ফ্রান্সের
বিদ্রুপ ম্যাগাজিন ‘শার্লি এবদো’র কার্যালয়ে শরীফ কৌচি এবং সাঈদ কৌচি
ভ্রাতৃদ্বয়ের সশস্ত্র হামলা এবং তাতে পত্রিকাটির সম্পাদকসহ ১২ জন ব্যক্তি
নিহত হওয়ার ঘটনায় সারাবিশ্ব এখন উত্তাল। পাশ্চাত্যবিশ্বের জনগণ ও মিডিয়া
ঘটনাটিকে দেখছে তথাকথিত ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হামলা’ হিসাবে।
একই সাথে চিরাচরিত ‘ইসলাম বিদ্বেষী জুজু’ উস্কে দিতে ব্যবহার করছে নতুন
অস্ত্র হিসাবে। ইতিমধ্যেই এই জুজুর কারণে ফ্রান্সের অর্ধশতাধিক স্থানে
মসজিদে এবং সাধারণ মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ২০০৬, ২০০৯ এবং ২০১২ সালেও এই পত্রিকাটি অত্যন্ত
উস্কানীমূলকভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছিল।
প্রথমেই পরিষ্কার করে নেয়া ভালো যে, শার্লি এবদো’র কার্টুনিস্টরা ইসলামের দৃষ্টিতে হত্যাযোগ্য অপরাধী হ’লেও যে প্রক্রিয়ায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তা ইসলাম সমর্থন করে না। কেননা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এখানে নিজের ইচ্ছামত কোন কিছু করার সুযোগ নেই। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, তাকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব ব্যক্তি বিশেষের উপর বর্তায় না, সে দায়িত্ব রাষ্ট্র তথা আইনগত প্রতিষ্ঠানের। এটা একটি সর্বস্বীকৃত বিষয়। কেননা অপরাধী চিহ্নিত করা এবং তার অপরাধের পরিমাপ ও শাস্তি নির্ধারণ করা এগুলোর জন্য একটি নিরপেক্ষ ও সুনির্দিষ্ট আইনী সংস্থার প্রয়োজন। কোন একক ব্যক্তি দ্বারা এই দায়িত্ব পালন কখনই সম্ভব নয়। সেকারণ সে দায়ভার তাকে দেয়াও হয় নি। এতদসত্ত্বেও যদি কোন ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে নিজেই শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নেয়, সেক্ষেত্রে সে-ই অপরাধী হবে। সুতরাং শার্লি এবদো’র কুখ্যাত কার্টুনিস্টরা যত বড় অপরাধীই হোক না কেন তাদের বিচারের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে হত্যাকারী ভাতৃদ্বয় সীমালংঘন করেছে এবং আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। যা ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। সুতরাং তারা যেটা করেছে, তা নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য। নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম কেউই এমন কাজকে সমর্থন দেননি।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘শার্লি এবদো’ নামক এই কুরুচিপূর্ণ ম্যাগাজিনই কেবল নয়, ইতিপূর্বে ডেনমার্ক সহ বেশ কয়েকটি দেশের পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষতঃ নাইন-ইলেভেনের পর থেকে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার অংশ হিসাবে এই জঘন্য অপতৎপরতা চালাচ্ছে কিছু মিডিয়া। আর তাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ যুগিয়ে যাচ্ছে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব। এই নির্লজ্জ মদদদানের পেছনে তাদের দাবী হচ্ছে, ‘ইউরোপীয় সভ্যতা’র মহা অর্জন হল ‘ফ্রীডম অফ এক্সপ্রেশন’, ‘ফ্রীডম অফ স্পীচ’ তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা। এটি ইউরোপীয় সমাজের এমন এক প্রশ্নাতীত অধিকার ও প্রাচীন ঐতিহ্য; যা কোন মতেই খর্ব করার উপায় নেই। সুতরাং এই অধিকারের সূত্র অনুযায়ী যদি কোন পত্রিকা ইসলামের নবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে, তবে তাতে বাধা দেয়া যাবে না। উল্টো মুসলমানদেরই নাকি উচিৎ পরমতসহিষ্ণু হওয়া এবং এই অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো!
‘শার্লি এবদো’য় হামলার ৪ দিন পর ১১ই জানুয়ারী এই ‘বাকস্বাধীনতা’র প্রতি সমর্থন জানাতেই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জড় হয়েছিল বিশেবর প্রায় ৫০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিসহ ১০ লক্ষেরও বেশী মানুষ। তাদের সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল একটি শ্লোগান-‘জ্য সুই শার্লি’ অর্থাৎ ‘আমরাই শার্লি (অর্থাৎ আমরা ‘শার্লি এবদো’র মত প্রকাশের অধিকারের ব্যাপারে একমত’)। হাস্যকর ব্যাপার হ’ল এই র্যালিতে যোগ দিয়েছিল ফিলিস্তীনীদের তাজা রক্তে রঞ্জিত ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুসহ সারাবিশ্বে মানবাধিকার লংঘনে শীর্ষস্থানীয় ক’টি দেশ। তাছাড়া স্বয়ং ফ্রান্সের হাতই তো রঞ্জিত হয়ে রয়েছে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের হাযারো মানুষের রক্তে। মাত্র কিছুদিন আগে তাদের নেতৃত্বেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে লিবিয়ার মত স্বচ্ছল ও স্বনির্ভর একটি দেশ। মানুষের প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারকে নিয়েই যারা ছেলেখেলা করে দিনরাত, তারাই কিনা সুবোধ বালকের মত এসেছে মানুষের তথাকথিত মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে আওয়াজ তুলতে! কি অদ্ভূত এক বিশ্বে বাস করি আমরা!
লন্ডন থেকে প্রকাশিত হাফিংটন পোস্টের রাজনৈতিক ভাষ্যকার মেহেদী হাসান তাঁর আর্টিকেলে পাশ্চাত্যের এই ‘বাকস্বাধীনতা’ তত্ত্বের শঠতা তুলে ধরে তথাকথিত উদারপন্থীদের নিকটে খুব শক্ত কিছু প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি জোর গলায় বলেন, এই বাকস্বাধীনতার বাগাড়ম্বরের পিছনে উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করা যে, পাশ্চাত্য হ’ল আলোকপ্রাপ্ত ও উদারপন্থী। আর মুসলমানরা হ’ল পশ্চাদপন্থী ও বর্বর। এজন্য সাবেক ফরাসী প্রধানমন্ত্রী নিকোলাস সারকোজি ঘটনার পরপরই বলেন, ‘এটা সভ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’। উদার-বামপন্থী ফরাসী নেতা জন স্নো আরো একধাপ বাড়িয়ে একে আখ্যায়িত করেন ‘সভ্যতার সংঘাত’ হিসাবে!
প্রশ্ন হল, বাকস্বাধীনতা কি কখনও বল্গাহীন হ’তে পারে? অথবা যে অর্থে পশ্চিমারা সেটাকে ব্যবহার করছে, তা কি তারা নিজেরাই বিশ্বাস করে? মেহেদী হাসান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে, কি রকম মিথ্যাচার এবং দ্বিচারিতায় লিপ্ত এই বাকস্বাধীনতার ফেরিওয়ালারা। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যারা আজ রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র অাঁকছে, তারা কি হলোকস্টকে ব্যঙ্গ করে চিত্র অাঁকতে পারবে? তারা কি ৯/১১-এর দিন টুইন টাওয়ারে নিহত ভিকটিমদের নিয়ে ক্যারিকেচার অাঁকতে পারবে? কিংবা অাঁকতে পারবে ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্মকে কটাক্ষ করে? তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কল্পনা করুন! একজন ব্যক্তি প্যারিসের ১১ই জানুয়ারী’র র্যালিতে যোগ দিয়েছে। তার বুকের ব্যাজে লেখা ‘জ্য সুই শরীফ’ (অর্থাৎ শার্লি এবদো’য় হামলাকারী শরীফ কৌচা)। আর তার হাতে বহন করছে নিহত সাংবাদিকদের ব্যঙ্গচিত্র। এমতাবস্থায় সমবেত জনতা লোকটির উপর কি আচরণ করবে? তারা কি এই একলা চলা লোকটাকে বাকস্বাধীনতার উপর অটল একজন ‘হিরো’ হিসাবে আখ্যায়িত করবে? নাকি এর বিপরীতে গভীরভাবে আহত বোধ করবে? বাস্তবতা কি এটাই নয় যে, লোকটি যদি প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে সেটাই হবে বিস্ময়কর?
যাবতীয় তত্তবকথার বাইরে সাদাচোখে যদি এই হিসাবটা মিলাতে যাই, তবে তাদের বাকস্বাধীনতার দাবী কোনমতেই কি ধোপে টিকতে পারে? পোপ ফ্রান্সিস সেদিকে দিকনির্দেশ করে বলেন, ‘যদি আমার মায়ের নামে কেউ কোন খারাপ কথা উচ্চারণ করে, তাহ’লে একটা ঘুষি অবশ্যই তার প্রাপ্য। সেটাই স্বাভাবিক নয় কী!’ এমনকি যে কার্টুনিস্ট এই জঘন্য কাজে হাত দিয়েছে, তার পিতামাতার নামেও যদি কেউ গালি দেয় সে কি পাল্টা প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে চুপ করে বসে থাকবে? একজন রক্ত মাংসের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হ’লে সেটা কখনই সম্ভব নয়।
একজন মুসলিমের কাছে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসার স্থানটি পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে পবিত্র। যার অন্তরে ক্ষীণতর ঈমান অবশিষ্ট আছে, তার কাছেও রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে প্রিয়তর মানুষ আর কেউ নেই। এমনকি যে মুসলমান আমলের ধার ধারে না, সে-ও পর্যন্ত রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্ত্তত থাকে। আর সেই মহা শ্রদ্ধার মানুষটিকে যখন কেউ হাসির খোরাক বানাতে চায় কিংবা অবমাননাকরভাবে উপস্থাপন করে, তখন তার অন্তরে কতটা আঘাত লাগে! কতটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়! পরিমাপ করা যায়! বাকস্বাধীনতার ফেরীওয়ালারা কি সেটা বোঝে না?
বোঝে। সবই বোঝে। আর এই বোঝার কারণেই ঠিক এই মুহূর্তে দুনিয়ার বহু দেশে সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ চালানো হলেও কোনটাই তাদের দৃষ্টি কাড়ে না। দৃষ্টি কাড়ে কেবল প্যারিসই। সমবেত হয় তারা প্যারিসেই। কেবলমাত্র এই সময়ই তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘জ্য সুই শার্লি’। এখানেই শেষ নয়, কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা দিতে সেই একই ‘শার্লি এবদো’ আবারও এ সপ্তাহে তথা ২১ জানুয়ারী প্রকাশ করেছে রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র। সেই সংখ্যার পাঠকচাহিদা এতই বেড়েছে যে, যে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ছিল ৬০ হাযার, তা নিমিষেই উপনীত হয়েছে ৫০ লাখে! সেই সংখ্যা ছাপানোর জন্য ফ্রান্স সরকারসহ বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থা দিয়েছে মোটা অংকের অনুদান!
মেহেদী হাসান ক্ষেদ নিয়ে লিখেছেন, ‘মুসলমানদের গায়ের চামড়া বোধহয় খৃষ্টান, ইহুদীদের চেয়ে মোটা হওয়ার আশা করা হয়। নতুবা কিভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র ছাপিয়ে তুমি কামনা কর যে, মুসলমানরা এটা দেখে হাসবে বা মজা পাবে? তুমি কিভাবে দাবী কর যে, মুসলিম সমাজকে হাতে গোনা ক’জন চরমপন্থীকে (যারা কিনা তোমাদের কারণেই সৃষ্টি) বাকস্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসাবে ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় নামতে, যখন এর চেয়ে আরও অনেক বড় হুমকি থেকে তোমরা চোখ সরিয়ে রেখেছ? (এই ফ্রান্সেই মুসলিম মহিলাদের নেক্বাব পরা এখন নিষিদ্ধ এবং জরিমানাযোগ্য অপরাধ!)’।
বৃটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিক্স তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাস্তবতা এটাই যে, এই অঘটনগুলো ঘটার পর মিডিয়ায় সবসময় বলা হয় ‘হু এবং হাউ’ অর্থাৎ ‘কে ঘটিয়েছে এবং কিভাবে ঘটিয়েছে’। কিন্তু খুব কমই বলা হয় ‘হোয়াই’ অর্থাৎ কেন ঘটিয়েছে’। চরমপন্থী এবং ইসলামের প্রকৃত নীতি সম্পর্কে অজ্ঞ দু’ভাইয়ের কাজকে আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু তাদের এই কাজের পিছনে শার্লি এবদো’ই কি পরিষ্কারভাবে দায়ী নয়? পশ্চিমা সমাজব্যবস্থার এই নগ্ন দ্বিচারিতাই কি তাদের উসকিয়ে দেয়নি? তারা কি আদতে ‘মতপ্রকাশের অধিকার’কে রোধ করার জন্যই আক্রমণ চালিয়েছিল? না কি নবী (ছাঃ)-এর প্রতি অসম্মানে বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিল? সুতরাং এই ‘জ্য সুই শার্লি’ শ্লোগান ভন্ডামী ছাড়া আর কিছুই নয়।
পশ্চিমারা এই বিকৃত ‘বাকস্বাধীনতা’র বুলি কেবল মুসলমানদের বিরুদ্ধেই কপচায়। কিন্তু নিজেদের বেলায় তাদের কী ভূমিকা? ‘উইকিলিকস’-এর সাংবাদিকদের ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপ কি ছিল? ইয়েমেনের ড্রোন-বিরোধী সাংবাদিক আব্দুল্লাহ হায়দার শাইকে আটক করার জন্য কেন আমেরিকা আজ ইয়েমেন সরকারকে চাপ দিচ্ছে? গতবছরই গাজায় বহু সাংবাদিক নিহত হওয়ার পরও তারা টুশব্দটি কেন উচ্চারণ করেনি? কেন এঞ্জেলা মার্কেলের জার্মানীতে হলোকস্টের বিরোধী কোন কথা উচ্চারণ করলে ৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়? কেন ডেভিড ক্যামেরনের ইংল্যান্ডে গণতন্ত্রবিরোধী মুসলিম ধর্মনেতাদেরকে টেলিভিশনে আসতে না দেয়ার জন্য সংসদে বিল তোলা হয়? কেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশসমূহে ডা. জাকির নায়িক, ড. আবু আমিনা বিলাল ফিলিপসের মত খ্যাতনামা দাঈদেরকে প্রবেশাধিকার দেয়া হয় না? কেন ‘শার্লি এবদো’ নতুন সংখ্যা প্রকাশের দিনই তথা ২১ জানুয়ারী ফ্রান্সের পুলিশ দিযোদন নামক এক কৌতুকাভিনেতাকে গ্রেফতার করল সাম্প্রদায়িক এবং ইহুদী বিদ্বেষী প্ররোচনার দায়ে? এইভাবে হাযারটা প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে ‘বাকস্বাধীনতা’র ফেরিওয়ালাদের কাছে। যার কোন উত্তর তাদের কাছে নেই।
মার্কিন সাংবাদিক নোয়াম চমস্কি এই ‘জ্য সুই শার্লি’ হিপোক্রিসির এমন অনেকগুলো উদাহরণ টেনে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-যেটা মূলত ‘আধুনিক যুগের সবচেয়ে চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদী প্রচারণা’ (the most extreme terrorist campaign of modern times) এবং বারাক ওবামার বৈশ্বিক গুপ্তহত্যা অভিযান, যেটি ১১ই জানুয়ারী প্যারিস র্যালির দিনও নিয়োজিত ছিল সিরিয়া, ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ হত্যায়, অথচ সেই দেশটিই কি-না মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য র্যালিতে নামে? তারপর নিবন্ধের একেবারে শেষ বাক্যে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহবান জানিয়ে যে কথা বলা হচ্ছে যে, ‘সন্ত্রাস সন্ত্রাসই, এর মধ্যে দ্বিতীয় কিছু নেই’-এটা চূড়ান্ত অসত্য কথা। অবশ্যই এর মধ্যে দ্বিতীয় কিছু রয়েছে। সেটা হ’ল ‘আমাদের সন্ত্রাস বনাম তোমাদের সন্ত্রাস’। অর্থাৎ পশ্চিমারা যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে তার কোন বিচার নেই। কিন্তু অন্যরা সন্ত্রাস করলে তার বিচার হ’তে হবে।
এভাবেই প্যারিসের ‘জ্য সুই শার্লি’ র্যালিতে আর যা-ই হোক কোন শান্তি, মানবাধিকার, পরমতসহিষ্ণুতার বার্তা ছিল না। বরং তা পশ্চিমাদের ডাবল স্টান্ডার্ডকে আরো নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। যার মধ্যে লুক্কায়িত আছে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ আর পরমতকে অশ্রদ্ধার লকলকে বিষাক্ত জিহবা। তাদের বিরাট সাফল্য যে তারা গোটা বিশ্বকে অন্ধ বানিয়ে তাদের ঔপনিবেশিক কালো ইতিহাসকে যেমন লুকিয়ে ফেলতে পেরেছে, ঠিক তেমনিভাবে আজও তাদের আসল চেহারাকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে বুক ফুলিয়ে সভ্যতার ঘোষণা দিতে পারছে।
শেষ কথা হল, পাশ্চাত্যের এই উসকানী মূলক কর্মকান্ডে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। কোন রকম উগ্রবাদী ও চরমপন্থী কর্মে লিপ্ত হওয়া যাবে না। রাসূল (ছাঃ)-কে যে যত মন্দভাবেই চিত্রিত করুক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তা কি কখনও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর আরোপিত হয়? কখনই না। একদল আত্মপ্রচারলোভী দুশ্চরিত্র শয়তানের কর্মকান্ডে রাসূল (ছাঃ)-এর সুমহান মর্যাদার কোনই ক্ষতি হয় না, তেমনি ইসলামেরও কিছু যায় আসে না। এজন্য প্রথমতঃ এই অসভ্য, জাহেলদের এড়িয়ে যাওয়াই উচিৎ। বিশেষতঃ এসব উস্কানীর পিছনে যখন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর গোপন এজেন্ডা কার্যকর রয়েছে। এ ব্যাপারে একটি হাদীছও বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। মক্কার জাহেলী আরবরা যখন রাসূল (ছাঃ)-কে ব্যঙ্গ করে কষ্ট দিতে চেয়েছিল, তখন তিনি তাদেরকে পাল্টা জবাব না দিয়ে অত্যন্ত বু&&দ্ধদীপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তিনি ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘তোমরা কি দেখছ না আমার উপর কুরাইশদের নিন্দা ও অভিশাপকে আল্লাহ কিভাবে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? তারা তো গালি দিচ্ছে ‘মুযাম্মাম’ তথা ‘নিন্দিত’কে। আর আমি তো ‘মুহাম্মাদ’ তথা প্রশংসিত (বুখারী হা/৩৫৩৩)। অর্থাৎ তিনি এদেরকে স্রেফ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। একটু ভাবলেই বোঝা যায় সভ্যতার সর্বোচ্চ নিদর্শন দেখিয়ে, নিজের সুউচ্চ মর্যাদায় এতটুকু আঁচড় কাটতে না দিয়ে কি অসাধারণভাবেই না তিনি এমন পরিস্থিতির সামাল দিয়েছিলেন! উম্মতের জন্য এই হাদীছটির চেয়ে উত্তম শিক্ষা আর কী হ’তে পারে! সুতরাং এই নিকৃষ্ট নরাধমদের দুর্গন্ধময় কর্মকান্ডকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দেয়াটাই হ’তে পারে এদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় জবাব।
দ্বিতীয়তঃ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না হ’লে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে। কিন্তু তার প্রকাশটা যেন অসংযত না হয়। প্রতিবাদের নামে আজকাল যা হয় অর্থাৎ পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাঁধানো, বোমাবাজি, ভাংচুর এবং প্রাণঘাতি কাজে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি একেবারেই অর্থহীন কাজ। এসবের বাইরে বৈধ সকল উপায়ে প্রতিবাদ করা যেতে পারে। এবারের ঘটনায় গত ১৯ জানুয়ারী চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীতে সরকারী উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ একত্রিত হওয়া একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত। সবচেয়ে উপযুক্ত হতো যদি মুসলিম সরকারগুলোর পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানানো হ’ত। সঊদী আরব সহ নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশগুলো যদি এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করত, তাহ’লে মানুষের অনুভূতি নিয়ে এই খেলা বন্ধ হত। দুস্কৃতিকারীরা এসব অপরাধ করার কোনই সুযোগ পেত না। দুর্ভাগ্য আমাদের সামনে যোগ্য নেতৃত্ব নেই। মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা সবাই আজ মেরুদন্ডহীন নপুংসক। ন্যায়ের পক্ষে একটি শক্ত কথা বলার ক্ষমতা পর্যন্ত তাদের নেই। তাদের অকর্মণ্যতার দরুণ আজ সংখ্যায় ১৬০ কোটি হয়েও ইসলামের অনুসারীদেরকে মাথা নত করে চলতে হচ্ছে।
তৃতীয়তঃ ইসলামী আইনে এমন অপরাধীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। সুতরাং কোন মুসলিম দেশে এমন ঘটনা ঘটলে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সরকারকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি তা না নেয়, তবে জনগণের কর্তব্য হ’ল সরকারকে সতর্ক করা। তারপরও যদি সরকার ব্যবস্থা না নেয় তবে সে জন্য সরকার দায়ী হবে।
আল্লাহ রববুল আলামীন মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন! আমাদের সামনে একটি যোগ্য নেতৃত্ব দিন। বাতিলের অন্যায় আক্রমণকে যথাযথভাবে মুকাবিলা করার শক্তি দিন এবং বাতিলের সামনে হকের ঝান্ডাকে উঁচু রাখার তাওফীক দান করুন- আমীন!
আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
* এম.এস (হাদীছ), ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান।