ভূমিকা :
শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার ব্যাপারে ইসলাম মানুষকে জোর তাকীদ দিয়েছে। অসুস্থ হ’লে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে অসুস্থ হ’লেও চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। আর চিকিৎসার জন্য স্বভাবতই ডাক্তারদের শরণাপন্ন হ’তে হয়। তাই সমাজে ডাক্তারদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাছাড়া ডাক্তারী পেশা ও মানবিকতা একই সুতোয় গাঁথা। কারণ ডাক্তারগণ মানুষের যত বেশী সেবা করার সুযোগ পান, অন্য পেশাজীবীরা ততটা পান না। একজন আদর্শ ডাক্তার মানুষকে সুস্থ করে নিজের ডবল দায়িত্ব হিসাবে দেখেন। একটি দায়িত্ব মানুষ হিসাবে, আরেকটি ডাক্তার হিসাবে। কাজেই একজন ডাক্তারকে আগে ভালো মানুষ হ’তে হয়, তাহ’লে তিনি পরবর্তীতে আদর্শ ডাক্তার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা আদর্শ ডাক্তারের করণীয় ও গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
আদর্শ ডাক্তারের গুরুত্ব ও মর্যাদা :
উসামা ইবনে শারীক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেন,تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ دَوَاءً، غَيْرَ دَاءٍ وَاحِدٍ الْهَرَمُ، ‘তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর, কেননা আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি, শুধু বার্ধক্যরোগ ব্যতীত’।[1] চিকিৎসা যেহেতু অভিজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া সম্ভব নয়, তাই প্রত্যেক এলাকায় প্রয়োজন মোতাবেক কিছু লোকের সাধারণ চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করা যরূরী।[2] সুতরাং সমাজের মেধাবী, আদর্শবান এবং আগ্রহী সন্তানদেরকে এই চিকিংসাবিদ্যায় অনুপ্রাণিত করা উচিত। তবে দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ডাক্তারদের ভিড়েও আদর্শ ডাক্তারের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। অনেক শিক্ষার্থী সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মেডিকেলে পড়াশোনা করলেও পরবর্তীতে আদর্শের পাটাতনে থিতু হ’তে পারে না। প্রতারণা, ধোঁকাবাজি ও লোভ-লালসার উন্মত্ত ঢেউয়ের উপর্যপুরি আঘাত তাদের মানবিকতা ও আদর্শের কিশতিকে টালমাটাল করে দেয়। ফলে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে আদর্শ ও মানবিকতার সীমানা থেকে ছিটকে পড়ে যায় এবং জনজীবনের জন্য কোন উপকারী রসদের যোগান দিতে পারে না। উপরন্তু এই অসাধু ডাক্তারদের অমানবিকতার কাছে মানবজীব যিম্মী হয়ে পড়ে, কখনো তাদের হাতেই নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যে সকল ডাক্তার লোভ-লালসা ও স্বার্থপরতা উপেক্ষা করে শক্ত হাতে দায়িত্বের হাল ধরে থাকেন, তারাই তাদের ত্যাগ, শ্রম ও সেবা দিয়ে মানবজীবনকে নিরাপদ রাখতে সচেষ্ট থাকেন। সমাজে তারাই আদর্শ ডাক্তার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তারাই হয়ে উঠেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমাজের মানুষ আদর্শ ডাক্তারদের মাধ্যমেই চিকিৎসার মৌলিক অধিকার পেয়ে থাকে। তারা যেমন মানুষের অন্তর খোলা দো‘আ পেয়ে থাকেন, পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকেও অঢেল পুরস্কার লাভে ধন্য হন।
আদর্শ ডাক্তারের করণীয় ও গুণাবলী
চিকিৎসা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আদর্শ ডাক্তাররা চিকিৎসার মৌলিক অধিকার পূরণে মানব সমাজে প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং তাদের হাত ধরেই মানবতা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে। নিমেণ আদর্শ ডাক্তারের করণীয় ও গুণাবলী তুলে ধরা হ’ল-
১. পূর্ণ দক্ষতা নিয়ে ডাক্তারী পেশায় আসা :
রাসূল (ছাঃ) খুব সংক্ষেপে, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা আমাদের শিখিয়ে গেছেন। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إنَّ اللهَ تعالى يُحِبُّ إذا عمِلَ أحدُكمْ عملًا أنْ يُتقِنَهُ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পসন্দ করেন, বান্দা যখন কোন কাজ করে বা কোন বিষয় শিখে, তা যেন খুব ভালভাবে করে বা শিখে’।[3] এই হাদীছের মর্মার্থ হ’ল- একজন ছাত্র চিকিৎসা পেশা গ্রহণ করতে চাইলে, তার জন্য কর্তব্য হচ্ছে উক্ত পেশায় পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করা। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হ’তে চাইলে, উক্ত বিষয়ে সে যেন পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে। আধা আধা শিখে কোন কাজ শুরু করা খুবই অন্যায়। একটি প্রবাদ বাক্য আছে, ‘অর্ধেক মোল্লা দ্বীনের জন্য হুমকি আর অর্ধেক ডাক্তার জীবনের জন্য হুমকি’। কারণ আমাদের দেশে এমন অনেক ভুয়া ডাক্তার আছে, যারা তাদের নামের পাশে এমন অনেক চটকদার ডিগ্রি উল্লেখ করেন, যেগুলো বাস্তবে নেই এবং দেশের আইনে যেগুলোর ব্যবহার দন্ডনীয় অপরাধ। এটা একদিকে সহজ-সরল রোগীদের বিভ্রান্ত করছে, অন্যদিকে দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখানো হচ্ছে। আবার অনেকেই বিশেষজ্ঞ না হয়েও ভিজিটিং কার্ড ও সাইন বোর্ডে নিজেকে বিশেষজ্ঞ দাবী করেন। এটাও একটা প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। কেউ কেউ ২/৪ মাসের প্রফেশনাল ট্রেনিংকে দিব্যি ডিগ্রি হিসাবে চালিয়ে দিচ্ছেন। কোন অশিক্ষিত লোকের আইন ভঙ্গ ও শিক্ষিত লোকের আইন ভঙ্গ কিন্তু এক নয়। শিক্ষিত মানুষের আইন ভঙ্গ অনেক গুরুতর অপরাধ। তাই ডাক্তারদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হ’ল পূর্ণ দক্ষতা নিয়ে মানুষের সেবা করা। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَطَبَّبَ، وَلَا يُعْلَمُ مِنْهُ طِبٌّ، فَهُوَ ضَامِنٌ، ‘যে ব্যক্তি চিকিৎসা বিদ্যা অর্জন না করেই চিকিৎসা করবে, সে (রোগীর জন্য) দায়ী থাকবে’।[4]
কারণ চিকিসৎসা শাস্ত্র ও অন্যান্য বিদ্যার মাঝে পার্থক্য হ’ল, এখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। তাই চিকিৎসা শাস্ত্রের কোন অপূর্ণতা নিয়ে মানুষের সেবা করা মানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা। সনদ থাকার কারণে, ভুল চিকিৎসা করে মানুষ মারলে দুনিয়ার আদালতে হয়তো ছাড় পেয়ে যাবে, কিন্তু বিবেকের দংশন ও আখেরাতের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে কখনো মুক্তি পাবে না।
২. রোগীর প্রতি সম্মান করা :
রোগীর প্রতি ডাক্তারের যে দায়িত্ব রয়েছে, এর অন্যতম হচ্ছে রোগীকে সম্মান করা। সম্মান করা মানে রোগীর অভিযোগ ও তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনা। তার রোগ বা তাকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক কোন কথা না বলা। রোগীর প্রতি কোনরূপ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন না করা। অনেক সময় রোগীর জ্ঞানগত যোগ্যতা বা সামাজিক অবস্থান নিচু হওয়ার কারণে অবজ্ঞা করা হয়, তাদেরকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং অধিক হক্বদার গরীব রোগীর চেয়ে সামান্য রোগের ধনী ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা আদৌ কাম্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، ‘কোন মানুষের খারাপ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে’।[5] পবিত্র কুরআনেও বলা হয়েছে,وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ، ‘আর অহংকারবশে তুমি মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালবাসেন না’ (লোক্বমান ৩১/১৮)।
ডাক্তারের খোশকথা দ্বারা উৎফুল্ল হয়ে অনেক সময় রোগীরা প্রশান্তি অনুভব করে। এটাও তাদের ওপর চাপ কমাতে সহায়ক হয়। তাই একজন আদর্শ চিকিৎসক সর্বদা রোগীকে সম্মান দেখিয়ে হাসি মুখে কথা বলেন। এর মাধ্যমে তার ছওয়াবে পাল্লাও সমৃদ্ধ হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ ‘ভাল ভাল কথা বলাও ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত’।[6]
৩. রোগীর দৃষ্টিতে রোগ দেখা :
ইঞ্জিনিয়ার বাড়ী বানাতে ভুল করলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা আছে। বিচারক আদালতে রায় ভুল দিলে উচ্চ আদালতে তা সংশোধনের সুযোগ থাকে। কিন্তু চিকিৎসায় ভুল করলে তা সংশোধনের সুযোগ থাকে না বললেই চলে। তাই কোন অসম্পূর্ণতা নিয়ে রোগী দেখা ঠিক নয়। মানব সেবার নিয়তে চিকিৎসা সেবা দিলে এর দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টি মিলবে। তাই একজন আদর্শ ডাক্তারের উদ্দেশ্য থাকবে মানুষের কল্যাণ সাধন করা এবং সহানুভূতি নিয়ে রোগী দেখা। অর্থাৎ রোগী তার রোগের কারণে মানসিক ও শারীরিকভাবে যতটুকু পেরেশানিতে আছে, তা উপলব্ধি করার অনুভূতি ডাক্তারের মাঝে থাকা। একজন ডাক্তারের কাছে রোগী কী প্রত্যাশা করে, সে অনুযায়ী রোগীর প্রতি খেয়াল করা, মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনা ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো। এর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর নিকটে জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পেতে পারেন এবং নিজেকে তাঁর করুণা লাভের যোগ্য হিসাবেও প্রমাণিত করতে পারেন। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ، ‘তোমরা যমীনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া কর, আকাশের মালিক তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন’।[7] অন্যত্র তিনি বলেন, ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ আদম সন্তানকে ডাক দিয়ে বলবেন,يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِيْ، قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُوْدُكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ، قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِيْ فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِيْ عِنْدَهُ؟ ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা-যত্ন করনি। তখন সে বলবে, হে রব! আমি কিভাবে তোমার সেবা-শুশ্রূষা করব, অথচ তুমি সারা জাহানের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, ‘তুমি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, কিন্তু তুমি তো তার সেবা করনি। এটা কি জানতে না যে, যদি তুমি তার সেবা করতে, তাহ’লে তার কাছেই আমাকে পেয়ে যেতে’।[8]
৪. মহিলাদের চিকিৎসা ও সতরের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা :
মহিলা রোগীর চিকিৎসা মহিলা ডাক্তার দ্বারা করাই উত্তম। তবে সংশ্লিষ্ট রোগের বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তার পাওয়া না গেলে বাধ্যগত অবস্থায় পুরুষ ডাক্তারও চিকিৎসা করতে পারবেন। সেখানে মহিলার কোন অভিভাবক তার সঙ্গে থাকবে। অনুরূপভাবে মহিলা ডাক্তারগণও প্রয়োজনে সতর্কতার সাথে পুরুষ রোগীর চিকিৎসা করতে পারবেন। তবে উভয়েই প্রয়োজনের বেশী দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না এবং স্পর্শ করবে না।[9]
আর চিকিৎসার প্রয়োজনে কারো সতর ও লজ্জাস্থান খোলার দরকার হ’লে শুধু প্রয়োজনীয় অংশ খোলার অনুমতি আছে, এর বেশী নয়। এক্ষেত্রে ডাক্তারদের জন্য যরূরী হ’ল দৃষ্টিকে সংযত রাখা ও সর্বাবস্থায় তাকওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া।[10]
৫. রোগীর কল্যাণ কামনা ও লাভজনক দিককে প্রাধান্য দান :
রোগীর অবস্থা বিবেচনায়, তার সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ডাক্তারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সাধারণ মানুষের ভূমিকা এক্ষেত্রে অন্ধের মতো। তাই একজন ডাক্তারকে আমানতদারী রক্ষা করে চলতে হয়। নির্দিষ্ট রোগের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা না থাকলে আমানতদারীর সঙ্গে তিনি রোগীকে অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। এক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা করবেন না। কেননা রোগী ডাক্তারের কাছে রোগবিষয়ক পরামর্শের জন্য আসে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, المُسْتَشَارُ مُؤْتَمَنٌ ‘যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়, সে আমানতদার’।[11] সুতরাং কোন কিছু ঠিক করে দেয়ার আগে, চিকিৎসা শাস্ত্রের আলোকে এর কার্যকারিতা ও প্রায়োগিক দিকগুলো ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। অপ্রচলিত, অগ্রহণযোগ্য কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। মানহীন কোম্পানীর ওষুধ শুধু কমিশনের লোভে দিলে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে এটা হবে এক ধরনের প্রতারনা।
নিম্নোক্ত বিষয়গুলোও রোগীর কল্যাণ কামনার অন্তর্ভুক্ত হবে-
(ক) লিখিত চিকিৎসা পত্র দেয়া। লেখা হবে স্পষ্ট অক্ষরে। সেখানে ওষুধের পরিমাণ, ব্যবহারের পদ্ধতি, চিকিৎসা গ্রহণের সময় যেসব বিষয় পরিহার করে চলতে হবে ও ওষুধ ব্যবহারের ফলে সাময়িক যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে তা সুস্পষ্ট অক্ষরে লেখা থাকতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ، ‘কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি মুমিন হ’তে পারে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পসন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে’।[12]
(খ) যে বিষয় নিয়ে পড়া-লেখা করা হয়েছে, অর্থাৎ চিকিৎসক যে বিষয়ে দক্ষ ঐ বিষয়ের কোন রোগী এলে চিকিৎসা দিতে কোন কার্পণ্য না করা। বরং সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা ব্যয় করা। যদি নিজের দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহ’লে উপযুক্ত কোন হাসপাতালে স্থানান্তর করা। মনে রাখতে হবে, একজন মানুষের জীবনের মূল্য জগতের কোন বস্ত্ত দ্বারা হ’তে পারে না। তাই অবহেলার কারণে রোগীর কোন ক্ষতি হ’লে ডাক্তার দায়ী হবেন এবং আল্লাহর কাছে তাকে জবাব দিতে হবে। ভাবতে হবে, আল্লাহ যেমন অনুগ্রহ করে আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন, আমারও কর্তব্য হ’ল মানুষের ওপর ইহসান করা।
(গ) রোগীর সার্জারী বা অপারেশন উপযুক্ত স্থানে করা। অর্থাৎ অপারেশন থিয়েটারেই অপারেশন করা। এমন যেন না হয়, অপারেশনের জন্য পর্যাপ্ত যোগান নেই, তারপরও অপারেশন শুরু হয়ে গেল। এটা হবে মানুষ ও মানবতার প্রতি চরম অবহেলা।
(ঘ) রিলিজ দেয়ার উপযুক্ত সময় আসার আগে রিলিজ না দেয়া। অনেক অসাধু বেসরকারী মেডিকেল কর্তৃপক্ষ টাকার নেশায় সময় পার হয়ে গেলেও রিলিজ দিতে চায় না। আবার অনেক সরকারী হাসপাতাল সময়ের আগেই বের করে দেয়। উভয়টাই রোগীর প্রতি অন্যায় ও চরম অবহেলা।
৬. অন্যায় কাজে সহযোগিতা না করা :
চিকিৎসা পেশাতে অন্যায় ও পাপ কাজের অনেক চোরাগলি আছে। সেগুলোর অন্যতম হ’ল- বাচ্চা নষ্ট করা, সার্জারীর মাধ্যমে চেহার বা দেহের আকৃতি পরিবর্তন করা প্রভৃতি। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللهِ وَمَنْ يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِنْ دُونِ اللهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُبِينًا-
‘আমি অবশ্যই তাদের পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেব, তাদেরকে আদেশ দেব যেন তারা পশুর কর্ণ ছেদন করে এবং তাদেরকে আদেশ করব যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে। বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়’ (নিসা ৪/১১৯)।
অত্র আয়াতে সৃষ্টির বিকৃতি বলতে আল্লাহর প্রাকৃতিক সৃষ্টির পরিবর্তন বুঝানো হয়েছে। পুরুষের স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা মহিলাদের গর্ভাশয় তুলে ফেলে তাদের সন্তান জন্মানোর যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করাও এই পরিবর্তনের আওতায় পড়ে। পাশাপাশি মেকআপের নামে ভ্রূর চুল চেঁছে নিজের আকৃতির পরিবর্তন করা, দাত সরু করা এবং চেহারা ও হাতে নকশা করা, উল্কি করা, ট্যাটু লাগানো ইত্যাদিও এর মধ্যে শামিল। এসবই হ’ল শয়তানী কার্যকলাপ, যা থেকে বিরত থাকা যরূরী।
৭. নতুন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করা :
আদর্শ ডাক্তারদের কাজের মাঝে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে, তারা রোগ কমানোর জন্য গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা করবেন। মানুষের শিক্ষার কোন শেষ নেই। বিশেষ করে চিকিৎসার ময়দানে। প্রত্যেক দিন মানব দেহে নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে। তাই প্রত্যেক ডাক্তারের কর্তব্য হচ্ছে নতুন নতুন বিষয় শেখার চেষ্টা করা। কোন কোন ডাক্তার রোগী দেখতেই ব্যস্ত থেকে সময় পার করে দেন। তারা শেখার সুযোগ পান না বা এর জন্য সময় দিতে চান না। এটা কোন সৃজনশীল ও আদর্শ ডাক্তারের বৈশিষ্ট্য হ’তে পারে না।
৮. রোগীর সাথে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি না করা :
রোগী ধনী বা গরীব যাই হোন না কেন তারা অসহায়। আর চরম অসহায় এই মানুষদের পকেটের সব টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য কিছু ডাক্তার, ক্লিনিক, প্যাথলজি, রক্তবিক্রেতা ও নামে-বেনামে ওষুধ কোম্পানী মিলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সারা দেশে তাদের লোভের জাল বিস্তার করে রেখেছে। ইথিকস বিসর্জন দেয়া বেনিয়া ডাক্তাররা রোগীকে কঠিন অসুখের ভয় দেখিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল টেস্ট করাতে বাধ্য করেন। পরে টেস্টের মোট টাকার অর্ধেক তিনি কমিশন পান সংশ্লিষ্ট প্যাথলজি থেকে। কমিশনের বাইরেও তিনি টেস্টের জন্য রোগী পাঠানোর নামে সংশ্লিষ্ট প্যাথলজি থেকে এককালীন সেলামী বাবদ মোটা টাকা পান। এছাড়া এরা বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী থেকে তাদের দামী দামী ওষুধ রোগীর প্রেসক্রিপশনে লেখার জন্য মোটা অংকের সেলামী আদায় করেন। ওষুধ ও কোম্পানী যত ভালই হোক না কেন টাকা না দিলে এসব ডাক্তার সেই ওষুধ কোন দিন রোগীর প্রেসক্রিপশনে লেখেন না। যেখানে একটা বা দুইটা সাধারণ কম দামী ওষুধে রোগীর অসুখ সারতে পারে, সেখানে এসব ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানীর সেলামী হালাল করতে রোগীকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অধিক সংখ্যক দামী ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও শুধু ওষুধ কোম্পানীর বিক্রি বাড়াতে এসব ডাক্তাররা অসহায় রোগীদের বেশী টাকার ওষুধ কিনতে বাধ্য করছেন। এসব ডাক্তাররা অসহায় মরণাপণ্ণ রোগীকে সুস্থ হবে না জেনেও ব্যয়বহুল বেসরকারী হাসপাতালে রেফার করেন স্রেফ কমিশনের জন্য। এরা কমিশনের জন্য রোগীকে সরকারী আ্যম্বুলেন্স রেখে বেসরকারী এ্যম্বুলেন্স ব্যবহারে উৎসাহ দেন। রোগীর অপারেশন দরকার না হ’লেও স্রেফ টাকার জন্য রোগীকে জোর করে অপারেশন করান। সরকারী হাসপাতালে টেস্টের ব্যবস্থা থাকলেও কমিশনের লোভে একজন গরীব রোগীকে ব্যবসায়িক প্যাথলজিতে পাঠান। সর্বশান্ত করেও সুস্থ করতে না পারলে আরো বড় ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানেও রয়েছে কমিশন। বেশী বেশী টাকার এই অসংযত লোভ মানসিক অসুস্থতার একটি বড় লক্ষণ।
আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই ডাক্তাররাই যদি এমন একটা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ থাকেন, তবে আমরা কার কাছে চিকিৎসা নেব? এই মানসিক রোগাক্রান্ত ডাক্তারদের কাছে শারীরিক রোগের সুপরামর্শ পাওয়া দিবা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই হ’তে পারে না।
আমরা সেই সকল ডিগ্রীধারী অসাধু ডাক্তারদের বলতে চাই, সাবধান! আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষের সাথে প্রতারণা করে নিজেদের আখেরাত ধ্বংস করবেন না। দয়া করে অমানবিক হবেন না। কোনরূপ অবহেলা ও লালসার কারণে যদি কোন রোগীর সামান্যতম ক্ষতি হয়, তাহ’লে এর হিসাব অবশ্যই আপনাকে আল্লাহর সামনে দিতে হবে। ডাকাতের হত্যা করা আর ডাক্তারের হত্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ বলেন, مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারু জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদা ৫/৩২)।
আমাদের সবাইকে একদিন মরতে হবে। ক্ষণস্থায়ী এই পার্থিব জীবনে আমরা কয়দিন আর বাঁচব? তাই আসুন! নিজেরদেরকে সংশোধন করে আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখের জন্য এখন থেকে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করি। আল্লাহ যেমন আমাদেরকে সর্বদা তাঁর দয়ার চাদরে আবৃত রাখেন, আমরাও সাধ্যানুযায়ী তাঁর সৃষ্টিকূলের প্রতি দয়া প্রদর্শনে সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন।
দাওয়াতী ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ভূমিকা ও করণীয়
ডাক্তারগণ দাওয়াতী ময়দানে অবদান রাখতে পারেন। সাধারণ দাঈর চেয়ে ডাক্তারদের দাওয়াতের প্রভাব কোন অংশে কম নয়; রবং কোন কোন ক্ষেত্রে দাওয়াতের প্রভাব বিস্তারে ডাক্তারা এগিয়ে থাকতে পারেন। কারণ সুস্থ অবস্থার চেয়ে রোগাক্রান্ত অবস্থায় মানুষের মন অধিক নরম থাকে এবং সৎ চিকিৎসকের যে কোন কথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে প্রস্ত্তত থাকে। এই সুযোগে ডাক্তারগণ যদি চিকিৎসা পরামর্শের পাশাপাশি দ্বীনের কিছু কথা রোগীর সামনে উপস্থাপন করেন, তাহ’লে এটা রোগীর জীবনে মহৌষধের মত কাজ করতে পারে। সেকারণ ডাক্তারী বিদ্যার পাশাপাশি দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান রাখা চিকিৎসকদের জন্যও যরূরী। এতে তারা মানব সেবার পাশাপাশি দাওয়াতী অঙ্গনে নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মানুষদের কাতারে শামিল করতে পারেন। তারা মানবতার কল্যাণকামী শিক্ষক হয়ে একই সাথে আল্লাহর দয়া এবং ফেরেশতামন্ডলী ও আল্লাহর সকল সৃষ্টির দো‘আ লাভে ধন্য হ’তে পারেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرَضِيْنَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الحُوْتَ لَيُصَلُّوْنَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الخَيْرَ، ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণকর জ্ঞান শিক্ষা দেয়, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন এবং তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, আকাশসমূহ ও যমীনসমূহের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তে পিঁপড়া ও পানির মাছ পর্যন্ত তার জন্য দো‘আ করে’।[13] নিমেণ দাওয়াতী ক্ষেত্রে ডাক্তারদের করণীয় ও ভূমিকা তুলে ধরা হ’ল-
১. তাওহীদ বা একত্ববাদের শিক্ষা দেওয়া :
শিরক-বিদ‘আত ও ভ্রান্ত আক্বীদায় নিমজ্জিত এই সমাজের মানুষকে নির্ভেজাল তাওহীদের শিক্ষা দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। ডাক্তারগণ এই ব্যাপারে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। ডাক্তারদের মনে রাখতে হবে যে, তিনি ডাক্তার হওয়ার আগে তার পরিচয় তিনি একজন মুসলিম। আর যে কোন পেশার একজন আদর্শ মুসলিমের করণীয় হ’ল সাধ্যানুযায়ী আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া। তাই রোগীর সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে তার আক্বীদা সংশোধন করে দেওয়া ডাক্তারের কর্তব্য। আর রোগী যদি অমুসলিম হয়, তাহ’লে তাকে ইসলামরে দাওয়াত দিবেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় চাচা আবু ত্বালেবের মৃত্যু শয্যায় ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন।[14]
আনাস (রাঃ) বলেন, মদীনার এক ইহুদী বালক রাসূল (ছাঃ)-এর খেদমত করতেন। সে একবার অসুস্থ হ’লে নবী করীম (ছাঃ) তাকে দেখতে গেলেন। তিনি বালকটির মাথায় হাত রেখে বললেন, أَسْلِمْ ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ কর’। সে তার পাশে অবস্থানরত পিতার দিকে তাকাল। পিতা তাকে বলল, أَطِعْ أَبَا القَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আবুল ক্বাসেমের (রাসূল (ছাঃ)-এর উপনাম) কথা মেনে নাও’। তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখান থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَنْقَذَهُ بِيْ مِنَ النَّارِ، ‘সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তাকে আমার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[15] হ’তে পারে আদর্শ মুসলিম ডাক্তারের কোন এক দাওয়াতে আল্লাহ তাঁর কোন পথভ্রষ্ট বান্দাকে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন। ডাক্তারের জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর এটাই হ’তে পারে আখেরাতে তার নাজাতের অসীলা। ডাক্তাররা শুধু একনিষ্ঠভাবে দাওয়াত দিবেন, আর হেদায়াত দেওয়ার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।
২. আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার দীক্ষা দেওয়া :
মুসলমানরা রোগে-শোকে এবং হর্ষ-বিষাদে একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরশীল থাকেন। তাই ডাক্তাররা রোগীকে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হ’তে অনুপ্রাণিত করবেন যে, তার এই রোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে এবং একমাত্র তিনিই এই রোগের আরোগ্য দাতা। ডাক্তাররা রোগ সারানোর কোন ক্ষমতা রাখেন না, তারা শুধু রোগীর চিকিৎসা-সেবা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং আল্লাহর হুকুমে সেই চিকিৎসা কার্যকর হয় অথবা অকার্যকর হয়। তাহ’লে রোগী ডাক্তার ও ঔষধের উপর ভরসা না করে আল্লাহর উপর ভরসা করবে, যা প্রকৃত মুসলিমের জন্য অবশ্য করণীয়। যেমন ইবরাহীম (আঃ) অসুস্থ হয়ে বলেছিলেন, وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِيْنِ ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন’ (শু‘আরা ২৬/৮০)। আর যেহেতু রোগ আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে, সেহেতু রোগী যেন রোগের ব্যাপারে হতাশ হয়ে রোগকে গালি না দেয়[16] এবং রোগের কষ্টে মৃত্যু কামনা না করে[17] এই মর্মে ডাক্তারগণ রোগীদেরকে অভয় দিবেন এবং আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দো‘আ করার ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহিত করবেন।
৩. আল্লাহভীতি ও ইবাদতের পদ্ধতি শিখানো :
অনেক রোগী আছেন, যারা দ্বীনের বিধান সঠিকভাবে পালন করেন না। অসুস্থ হ’লে তাদের হৃদয়ে অনুতাপের অনুভূতি জাগ্রত হয়। তখন তাদের হৃদয় আল্লাহর দিকে রুজূ হয় এবং দাওয়াত গ্রহণের উপযোগী হয়ে উঠে। আর সেই অনুতপ্ত হৃদয়ে ডাক্তাররা আল্লাহভীতির বীজ বপন করতে পারেন। অনেকেই রোগক্রান্ত হয়েও ইবাদতের বিধি-বিধান না জানার কারণে ইবাদত থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। যেমন অনেক রোগী অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ছালাত আদায় করেন না, আবার কেউ হাসপাতালে বেডে বসে গান শোনে-টিভি দেখে সময় কাটান। তাই ছালাতের আবশ্যকতা, ছালাত পরিত্যাগের পরিণতি, অসুস্থাবস্থায় ওযূ, গোসল, তায়াম্মুম এবং অক্ষম অবস্থায় বসে বা শুয়ে থেকে ছালাত আদায়ের পদ্ধতি ও বিধানগুলো ডাক্তারদের মাধ্যমে শিখলে রোগীরা বেশী প্রভাবিত হন। কোন কোন রোগীর জীবনে ডাক্তারদের দাওয়াতের প্রভাব আজীবন থেকে যায়। তাই ডাক্তারদেরকে চিকিৎসা বিদ্যা চর্চার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় শারঈ জ্ঞান চর্চার প্রতিও মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। এজন্য মেডিকেলের সিলেবাসগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাশাপাশি দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
৪. কালেমার তালক্বীন দেওয়া :
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لَقِّنُوْا مَوْتَاكُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، ‘তোমরা মৃত্যু পথযাত্রীকে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই) তালক্বীন দাও (পাঠ করাও)।[18] তিনি বলেন,مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ، ‘যার শেষ বাক্য হবে ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[19] ডাক্তারগণ মৃত্যুর পথযাত্রীদেরকে কালেমার তালক্বীন (পড়ানো) দেওয়ার বেশী সুযোগ পান। সুতরাং হসপিটালের বেডে বা অপারেশন থিয়েটারে মরণাপন্ন রোগীকে কালেমার তালক্বীন দেওয়া ডাক্তারের অন্যতম কর্তব্য।
৫. ডাক্তারদের মাঝে দাওয়াতী কাজ করা :
দ্বীনদার ডাক্তারদের অন্যতম করণীয় হ’ল তাদের মেডিকেল, হসপিটাল, ক্লিনিক এবং চেম্বারগুলোতে দ্বীনি পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। সহকারী ডাক্তার, নার্স ও সহকর্মীদের মাঝে হালাল-হারাম, ডাক্তারী পেশার খেয়ানত, পর্দা-পুশিদা প্রভৃতি বিষয়ে দাওয়াত দানে সদা তৎপর থাকা। কোন মেডিকেল, হসপিটাল বা ক্লিনিকের পরিবেশ যদি অনুকূলে নাও থাকে, তবুও আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্যের সাথে নিজের দ্বীনি দায়িত্ব পালন করা। অনেকেই দূষিত পরিবেশের দোহাই দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন, এটা আদৌ কাম্য নয়। আবার কোন কোন অপরিণামদর্শী আলেম ডাক্তারদেরকে এই পেশায় নিরুৎসাহিত করেন এবং নারীদের জন্য হারাম হওয়ার ফৎওয়া দেন। এই ব্যাপারে শায়খ উছায়মীন (রহঃ)-এর কথাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ডাক্তারদেরকে চিকিৎসাবিদ্যা ছেড়ে দিতে বলি, ভাল লোকেরা এই জ্ঞান অর্জন না করে এবং বলে যে, আমরা কিভাবে চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করব, অথচ আমাদের পাশে থাকে মহিলা নার্স, শিক্ষার্থী ও ইন্টার্নী ডাক্তার? আমরা বলব, আপনি যদি এই চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করা থেকে বিরত থাকেন, তাহ’লে এ বিদ্যার ময়দান কি খালি থাকবে? অচিরেই খারাপ লোকগুলো এ ময়দান দখল করে নিবে এবং যমীনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিবে। বরং আপনারা একজন, দুইজন, তিনজন, চারজন যদি একত্রিত হন, আশা করি এমন একদিন আসবে যেদিন আল্লাহ তা‘আলা রাষ্ট্রপ্রধানকে হেদায়াত দিবেন এবং তিনি মহিলাদের জন্য আলাদা ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করবেন’।[20] সুতরাং দ্বীনদার ডাক্তারের কর্তব্য হ’ল তার কর্মক্ষেত্রে যদি কলুষিত পরিবেশ থাকে, তাহ’লে প্রথমে ব্যক্তি পর্যায়ে দাওয়াতের মাধ্যমে সাধ্যমত তিনি তার দ্বীনি দায়িত্ব পালন করতে থাকবেন।
দ্বীন বিমুখ, আত্মহারা ও অসাধু ডাক্তারদেরকে সঠিক পথে আনার জন্য দ্বীনদার ডাক্তারদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ সাধারণত আলেমগণের দাওয়াত অধিকংশ সময় তাদের দোর গোড়ায় পৌঁছে না। তাই মৌখিকভাবে হোক এবং বইপত্র বা অন্য কোন মাধ্যমে হোক নিজেদের পরিমন্ডলে সাধ্য অনুযায়ী দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করা একজন আদর্শ ডাক্তারের ঈমানী দায়িত্ব।
উপসংহার :
চিকিৎসা পেশা একটি মহান পেশা। এই পেশায় মানব সেবার যত বেশী সুযোগ পাওয়া যায়, পৃথিবীর অন্য কোন পেশাতে সেটা পাওয়া যায় না। ডাক্তারগণ হ’লেন মানবতার খাদেম। তারা যদি আদর্শবান হন, তাহ’লে তাদের হাত ধরেই সমাজে মানবিকতার ভিত রচিত হবে এবং মনুষ্যত্বের নিশান উচ্চকিত হবে। পক্ষান্তরে তারা বিপথগামী হ’লে জনজীবনে নেমে আসবে অশান্তি ও দুর্ভোগের কালো মেঘ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মানব সেবায় এগিয়ে আসার তাওফীক্ব দান করুন এবং আমাদের ডাক্তারগণকে আদর্শবান ও মানবসেবী হওয়ার তাওফীক্ব দিন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম. এ শেষ বর্ষ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. আবূদাঊদ হা/৩৮৫৫; তিরমিযী হা/২০৩৮; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৩০; ছহীহ হাদীছ।
[2]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যা (কুয়েত: ওয়াযারাতুল আওক্বাফ ওয়াশ শুঊনিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৪-১৪২৭ হিজরী) ১২/১৩৫।
[3]. তাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৮৯৭; ছহীহাহ হা/১১১৩; ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৮০, সনদ হাসান।
[4]. আবূদাঊদ হা/৪৫৮৮; নাসাঈ হা/৪৮৩০; ইবনু মাজাহ হা/৩৪৬৬; ছহীহাহ হা/৬৩৫।
[5]. ছহীহ মুসলিম হা/২৫৬৪; আবূদাঊদ হা/৪৮৮২।
[6]. বুখারী হা/২৯৮৯; মুসলিম হা/১০০৯; মিশকাত হা/১৮৯৬।
[7]. আবূদাঊদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/২০০৬; মিশকাত হা/৪৯৬৯ সনদ ছহীহ।
[8]. মুসলিম হা/২৫৬৯; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/ ৫১৭।
[9]. ইবনুল মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ঈয়্যাহ ২/৪৪২; খত্বীব আশ-শিবরিনী, মুগনীল মুহতাজ ৪/২১৫।
[10]. আবূ মুহাম্মাদ ইযযুদ্দীন, ক্বাওয়া‘ইদুল আহকাম (বৈরূত: দারুল কুতুবিল-ইলমিয়্যাহ ১৪১৪ হিঃ/১৯৯১ খ্রীঃ) ২/১৬৫।
[11]. আবূদাঊদ হা/ ৫১২৮; তিরমিযী হা/২৮২২;ইবনু মাজাহ হা/৩৭৪৫, সনদ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/১৩; মুসলিম হা/৪৫।
[13]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; তাবারাণী, ম‘জামুল কাবীর হা/৭৯১২, হাদীছ ছহীহ।
[14]. বুখারী হা/৩৮৮৪; মুসলিম হা/২৫; তিরমিযী হা/৩১৮৮; নাসাঈ হা/২০৩৫।
[15]. বুখারী হা/১৩৫৬; আবূদাঊদ হা/৩০৯৫; নাসাঈ, সুনানুল কুবরা হা/৮৫৩৪।
[16]. মুসলিম হা/২৫৭৫; আদাবুল মুফরাদ হা/৫১৬; ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৯৩৮।
[17]. বুখারী হা/৫৬৭৩; মিশকাত হা/১৫৯৮।
[18]. মুসলিম হা/১৯১৬; আবূদাঊদ হা/৩১১৭; তিরমিযী হা/৯৭৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪৪৪; মিশকাত হা/১৬১৬।
[19]. আবূদাঊদ হা/৩১১৬; আহমাদ হা/২১৫২৯, হাদীছ ছহীহ।
[20]. শারহু কিতাবুস সিয়াসা আশ-শার‘ইয়্যাহ, পৃঃ ১৪৯।