মানুষ আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় এবং সেরা সৃষ্টি (ইসরা ১৭/৭০)। মানুষকে আল্লাহ ‘নিজের দু’হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। অতএব জীবন দানের মালিক যিনি, তিনিই কেবল জীবন নিতে পারেন। কেউ তাতে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করলে সে মহাপাপী হবে এবং জাহান্নামী হবে। তাই তিনি মানুষকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল’ (নিসা ৪/২৯)। তিনি সাবধান করে বলেন, যদি কেউ সীমা লংঘন ও অত্যাচার বশে এ কাজ করে, তাহ’লে সত্বর আমরা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’ (নিসা ৪/৩০)। অতঃপর যদি কেউ আল্লাহর নিষেধাজ্ঞাকে সম্মান করে আত্মহত্যার মত কঠিন পাপ থেকে বিরত হয়, তার জন্য মহা পুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা কবীরা গোনাহ সমূহ থেকে বিরত হও, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তাহ’লে আমরা তোমাদের পাপ সমূহ মার্জনা করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব’ (অর্থাৎ জান্নাত দান করব) (নিসা ৪/৩১)

আত্মহত্যা মহাপাপ। এরপরেও মানুষ আত্মহত্যা করে। নিঃসন্দেহে সেটি করে যখন তার সামনে কোন উপায়ান্তর না থাকে। এরপরেও কোন মুমিন আত্মহত্যা করতে পারে না। কেননা এটা করলে সে ইহকাল ও পরকাল দু’টিই হারাবে। তাকে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, উপায়-উপাদানের মালিক আল্লাহ। নিরুপায় মানুষ আল্লাহর উপর একান্ত ভরসা করে বৈধ পন্থায় চেষ্টা করে গেলে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য উত্তম পথ বের করে দিবেন। এ ব্যাপারে তিনি তার অনুগত বান্দাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তার জন্য তিনি উপায় বের করে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রূযী দেন, যা সে কল্পনাও করেনি’ (তালাক ৬৫/২-৩)। তিনি বলেন ‘যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, অবশ্যই আমরা তাদেরকে আমাদের পথসমূহে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)। আল্লাহর এরূপ দৃঢ় আশ্বাস সত্ত্বেও অস্থিরচিত্ত মানুষ আত্মহত্যা করে। সে নিজে মরে, পরিবারের মুখে চুনকালি মাখায়। তাতে বংশের বদনাম হয়। দেশের সম্মান নীচু হয়।

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে। যাদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০-এর মধ্যে। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ হ’তে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ২৫৫৫ জন আত্মহত্যা করত। এখন করছে বছরে গড়ে ১০ হাযারের বেশী। এছাড়াও যারা দেশের বড় বড় হাসপাতালের যরূরী বিভাগে ভর্তি হয়, তাদের শতকরা ২০ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টাকারী। ১০ই সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আতমহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ (WHO)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যায় সফল হয়। উক্ত সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে আত্মহত্যায় বিশ্বে ভারতের স্থান ছিল ১৬ এবং বাংলাদেশের ৩৮। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ১ ও ১০। অর্থাৎ প্রতি বছর এ সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মুসলিম দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে কম।

আমাদের সরকারী হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের উঠতি যুবশক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী। যা অত্যন্ত ভয়ংকর। যারা দেশের মেরুদন্ড এবং আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তারাই যদি আত্মহত্যা করে, তাহ’লে দেশের চালিকাশক্তি কারা হবে? এরপরেও এদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশী। যেটা আরও ভীতিকর। কেননা মায়ের জাতি যদি এভাবে শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে আগামী দিনের তরুণ শক্তি আসবে কোত্থেকে? আর্থিক অনটন ও বেকারত্ব এর জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় কারণ। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। কেননা উন্নত দেশগুলিতে আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশী।

আত্মহত্যার কারণ প্রধানতঃ ৩টি। (১) হতাশা : যেকোন কারণেই এটা হ’তে পারে। আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’ (যুমার ৩৯/৫৩)। অতএব মুমিন কখনো হতাশায় ভোগে না। (২) অধিক পাওয়ার আকাংখা : যারা অল্পে তুষ্ট হতে পারে না। বরং সর্বদা অধিক পাওয়ার আকাংখায় পাগলপারা হয়। তারা তা না পেয়ে আত্মহত্যা করে। আল্লাহ বলেন, তোমাদেরকে আমার স্মরণ থেকে উদাসীন করে তোমাদের অধিক পাওয়ার আকাংখা’। ‘অবশেষে তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/২)। অতএব মুমিন সর্বদা অল্পে তুষ্ট থাকে। (৩) অতি ক্রোধ : ক্রোধান্ধ মানুষ যা খুশী করতে পারে। অন্যায় যিদ তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। একদা জনৈক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপদেশ চাইলে তিনি বলেন, তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না। পরবর্তী প্রশ্নগুলিতে তিনি একই কথা বলেন (বুখারী)। তিনি বলেন, বীর সে নয়, যে অন্যকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং বীর সেই যে নিজের ক্রোধকে সামলে নেয়’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ)। তিনি বলেন, ক্রুদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়ো, বসে থাকলে পার্শ্বে ঠেস দাও। অথবা ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজীম পড়ো’ (আবুদাঊদ)। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মা মোবাইল কিনে না দেওয়ায় সন্তান আত্মহত্যা করে। এগুলি অতি ক্রোধের ফল।

বাঁচার উপায় : (১) সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার কায়েম করা। যেটা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নেই। বাংলাদেশে যার অবস্থা অতীব করুণ। সরকার ও সমাজ নেতাদের উচিত এদিকে সর্বাধিক দৃষ্টি দেওয়া। নইলে তারা আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে পারবেন না। (২) তাক্বদীরে বিশ্বাস মযবুত করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুমিনের বিষয়টি বিস্ময়কর। যখন সে কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। আবার যখন বিপদগ্রস্ত হয়, তখন ছবর করে। উভয় অবস্থায় সে আল্লাহর নিকট পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়’ (মুসলিম)। (৩) সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা। আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন’ (তালাক ৬৫/৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমার উম্মতের ৭০ হাযার ব্যক্তি বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। যারা কখনো ঝাড়ফুঁক নেয়নি, শুভাশুভ গণনা করেনি। বরং সর্বাবস্থায় তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করেছে’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ)

আত্মহত্যার পরিণতি : এর পরকালীন পরিণতি হ’ল জাহান্নাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি যে বস্ত্ত দ্বারা নিজেকে হত্যা করবে, সেই বস্ত্ত দ্বারা তাকে ক্বিয়ামতের দিন শাস্তি দেওয়া হবে (বুখারী)। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি লোহা দ্বারা কিংবা বর্শা দ্বারা কিংবা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, ওভাবেই তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে (বুখারী)। যখমের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জনৈক ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার আগেই নিজের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছে। অতএব তার উপরে আমি জান্নাতকে হারাম করে দিলাম’ (বুখারী)। এমনকি জিহাদের ময়দানে আত্মঘাতি বীর মুজাহিদকেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাহান্নামী বলেছেন (বুখারী হা/৪২০৩)। অতএব হে মুমিন! আত্মহত্যা করা থেকে বিরত হও! (স.স.)






বিষয়সমূহ: পাপ
স্বাধীনতা রক্ষার শপথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নেপালের ভূমিকম্প ও আমাদের শিক্ষণীয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
গ্রাহক ও এজেন্ট সংগ্রহের ফরম
111
ঈদুল আযহা সমাগত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হাদীছ অস্বীকারের ফিৎনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
১. মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী! মূর্তিটা নামিয়ে দিন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কুরবানীর মাসায়েল - .
পিওর ও পপুলার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুছল্লী না সন্ত্রাসী? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আন্তঃধর্ম শান্তি সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.