পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ ।  পর্ব ৮ ।

প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ

ইসলাম মানব জাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। যার প্রত্যেকটি বিষয় আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত অহী। মুমিন তার সার্বিক জীবন পরিচালিত করবে অহি-র বিধান অনুযায়ী। প্রত্যাখ্যান করবে ইবাদতের নামে প্রচলিত মানব রচিত যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকান্ড। বর্তমান মুসলিম সমাজে এমন সব বিদ‘আত বিস্তার লাভ করেছে, যার ফলে ইসলামের প্রকৃত বিধানকেই মানুষ ভুলতে বসেছে। হারিয়ে ফেলেছে ইসলামী চেতনা। গুলিয়ে ফেলেছে ইসলামের বিধানের সাথে মানব রচিত বিধান। এ কারণেই মুসলমানরা আজ শতধাবিভক্ত। ফলে হ্রাস পেয়েছে তাদের শক্তি-সামর্থ্য। মার খাচ্ছে তারা প্রতিনিয়ত। অতএব যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকান্ড ছেড়ে ফিরে আসতে হবে আল্লাহর নাযিলকৃত অহি-র বিধানের দিকে। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্তমান সমাজে বহুল প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ তুলে ধরা হ’ল।-

দিবস সম্পর্কিত বিদ‘আত

(ক) ঈদে মীলাদুন্নবী :

জন্মের সময়কালকে আরবীতে ‘মীলাদ’ বা ‘মাওলিদ’ বলা হয়ে থাকে। সুপ্রসিদ্ধ আরবী অভিধান ‘লিসানুল আরাব’ প্রণেতা ইবনু মানযূর (রহঃ) ‘মীলাদ’ শব্দের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, اسم الوقت الذي ولد فيه ‘মীলাদ হ’ল সেই সময়ের নাম, যে সময় সে জন্মগ্রহণ করেছে’।[1] সুতরাং ‘মীলাদুন্নবী’ অর্থ দাঁড়ায় ‘নবীর জন্মমুহূর্ত’। বর্তমানে ‘মীলাদুন্নবী’ বলতে নবী (ছাঃ)-এর জন্মদিনকে বিশেষ ফযীলতের আশায় বিশেষ পদ্ধতিতে উদ্যাপন করাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এর সাথে ‘ঈদ’ শব্দটি সংযোজনের মাধ্যমে ইসলাম স্বীকৃত মুসলমানদের দু’টি ধর্মীয় ‘ঈদ’ অনুষ্ঠানের সঙ্গে তৃতীয় আরেকটি ‘ঈদ’ সংযোজিত হয়েছে। যার কারণে অন্য দুই ঈদের ন্যায় এদিনেও সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়। মিল, কল-কারখানা, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মসময়কে কেন্দ্র করেই ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ উদ্যাপিত হয়, সেহেতু নিম্নে তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।

(ক) রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মসাল : রাসূল (ছাঃ) কোন্ বছরে জন্মগ্রহণ করেছেন সে সম্পর্কে কায়েস ইবনু মাখরামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, وُلِدْتُ أَنَا وَرَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَامَ الْفِيلِ ‘আমি এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হস্তীর বছরে জন্মগ্রহণ করেছি’।[2]

উল্লিখিত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (ছাঃ) হস্তীর বছর তথা আবরাহা যে বছর হস্তীবাহিনী নিয়ে পবিত্র কা‘বা গৃহ ধ্বংস করতে এসেছিল, সে বছরেই জনমগ্রহণ করেছিলেন। আর সেটা ছিল ৫৭১ খৃষ্টাব্দ।

(খ) রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মবার : রাসূল (ছাঃ)-কে সপ্তাহের প্রতি সোমবারে ছিয়াম পালনের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَوْمٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَىَّ فِيهِ ‘এই দিনে (সোমবারে) আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই আমি নবুঅত প্রাপ্ত হয়েছি বা এই দিনেই আমার প্রতি অহী অবতীর্ণ করা হয়েছে’।[3] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ دَخَلْتُ عَلَى أَبِيْ بَكْرٍ رضى الله عنه فَقَالَ فِيْ كَمْ كَفَّنْتُمُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ فِيْ ثَلاَثَةِ أَثْوَابٍ بِيْضٍ سَحُولِيَّةٍ، لَيْسَ فِيْهَا قَمِيْصٌ وَلاَ عِمَامَةٌ وَقَالَ لَهَا فِيْ أَىِّ يَوْمٍ تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ يَوْمَ الْاِثْنَيْنِ قَالَ فَأَىُّ يَوْمٍ هَذَا قَالَتْ يَوْمُ الْاِثْنَيْنِ-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবুবকর (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হ’লে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা রাসূল (রাঃ)-কে কয় খন্ড কাপড়ে কাফন দিয়েছিলে? তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, তিন খন্ড সাদা সাহূলী কাপড়ে, যার মধ্যে জামা ও পাগড়ী ছিল না। তিনি পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূল (রাঃ) কোন দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন? আয়েশা (রাঃ) বললেন, সোমবার। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি বার? আয়েশা (রাঃ) বললেন, সোমবার।[4]

উপরোক্ত হাদীছদ্বয় প্রমাণ করে, রাসূল (ছাঃ) জন্ম ও মৃত্যুদিন সোমবার। এতে কারো দ্বিমত নেই।

রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মের মাস ও তারিখ : উল্লিখিত ছহীহ হাদীছ সমূহের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মের দিন ও বছর স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হ’লেও তাঁর জন্মের মাস ও তারিখ উল্লেখ করতঃ ছহীহ, যঈফ, জাল কোন হাদীছই বর্ণিত হয়নি। আর এই কারণেই রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মতারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ব্যাপক মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। কারো মতে, তিনি মুহাররম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। আবার কারো মতে সফর মাসে, কারো মতে রামাযান মাসে। কারো কারো মতে রবীউল আওয়ালের ২, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৭ ও ২২ তারিখে রাসূল (ছাঃ) জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে ৮ হ’তে ১২ই রবীউল আউয়ালের মধ্যে ৯ ব্যতীত সোমবার ছিল না। অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর সঠিক জন্মদিবস ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার, ১২ই রবীউল আউয়াল বৃহস্পতিবার নয়। দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা ১২ই রবীউল আউয়াল রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুদিবসেই তাঁর জন্মদিবস বা মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান করছি।

সম্মানিত পাঠক! রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মতারিখ সম্পর্কিত উল্লিখিত মতবিরোধের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় কখনোই ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ উদযাপিত হয়নি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরে ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের যামানাতেও তা পালিত হয়নি। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশা থেকেই যদি ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ উদযাপিত হয়ে আসত এবং ছাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক তা পালনের সিলসিলা জারী থাকত, তাহ’লে তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে কোন মতভেদ হ’ত না। বরং সকল যুগের সকল মানুষের নিকট দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যেত। অতএব ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ ইবাদতের নামে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট নবাবিষ্কৃত কাজ; যা স্পষ্টতই বিদ‘আত।

ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তক : রাসূল (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে ইযামের যামানায় ঈদে মীলাদুন্নবী পালনের কোনই প্রচলন ছিল না। যুগে যুগে শাসকগোষ্ঠী জনসমর্থন লাভের জন্য এহেন অপকর্ম নেই তারা করেনি। ঈদে মীলাদুন্নবী প্রবর্তন এহেন অপকর্মেরই ফসল। ক্রসেড বিজেতা মিসরের সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হিঃ) কর্তৃক নিয়োজিত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্ণর আবু সাঈদ মুযাফ্ফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম ৬০৪ মতান্তরে ৬২৫ হিজরীতে ঈদে মীলাদুন্নবী প্রবর্তনের মাধ্যমে মিথ্যা নবী প্রেমের মহড়া দেখিয়ে জনসমর্থন লাভের চেষ্টা করেছিলেন।[5] প্রতি বছর মীলাদুন্নবীর মওসুমে প্রাসাদের নিকটে তৈরী কমপক্ষে ২০টি খানকায় গান-বাদ্যের আসর বসাতেন। কখনো মুহাররম, কখনো ছফর মাস থেকেই এই মওসুম শুরু হ’ত। মীলাদুন্নবীর দু’দিন পূর্বে থেকেই খানকাহর আশে-পাশে গরু-ছাগল যবহের ধূম পড়ে যেত। কবি, গায়ক, বক্তা সহ অসংখ্য লোক সেখানে ভিড় জমিয়ে মীলাদুন্নবী উদযাপনের নামে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হ’ত। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, গভর্ণর নিজে নাচে অংশ নিতেন। মুইযুদ্দীন হাসান (রহঃ) বলেন, তিনি আলেমদেরকে উপঢৌকন ও চাপ দিয়ে মীলাদের পক্ষে জাল হাদীছ ও বানোয়াট গল্প লিখতে বাধ্য করতেন।[6]

সম্মানিত পাঠক! দেখা গেছে প্রত্যেক যুগেই কতিপয় পেটপূজারী আলেমকে; যারা নিজেদের উদর পূর্তির ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলামকে বিকৃত করেছে এবং সেটাকেই প্রকৃত দ্বীন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছে। তদানীন্তনকালে আবু সাঈদ মুযাফ্ফরুদ্দীন কুকুবুরী কর্তৃক প্রবর্তিত ঈদে মীলাদুন্নবীকেও তথাকথিত কতিপয় নামধারী আলেম নিজেদের উদরপূর্তির জন্য গ্রহণ করেছিল। আজও ঠিক একই কারণে ইসলামের লিবাসধারী কিছু আলেম তা কায়েম রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আজই যদি ঘোষণা দেওয়া হয় যে, মীলাদুন্নবী উদযাপন করা হবে, কিন্তু কোন খাদ্যের আয়োজন করা হবে না। মীলাদ মাহফিল করা হবে, কিন্তু মীলাদ পড়া মৌলভীকে কোন টাকা দেওয়া হবে না। তাহ’লে ঐ সমস্ত মীলাদ পড়ুয়া মৌলভীরাই মীলাদ মাহফিলকে অবলীলায় বিদ‘আত বলে ঘোষণা দিবে। কেননা তারাও জানে যে, আদতেই এ সমস্ত আমলের কোন ভিত্তি ইসলামে নেই।

ঈদে মীলাদুন্নবী-এর হুকুম : ঈদে মীলাদুন্নবী একটি স্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূল (ছাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় কখনোই নিজের জন্মবার্ষিকী পালন করেননি। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ চার সাথী, সংকট মুহূর্তের সঙ্গী, দু’জন শ্বশুর ও দু’জন জামাতা, জীবনের চেয়ে যারা নবী করীম (ছাঃ)-কে বেশী ভালবাসতেন, সেই মহান চার খলীফা দীর্ঘ ত্রিশ বছর খেলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।[7] তাঁরা কখনোই রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে প্রিয়নবীর উদ্দেশ্যে ‘মীলাদ’ অনুষ্ঠান করেননি। ছাহাবায়ে কেরামের পরে তাবেঈনে ইযামের কেউ তা পালন করেননি। এমনকি চার ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর যামানাতেও ঈদে মীলাদুন্নবী-এর কোনই প্রচলন ছিল না। অতএব এটা ইবাদতের নামে নতুন আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এরূপ নবাবিষ্কৃত বস্ত্তকেই বিদ‘আত বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِيْ النَّارِ-

‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম কথা হ’ল আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হেদায়াত। সর্বনিকৃষ্ট কাজ হ’ল (শরী‘আতের মধ্যে) নব আবিষ্কার। আর প্রত্যেক নব আবিষ্কারই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণামই জাহান্নাম’।[8] তিনি অন্যত্র বলেন,  مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ-‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[9]  তিনি আরো বলেন,مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ- ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[10]

ঈদে মীলাদুন্নবী-এর অপকারিতা

(ক) এর মাধ্যমে মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করা হয় : ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের মাধ্যমে মানুষকে বিদ‘আতের দিকে আহবান করা হয়। ফলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত অন্যের পাপের অংশীদার হ’তে হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لِيَحْمِلُوْا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِيْنَ يُضِلُّوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُوْنَ-  ‘ক্বিয়ামত দিবসে তারা তাদের পাপভার পূর্ণমাত্রায় বহন করবে এবং তাদেরও পাপভার বহন করবে, যাদেরকে তারা অজ্ঞতাহেতু বিভ্রান্ত করেছে। সাবধান! তারা যা বহন করবে তা কতই না নিকৃষ্ট’ (নাহল ১৬/২৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا-

‘যে ব্যক্তি কাউকে সৎ পথের দিকে আহবান করে, তার জন্যও সেই পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে যা তাদের অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ এটা তাদের ছওয়াবের কোন অংশকেই কমাবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কাউকে গোমরাহীর দিকে আহবান করে, তার জন্য সেই পরিমাণ গুনাহ রয়েছে, যা তাদের অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ এটা তাদের গোনাহের কোন অংশকেই কমাবে না’।[11]

(খ) এটা রাসূল (ছাঃ)-কে নিয়ে বাড়াবাড়ির অন্যতম মাধ্যম : ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করা হয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে আল্লাহর আসনে বসানো হয়। মীলাদ অনুষ্ঠানে মৌলভী ছাহেব মাথা দুলিয়ে সুরের তরঙ্গ উঠিয়ে ভক্তিরসে গলা ডুবিয়ে আরবী, ফার্সী, উর্দূ, বাংলাতে নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রশংসায় এমন সব কবিতা গেয়ে থাকেন; যার মাধ্যমে প্রমাণ করা হয় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ)। যেমন শুনুন শ্রুতিমধুর উর্দূ কবিতার একটি অংশ-

وه  جو مستوى عرش تہا  خدا ہو كر

اتر يڑا ہے  مدينہ ميں مصطفى ہو كر

ওহ্ জো মুস্তাবী আরশ থা খোদা হো কার্

উতার পাড়া হ্যায় মদীনা মেঁ মোছতফা হো কার্।

অর্থ: আরশের অধিপতি আল্লাহ ছিলেন যিনি, মুছতফা রূপে মদীনায় অবতীর্ণ হ’লেন তিনি’ (নাঊযুবিল্লাহ)

সম্মানিত পাঠক! কেউ যদি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আল্লাহ বলে স্বীকৃতি দেয়, তবে কি সে মুসলিম থাকতে পারে? কখনো না। আপনি নিজে অন্তর থেকে তা স্বীকার না করলেও ঐ সমস্ত মীলাদ পড়ুয়া মৌলভী ছাহেবরা নিজে এ সমস্ত কবিতা পড়ছে এবং আপনাদেরকেও পড়াচ্ছে।

অনুরূপভাবে তাদের প্রতিনিয়ত পঠিতব্য দরূদের প্রথমেই বলা হয়ে থাকে, بلغ العلى بكماله ‘রাসূল (ছাঃ) তাঁর নিজ যোগ্যতায় উচ্চ মর্যাদায় উপনীত হয়েছেন’ (নাঊযুবিল্লাহ)। এই বাক্যের মাধ্যমে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি আল্লাহর রহমতকে অস্বীকার করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর রহমতেই তিনি নবী ও রাসূল হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُ لَهَمَّتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ أَنْ يُضِلُّوْكَ وَمَا يُضِلُّوْنَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّوْنَكَ مِنْ شَيْءٍ وَأَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ عَظِيْمًا-

‘আর যদি তোমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হ’ত, তবে তাদের একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করতে ইচ্ছুক হয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদেরকে ছাড়া পথভ্রষ্ট করেনি। আর তারা তোমার কোন বিষয়ে  ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ (হাদীছ) নাযিল করেছেন। আর তোমাকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা তুমি জানতে না। তোমার প্রতি আল্লাহর অসীম করুণা রয়েছে’ (নিসা ৪/১১৩)

নিম্নে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করার আরো কতিপয় নমুনা পেশ করা হ’ল :

(১) ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতে গিয়ে ‘যিন্দা নবীর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ বলে শ্লোগান দেওয়া হয়। অথচ দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ (আলে-ইমরান ৩/১৮৫)। আর রাসূল (ছাঃ) অবশ্যই প্রাণী ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُوْنَ ‘নিশ্চয়ই তুমি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল’ (যুমার ৩৯/৩০)। তিনি অন্যত্র বলেন, وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُوْنَ ‘আমরা তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করিনি। সুতরাং তোমার মৃত্যু হ’লে তারা কি চিরজীবী হয়ে থাকবে?’ (আম্বিয়া ২১/৩৪)। তিনি আরো বলেন,

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللهُ الشَّاكِرِيْنَ-

‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র; তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়ে গেছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয়, তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? আর কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন’ (আলে-ইমরান ৩/১৪৪)

রাসূল (ছাঃ) যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন তখন তাঁর এই মৃত্যু সংবাদ ওমর (রাঃ) কোন মতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বরং তিনি অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তখন আবুবকর (রাঃ) বলেছিলেন, أَلَا مَنْ كَانَ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فَإِنَّ اللهَ حَيٌّ لَا يَمُوْتُ- ‘যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ইবাদত করতে তারা জেনে রেখ, মুহাম্মাদ (ছাঃ) মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদতকারী ছিলে তারা জেনে রেখ, আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি অমর’। [12] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ قَالَ لَمَّا ثَقُلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم جَعَلَ يَتَغَشَّاهُ، فَقَالَتْ فَاطِمَةُ عَلَيْهَا السَّلاَمُ وَاكَرْبَ أَبَاهُ فَقَالَ لَهَا لَيْسَ عَلَى أَبِيْكِ كَرْبٌ بَعْدَ الْيَوْمِ فَلَمَّا مَاتَ قَالَتْ يَا أَبَتَاهْ، أَجَابَ رَبًّا دَعَاهُ، يَا أَبَتَاهْ مَنْ جَنَّةُ الْفِرْدَوْسِ مَأْوَاهُ، يَا أَبَتَاهْ إِلَى جِبْرِيْلَ نَنْعَاهْ فَلَمَّا دُفِنَ قَالَتْ فَاطِمَةُ عَلَيْهَا السَّلاَمُ يَا أَنَسُ، أَطَابَتْ أَنْفُسُكُمْ أَنْ تَحْثُوْا عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم التُّرَابَ-

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর রোগ প্রকটরূপ ধারণ করল তখন তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। এ সময় ফাতেমা (রাঃ) বললেন, আহ্! আমার পিতার কত কষ্ট! তখন নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, আজকের পরে তোমার পিতার আর কোন কষ্ট নেই। অতঃপর যখন নবী করীম (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করলেন, তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হায়! আমার পিতা! রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায়! আমার পিতা! জান্নাতুল ফেরদাউসে তাঁর বাসস্থান। হায়! আমার পিতা! জিব্রীল (আঃ)-কে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনাই। অতঃপর যখন নবী করীম (ছাঃ)-কে দাফন করা হ’ল, তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হে আনাস! রাসূল (ছাঃ)-কে মাটি চাপা দিয়ে আসা তোমরা কিভাবে বরদাশত করলে? [13] অন্য হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলতেন,

إِنَّ رَسُوْلَ اللهَ صلى الله عليه وسلم كَانَ بَيْنَ يَدَيْهِ رَكْوَةٌ أَوْ عُلْبَةٌ فِيْهَا مَاءٌ، يَشُكُّ عُمَرُ فَجَعَلَ يُدْخِلُ يَدَيْهِ فِيْ الْمَاءِ، فَيَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ وَيَقُوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ثُمَّ نَصَبَ يَدَهُ فَجَعَلَ يَقُوْلُ فِيْ الرَّفِيْقِ الأَعْلَى حَتَّى قُبِضَ وَمَالَتْ يَدُهُ-

নিশ্চয়ই রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে চামড়ার অথবা (বর্ণনাকারী ওমরের সন্দেহ) কাঠের একটি পাত্রে পানি রাখা ছিল। তিনি তাঁর হাত ঐ পানির মধ্যে প্রবেশ করাচ্ছিলেন। অতঃপর তাঁর মুখমন্ডল মাসাহ করছিলেন এবং বলছিলেন, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যু যন্ত্রণা খুব কঠিন। এরপর দু’হাত তুলে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমাকে সর্বোচ্চ বন্ধুর সান্নিধ্যে করে দিন। এ অবস্থাতেই তাঁর জীবন কবয হয়ে গেল এবং তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল’।[14] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَا فِيْ بَيْتِيْ مِنْ شَىْءٍ يَأْكُلُهُ ذُوْ كَبِدٍ، إِلاَّ شَطْرُ شَعِيْرٍ فِيْ رَفٍّ لِيْ، فَأَكَلْتُ مِنْهُ حَتَّى طَالَ عَلَىَّ، فَكِلْتُهُ فَفَنِىَ-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করলেন। এমতাবস্থায় আমার বাড়িতে এমন কিছু ছিল না যা খেয়ে কোন প্রাণী বাঁচতে পারে। শুধুমাত্র তাদের উপর অর্ধ ওয়াসাক যব ছিল। আমি তা হ’তে খেতে থাকলাম এবং বেশ কিছু দিন কেটে গেল। অতঃপর আমি তা মেপে দেখলাম, ফলে তা শেষ হয়ে গেল।[15] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه أَنَّ اللهَ تَعَالَى تَابَعَ عَلَى رَسُوْلِهِ صلى الله عليه وسلم قَبْلَ وَفَاتِهِ حَتَّى تَوَفَّاهُ أَكْثَرَ مَا كَانَ الْوَحْىُ، ثُمَّ تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَعْدُ-

আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ক্রমাগত অহী অবতীর্ণ করতে থাকেন এবং তাঁর মৃত্যুর নিকটবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশী পরিমাণ অহী অবতীর্ণ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।[16] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رضـ أَنَّ أَزْوَاجَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم حِينَ تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَرَدْنَ أَنْ يَبْعَثْنَ عُثْمَانَ إِلَى أَبِيْ بَكْرٍ يَسْأَلْنَهُ مِيْرَاثَهُنَّ فَقَالَتْ عَائِشَةُ أَلَيْسَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ نُوْرَثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, যখন রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করলেন তখন তাঁর স্ত্রীগণ আবুবকর (রাঃ)-এর নিকট তাদের প্রাপ্য উত্তরাধিকার চাওয়ার জন্য ওছমান (রাঃ)-কে পাঠনোর ইচ্ছা করলেন। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, রাসূল (ছাঃ) কি বলেননি যে, আমরা কাউকে ওয়ারিছ বানাই না। আমরা যা রেখে যাই তার সবই ছাদাক্বাহ।[17] অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَمَّا تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَاسْتُخْلِفَ أَبُوْ بَكْرٍ بَعْدَهُ- ‘রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করলেন।  অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-কে

খলীফা নিযুক্ত করা হ’ল।[18] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ لَمَّا مَاتَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم اخْتَلَفُوْا فِيْ اللَّحْدِ وَالشَّقِّ حَتَّى تَكَلَّمُوْا فِيْ ذَلِكَ وَارْتَفَعَتْ أَصْوَاتُهُمْ فَقَالَ عُمَرُ لاَ تَصْخَبُوْا عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم حَيًّا وَلاَ مَيِّتًا أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا فَأَرْسَلُوْا إِلَى الشَّقَّاقِ وَاللاَّحِدِ جَمِيْعًا فَجَاءَ اللاَّحِدُ فَلَحَدَ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ دُفِنَ صلى الله عليه وسلم-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন মৃত্যুবরণ করলেন, তখন ছাহাবায়ে কেরাম তাঁকে লাহাদ ও শাক্ব কবরে দাফন করার ব্যাপারে মতভেদ করল। এমনকি তারা এব্যাপারে বাদানুবাদ শুরু করল ও তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে গেল। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উচ্চকণ্ঠে বাকবিতন্ডা করো না, চাই তা তাঁর জীবিত অবস্থায় হোক অথবা মৃত অবস্থায় হোক। অথবা এ জাতীয় কিছু বললেন। অতঃপর লাহাদ ও শাক্ব উভয় কবর খননকারীর নিকট সংবাদ পাঠালেন। অতঃপর লাহাদ কবর খননকারী আসলেন ও রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য লাহাদ কবর খনন করা হ’ল। অতঃপর তাঁকে দাফন করা হ’ল।[19]

সম্মানিত পাঠক! উপরোক্ত দলীল সমূহের দিকে লক্ষ্য করুন! যেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়েছে। এমনকি জান কবয হওয়ার সময় তাঁর অবস্থা, মৃত্যুর পর ছাহাবায়ে কেরামের অবস্থা এবং তাঁকে কোন ধরনের কবরে দাফন করা হয়েছে তার সবগুলোই স্পষ্ট হয়ে গেছে। উল্লিখিত দলীলগুলি দেখার পরে কোন বিবেকবান মুসলিম ব্যক্তি কি রাসূল (ছাঃ)-কে জীবিত বলতে পারে? কখনোই না। তবে তো পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আয়াত সমূহ ও বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। নাঊযুবিল্লাহ! আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন -আমীন!

(২) মৃত্যুর পরেও রাসূল (ছাঃ) মীলাদ প্রেমীদের ডাকে সাড়া দিয়ে মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। এজন্য সকলেই দাঁড়িয়ে ‘ইয়া নাবী সালামু আলাইকা’ বলে সালাম দিয়ে থাকে। ভাবখানা এমন যেন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর উপস্থিতি সরাসরি অবলোকন করছেন। আর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন।

সম্মানিত পাঠক! ধারণা যদি এরূপই হয় তাহলে সাধারণভাবেই দু’টি বিষয় সামনে এসে যায়। ১- রাসূল (ছাঃ)-কে আগে থেকেই জানতে হবে যে, অমুক বাড়িতে মীলাদ অনুষ্ঠিত হবে। ২- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতি মিনিটে অসংখ্য মীলাদের মাহফিলে তাঁকে প্রায় একই সময়ে উপস্থিত হ’তে হবে।

প্রথমটি গায়েব জানার বিষয়, যা আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِيْ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ وَمَا يَشْعُرُوْنَ أَيَّانَ يُبْعَثُوْنَ-

‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ ব্যতীত আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য বা গায়েবের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না তারা কখন পুনরুত্থিত হবে’ (নামল ২৭/৬৫)। তিনি অন্যত্র বলেন,

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوْءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيْرٌ وَبَشِيْرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ-

‘হে মুহাম্মাদ! বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোন অধিকার নেই, আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে আমি বেশী বেশী ভাল কাজ করতাম। আর আমাকে কোন অকল্যাণ স্পর্শ করতে পারতো না। আমি শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্যে একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা’ (আ‘রাফ ৭/১৮৮)।

তিনি অন্যত্র বলেন, قُلْ لَا أَقُوْلُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَائِنُ اللهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُوْلُ لَكُمْ إِنِّيْ مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوْحَى إِلَيَّ- ‘হে মুহাম্মাদ! তুমি (তাদেরকে) বল, আমি তোমাদের একথা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডার রয়েছে, আর আমি অদৃশ্যের কোন জ্ঞানও রাখি না এবং আমি তোমাদেরকে এ কথাও বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার কাছে যা কিছু অহীরূপে পাঠানো হয়, আমি শুধুমাত্র তারই অনুসরণ করে থাকি’ (আন‘আম ৬/৫০)

আর দ্বিতীয়টি তথা একই সময়ে অসংখ্য স্থানে উপস্থিত হওয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যেখানে রাসূল (ছাঃ) তাঁর জীবদ্দশাতেই কখনো একই সময়ে একাধিক স্থানে উপস্থিত হ’তে পারেননি, সেখানে মৃত্যুর পরে তা কিভাবে সম্ভব হ’তে পারে? অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ ‘মৃত্যুর পরে তাদের সামনে বারযাখ বা পর্দা আছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। অতএব মৃত্যুর পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষ দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে কখনো দুনিয়াতে ফিরে আসতে পারে না, কোন মানুষের উপকার করতে পারে না এবং মানুষের কোন কথাও শুনতে পায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا يَسْتَوِيْ الْأَحْيَاءُ وَلَا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللهَ يُسْمِعُ مَنْ يَشَاءُ وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِيْ الْقُبُوْرِ- ‘আর জীবিতরা ও মৃতরা সমান নয়; নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শুনাতে পারেন, কিন্তু যে ব্যক্তি কবরে আছে তাকে তুমি শুনাতে পারবে না’ (ফাতির ৩৫/২২)। তিনি অন্যত্র বলেন, إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِيْنَ- ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃতকে শোনাতে পারবে না, আর তুমি বধিরকে আহবান শোনাতে পারবে না, যখন তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে চলে যায়’ (নামল ২৭/৮০)

শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন, ‘মীলাদ সমর্থক লোকদের মধ্যে কিছু লোক এমন ধারণা করে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং মীলাদের মাহফিলে হাযির হন এবং সেজন্য তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উঠে দাঁড়ায় (ক্বিয়াম করে)। তাঁকে সালাম জানায় (যেমন, ইয়া নাবী সালামু আলায়কা)। এটাই হ’ল সবচাইতে চরম মূর্খতা ও ভিত্তিহীন কর্ম। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বিয়ামতের পূর্বে কবর থেকে বাইরে আসতে পারবেন না। পারবেন না কোন মানুষের সাথে মিলিত হ’তে কিংবা তাদের কোন মজলিসে যোগদান করতে। তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত কবরেই থাকবেন এবং তাঁর পবিত্র রূহ তাঁর প্রতিপালকের নিকট মহা সম্মানিত ‘ইল্লীঈনে’ থাকবে। যেমন সূরায়ে মুমিনূনে এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, ثُمَّ إِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ، ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ- ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যু মুখে পতিত হবে। অতঃপর তোমরা ক্বিয়ামত দিবসে অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে’ (মুমিনূন ২৩/১৫-১৬)।[20]

সম্মানিত পাঠক! লক্ষ্য করুন কিভাবে মীলাদ মাহফিলের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়। অথচ তিনি নিজেই তাঁকে নিয়ে অতিরঞ্জন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِيْ الدِّيْنِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِيْ الدِّيْنِ- ‘হে মানব সকল! তোমরা দ্বীনের মধ্যে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি থেকে সাবধান থাকবে। তোমাদের পূর্ববর্তীগণ দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে’।[21] তিনি অন্যত্র বলেন, لاَ تُطْرُوْنِيْ كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ- ‘তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেমন ঈসা ইবনু মারইয়াম সম্পর্কে খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি তাঁর (আল্লাহর) বান্দা। তাই তোমরা বলবে, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[22]

[চলবে]


মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরাব ( বৈরুত: দারুছ ছাদের), ৩/৩৬৭ পৃঃ।

[2]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৯২২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩১৫২।

[3]. মুসলিম হা/১১৬২, ‘প্রত্যেক মাসে তিনটি ছিয়াম পালন করা মুস্তাহাব’ অনুচ্ছেদ।

[4]. বুখারী হা/১৩৮৭, ‘সোমবারে মৃত্যুবরণ’ অনুচ্ছেদ।

[5]. ফাহাদ আব্দুল্লাহ, মাওলুদিন নবী, পৃঃ ২।

[6]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মীলাদ প্রসঙ্গ, (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ফেব্রুয়ারী ২০০৮), পৃঃ ৬। গৃহীত : আব্দুস  সাত্তার দেহলভী, মীলাদুন্নবী (করাচী ছাপা, তাবি), পৃঃ ২০, ৩৫

[7]. আলবানী, সিলসিলা ছাহীহাহ হা/৪৫৯।

[8]. নাসাঈ হা/১৫৭৮; সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩৫৩। 

[9]. মুসলিম হা/১৭১৮।

[10]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; মিশকাত হা/১৪০।

[11]. মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮।

[12]. বুখারী হা/৩৬৬৮।

[13]. বুখারী হা/৪৪৬২; মিশকাত হা/৫৯৬১।

[14]. বুখারী হা/৬৫১০; মিশকাত হা/৫৯৫৯।

[15]. বুখারী হা/৩০৯৭;মুসলিম হা/২৯৭৩।

[16]. বুখারী হা/৪৯৮২।

[17]. বুখারী হা/৬৭৩০।

[18]. বুখারী হা/৭২৮৪; মুসলিম হা/২০।

[19]. ইবনু মাজাহ হা/১৫৫৮; সনদ হাসান।

[20]. রিসালাহ ফী হুকমিল ইহতিফাল বিল মাওলিদিন নববী ১/৬৩।

[21]. মুসনাদে আহমাদ হা/৩২৪৮; ইবনু মাজাহ হা/৩০২৯; আলবানী, সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহা হা/১২৮৩।

[22]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।






পুলছিরাত : আখেরাতের এক ভীতিকর মনযিল (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
শারঈ ইমারত - ড. নূরুল ইসলাম
দাঈর সফলতা লাভের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (৪র্থ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
কুরআনের বঙ্গানুবাদ, মুদ্রণ প্রযুক্তি ও ঊনিশ শতকের মুসলিম সমাজে এর প্রভাব - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হজ্জকে কবুলযোগ্য করার উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা (গত সংখ্যার পর) - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.