বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অনন্তরূপের সৌন্দর্য সুন্দরবন থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে হ’তে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ ১ হাযার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। অর্থমন্ত্রী দ্বিতীয় দফায় ঘোষণা করলেন, রামপালে নির্মিতব্য কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সুন্দরবনের কিছু ক্ষতি অবশ্যই হবে। কিন্তু কিছু নাকি করার নেই। তবু এ বনেই বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হবে! তার বক্তব্যে সুন্দরবনের ওপর কোন জোর নেই, জোরটা আছে কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর। সুন্দরবনকে হুমকিতে ফেলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির এ পরিকল্পনা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বনাম প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের পুরনো বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। একসময় এ চাহিদা মেটাতে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ব্যবহৃত হ’লেও এখন আমাদের সমহারে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন কোনটি যেমন সরকারি উৎপাদন কেন্দ্রের চেয়েও পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী, আবার কোন কোনটি পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ ও অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সুন্দরবনের পরিবেশগত বিপদসীমার মধ্যে প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তেমনই একটি সম্ভাব্য স্থাপনা।
যারা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে আছেন, তারা দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ ঘাটতি কমানোটাকে অনেক বেশি যরূরী বলে মনে করছেন। তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ মুহূর্তে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং কারিগরি দক্ষতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, ‘সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’-এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ সুন্দরবনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে! যারা বিরোধিতা করছেন তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরুর প্রক্রিয়াগত ত্রুটি, অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্থান নির্বাচন, জমি অধিগ্রহণ, দুর্বল এবং পক্ষপাতমূলক পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ), নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশগত ছাড়পত্র সংগ্রহ, প্রকল্পের দূরত্বভিত্তিক অবস্থানের বিতর্ক প্রভৃতি বিষয়কে সামনে এনে দাবী করছেন এ প্রকল্প নিশ্চিতভাবে সুন্দরবনের বিনাশ করবে।
প্রকল্পের স্থান চূড়ান্তকরণ ও জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিস্বাক্ষর ইত্যাদি যাবতীয় কাজ শেষ হওয়ার পর কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ বা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) করা ও তার জন্য জনসাধারণের কাছে মতামত চাওয়াটা তামাশাই বটে! সরকার জনগণের সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর তামাশাটি করল, তাও আবার এমন একটি স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে; যা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনের খুব কাছেই, একেবারে বিপজ্জনক সীমার মধ্যে অবস্থিত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের একটি প্রস্তাব ছিল। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১২ সালে সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে দু’টি ৬৬০ ইউনিট মিলে মোট ১ হাযার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের ‘ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনে’র (এনটিপিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়, ভারতের এনটিপিসি কোম্পানি সে দেশের ছত্তিশগড়ে একই প্রকল্প অর্থাৎ একটি ১ হাযার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। সে দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করায় ভারত সরকার সে প্রকল্পটি বাতিল করেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যে প্রকল্পটি তার জন্মভূমি ভারতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হ’ল সেটি আমাদের দেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেল কীভাবে?
পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য যে ইআইএ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু মোটা দাগের অসঙ্গতি রয়েছে। ভারতের ছত্তিশগড়ে বাতিল হয়ে যাওয়া একই প্রকল্পের জন্য ভারতীয় ইআইএ প্রতিবেদনের সঙ্গে বাংলাদেশের ইআইএ প্রতিবেদনের তুলনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়।
ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এনভায়রনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) থেকে চার কিলোমিটার বাইরে বলে নিরাপদ হিসাবে দাবী করা হয়েছে। কিন্তু জিআইএস সফটওয়্যার দিয়ে মেপে দেখা যায়, এই দূরত্ব সর্বনিম্ন নয় কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ ১৩ কিলোমিটার। এনটিপিসি নামে যে ভারতীয় কোম্পানিটি সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের পাশে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সেই ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৭২ অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বাঘ বা হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে দেওয়া হচ্ছে, নিজ দেশ ভারতে হ’লে সেটা তারা করতে পারত না। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক কোন মানদন্ডেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এত স্বল্প দূরত্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কোন আইন না থাকায় এনটিপিসি ও পিডিবি এই ১০ কিলোমিটারের সুযোগটা নিয়েছে।
বাংলাদেশের ইআইএ প্রতিবেদন অনুসারেই প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে ৭৫ শতাংশ কৃষিজমি, যেখানে বছরে ৬২ হাযার ৩৫৩ টন ধান এবং ১ লাখ ৪০ হাযার ৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়। গরান (ম্যানগ্রোভ) বনের সঙ্গে এ এলাকার নদী ও খালের সংযোগ থাকায় এখানে বছরে ৫,২১৮ দশমিক ৬৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এই ধান-মাছ উৎপাদন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রায় ৮ হাযার পরিবার উচ্ছেদ হবে, যার মধ্যে উদ্বাস্ত্ত এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭ হাযার ৫০০ পরিবার। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রকল্প এলাকার ফসল ও মৎস্যসম্পদ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিবহন করার ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও তেলসহ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণ ইত্যাদি। পরিবেশ আইন অনুসারে এসব নিয়ন্ত্রণের কোন নযীর বাংলাদেশে নেই বলেই আমরা বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে তাকালে প্রমাণ পাই। সুতরাং এই অতিরিক্ত নৌযান চলাচলের ফলে সুন্দরবনের বাস্ত্তব্যবস্থা (ইকোসিস্টেম) বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, গরান বন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া প্রকল্প নির্মাণ পর্যায়ে পশুর নদীতে ড্রেজিং করার কারণে পানি ঘোলা হয়ে নদীর বাস্ত্তব্যবস্থা বিপন্ন হবে এবং জেটি ও নদীতীর সংরক্ষণের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের সময় গরান বনভূমির অনেক গাছ ও ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন পাখি, বিশেষ করে সারস ও বকজাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে।
ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সঙ্গে মিলে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বানাচ্ছে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। যাতে কয়লা পুড়বে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাযার টন, প্রতিদিন ১৩ হাযার টন। এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন। যেখানে কিনা একটি ইটের ভাটায় কয়লা পোড়ে বছরে ২ হাযার ৫০০ টন, যা কিনা সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে হাযার হাযার ইটের ভাটা বসিয়ে দেওয়ারই নামান্তর। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ফ্লাই অ্যাশ বা কয়লা পোড়া ছাই বাতাসে উড়ে ঢুকতে থাকবে বনের ভেতর।
বনের পানিজীবন ধ্বংস হবে, মাটির উর্বরতা নষ্ট হবে, গাছ ও প্রাণীরা বিপন্ন হবে। এ প্রকল্পের ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হবে প্রায় ৭৯ লাখ টন, যা ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান। এছাড়া বাতাসে পারদ, প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড (বছরে ৫১ হাযার ৮৩০ টন) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (বছরে ৩১ হাযার ২৫ টন) নির্গত হবে, যা ফুসফুস ও টিস্যুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘোরানো ও শীতলীকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য পশুর নদী থেকে ঘণ্টায় ৯ হাযার ১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে এবং ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি পরিশোধন করে ঘণ্টায় ৫ হাযার ১৫০ ঘনমিটার হারে আবার নদীতে ফেরত দেওয়া হবে। ফলে নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় কার্যকর পানি প্রত্যাহারের পরিমাণ হবে ৪ হাযার ঘনমিটার। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে ক্ষতিকর বর্জ্য হবে এর দুই ধরনের কয়লা পোড়া ছাই। এখানে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাযার টন কয়লা পোড়ানোর ফলে ৭ লাখ ৫০ হাযার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশের বর্জ্য তৈরি হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই বিপজ্জনক মাত্রায় পরিবেশদূষণ করে। কারণ এতে আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়ামের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর ও তেজস্ক্রিয় ভারী ধাতু মিশে থাকে। কিন্তু সরকার এসবকে কোনভাবেই গুরুত্ব সহকারে দেখছে না।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপদ নিশ্চিত জেনে রামসার ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি থেকে নরওয়ে সরকারের গ্লোবাল পেনশন ফান্ড বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থসংস্থানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এমনকি প্রথম দিকে খোদ সরকারের বিভিন্ন বিভাগও লিখিতভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল! কিন্তু কতিপয় দেশী-বিদেশী গোষ্ঠীর মুনাফা উন্মাদনা সরকারকে বধির করেছে, সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন আরও যোরদার হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের দালাল পুঁজিপতি মুনাফাখোরদের বন থেকে হটাতে, সুন্দরবন বাঁচানোর আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ও জনমনে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে দীর্ঘদিন থেকে সাত দফা দাবী নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। ইতিপূর্বে তারা সুন্দরবন রক্ষায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ছয় দিনব্যাপী এক লংমার্চের আয়োজন করেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিত সরকার ভীষণ চাপে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী রামপাল এলাকায় যেতে দ্বিধা করেন এবং গোপনে ঢাকায় বসে স্কাইপের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন।
পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শাসকশ্রেণী ব্যক্তিগোষ্ঠী মুনাফা ও দেশী-বিদেশী শক্তির স্বার্থ নিশ্চিত করতে গিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নানা সংকটে ফেলে দেয় এবং পরে আবার সেই সংকট থেকে উদ্ধারের নামে মুনাফার প্রাধান্য দিয়ে আরও বড় সংকট ডেকে আনে। গ্যাস ব্লক বিদেশী কোম্পানির কাছে ইজারা, কুইক রেন্টালের নামে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়, ভারতীয় বিনিয়োগে সুন্দরবন-কৃষিজমি ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, রিলায়েন্স-আদানীর সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সমঝোতা চুক্তি ইত্যাদি সবকিছুই এই মুনাফা ও লুটপাটের আয়োজনের অংশ। এ কারণেই স্থানীয় জনগণ, সারা দেশের জনমত, বিশেষজ্ঞ মতামত এমনকি রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের মতামত পর্যন্ত উপেক্ষা করে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার।
আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তবে সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার আরও পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী উপায় থাকতে সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তাও আবার এমন একটি প্রতিষ্ঠানের
মাধ্যমে, যে প্রতিষ্ঠানটি তার নিজের দেশেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়নি। সুন্দরবন ও এর বাস্ত্তব্যবস্থা এবং জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে চাইলে অবশ্যই রামপালে প্রতিষ্ঠিতব্য কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি বাতিল করতে হবে।
রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে তর্ক-বিতর্কে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হ’ল বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, বহু বিকল্প জায়গা আছে। কিন্তু সুন্দরবন আমাদের এই পৃথিবীতে একটাই। আর এই ম্যানগ্রোভ বনটিই শত শত বছর ধরে আমাদের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করে আসছে। এটার দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধী নই, কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের অজুহাতে পানি-জমি-জঙ্গল-জীবন ও অর্থনীতি ধ্বংসকারী কোন প্রকল্প মেনে নিতে রাযী নই। এজন্য রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করে এই বিশ্ব সম্পদটিকে বাঁচানো যরূরী। কেননা দেশের সম্পদ রক্ষা পেলে মানুষ বাঁচবে।
\ সংকলিত \
[উল্লেখ্য যে, গত ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারী’১৬ রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর ২৬তম বার্ষিক কেন্দ্রীয় তাবলীগী ইজতেমার শেষদিনে গৃহীত ৯নং প্রস্তাবে রামপাল পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হ’তে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি জোরালো দাবী জানানো হয়। আমরা এই প্রকল্প অনতিবিলম্বে বাতিল করার জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছি (স.স.)]