বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তের
ওপারে ভারতের আসাম রাজ্য অবস্থিত। ৭৮ হাযার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই রাজ্যে
৩ কোটির কিছু বেশী লোকের বাস। ভাষ্যগত দিক দিয়ে ‘অহমিয়া’ হ’ল প্রধান ভাষা
প্রায় ৫৮ শতাংশ। এর পরেই বাংলার অবস্থান প্রায় ২২ শতাংশ। ধর্মীয় দিক দিয়ে
প্রায় ৬০ ভাগ হিন্দু ও ২৫ ভাগ মুসলমান। বাদবাকী খৃষ্টান ও শিখ প্রভৃতি।
হিন্দুরা ‘বোড়ো’ নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আসামের চা, তৈল,
গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং আসাম থেকেই ভারতীয় রাজ্যসভার
এম,পি।
আসামের সংসদ সদস্যা রুমি নাথ ইসলাম কবুল করে একজন মুসলমানকে বিয়ে করায় গত ১লা জুলাই হিন্দুদের হাতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হওয়ার কয়েকদিন পরেই গত ১৬ই জুলাই বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন আসামের কোকড়াঝাড় যেলায় দু’জন বাঙ্গালী মুসলিম ছাত্রনেতা খুন হন। এরপর ১৯শে জুলাই আরও ২ জন। একই দিনে খুন হয় বোড়ো ন্যাশনাল প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টের ৪ জন। অতঃপর শুরু হয় বাঙ্গালী মুসলিম নিধনযজ্ঞ। জ্বালাও-পোড়াও, খুন-ধর্ষণ, লুট-পাট সবই চলতে থাকে বাধাহীন গতিতে। দিল্লীগামী রাজধানী এক্সপ্রেস থামিয়ে সেখানেও হামলা চালানো হয়। কোকড়াঝাড় সহ ৪টি যেলায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস দলীয় রাজ্য সরকার দেশব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখে অবশেষে ২৫শে জুলাই সেনাবাহিনী নামায়। এতে দাঙ্গার ব্যাপকতা কমলেও বোড়াদের হিংস্রতা বন্ধ হয়নি। ইতিমধ্যে শতাধিক নিহত হয়েছে এবং গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। ২ লাখের উপর মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সরকারের খোলা প্রায় ২৫০টি আশ্রয় শিবিরে। বাকীরা পশ্চিমবঙ্গের দিকে পালিয়ে গেছে। আশ্রয় শিবিরে খাবার নেই, পানি নেই, মাথা গোঁজার ঠাই নেই। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ। অভিযোগের ঝড় বয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ অবশেষে ২৮ জুলাই উপস্থিত হয়েছেন মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধী। ঘোষণা দিয়েছেন নিহত ব্যক্তি প্রতি ২ লাখ রূপী এবং আহত ব্যক্তি প্রতি ৫০ হাযার রূপী দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দাঙ্গায় হতাহতদের জন্য ৩০০ কোটি রূপী অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দেবেন তো রাজ্য সরকারের দলবাজ প্রশাসনের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে নিহতদের তালিকা কমিয়ে বলা হয়েছে ৫২ জন। যা প্রকৃত সংখ্যার অর্ধেকেরও কম। এরপর বলা হবে উপদ্রুতদের বহু সংখ্যক বোড়ো হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এরপরেও সরকারী অফিসার ও দলীয় ক্যাডারদের খায়েশ মিটিয়ে প্রকৃত ব্যক্তিরা অবশেষে কত টাকা হাতে পাবে, কতদিনে পাবে, তার খবর কে নেবে? কেননা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ন্যায় এখানেও ঘুষ-দুর্নীতি, দলীয় ক্যাডারবাজি ও চাঁদাবাজি একটি সাধারণ ব্যাপার বলে ধরে নেওয়া যায়। আসল কথা হ’ল, টাকা দিয়ে জীবনের মূল্য দেওয়া যায় না। যে মূল্যবান জীবনগুলি চলে গেল, তা আর কখনোই ফিরে আসবে না। নিহতদের উত্তরাধিকারী ও নিকটাত্মীয়দের হৃদয়ে রক্তাক্ত স্মৃতির যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হ’ল, যুগ যুগ ধরে তা অমলিন থাকবে। এই স্মৃতি উসকে দিয়ে রাজনৈতিক দাঙ্গাবাজরা আগামীতে আবার দাঙ্গা বাধাবে। শত শত বছর ধরে সহাবস্থানকারী বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা আবারও বিনষ্ট হবে। কেননা সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চায়। তারা অশান্তি চায় না। সমাজনেতা ও সরকারের উচিত সর্বদা নিরপেক্ষ থাকা। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে নিরপেক্ষ শাসন অলীক চিন্তা মাত্র।
আসামের বাঙ্গালী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বোড়াদের প্রধান অভিযোগ হ’ল এই যে, তারা বহিরাগত। অতএব তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। অথচ আসামে তাদের বসবাস অহমিয় হিন্দুদের আগমনের বহু আগে থেকেই। কেননা বাংলাভাষী মুসলমানেরা বাংলা থেকে আসামের কামরূপ যায় ১২০৬ খৃষ্টাব্দে। আর অহমিয়রা বার্মা থেকে এখানে আসে ১২২৮ সালে। অথচ তারাই এখন মুসলমানদের ‘ফরেনার’ বলছে। আদি হিন্দু বোড়ো কাচাড়ি সম্প্রদায় এখানকার প্রথম অধিবাসী হ’লেও ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও কলিতরা আসে অনেক পরে কনৌজ ও উড়িষ্যা থেকে। কিন্তু তাদের বিতাড়ন করা হচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রের যেকোন নাগরিক যেকোন স্থানে বসবাস করতে পারে নিজ নিজ ধর্ম ও আক্বীদা-বিশ্বাস নিয়ে। রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের নিরাপত্তা দিবে। কারা আগে এল বা পরে এল এটা দেখার বিষয় নয়। কিন্তু বস্ত্তবাদী ধারণায় মানুষ ভেবেছে, সে নিজেই মাটির মালিক। অথচ মাটির প্রকৃত মালিক আল্লাহ। আল্লাহর বান্দা আল্লাহর যমীনে যেখানে খুশী বসবাস করতে পারে। মানুষের এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করা কোন রাষ্ট্রের উচিত নয় সঙ্গত কারণ ব্যতীত।
কেবল আসাম নয় ভারতের প্রায় সর্বত্র মুসলিম নির্যাতনের ইতিহাস প্রধানতঃ বৃটিশ শাসনের যুগ থেকে শুরু হয়ে আজও চলছে। অথচ প্রায় সাড়ে ছয়শো বছর মুসলমানেরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে। তখন ধর্মীয় দাঙ্গার কোন খবর ছিল না। বরং মুসলিম শাসনামলে অমুসলিমরা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। বৃটিশরা এসে সদ্য শাসনহারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুনেতাদের ব্যবহার করে। অতঃপর ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এই নীতি সামনে রেখে তারা এদেশকে কব্জায় রাখতে চেষ্টা করে। ১৯৪৭ সালে তারা চলে গেলেও রেখে যায় ‘গণতন্ত্র’ নামক ইলাহী সার্বভৈŠমত্বহীন মেজরিটির শাসনের এক অত্যাচারী মতবাদ। ফলে মেজরিটি হিন্দুদের হাতে মাইনরিটিরা মার খাচ্ছে এবং খাবে, যতদিন এই মতবাদের খপ্পর থেকে জাতি মুক্ত না হবে। এই শাসনে ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্ধারিত হয় মেজরিটির নিরিখে। আদালতের কথিত ন্যায়বিচার কখনোই নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের হৃদয়ের কান্না থামাতে পারেনি। অথচ ইসলামী শাসন সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে। সেখানে মেজরিটি-মাইনরিটিতে কোন প্রভেদ নেই। যার বাস্তব নমুনা ভারতবর্ষের ও বাংলার বিগত যুগের মুসলিম শাসকদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। আধুনিক মতবাদীরা ইসলামের এই নিরপেক্ষ শাসনকে ভয় পায়। সেকারণ তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ইসলামী নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর এবং এর মাধ্যমে মানবতাকে তাদের দুঃশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট করতে চায়।
ভারতের প্রগতিশীল পত্রিকা Front line ১৯৯১ সালের ১৫ই নভেম্বরে প্রকাশিত হিসাব মতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সেদেশে ১৩,৯০৫টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে পশ্চিম বঙ্গ সরকার তার রাজ্য বিধান সভায় প্রদত্ত রিপোর্টে বলেন যে, ঐ সময় পর্যন্ত প্রাদেশিক রাজধানী কলিকাতা শহরেই ৪৬টি মসজিদ এবং ৭টি মাযার ও গোরস্থান হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে’। উক্ত হিসাব মতে দেখা যায় যে, বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে কথিত ভারতে তার স্বাধীনতা লাভের ৪৫ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৩০৯টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে ২০০১-২০০৯ সাল পর্যন্ত সেদেশে ৬৫৪১টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। জান-মাল ও ইযযত হারিয়েছে এবং গৃহহারা হয়েছে কত অসংখ্য মানুষ তার হিসাব কে রাখে? ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারিখে ৪৬৫ বছরের সুপ্রাচীন ‘বাবরী মসজিদ’ ভেঙ্গে তারা সেখানে কথিত ‘রাম মন্দির’ গড়েছে। ২০০২ সালে গুজরাটে প্রায় ২০০০ মুসলিমকে তারা হত্যা করেছে সরকারী ছত্রছায়ায়। আজও যার বিচার হয়নি। এখনো প্রতিদিন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট কাশ্মীরে মুসলিম নির্যাতন চলছে। সারা ভারত থেকে বাংলাভাষী মুসলিমদের হাঁকিয়ে এনে বাংলাদেশে ‘পু্শ ইন’ করার চেষ্টা চলছে হরহামেশা। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চলছে প্রতিদিন। এখন আবার আসাম থেকে মুসলিমদের খেদিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর মিশন শুরু হয়েছে। কি চমৎকার ধর্মনিরপেক্ষতা! আমরা আসামের মযলূম অসহায় ভাই-বোনদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই এবং তাদের প্রতি আল্লাহর গায়েবী মদদের প্রার্থনা জানাই। (স.স.)।