ভূমিকা :
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (১২৮৯-১৩৪২ হিঃ) ছিলেন হিজরী চতুর্দশ শতকের একজন খ্যাতিমান আহলেহাদীছ আলেম। মুবারকপুরের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের এই কৃতী সন্তান শিক্ষকতা ও লেখালেখিতে নিজের সারাজীবন ব্যয় করেছেন। তাহকীকী মেযাজ তাঁর লেখনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি উর্দূ ভাষার একজন উঁচুমাপের প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক ও সমালোচক ছিলেন। উর্দূ ভাষায় রচিত তাঁর ‘সীরাতুল বুখারী’ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। যংঔ
পারিবারিক ঐতিহ্য :
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরীর বাপ-দাদারা মুত্তাক্বী-পরহেযগার, সমাজের নেতৃস্থানীয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ হুসামুদ্দীন ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী (১৭৮৬-১৮৩১) ও মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ (১৭৭৯-১৮৩১)-এর সাথী ও সহযোদ্ধা ছিলেন। তিনি তাঁদের সাথে জিহাদে গমন করেছিলেন এবং তাঁদের পূর্বেই ১২৪৪ হিজরীতে এক যুদ্ধে (সম্ভবতঃ পাঞ্জতার) শাহাদতবরণ করেন।[1] তাঁর দাদা আমানুল্লাহ আলেম-ওলামার মজলিসে উঠাবসা করতেন এবং বিশুদ্ধ আক্বীদা লালন করতেন। বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল রুদ্রকঠোর। তাঁর নানা মাওলানা হাকীম আমানুল্লাহ (মৃঃ ১২৯৯ হিঃ) খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ মাওলানা আবূ ইসহাক লুহরাবীর (মৃঃ ১২৩৪ হিঃ) ছাত্র ছিলেন। যিনি শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভীর (১৭৪৬-১৮২৪) ছাত্র। তিনি তাঁর সময়ে মুবারকপুরের অভিজ্ঞ হেকিম ও গ্রামের সর্দার ছিলেন।[2] মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী তাঁর নানা সম্পর্কে বলেছেন,وكان رئيس القوم، وطبيبا مرجعا للخلائق... وكان من العاملين بالحديث، ‘তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের-সরদার, হেকিম ও মানুষের আশ্রয়স্থল ছিলেন। ... তিনি হাদীছের প্রতি আমলকারীদের অন্তর্ভুক্ত তথা আহলেহাদীছ ছিলেন’।[3] পিতা খান মুহাম্মাদ (১২৫৭-১৩২৭ হিঃ) অত্যন্ত দ্বীনদার ও ইবাদতগুযার ছিলেন। মাওলানা আব্দুস সালাম তাঁর পিতা সম্পর্কে লিখেছেন, كان تلاَّء للقرآن، خاشعا لله، حافظا للأدعية المأثورة، متبعا للسنن النبوية شغفا بها، مشتغلا بمطالعة الكتب الدينية، عارفا للحلال والحرام، جوادا خادما للخلق، صابرا شاكرا، ‘তিনি কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতকারী, আল্লাহভীরু এবং মাসনূন দো‘আ সমূহের হাফেয ছিলেন। হাদীছে নববীর অনুসারী ও অনুরক্ত ছিলেন। তিনি ধর্মীয় বই-পুস্তক অধ্যয়নে মশগূল থাকতেন। হালাল-হারাম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, দানশীল, জনসেবক, ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী ছিলেন’।[4] দ্বীনী কাজ-কর্মে তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল অতুলনীয়। তিনি পেশায় কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। মুবারকপুরের তৈরী রেশমী কাপড় ভূপাল ও হায়দ্রাবাদের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন।[5]
জন্ম :
মাওলানা আব্দুস সালাম[6] মুবারকপুরী ভারতের আযমগড় যেলার মুবারকপুরে এক সম্ভ্রান্ত আহলেহাদীছ পরিবারে[7] ১২৮৯ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।[8]
শিক্ষা জীবন :
মাওলানা আব্দুস সালাম পিতার তত্ত্বাবধানে ধার্মিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখাপড়ার ব্যাপারে পিতা খান মুহাম্মাদ যত্নবান ছিলেন। তিনি কাফিয়া ও শাফিয়া পর্যন্ত মাওলানা হাফেয আব্দুর রহীম মুবারকপুরী (আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর পিতা) ও অন্য শিক্ষকদের কাছে পড়েন। তিরমিযীর বিশ্বখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ প্রণেতা আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর কাছে শরহে জামী ও শরহে তাহযীব অধ্যয়ন করেন। মোল্লা হুসামুদ্দীন মৌভী (মৃঃ ১৩১০ হিঃ)-এর নিকট শরহে বেকায়া পড়েন। অতঃপর ১৩০৭ হিজরীতে গাযীপুর শহরে গিয়ে ‘উসতাযুল আসাতিযাহ’ (শিক্ষককুল শিরোমণি) হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরীর মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এরপর দিল্লীতে গিয়ে ‘মাদ্রাসা ফতেহপুরী’তে মাওলানা আব্দুল হক বেলায়াতী মুলতানীর (মৃঃ ১৩২১ হিঃ) নিকট কতিপয় দরসী কিতাব পাঠ করেন।[9]
মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর সান্নিধ্যে :
এরপর তিনি সাইয়িদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর নিকট গমন করেন এবং তাঁর নিকট কুতুবে সিত্তাহ, মিশকাতুল মাছাবীহ, মুত্তয়াত্ত্বা ইমাম মালেক, দারাকুতনী, শরহে নুখবা, তাফসীরে জালালাইন এবং হেদায়া ও বায়যাভীর কিয়দংশ পাঠ করেন। তাছাড়া তিনি তাঁর নিকট থেকে কুরআন মাজীদের অনুবাদও শ্রবণ করেন। ১৩১১ হিজরীতে মিয়াঁ নাযীর হুসাইনের নিকট থেকে শিক্ষা সমাপনী সনদ লাভ করেন। সনদের শেষে মিয়াঁ ছাহেব বলেন,وأوصيه بتقوى الله تعالى وإشاعة السنة بلا خوف لومة لائم، اللهم أيده بالاستقامة إلى الدين القويم، ‘আমি তাঁকে তাক্বওয়া অর্জনের এবং নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া না করে নির্ভয়ে সুন্নাহর প্রচার-প্রসারের জন্য অছিয়ত করছি। হে আল্লাহ! তুমি তাঁকে সঠিক দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে সহায়তা করো’।[10]
মাওলানা আব্দুস সালাম ছহীহ বুখারী অধ্যয়নের সময় মিয়াঁ নাযীর হুসাইনের ইলমী ফায়েদাগুলো তাঁর কপিতে লিখে নিয়েছিলেন। এটি অদ্যাবধি তাঁর উত্তরাধিকারীদের নিকট মওজুদ রয়েছে।[11]
অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলী :
দিল্লীতে বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ শায়খ হুসাইন বিন মুহসিন ইয়ামানী আনছারী (মৃঃ ১৩২৭ হিঃ) আগমন করলে মাওলানা আব্দুস সালাম তাঁর নিকট হাযির হয়ে কুতুবে সিত্তাহ, মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালেক ও দারেমীর প্রথম দিকের কিছু অংশ পাঠ করে ১৩১০ হিজরীতে ‘ইজাযাহ’ লাভ করেন। অতঃপর ১৩২১ সালে তাঁর সাথে মাওলানার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। এ সময় তিনি তাঁর নিকট থেকে হাদীছের ‘মুসালসাল বিল আওয়ালিয়াহ’ সনদ হাছিল করেন।[12] লাক্ষ্মৌর প্রসিদ্ধ হেকিম আব্দুল অলী বিন আব্দুল উলার নিকট তিনি হেকিমী বিদ্যা শিক্ষা করেন।[13]
১৩১৩ হিজরীর রামাযান মাসে তিনি প্রখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিছ মাওলানা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয জা‘ফরী মিছলীশহরীর (মৃঃ ১৯০৪) নিকট আযমগড়ে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী সংকলিত ‘বুলূগুল মারাম’ পাঠ করে সনদ লাভ করেন। পাঠদান শেষে স্নেহের নিদর্শন স্বরূপ উস্তাদ তাঁর নিজের কপিটি প্রিয় ছাত্রকে হাদিয়া দেন। যা অদ্যাবধি তাঁর পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে।[14]
শিক্ষকতা :
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী স্বীয় যুগের একজন খ্যাতিমান ও বড় মাপের শিক্ষক ছিলেন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘মাওলানা আব্দুস সালাম সত্যিকার অর্থে একজন আলেম এবং বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমি যখন শিক্ষক খুঁজতাম তখন সর্বপ্রথম তাঁর ওপরেই আমার নযর পড়ত’।[15] মাওলানা কাযী আতহার মুবারকপুরী (১৯১৬-১৯৯৬) বলেন, ‘তাঁর পাঠদানের যোগ্যতা ও খিদমতের খ্যাতি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল’।[16]
তিনি মাদ্রাসা আহমাদিয়াহ, আরাহ-তে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। সেখানে তিনি মুদাররিসে চাহারম তথা চতুর্থ শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। এরপর প্রায় ১৫ বছর ছাদেকপুর, পাটনার মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। এ দীর্ঘ সময় ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। এখানে তাঁর ইলমী যোগ্যতার মুক্তা বিচ্ছুরিত হয়। তারীখুল মিনওয়াল ওয়া আহলুহু, সীরাতুল ইমাম আল-বুখারী সহ অধিকাংশ গ্রন্থ তিনি এ সময় রচনা করেন।[17]
মাদ্রাসা আহমাদিয়াহ, আরাহ ছেড়ে ছাদেকপুর, পাটনায় চলে আসলেও মাদ্রাসা আহমাদিয়াহ-এর সাথে তাঁর সম্পর্ক অটুট ছিল। মাদ্রাসার বার্ষিক পরীক্ষায় পরীক্ষক হিসাবে তাঁকে ডাকা হ’ত। তিনি আমানতদারিতার সাথে পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব পালন করতেন। তাছাড়া উক্ত মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক জালসা সমূহে উপস্থিত হয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করতেন।[18]
উল্লেখ্য যে, আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর পরামর্শ মোতাবেক ছাদেকপুরী পরিবারের অন্যতম স্তম্ভ ও শহরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব ছাদেকপুরী তাঁকে ছাদেকপুরে নিয়ে এসেছিলেন।[19]
অতঃপর আব্দুস সালাম মাদ্রাসা আলিয়া আরাবিয়া মৌনাথভঞ্জনে তিন বছর, বলরামপুর যেলার বনঢেয়ার গ্রামে অবস্থিত মাদ্রাসা সিরাজুল উলূমে ৪ বছর এবং দেড় বছর দারুল হাদীছ রহমানিয়া, দিল্লীতে শায়খুল হাদীছ হিসাবে পাঠদান অব্যাহত রাখেন।[20]
আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর সাথে তাঁর সম্পর্ক :
ছাদেকপুর, পাটনায় অবস্থানকালে আওনুল মা‘বূদ-এর স্বনামধন্য লেখক আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর সাথে মাওলানা আব্দুস সালামের গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়। আযীমাবাদী ‘মাদ্রাসা ইছলাহুল মুসলিমীন’ (পাটনা)-এর মুহতামিম ও সেক্রেটারী এবং মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুবের বিয়াই ছিলেন।[21] আযীমাবাদী আব্দুস সালামকে শিক্ষকতার পাশাপাশি গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর উৎসাহ ও সার্বিক সহযোগিতায় তিনি সীরাতুল বুখারী রচনা করেন।[22]
ছাত্রবৃন্দ :
মাওলানা আব্দুস সালাম প্রায় ২৪ বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষকতার বরকতময় ময়দানে নিয়োজিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ের পথপরিক্রমায় বহু ছাত্র তাঁর নিকট থেকে ইলমে দ্বীন হাছিল করেছেন। এদের অধিকাংশই আযীমাবাদ ও এর আশপাশের এলাকার। কারণ তিনি এখানে ১৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম হ’ল:
মুবারকপুর : ১. মাওলানা আব্দুল আযীয মুবারকপুরী ২. মাওলানা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী ৩. মাওলানা আব্দুছ ছামাদ মুবারকপুরী ৪. মাওলানা হাকীম মুহাম্মাদ বাশীর মুবারকপুরী ৫. মাওলানা নাযীর আহমাদ রহমানী আমলুবী (‘আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত’ গ্রন্থের লেখক)।
আযীমাবাদ : ৬. মাওলানা আব্দুল গাফফার ছাদেকপুরী ৭. মাওলানা হাকীম আব্দুর রায্যাক ছাদেকপুরী ৮. প্রফেসর মুহাম্মাদ মুসলিম ছাদেকপুরী ৯. মাওলানা হাকীম আব্দুল ওয়াহ্হাব ছাদেকপুরী ১০. মাওলানা আব্দুস সাত্তার ছাদেকপুরী ১১. মাওলানা মুজীবুল্লাহ আযীমাবাদী ১২. সাইয়িদ মুহাম্মাদ সাঈদ বাযীদপুরী ১৩. মৌলভী মাসঊদ বিন সাঈদ আযীমাবাদী ১৪. মৌলভী লাডলে ছাহেব আযীমাবাদী ১৫. মাওলানা সাইয়িদ আব্দুল গফূর দানাপুরী।
অন্যান্য ছাত্রমন্ডলী : ১৬. হাকীম সাইয়িদ মুহাম্মাদ ফরীদ ১৭. মাওলানা মুমতায আলী বাস্তাবী ১৮. মাওলানা ইকবাল আলী বাস্তাবী ১৯. মাওলানা আব্দুল জাববার খান্ডেলবী ২০. মাওলানা আব্দুস সাত্তার মাওলানগরী ২১. মাওলানা আব্দুল হাকীম মুযাফফরপুরী ২২. মাওলানা আব্দুল উলা মৌভী ২৩. মাওলানা হাকীম মুহাম্মাদ ইয়াসীন বনঢেয়ার ২৪. মাওলানা হাকীম আহমাদ হাসসান সানজারপুরী আযমগড়ী ২৫. মাওলানা শুজাউদ্দীন বাসুদেবপুরী (গোদাগাড়ী, রাজশাহী) ২৬. মাওলানা আব্দুল আযীয রহমানী ডুমরানবী ২৭. মাওলানা হুসাইন বাঙ্গালী।[23]
পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখন :
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী ছহীহ বুখারী, ছহীহ মুসলিম প্রভৃতি উচ্চতর গ্রন্থাবলী পাঠদান ও দাওয়াতী কর্মকান্ডে ব্যস্ততার মাঝেও সাপ্তাহিক আহলেহাদীছ (অমৃতসর), যিয়াউস সুন্নাহ (কলকাতা), আন-নাজম (লাক্ষ্মৌ) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় শত শত মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন। যেগুলি সংকলন করলে কয়েক খন্ড বই হবে।[24]
আহলেহাদীছ মনীষীদের জীবনী লিপিবদ্ধকরণ :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকায় ‘তারাজুমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ’ শিরোনামে ১৯১৮ সালের ৩০শে আগস্ট হ’তে ১৯২২ সালের ১৭ই আগস্ট পর্যন্ত মোট ৮২ জন আহলেহাদীছ আলেমের জীবনী প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ২৯ জনের জীবনী মাওলানা আব্দুস সালাম লিখেছিলেন।[25]
গ্রন্থাবলী :
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখিতেও স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর উৎসাহেই তিনি এ ময়দানে পদার্পণ করেন। আযীমাবাদী সম্পর্কে এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি (শামসুল হক আযীমাবাদী) আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা বা ফারেগ ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাদেরকে গ্রন্থ রচনা ও লেখালেখির বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। ইলমী তাহকীকের সন্ধান দিতেন, গ্রন্থের প্রাপ্তিস্থানের খোঁজ-খবর দিতেন, বইপত্র সংগ্রহ করে দিতেন এবং মাসোহারা প্রদান করতেন। যে ব্যক্তি দু’চারদিন তাঁর সাহচর্য লাভ করত সে গ্রন্থ রচনায় আগ্রহী হয়ে উঠত’।[26]
নিম্নে তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হ’ল :-
১. সীরাতুল বুখারী :
এটি মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী লিখিত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এতে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবনী, ফিক্বহ ও ইজতিহাদ, ছহীহুল বুখারীর বৈশিষ্ট্য ও এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সাথে সাথে এতে ছহীহ বুখারী সম্পর্কে কিছু অমূলক সন্দেহ-সংশয়ের জবাব প্রদান করা হয়েছে। বিশেষতঃ মাওলানা শিবলী নোমানী ‘সীরাতুন নু‘মান’ গ্রন্থে ইমাম বুখারী ও ছহীহ বুখারী সম্পর্কে যেসব সংশয় উত্থাপন করেছেন তার যথোচিত খন্ডন রয়েছে এতে।[27] উর্দূ ভাষায় এটিই প্রথম গ্রন্থ যাতে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বিস্তারিত জীবনী আলোচনা করা হয়েছে এবং মুহাদ্দিছ হিসাবে তাঁর মর্যাদার সকল দিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[28]
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লেখকের সময় পর্যন্ত ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবন ও কর্মের উপর শতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। কিন্তু উর্দূ ভাষাভাষী বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য তখন উর্দূতে রচিত ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর উপর কোন গ্রন্থ ছিল না। এ শূন্যতা পূরণের জন্যই আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর উৎসাহ ও সার্বিক সহযোগিতায় তিনি এ বিখ্যাত গ্রন্থটি উর্দূ ভাষায় রচনা করেন।[29]
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী গ্রন্থটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সীরাতুল বুখারী’ তার ঢংয়ে রচিত প্রথম গ্রন্থ। ইমাম বুখারী ও তাঁর ছহীহ বুখারীর যে মর্যাদা ইসলামে সাধারণভাবে স্বীকৃত তা কারো কাছে গোপন নয়। ছহীহ বুখারীকে কুরআন মাজীদের পরে সর্বাধিক বিশুদ্ধ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং ইমাম বুখারী ইমামুল মুহাদ্দিছীন (মুহাদ্দিছগণের নেতা) ও সাইয়িদুল ফুকাহা (ফকীহগণের সরদার) উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। সীরাতুল বুখারী তাঁরই বিস্তারিত জীবনী। ... আমার বিশ্বাস এই গ্রন্থটি সাধারণ মানুষের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি ঐ সকল ছাত্র যারা ইলমে হাদীছ বিশেষত ছহীহ বুখারী পড়ছেন বা পড়াতে চান তাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। হাদীছ শাস্ত্রের ছাত্র এবং ছহীহ বুখারী অধ্যয়নকারীদের নিকট এই গ্রন্থটি রাখা অত্যন্ত যরূরী’।[30]
সাইয়িদ সুলাইমান নাদভী লিখেছেন, ‘মুসলিম বিশ্বে ইমাম বুখারীর যে গুরুত্ব রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য তাঁর জীবনী, রচনাবলী ও ইজতিহাদ সমূহ সম্পর্কে আমাদের ভাষায় (উর্দূ) পৃথক কোন গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন ছিল। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী ছাহেব অত্যন্ত সুন্দরভাবে এই গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি, দলীল উপস্থাপন পদ্ধতি, ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ, উদ্দেশ্য সমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, মাসআলা সমূহের তাহকীক প্রত্যেক বিষয়ে তাঁর কলম উর্দূ ধর্মীয় সাহিত্যের উত্তম নমুনা পেশ করেছে’।[31]
আযমগড়ের দারুল মুছান্নিফীন শিবলী একাডেমী-এর একজন গবেষক মাওলানা আবূ আলী আছারীর বর্ণনা মতে সাইয়িদ সুলাইমান নাদভী ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবনী লেখার ইচ্ছা পোষণ করতেন। কিন্তু ‘সীরাতুল বুখারী’ পাঠ করার পর তিনি সেই ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন এবং এটি দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন। নাদভী আব্দুস সালাম মুবারকপুরীকে নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর অত্যন্ত বড় মাপের ছাত্র হিসাবে গণ্য করতেন এবং তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। এজন্য পাটনা শহর অতিক্রমকালে তিনি তাঁর সাথে দেখা করতেন।[32]
কাযী আতহার মুবারকপুরী বলেন, ‘সীরাতুল বুখারী’ মাওলানার জ্ঞানগত, ঐতিহাসিক ও তাহকীকী অবদানের উত্তম নমুনা’। ১৩২৯ হিজরীতে তিনি ‘সীরাতুল বুখারী’র মতো মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন, যা এ বিষয়ে একক গ্রন্থ। উর্দূ ভাষায় সামগ্রিকতা ও ইলমী মানদন্ডের দিক থেকে সীরাতুল বুখারী প্রথম গ্রন্থ। এই গ্রন্থ রচনার ফলে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবনী লেখার ঋণ উর্দূ ভাষীদের মাথা থেকে হাল্কা হয়ে গেছে’।[33]
তদীয় পুত্র আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,لقد تلقاه أهل العلم بيدي القبول وقدروه حق قدره، ... فهذا هو الكتاب الوحيد في موضوعه في اللغة الأردية بهذا البسط والكمال. ‘আলেমগণ এ গ্রন্থটিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং এর যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। ...উর্দূ ভাষায় এত পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তৃতভাবে এ বিষয়ে লিখিত এটিই একমাত্র গ্রন্থ’।[34]
শায়খ উছমান আল-খামীস বলেন,ومن أجمل الكتب التي قرأتها عن ترجمة الإمام البخاري، كتاب: الإمام البخاري سيرته وحياته للعلامة الشيخ عبد السلام المبارك فوري، وهو كتاب ممتازٌ جداً، ... بل فيه ردود على المنتقصين من الإمام البخاري وصحيحه، وهو كتاب قويٌ جداً في مجاله- ‘ইমাম বুখারীর জীবনী সম্পর্কে আমি যেসব গ্রন্থ পড়েছি আল্লামা শায়খ আব্দুস সালাম মুবারকপুরীর সীরাতুল বুখারী তন্মধ্যে অন্যতম। এটি অত্যন্ত চমৎকার একটি গ্রন্থ।... এতে ইমাম বুখারী ও ছহীহ বুখারীর মর্যাদাহানিকারীদের জবাব রয়েছে। এ বিষয়ে এটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি গ্রন্থ’।[35]
সীরাতুল বুখারী ১৩২৯ হিজরীতে (১৯১১) সর্বপ্রথম মাতবা আহমাদী, পাটনা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর পাক-ভারত থেকে এর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ড. রফীক আহমাদ খান এর ইংরেজী অনুবাদ করেছেন। ১৯৮৪ সালে জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস থেকে যেটি প্রকাশিত হয়। বিশিষ্ট মুহাক্কিক ড. আব্দুল আলীম আব্দুল আযীয বাস্তাবী কৃত আরবী অনুবাদটি ১৯৮৬ সালে জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে শারজার দারুল ফাতহ থেকে এর ৮ম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ১৪২২ হিজরীতে মক্কাস্থ দারু আলামিল ফাওয়াইদ প্রকাশনী থেকে প্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনী সহ দুই খন্ডে (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৮৪) এটি প্রকাশিত হয়েছে। উযবেক ভাষাতেও এটি অনূদিত হয়েছে বলে জানা গেছে।[36]
২. তারীখুল মিনওয়াল ও আহলুহু (তাঁত ও তাতীদের ইতিহাস) : ছাদেকপুর পাটনায় অবস্থানকালে তিনি ‘কিতাবুত তামাদ্দুন’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন। এর দু’টি অংশ ছিল। দ্বিতীয় অংশ উক্ত শিরোনামে ১৩৩২ হিজরীতে মাতবা আহমাদী, পাটনা থেকে প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১১৫।
তদানীন্তন সময়ে তাঁতীদেরকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যক্তিরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখত। তাঁতীদের সার্বিক উন্নতি দেখে তারা হিংসা করত। এতে এদের অনেকে তাদের পরিচয় গোপন করত। মাওলানা আব্দুস সালাম এই শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং উক্ত গ্রন্থ লিখে প্রমাণ করে দেন যে, কোন পেশাই তুচ্ছ বা হীন নয়। গ্রন্থটি ইলমী ও
সাংস্কৃতিক জগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।[37]
২০০৪ সালে বেনারস থেকে এটির নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এতে এর অপ্রকাশিত অংশগুলোও সংযোজিত হয়েছে। ফলে গ্রন্থটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৮।
৩. আওলিয়াউল্লাহ আওর তাছাওউফ :
আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর পরামর্শে তিনি এ গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি কিস্তি আকারে সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ (অমৃতসর) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ড. ফাওয়ায আব্দুল আযীয মুবারকপুরীর তাহকীক সহ হারেছ পাবলিকেশন্স, করাচী থেকে ২০১৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮৮।
৪. দাস সুওয়ালাত কে জওয়াব মেঁ :
মুবারকপুর ও এর আশপাশের অঞ্চল সমূহে মৌলভী আলী হুসাইন আশরাফী নামক পীরের বেশ প্রভাব ছিল। ১৩৩৩ হিজরীতে মাওলানা আব্দুস সালাম তাঁর নিকট ১০টি প্রশ্ন প্রেরণ করেন এবং এর দলীল চান। পীর ছাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রশ্নপত্র ছিড়ে ফেলে জ্বালিয়ে দেন। এদিকে জনৈক ব্যক্তি ঐ প্রশ্নগুলো ছাপিয়ে বিতরণ করেন। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং মুবারকপুরের জামে মসজিদ রাজা শাহ মুবারকে মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। পীর ছাহেবের দৌহিত্র মৌলভী আবুল মাহামিদ মুহাম্মাদ আশরাফী মাওলানার জবাবে ‘নোকে তীর বর জিগরে বে পীর’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছিলেন। এর জবাবে মাওলানা আব্দুস সালাম উক্ত গ্রন্থটি রচনা করেন। এতে উক্ত দশটি প্রশ্নের সাথে সাথে আক্বীদার মৌলিক বিষয়গুলি আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
৫. গিযাউর রূহ লিত-তাফরীক বায়না গিযাইর রূহ আল-খাবীছাহ ওয়ার রূহ আত-তইয়িব :
মৌলভী মুহাম্মাদ হানীফ চিশতী ছাবেরী জলন্ধরী সামা‘ (আধ্যাত্মিক) সঙ্গীত শোনা জায়েয মর্মে ‘গিযায়ে রূহ’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর নির্দেশে মুবারকপুরী তার জবাবে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। এটিও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।[38]
মৃত্যু :
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী বইপ্রেমিক ছিলেন। কোন পুস্তক ব্যবসায়ীর নিকট নতুন কোন বই এসেছে জানতে পারলে যেকোন মূল্যে তিনি তা সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন। বই সংগ্রহের এই নেশাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন তিনি দিল্লীর জামে মসজিদ এলাকার এক বই মার্কেটে একটি বই ক্রয় করার জন্য যান। বই ক্রয় করে চাঁদনী চকে (Chandni Chowk) ঘণ্টাঘরের (বর্তমানে বিলুপ্ত) নিকটে রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার গাড়ি এসে তাঁকে পদদলিত করে চলে যায়। গাড়িতে কোচোয়ান ও আরোহী কেউই ছিল না। এতে তিনি সারা শরীরে বিশেষ করে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। ১৩৪২ হিজরীর ১০ই রজব সন্ধ্যা সাড়ে ৬-টার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু কোন চিকিৎসাই ফলপ্রসূ হয়নি। অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী (১৮ই রজব ১৩৪২ হিঃ) রাত দেড়টার সময় ইলমের এই উজ্জ্বল দেউটি দপ করে নিভে যায়।[39] স্বীয় শিক্ষক মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর কবরের পাশে দিল্লীর ঐতিহাসিক শীদীপুরা কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।[40]
দুর্ঘটনার সময় সদ্য ক্রীত বইটি মুবারকপুরীর হাতেই ছিল, যার সবুজ রংয়ের টাইটেল তাঁর রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। এটি বর্তমানে তাঁর পারিবারিক লাইব্রেরীতে সযত্নে সংরক্ষিত আছে।
সন্তান-সন্ততি :
মাওলানা আব্দুস সালাম প্রথমত মা‘ছূমা বিনতে হাফেয আব্দুস সুবহান মুবারকপুরীকে বিবাহ করেছিলেন। ১৯২২/১৯২৩ সালে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। মাওলানার মৃত্যুর পর তিনি বহুদিন বেঁচেছিলেন। তাঁর সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ১১। ৭ পুত্র ও ৪ কন্যা। সবাই প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত। তিন পুত্র সন্তান ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। তাঁর বাকী চার পুত্র সন্তানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নরূপ :
১. মাওলানা হাফেয আব্দুল আযীয মুবারকপুরী :
ইনি মাওলানা আব্দুস সালামের জ্যেষ্ঠপুত্র। স্বীয় পিতা ছাড়াও মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী এবং মাওলানা হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী তাঁর অন্যতম শিক্ষক। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও চরিত্রবান আলেম ছিলেন। দ্বীনী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের বগুড়া যেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন এবং এতদঞ্চলে তাদরীস ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত থাকেন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখতেন। যৌবন বয়সে পিতার জীবদ্দশাতেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯২১ সালের ৫ই জুন বগুড়ায় মৃত্যুবরণ করেন।[41]
২. আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী :
মিশকাতুল মাছাবীহ-এর আরবী ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’ রচয়িতা আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী থেকে ফারেগ হয়ে সেখানেই শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৩. ডা. মুহাম্মাদ উযাইর :
ইনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং মুবারকপুরের বিখ্যাত হোমিও ডাক্তার ছিলেন। সাধারণ্যে মৌলভী উযাইর নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাযাহেরী রহমানী :
মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাদ্রাসা ফয়যে আম, মৌ-য়ে তিন বছর অধ্যয়ন করার পর মাদ্রাসা মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুরে ভর্তি হন। তিনি ১৩৫৬ হিজরীতে এখান থেকে ফারেগ হন। এরপর দারুল হাদীছ রহমানিয়া, দিল্লীতে দু’বছর অধ্যয়নের পর দ্বিতীয়বার ফারেগ হন। অতঃপর সেখানেই শিক্ষকতার পদ অলংকৃত করেন।
তিনি একজন যোগ্য আলেম ও নিখাদ ভদ্র মানুষ ছিলেন। একজন ভাল উর্দূ কবি ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। ১৯৪৫ সালে যৌবন সময়ে তিনি মারা যান।[42]
ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে মাওলানা আব্দুস সালাম :
১. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী বলেন, ‘মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী আহলেহাদীছ জামা‘আতের একজন বড় মাপের আলেম ছিলেন। তিনি আল্লাহভীরু, সবার প্রিয়, চরিত্রবান, নরম ও স্বল্পভাষী ছিলেন’।[43]
২. মাওলানা আব্দুছ ছামাদ হুসাইনাবাদী বলেন,
كان الشيخ رحمه الله تعالى بارعاً في جميع العلوم العربية، وله اليد الطولى في علوم الحديث والتفسير والفقه والأصول، وكان ماهراً في صناعة الأدب والمعقول، ومتبحراً في فنون الحكمة والطب والفرائض والكلام، وله قدرةٌ تامةٌ على نظم الشعر الجيد-
‘মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী আরবীর সকল বিদ্যায় দক্ষ ছিলেন। হাদীছ, তাফসীর, ফিক্বহ ও উছূলে ফিক্বহে তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সাহিত্য ও মা‘কূলাতে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। হিকমত (দর্শন), হেকিমী চিকিৎসা, ফারাইয ও ধর্মতত্ত্বেও তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। চমৎকার কবিতা রচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত।[44]
৩. কাযী আতহার মুবারকপুরী বলেন, ‘মাওলানা আব্দুস সালামের অধিকাংশ শিক্ষক আহলেহাদীছ মাসলাকের ছিলেন এবং তিনি নিজেও এই মাসলাকের যবরদস্ত আলেম ছিলেন’।[45] তিনি আরো বলেন, ‘মাওলানা আব্দুস সালাম অনন্য শিক্ষক ও অতুলনীয় আলেম হওয়ার পাশাপাশি অত্যন্ত ভাল লেখক, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও সমালোচক ছিলেন। ইতিহাস ও জীবনী লেখায় অত্যন্ত সাবলীল রচনাশৈলীর অধিকারী ছিলেন। মুবারকপুরের আলেম ও লেখকদের মাঝে এ বিষয়ে তিনি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন’।[46]
৪. ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী বলেন, كان مدرساً ناجحاً في جانبٍ، ومصنفاً محققاً وأديباً بارعاً ومؤرخاً نقاداً في آخر، ‘তিনি একদিকে সফল শিক্ষক, অন্য দিকে মুহাক্কিক গ্রন্থপ্রণেতা, দক্ষ সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক সমালোচক ছিলেন।[47]
৫. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী বলেন, ‘মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী অধিক অধ্যয়নকারী আলেম ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর গ্রন্থ রচনার ধারাও অব্যাহত থাকত’।[48]
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর শিক্ষা বিপ্লবের সোনালী ফসল মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী। জীবনের ২৪টি বছর শিক্ষকতা ও জ্ঞান সাধনায় কেটেছে এই মহামনীষীর। আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর উৎসাহে তিনি লেখনী জগতে পদার্পণ করেন এবং গবেষণালব্ধ গ্রন্থ সমূহ জাতিকে উপহার দেন। তাঁর ‘সীরাতুল বুখারী’ উর্দূ সাহিত্যে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর উপর লিখিত প্রথম গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। আরবী, ইংরেজী ও উযবেক ভাষায় অনূদিত হওয়ার ফলে এর খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা উপমহাদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। ইমাম বুখারী ও ছহীহ বুখারী সম্পর্কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ হিসাবে এটি গবেষণা জগতে সমাদৃত ও স্বীকৃত।
ভাইস প্রিন্সিপাল, -মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. মুহাম্মাদ তানযীল ছিদ্দীকী হুসাইনী, দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ (গুজরানওয়ালা : দারু আবিত তইয়িব, ১ম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০১৯), ২য় খন্ড, পৃঃ ৫২৮।
[2]. ড. ফাওয়ায আব্দুল আযীয মুবারকপুরী, আশ-শায়খ আব্দুস সালাম আল-মুবারাকফূরী ওয়া কিতাবুহু সীরাতুল ইমাম আল-বুখারী, নাকীবুল হিন্দ (ত্রৈমাসিক পত্রিকা), অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৮, https://naqeebulhind.hdcd.in.
[3]. মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী, সীরাতুল ইমাম আল-বুখারী (শারজাহ, আরব আমিরাত: দারুল ফাতহ, ১৯৯৭), ১/৪১।
[4]. ঐ, পৃঃ ৪১।
[5]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩০।
[6]. মাওলানা আব্দুস সালামের বংশীয় নাম ছিল সালামাতুল্লাহ। তাঁর শিক্ষা সনদ ও ইজাযাহ সমূহে এই নামই রয়েছে। পরবর্তীতে তিনি আব্দুস সালাম নাম ধারণ করেন এবং এই নামেই ইলমী জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
[7]. মাওলানা আব্দুস সালাম ‘সীরাতুল ইমাম আল-বুখারী’ (১/৪১)-এর পাদটীকায় তাঁর বংশ পরিক্রমা সম্পর্কে লিখেছেন, هو خان محمد بن أمان الله بن حسام الدين المحمديون، এখানে তিনি তাঁর পিতা, দাদা ও পরদাদা সবাইকে মুহাম্মাদী তথা আহলেহাদীছ বলে উল্লেখ করেছেন।
[8]. মাওলানা কাযী আতহার মুবারকপুরী, তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর (মৌনাথভঞ্জন, ইউপি : মাকতাবাতুল ফাহীম, ২০১০), পৃঃ ২১৫।
[9]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২১৫-১৬; দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩১।
[10]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩১-৫৩২; সীরাতুল বুখারী ২/৪৮৮।
[11]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩২।
[12]. ঐ ২/৫৩৩।
[13]. আব্দুর রশীদ ইরাকী, চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ (নয়া দিল্লী : ফরীদ বুক ডিপো, তাবি), পৃঃ ১১১।
[14]. সীরাতুল ইমাম আল-বুখারী ২/৪৮৯; মির‘আতুল মাফাতীহ ১/৭৩; দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৩।
[15]. সাপ্তাহিক আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ৭ই মার্চ ১৯২৪।
[16]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২১৭।
[17]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৩-৫৩৪; নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[18]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৪।
[19]. মাওলানা আব্দুর রহীম ছাদেকপুরী, আদ-দুর্রুল মানছূর ফী তারাজুমি আহলিছ ছাদেকপুর, পৃঃ ২৯৯।
[20]. তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ, পৃঃ ৩২৩; দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৪; নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[21]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৬।
[22]. সীরাতুল বুখারী ১/৩৬; আল-ইনতিকাদ, আল্লামা আযীমাবাদী সংখ্যা, করাচী, আগস্ট ২০১০, পৃঃ ২৮, ৮৯।
[23]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৭-৫৩৮; নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[24]. সীরাতুল বুখারী ১/২৪-২৫; নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[25]. তারাজুমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ, পৃঃ ৩২৪; তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২১৮; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ১১২।
[26]. আল-ইনতিকাদ, পৃঃ ২৭। গৃহীত: আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ২৮শে এপ্রিল ১৯১১।
[27]. সীরাতুল বুখারী ২/২৭৮-২৮৬।
[28]. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কি আওয়ালিয়াত (গুজরানওয়ালা : দারু আবিত তইয়িব, ১ম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১২), পৃঃ ৭৩।
[29]. সীরাতুল বুখারী, ১/৩৬।
[30]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৩৯-৪০। গৃহীত: সাপ্তাহিক আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ২১শে এপ্রিল ১৯১১।
[31]. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, ইউপি, ভারত, বর্ষ ২, সংখ্যা ১১, মে ১৯১৮, পৃঃ ৫৫।
[32]. নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[33]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২১৮, ২১৯, ২২০।
[34]. সীরাতুল বুখারী, ১/২৭, ২৯।
[35]. নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[36]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২২০; সীরাতুল বুখারী, ১/২০; দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৪১।
[37]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২১৮, ২২০; দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৪১-৫৪৩।
[38]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৪১, ৫৪৩।
[39]. ঐ, ২/৫৪৪-৪৫; বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কি আওয়ালিয়াত, পৃঃ ৭৩-৭৪।
[40]. নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[41]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২৮৯-২৯০।
[42]. তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ, পৃঃ ৩২০-৩২১; সীরাতুল বুখারী ১/২৮; তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ৩২৯।
[43]. দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ ২/৫৪৫।
[44]. নাকীবুল হিন্দ, পূর্বোক্ত।
[45]. তাযকেরায়ে ওলামায়ে মুবারকপুর, পৃঃ ২১৭।
[46]. ঐ, পৃঃ ২২২-২২৩।
[47]. সীরাতুল বুখারী ১/২৩।
[48]. বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী আওয়ালিয়াত, পৃঃ ৭২।