সেটা একটা প্রশ্ন। আর যেকোন পর্যায়ের কর্মীকে তার কাজের প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। প্রতিদান দেওয়ার পাশাপাশি আপনাকে অর্থবহ ক্ষমতায়নও করতে হবে। তার কাজের গন্ডির মধ্যে অবশ্যই তার নিজের কর্তৃত্ব থাকতে হবে। অর্থনৈতিক চাহিদা মানুষের আছে। কিন্তু কাজের সন্তুষ্টি আসবে তখন, যখন সে সত্যিকার কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে। তাকে ঐ পেশাগত সন্তুষ্টি দিতে হবে। আর অবশ্যই প্রত্যেককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। কেউ কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন মানে এই নয়, তিনি তার সম্মান সমর্পণ করেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কিন্তু অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার হার খুব কম, বিশেষ করে ওপরের দিকের পদে।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী তাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক বলে আখ্যায়িত করলে তিনি বলেন, বিনয় করে বলছি না, তবে মালিক শব্দটা আমি পসন্দ করি না। প্রথম আলো, ডেইলী স্টার, এসব প্রতিষ্ঠানে কিন্তু আমার কোন অফিস নেই। কোন রুম নেই। আমি এগুলো পরিচালনা করি না। পত্রিকাগুলো পরিচালনা করেন আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মী মতিউর রহমান এবং মাহফুজ আনাম। মালিক শব্দটা আধুনিক ব্যবসার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। তুমি যদি মালিক শব্দটা ব্যবহার কর, তাহ’লে তুমি বাকী সবাইকে উল্টো দিকে ঠেলে দিচ্ছ। মালিক, শ্রমিক বা কর্মচারী, এভাবে ভাবলে চলবে না। আমার শেয়ার আছে, মালিকানা আছে, কিন্তু যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সবাই আমার সহকর্মী। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, উপাচার্য বা অধ্যাপক, যে-ই হন না কেন, সবাই মিলেই ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি গড়েছেন। সবাই সবার সহকর্মী। প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের কাজ করেন। যখনই তুমি মালিক শব্দটা ব্যবহার করবে, তখন তুমি আর টিমওয়ার্ক পাবে না।
[উদ্যোক্তা ও সংগঠকদের জন্য উপরের কথাগুলিতে অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে। আমরা তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করছি (স.স.)]