ভূমিকা :

এবারে দেশে বোরো ধানের উৎপাদন গত বছরকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু কৃষকের মুখে হাসি নেই। কারণ ধানের যে দাম তাতে লাভতো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠছে না। বরং প্রতি মণ ধানে ন্যূনতম ২০০ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। পাকা ধান ঘরে তুলতে  না পেরে সংশ্লিষ্ট হাওর এলাকার মানুষেরও কষ্টের শেষ নেই। আর যারা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে কিছু ধান ঘরে উঠিয়েছে তাও বিক্রি করতে পারছে না ন্যায্য দামে। ফলে কৃষকরা পড়েছে দারুণ বিপাকে।     

পাকা ধানে আগুন দিয়ে কৃষকের প্রতিবাদ :

ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপযেলার পাইকড়া গ্রামের আব্দুল মালেক সিকদার নামের এক কৃষক নিজের পাকা ধানে আগুন দিয়ে অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গত ১২ই মে ২০১৯ ইং রবিবার  দুপুরে তিনি তার নিজস্ব ধানক্ষেতে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। দিশেহারা এই কৃষকের প্রতিবাদে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। পাকা ধানে আগুন দেখে অনেকেই ছুটে যান ধানক্ষেতে। এ বিষয়ে আব্দুল মালেক সিকদার জানান, ‘প্রতি মণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরী দ্বিগুণ। এবার ধান আবাদ করে আমরা মাঠে মারা পড়েছি। তাই মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন দিয়েছি’। ওদিকে ধানের ন্যায্য দাম না থাকায় কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপযেলার কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ধান রাস্তায় ফেলে আগুন দিয়েছে। গত ১৯শে মে ২০১৯ইং রবিবার সকাল ১০-টা থেকে ১১-টা পর্যন্ত উপযেলার গোবিন্দপুর চৌরাস্তায় ‘গোবিন্দপুর কৃষক অধিকার রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র আহবায়ক আলাল মিঁয়ার নেতৃত্বে এ এলাকার কৃষকরা এই কর্মসূচী পালন করেন। এ সময় কৃষকেরা বিক্ষোভ মিছিলও করেন। বিক্ষোভ কর্মসূচী থেকে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের জন্য সরকারের প্রতি তারা দাবী জানান।

কতটা কষ্টে একজন কৃষক তার পাকা ধানে আগুন লাগায় তা ভাবতে গেলে চোখে অশ্রু এসে যায়। যারা কৃষক নন, তারা হয়তো বুঝতে পারবেন না যে, প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে কমপক্ষে ২০০ টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ হচ্ছে (সার, সেচ, কীটনাশক, বীজ, শ্রমিকের মজুরী বাবদ) ২৪ টাকা। সেখানে ধানের দাম না থাকলে কৃষকরা কীভাবে জীবন চালাবে?

কৃষাণের এক দিনের মজুরী এক মণ ধানের চেয়েও বেশী :

খুলনা যেলার কৃষক সংগ্রাম সমিতির কমিটির সদস্য প্রশান্ত রায় শিবু বলেন, বোরো ধান উৎপাদনে প্রতি মণ ধানের বিপরীতে খরচ হয়েছে ৮৫০ টাকা। কিন্তু বাজারে ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা দাম দিচ্ছে মোটা ধান ৫৫০ টাকা, চিকন ধান ৬৫০ টাকা। এতে মণ প্রতি লোকসান গুণতে হচ্ছে ২ থেকে ৩ শত টাকা। মাঠে কাজ করার জন্য কৃষি শ্রমিক যোগাড় করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কৃষকদের। যদিও পাওয়া যায়, কিন্তু একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরী অন্তত ৫০০/৭০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। আবার শ্রমিককে দুপুরে খাবারও দিতে হচ্ছে। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরী এক মণ ধানের চেয়েও বেশী।

লোকসানের পরিমাণ :

চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এএফও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ বলেছে, বিশে^ এ বছর ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেড়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু বাম্পার ফলন হ’লেও বোরো চাষীদের মুখে হাসি নেই। কারণ চলতি বছর প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে সাড়ে ২৪ টাকা। এ হিসাবে, প্রতি মণ  (কেজির হিসাবে) ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৯০৬ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ বর্তমানে দেশের হাট-বাজারগুলোতে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ থেকে সর্বোচ্চ ৭শ’ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। বর্গাচাষীরা বিঘা প্রতি জমিতে লোকসান দিচ্ছে ৫,০০০ টাকা। অন্যদিকে নিজস্ব জমিতে ধান চাষ করেও লাভের মুখ চোখে দেখছে না কৃষকরা। উপরন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বেশী দামে শ্রমিক নিয়ে তড়িঘড়ি করে ধান ঘরে তুলতে দ্বিগুণ খরচ গুণতে হয়েছে তাদের। দিনাজপুর যেলার ফুলবাড়ী উপযেলার বাসুদেবপুরের ধান চাষী পল্লী চিকিৎসক ওয়াজেদুর রহমান বাবলু বলেন, ‘এক একর ধান চাষ করতে খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ হাযার টাকা। আর প্রান্তিক চাষীদের জমির ভাড়া রয়েছে ৫ থেকে ৭ হাযার টাকা। অথচ এক একর জমির ধান বিক্রি করে  কৃষক পাচ্ছে ২৭ থেকে ২৮ হাযার টাকা। ধান চাষ করে একর প্রতি কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৫ থেকে ৭ হাযার টাকা। আর বর্গা চাষীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাযার টাকা। প্রতি বছর যদি কৃষকদেরকে ধান চাষ করে শুধু লোকসান গুনতে হয়, তাহ’লে এই কৃষক পরিবারগুলো বাঁচবে কিভাবে?

বোরো আবাদে কৃষকের ক্ষতি ১৭ হাযার ৫০০ কোটি টাকা :

বর্তমান দামে যদি দেশের কৃষক তাদের ৬৫ শতাংশ ধান বিক্রি করে দেয় তাহলে কৃষকের ১৭ হাযার ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হবে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ২৫ হাযার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হবে। এছাড়া সরকারীভাবে শস্য গুদাম ও মজুদাগার ২১ লাখ টন থেকে ৬০ লাখ টনে উন্নিত করতে হবে। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে কমিউনিটি ভিত্তিক শস্যভান্ডার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। গত ২৮শে মে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘ধানসহ কৃষিপণ্যের মূল্য: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা।

কৃষকের ধান কেটে দিল শিক্ষার্থীরা :

ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় সারাদেশে চলমান কৃষকদের প্রতিবাদের সাথে একাত্মতা জানিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ই মে ২০১৯ইং বৃহস্পতিবার সকাল ১১-টায় বিশ^বিদ্যালয়ের পাশ^র্বর্তী এলাকায় এক কৃষকের জমির ধান কেটে দেয় তারা। এসময় বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অর্ধশত শিক্ষার্থী এ কর্মসূচীতে অংশ নেয়।

অধিনায়ক মাশরাফী বিন মুর্তাযার দিক-নির্দেশনা :

বোরো ধানের দাম কম পেয়ে সারাদেশের কৃষকেরা যখন হতাশ, সেই মুহূর্তে নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফী বিন মুর্তাযা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং সরকারীভাবে ধান কেনার ক্ষেত্রে কৃষকেরা যাতে বঞ্চিত ও হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গত ১৯শে মে ২০১৯ইং রবিবার যেলা প্রশাসক আনজুমান আরার সঙ্গে ফোনে কথা বলে ধান কেনার ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।

ধানের দাম কম হওয়ার প্রধান কারণ :

২০১৭ সালের বন্যায় ফসলহানির পর ৮২ লাখ টন চাল আমদানী করা হয়েছিল। সরকারী হিসাব মতে, সে বছরের বন্যায় ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন কমে যায়। অথচ বন্যার পর আমদানী করা হয়েছিল ৮২ লাখ টন চাল। এই বিপুল পরিমাণ চাল আমদানী বিরূপ প্রভাব ফেলেছে আজকের কৃষকদের ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার ওপর। তখনকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা শুল্ক প্রত্যাহার ও ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়ে যে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানী করেছিল; সেই চালের দখলে এখনকার বাজার। এর ফলে কৃষকেরা হাট-বাজারে তাদের উৎপাদিত চাল বিক্রি করতে পারছেন না। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় বেশী চাল আমদানী করার কারণে আজকে কৃষকদের এই করুণ অবস্থা। পত্রিকার খবরে জানা গেছে, এখনও দেশে ২৫-৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে। এ বছরের বাড়তি ধান উৎপাদন ও আমদানী করা চাল বাজারে চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে ধানের দাম কমে গেছে।

ধানের ন্যায্য মূল্য পেতে কতিপয় সুপারিশ :

প্রতি বছর কৃষক ধানের উৎপাদন বাড়ালেও সে তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। কিন্তু যেভাবেই হোক কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথা কৃষক ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এজন্য আমাদের কতিপয় প্রস্তাব নিম্নরূপ।-

(১) সরকারী পর্যায়ে কৃষিপণ্যের বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।

(২) সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ও কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

(৩) কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে হবে এবং দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

(৪) যখন ফসল ওঠে তখন একজন ক্ষুদ্র কৃষক তার ফসল ধরে রাখতে পারে না। কারণ ফসল বিক্রি করে তার প্রয়োজন মিটাতে হয়। আর এই সুযোগটাই নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাই যে কোন মূল্যে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।

(৫) প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত চাল আমদানী বন্ধ করতে হবে।

(৬) সরাসরী কৃষকদের কাছ থেকে সরকারকে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৭) সার, বীজ, কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর দাম কৃষকদের অনুকূলে রাখতে হবে।

(৮) কৃষি যন্ত্রপাতি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। 

উপসংহার :

গত কয়েক বছর ধরে আমন ও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হ’লেও ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না কৃষক। ধানের উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বারবার লোকসানে পড়ে কৃষকরা ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ধানের বাম্পার ফলনের ধারাবাহিক সাফল্য দেশের জিডিপি ও খাদ্য নিরাপত্তায় বড় অবদান রাখছে। কিন্তু যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করছে তারাই হচ্ছে সর্বস্বান্ত। বর্তমান দরে কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসল বিক্রি করে স্বচ্ছলতার মুখ দেখা তো দূরের কথা, তাদের জীবিকা চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা কৃষকদের এই দুরাবস্থার অবসান চাই। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।







নাস্তিকতার ভয়ংকর ছোবলে বাংলাদেশের যুবসমাজ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
অক্টোবর বিপ্ল­ব (গর্বাচেভ কি বিশ্বাসঘাতক?) - মশিউল আলম
মিয়ানমার ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি - জামালউদ্দীন বারী
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান : স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয় - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের করণীয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রব
রক্তের এই হোলি খেলা বন্ধ হোক
আজারবাইজানের নাগর্নো-কারাবাখ বিজয় - মুহাম্মাদ ফেরদাউস
অবরুদ্ধ পৃথিবীর আর্তনাদ! - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ - জামালুদ্দীন বারী
নদী আটকে চীনের বাঁধ ও শত বছরের ধ্বংসযজ্ঞ - আত-তাহরীক ডেস্ক
আরাকানে পুনরায় বিপন্ন মানবতা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
শাহবাগ থেকে শাপলা : একটি পর্যালোচনা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আরও
আরও
.