১৯২১ সালে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নানান চড়াই-উতরাই পার করে পূর্ব বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ের মূলে ছিল মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ ও পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা যেমন পুরুষ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা লাভের কারণ হয়েছিল, তেমনি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের ধর্মভীরু নারীদের শিক্ষার পথও সহজ হয়। এ ব্যাপারে মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম লিখেছেন, ‘If we think of the education of women in the Dacca University in the twenties and thirties and compare with the present state of their educational progress and their academic distinction, we wonder at the revolutionary change the University of Dacca has effected in social outlook in respect of the higher education of the females in Eastern Bengal.’ অর্থাৎ ‘আমরা যদি বিশ ও ত্রিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের শিক্ষার কথা চিন্তা করি এবং তাদের শিক্ষাগত অগ্রগতির বর্তমান অবস্থা এবং তাদের একাডেমিক পার্থক্যের সাথে তুলনা করি, তাহ’লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব বাংলায় নারীদের উচ্চশিক্ষার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তাতে আমরা বিস্মিত হই।[1]
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে এগিয়ে যাওয়া যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, সেখানে কয়েক দশকের মধ্যেই তা কলকাতা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বয়ান আত্মস্থ করতে শুরু করে। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত হ’লেও দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। দীর্ঘ এক শতাব্দীর পথচলা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করল, তার অব্যবহিত পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছাত্রীদের জন্য হিজাব নিষিদ্ধ করল। নিজের ইতিহাসের সাথে এ যেন এক তামাশা। মূলতঃ বিগত বছর ১৮ই সেপ্টেম্বর ‘প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ছাত্রীদের কান এবং মুখমন্ডল খোলা রাখা বাধ্যতামূলক’ মর্মে নোটিশ জারী করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। পরবর্তীতে ৬ই ডিসেম্বর পুনরায় নোটিশে বলা হয়, উক্ত সিদ্ধান্ত মানতে যারা শৈথিল্য দেখাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর প্রেক্ষিতে কতিপয় ভুক্তভোগী ছাত্রী জারীকৃত নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করে। এতে ‘ছাত্রীদের মুখ-কান খোলার নির্দেশনা কেন অবৈধ নয়’ মর্মে রুল জারী করে আদালত বাংলা বিভাগ কর্তৃক জারীকৃত নোটিশ স্থগিত করে। কিন্তু এবছর গত ২৯শে মে আপিল বিভাগ উচ্চ আদালতের এই রায় স্থগিত করে ঢাবির বিভাগীয় নোটিশ বহাল করার মধ্যে দিয়ে এক ন্যক্কারজনক নযীর স্থাপন করে।[2]
ঢাবির বাংলা বিভাগ থেকে প্রদত্ত নোটিশে বলা হয়, পরীক্ষার্থীদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্বাপর সামগ্রিক ঘটনা সামনে রাখলে হিজাব নিষিদ্ধ করার এমন ঘটনা এতটা সরল মনে হবে না। ইতিপূর্বে ২০২২ সালে ‘প্রোটেস্ট সেল অ্যাগেইনস্ট হিজাবোফোবিয়া ইন ডিইউ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে ঢাবি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে হিজাব-নিকাব পরার অধিকার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। সম্মেলনে তারা জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-নিকাব পরার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিকাব পরা অধিকাংশ ছাত্রী কখনো না কখনো সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষক কর্তৃক অপমান, উত্ত্যক্ত, হেনস্তা, বিরূপ মন্তব্য বা বুলিংয়ের শিকার হয়।[3] এছাড়াও দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজেও এমন ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে। বোরক্বা পরার কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিকার হেনস্তার শিকার হ’তে হয় এক ছাত্রীকে[4], কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার জন্য এক ছাত্রীকে ‘মৌলবাদী জঙ্গি’ বলে মন্তব্য করে শিক্ষক।[5] এগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এরকম বহু নযীর পত্র-পত্রিকা, অনলাইন পোর্টালে ছড়িয়ে রয়েছে। মফস্বলের স্কুল, যেলা শহরের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে হিজাব-নিকাবের ব্যাপারে বিদ্বেষী মনোভাব।
উপনিবেশবাদের সিলসিলা :
বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাবোফোবিয়ার যে স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তার মূল প্রোথিত রয়েছে উপনিবেশবাদের গভীরে। প্রকৃতপক্ষে হিজাবোফোবিয়া একটি উপনিবেশবাদী খাসলত। University of Ottawa-এর ইতিহাসের প্রফেসর Ryme Seferdjeli-এর দৃষ্টিতে, হিজাব বিদ্বেষ কোন সাধারণ ব্যাপার নয়, বরং এর পেছনে আছে (হীন) রাজনৈতিক স্বার্থ এবং ঔপনিবেশিকতার সাথে রয়েছে এর সরাসরি সম্পর্ক।[6] ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ফ্রানজ ফনোঁ। উত্তর-ঔপনিবেশিক (Post Colonialism) চিন্তার অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক হিসাবে ফনোঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। ফ্রানজ ফনোঁ তার ‘A Dying Colonialism’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘The women who sees without being seen frustrates the coloniser.’’ অর্থাৎ ‘যে নারী নিজেকে প্রদর্শন করে না, সে ঔপনিবেশিকদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়’। ফনোঁর এই উক্তি অমূলক নয়। তিনি তার গ্রন্থে ‘Algeria Unveiled’ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, আলজেরিয়ার সমাজ কাঠামো ও এর প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল নারী। কিন্তু আলজেরীয় নারীদের কাছে পৌঁছানোর পথে তাদের প্রধান বাধা হ’ল পর্দা বা হিজাব। ফনোঁ বলেন, ঔপনিবেশিকদের কথা হ’ল, ‘আমরা যদি আলজেরিয়ার সমাজের কাঠামোকে ধ্বংস করতে চাই, আমাদের সবার আগে নারীদের জয় করতে হবে; আমাদের অবশ্যই যেতে হবে এবং ঘোমটার আড়ালে তাদের খুঁজে বের করতে হবে যেখানে তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখে এবং যে বাড়িতে পুরুষরা তাদের দৃষ্টির বাইরে রাখে’।[7]
এই বাধাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য পুরো আলজেরিয়া জুড়ে ফরাসি দখলদাররা দেওয়ালে দেওয়ালে সেঁটে দিত পোস্টার, যাতে লেখা থাকত, ‘Aren't you pretty, remove your veil’ (তুমি কি সুন্দরী না? খুলে ফেল তোমার হিজাব)। কিন্তু আলজেরীয় নারীরা ফরাসিদের এই আহবান প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে ফরাসি ঔপনিবেশের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ায় হিজাব হয়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী অস্ত্র। যার কারণে ফনোঁ হিজাবকে দেখেছেন বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে।
হিজাবের অন্তঃস্থিত এই বিপ্লবী শক্তি হাল যামানাতেও নিঃশেষ বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আজও হিজাবকে নিজেদের জন্য ‘বিরক্তির কারণ’ হিসাবে বিবেচনা করে। একবিংশ শতকের শুরুতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র ঠিকাদারি নিয়ে আমেরিকা যখন আফগান ও ইরাকে যুদ্ধ বাধায়, তখন আফগান ও ইরাকে তাদের শ্যেনদৃষ্টি ছিল পর্দাবৃত মুসলিম নারীদের দিকে। সেখানে আমেরিকা নিজেকে যাহির করেছিল নারী মুক্তির দূত হিসাবে। বিশ বছরের যুদ্ধ শেষে ব্যর্থ আমেরিকা যখন আফগান ছাড়ার জন্য তল্পিতল্পা গোটায় তখনও বুশ উৎকণ্ঠিত ছিল আফগান নারীদের নিয়ে। যে সময় মুসলিম বিশ্বের নারীদের নিয়ে আমেরিকা এত চিন্তিত, সেই সময়ে খোদ মার্কিন মুলুকে নারীদের অবস্থা কেমন? আমেরিকায় নারীদের উপর হওয়া দৈনন্দিন নিপীড়নের পরিসংখ্যান দেখলে স্বাভাবিক মানুষের গা শিউরে উঠার কথা। প্রতিবছর আমেরিকায় ধর্ষণের শিকার হয় ৩,২১,৫০০ নারী (প্রতি ঘণ্টায় ৩৬ জন)[8] আমেরিকার ৮০ শতাংশের অধিক নারী জীবনে একবার হ’লেও যৌন হয়রানির শিকার হয়।[9] মার্কিন নারীরাই যখন তাদের দেশে সুরক্ষিত নয়, তখন আমেরিকা মুসলিম বিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে নারী মুক্তির ঠিকাদারি নিয়ে! কি আশ্চর্য বিষয়!
কেন এই দ্বিচারিতা? এর কারণ হ’ল, নয়া-উপনিবেশবাদের প্রধান পুরোহিত আমেরিকাও শালীনতার যেকোন প্রতীককে (বোরক্বা, হিজাব) মুসলিম বিশ্বে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিবন্ধক হিসাবে বিবেচনা করে।
সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার দেশ ফ্রান্সে ২০১১ সালে হিজাব নিষিদ্ধ হয়। রেনেসাঁর আঁতুড়ঘর ইতালিতে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৫ সালে। একই সালে মার্ক্সবাদী রাশিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ আদালত ‘ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস’ ২০২১ সালে রায় দেয় হিজাব নিষিদ্ধ করার পক্ষে। এছাড়াও স্পেন, বুলগেরিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড, নরওয়েসহ আধুনিকতাবাদের ঘাড়ে সওয়ার হওয়া ইউরোপের আরও বেশ কিছু দেশে সামগ্রিক বা আংশিকভাবে হিজাব নিষিদ্ধ করে। হিজাবোফোবিয়ার চর্চাকারী এসব রাষ্ট্রগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে দেখতে পাই কয়েক যুগ আগেও তারা মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য ভূখন্ডে কলোনি গেড়েছিল। হিজাবের বিরুদ্ধে নিজ ভূখন্ডেও তারা নিজেদের উপনিবেশবাদী মানসিকতা চর্চার সাক্ষর রাখতে ভোলেনি। প্রভাবশালী পশ্চিমা নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ সত্য বলেছেন, ‘উপনিবেশবাদ আধুনিক ইতিহাসের পর্বমাত্র নয়, এটা খোদ আধুনিকতারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’।[10]
এছাড়া পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ব, প্রগতি ও অন্যান্য যেসব মিথ (Myth) চালু রয়েছে, সেগুলো রক্ষার জন্য ‘স্বাধীন পশ্চিমা নারী’র গুরুত্ব অপরিসীম।[11] বিশ্বব্যাপী পর্ণোগ্রাফি, যৌনতা, ভোগবাদ ও পুঁজিবাদের যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তা টিকিয়ে রাখতেও ‘স্বাধীন নারী’র বিকল্প নেই। নগ্ন/অর্ধনগ্ন নারীর প্রদর্শনী উসকে দেয় ভোগবাদের তাড়নাকে। নগ্নতার পালে হাওয়া দিয়েই এগিয়ে যেতে হয় পুঁজিবাদকেও। তাই শালীন নারীর অস্তিত্ব পশ্চিমা দুনিয়া কল্পনা করতে পারে না। বৃটিশ গবেষক অরুণ কুন্দনানি পশ্চিমা লিবারেল দুনিয়ার শিকড় সন্ধান করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, স্কার্ফের মাধ্যমে মুসলিম নারীদের মাথা ঢাকাকে তারা পশ্চিমা যৌনতার চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান হিসাবে বিবেচনা করে।[12]
অতএব ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, হিজাব নিষিদ্ধ করা বা হিজাবোফোবিয়ার পেছনের মনস্তত্ত্ব আসলে প্রবলভাবে ঔপনিবেশী। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও রাষ্ট্রকাঠামোতে আমরা বাহ্যত স্বাধীন মনে হ’লেও কার্যত পরাধীন। ব্রিটিশ আমলা লর্ড মেকলে বলেছিলেন, আমরা এদেশে এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলব, যারা হবে, ‘‘A class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect.’’ অর্থাৎ তাদের শরীরটা এদেশীয় হ’লেও মনটা হবে ব্রিটিশ।
মুখ ঢেকে রাখবার সামান্য এক টুকরা কাপড় পুরো পশ্চিম ও তাদের এদেশীয় তাঁবেদারদের তটস্থ করে তুলছে কেন? কারণ এর মধ্যে আছে রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা, আছে প্রত্যাখ্যাত হবার বিষাদ বেদনা এবং বিকাশমান নয়া-উপনিবেশবাদ ভেঙ্গে পড়ার ভয়। উপনিবেশের যে ধারাবাহিকতা মজ্জাগতভাবে আজও মিশে আছে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে, তার থেকেই উৎপাদিত হচ্ছে হিজাব বিদ্বেষের মত বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক প্রপঞ্চ। হিজাব আজও সেই শক্তি সংরক্ষণ করে, যা কম্পিত করত উপনিবেশবাদের রূহকে।
নারীবাদী ও লিবারেলদের অবস্থান :
ক্লাসিকাল ফেমিনিজমের তুলনায় বঙ্গীয় নারীবাদ এককাঠি বেশী সরস। পত্র-পত্রিকা, টিভি টকশোতে অনবরত তারা কথার তুবড়ি ছুটিয়ে চলেন কথিত মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু নারীর বোরক্বা-হিজাব-নিকাবের বিরুদ্ধে অনবরত আক্রমণেও তাদের নীরবতার রেশ কাটে না। বরাবরের মত ঢাবির বাংলা বিভাগে হিজাব নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এদেশের নারীবাদীরা ‘টু’ শব্দটি করেনি। এর কারণ কি? এর কারণ খুঁজতে হ’লে আমাদরকে নারীবাদের গোঁড়ায় যেতে হবে এবং বুঝতে হবে বোরক্বা-হিজাবের সাথে এর সম্পর্কের বিন্যাস।
মূলত গলদ রয়েছে নারীবাদের গোড়াতেই। মৌলিকভাবে নারীবাদ মডার্নিটির একটি প্রকল্প। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপিকা সাবা মাহমূদ তার ‘Politics of Piety’ গ্রন্থে নারীবাদের সুলুক সন্ধান করে দেখিয়েছেন। সেক্যুলার-লিবারেল নারীবাদী কাঠামোতে নারীর কর্তাসত্ত্বার (Agency) ধারণাকে পাঠ করা হয় ‘রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ’ আকারে এবং এই প্রতিরোধকেই নারীর ‘স্বাধীনতা’র মানদন্ড হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিসের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ? নারীবাদের দৃষ্টিতে ধর্ম, সমাজ, নৈতিকতা যা কিছু নারীকে অধীনস্থ করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। তাই শেষ পর্যন্ত নারীবাদী প্রস্তাবনায় হিজাব হয়ে দাঁড়ায় ‘শোষণ’ এর প্রতীক।
নারীবাদী বয়ানের আরেকটু খোলাসা কথা হ’ল, স্বেচ্ছায় কোন নারীর বোরক্বা-হিজাবকে নিজের ‘চয়েস’ (Choice) হিসাবে গ্রহণ করাও যৌক্তিক না। নারীবাদী দৃষ্টিতে কাঠামোগতভাবে যা শোষণের হাতিয়ার (বোরক্বা, হিজাব, নিকাব), তা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করাও স্বাভাবিক স্বাধীনতা চর্চার অংশ নয়।
বাংলাদেশে হিজাবোফোবিয়ার আলাদা একটা ধরণও আছে। সেটা হ’ল, বাঙালিয়ানা বা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে হিজাবকে দাঁড় করানো। ঊনিশ শতকে উপনিবেশের গর্ভে স্ফীত কলকাতার ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর হাতে বাঙালিত্ব বা বাঙালি সংস্কৃতির যে বয়ান গড়ে উঠেছিল, তা পুরোপুরিভাবে মুসলিম সমাজকে খারিজ করেছিল এবং হিন্দুত্ববাদী উপাদান দ্বারা নিজেকে বিনির্মাণ করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা কলকাতায় তৈরী এই বয়ানকেই আপনকরেছিল। ঢাবি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘এ প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে ধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি সম্পর্কে উন্নাসিকতা বেশী ছিল। ... অন্যদিকে বাঙালি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার একটা অতিরিক্ত চাপ থাকায় তারা প্রায় বাচবিচারহীনভাবে কলকাতার সাংস্কৃতিক উৎপাদনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ফলে বৃহত্তর জনমানুষের জীবনযাপন, ধর্ম, সংস্কৃতির ভিত্তিতে চিন্তা-চর্চার উচ্চাভিলাষ খুব কমই পরিলক্ষিত হয়েছে’।[13] ষাটের দশকে খরিদ করা এই বয়ান স্বাধীন বাংলাদেশে আজও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সংস্কৃতিক অঙ্গন, নারীবাদী ও সুশীল-প্রগতিশীল সমাজে প্রভাবশালী।
বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত ‘হিজাবের রাজনীতি, হিজাবের সংস্কৃতি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে দাবী করা হয়, হিজাব বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং হিজাবের মাধ্যমে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য পরিবর্তিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি দ্বারা এবং বাঙালির নিজস্ব পোষাক (যেমন শাড়ি, ম্যাক্সি) বদলে যাচ্ছে, যা অবশ্যই বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষতির কারণ।[14] এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা টিভি টকশোর আলাপচারিতায় পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ ও ‘আরব্য সংস্কৃতি’র এই সমীকরণের পশ্চাতে হিজাবকে উপস্থাপন করা হচ্ছে ক্ষতিকর-নেতিবাচক হিসাবে। একই সাথে বাঙালি নারীবাদী ডিসকোর্সে হিজাব ‘পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া শেকল’ আর উন্মুক্ত বদনে টিপ ও পেট অনাবৃত রেখে শাড়ি পরা ‘বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। তাই যা কিছু বাঙালিত্ব ও বাঙালি সংস্কৃতির উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে, তার প্রতি শত আঘাতও বাঙালি নারীবাদের নিদ্রাভঙ্গ করতে পারে না।
উপসংহার :
মুসলিম সমাজের আদর্শিক মেরুদন্ড হ’ল নারী। একটি সুস্থ আদর্শবান সমাজকে স্থিতিশীল রাখার জন্য এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইসলামী আদর্শের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য একজন নারী ‘মা’ হিসাবে প্রধান দায়িত্ব পালন করে। নারীর এই ভূমিকাই ইসলামী আদর্শবাদের কাঠামোকে স্ব-স্থানে বহাল রাখে। ‘নারী মুক্তি’, ‘নারী স্বাধীনতা’র চটকদার বুলির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ এবং তাদের স্থানীয় তাঁবেদাররা সর্বদা মুসলিম নারীদের ঘর ও হিজাব-নিকাবের আড়াল থেকে টেনে বের করে নিজ স্বার্থ হাছিল করতে চায়। কিন্তু যখন মুসলিম নারী পর্দাবৃত হয়, তখন সে দখলদারদের আহবান প্রত্যাখ্যান করে। বোরক্বা/হিজাব শুধু নারীর ইয্যত-আব্রুরই হেফাযত করে না, বরং এটা সাম্রাজ্যবাদেরও তীব্র প্রত্যাখ্যান বটে। তাই হিজাব বা বোরক্বাবৃত হওয়া কোন সাধারণ বিষয় নয়। এর পেছনে রয়েছে মুসলিম নারীদের সফলতার চিহ্ন ও পরাধীনতার সামনে মাথা নত না করার দ্যোতনা, যা উপনিবেশবাদের রূহকে ক্রমাগত সন্ত্রস্ত করে। অতএব যে কোন মূল্যে মুসলিম নারীর হিজাব-পর্দা বজায় রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা, তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। যাতে এই ফরয বিধান বন্ধ না হয় এবং মুসলিম নারীরা হায়েনাদের লোলুপ দৃষ্টির শিকার এবং তাদের খোরাকে পরিণত না হয়। আল্লাহ মুসলিম নারীদের হেফাযত করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ আবূ হুরায়রা ছিফাত
বি.এ (অনার্স) ২য় বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।
[1]. Muhammad Abdur Rahim, The History of the University of Dacca (Second Reprint, 1981), p. 173; গৃহীত : বাঙলানামা, অক্টোবর ২০২১, দ্বিতীয় সংখ্যা (সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ), পৃ. ৫৯-৬০।
[2]. পরীক্ষার্থীর কান-মুখ খোলা রাখতে বাংলা বিভাগের বিজ্ঞপ্তি বহাল, প্রথম আলো, ২৯ মে ২০২৩ (অনলাইন)।
[3]. ঢাবি ক্যাম্পাসে ‘হিজাব-নিকাব পরার স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করার দাবি, প্রথম আলো, ৩১ মার্চ ২০২২ (অনলাইন)।
[4]. বোরকা পরায় হেনস্তার শিকার ইবি ছাত্রী, দৈনিক ইনকিলাব, ২৮ আগস্ট ২০২২ (অনলাইন)।
[5]. ছাত্রীকে ‘মৌলবাদী জঙ্গি’ বলে বির্তকে কুবি শিক্ষক, Banglanews24.com, ২৩ আগস্ট ২০২২।
[6].Seferdjeli Ryme, THE VEIL IN COLONIAL ALGERIA : THE POLITICS OF UNVEILING WOMEN, THE FUNAMBULIST.
[7].Frantz Fanon, A Dying Colonialism (New York : GROVE PRESS), p. 37-38.
[8].Victims of Sexual Violence : Statistics, RAINN (https://www.rainn.org/statistics/victims-sexual-violence).
[9].The Facts behind the MeToo Movement : A National Study on Sexual Harassment and Assault. February 2018.
[10]. চিন্তার মুসিবত : তালাল আসাদের বাতচিত (কথাপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৩), ‘সাক্ষাৎকার : নৃবিজ্ঞান এবং উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে’, পৃ. ৩৩।
[11]. ড্যানিয়েল হাকিকাতযু, সংশয়বাদী (ইলমহাউস পাবলিকেশন, প্রথম সংস্করণ : এপ্রিল ২০২১), ‘যৌনতা ও যিনা’ অধ্যায়, পৃ. ২২৩।
[12].Arun Kundnani, The Muslims Are Coming! Islamophobia, Extremism, and the Domestic War on Terror (2014).
[13]. মোহাম্মদ আজম, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ (সংহতি প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২২), পৃ. ৩৪।
[14]. উদিসা ইসলাম, ‘হিজাবের রাজনীতি, হিজাবের সংস্কৃতি’, বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ মার্চ ২০১৮।