৭. কুধারণা করা :
কোন মানুষের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা সমীচীন নয়। কেননা এতে মানুষ কষ্ট পায়। বরং মুমিনের প্রতি সুধারণা পোষণ করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়্যাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একদা তিনি রমাযানের শেষ দশকে মসজিদে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হন। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ই‘তিকাফরত ছিলেন। ছাফিয়্যাহ তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেন। অতঃপর ফিরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ান। নবী করীম (ছাঃ) তাকে পেঁŠছে দেয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালেন। যখন তিনি উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর গৃহ সংলগ্ন মসজিদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন দু’জন আনছারী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা উভয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম করলেন। তাদের দু’জনকে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তোমরা দু’জন থাম। ইনি তো (আমার স্ত্রী) সাফিয়্যাহ বিনতু হুয়াই। এতে তাঁরা দু’জনে সুবহানাল্লাহ হে আল্লাহর রাসূল বলে উঠলেন এবং তাঁরা বিব্রত বোধ করলেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, শয়তান মানুষের রক্তের শিরায় চলাচল করে। আমি ভয় করলাম যে, সে তোমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে’।[1]
৮. খোঁটা দেওয়া :
পৃথিবীর সকল মানুষকে আল্লাহ সমান করে সৃষ্টি করেননি। বরং কাউকে ধনী, কাউকে দরিদ্র করেছেন। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ، ‘আর তোমরা এমন সব বিষয় আকাঙ্ক্ষা করো না, যেসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন’ (নিসা ৪/৩২)। সুতরাং ধনী-দরিদ্রের এ মর্যাদাগত পার্থক্য আল্লাহ করে দিয়েছেন। তাই ধনীরা দরিদ্রদের দান করে খোঁটা দিলে তারা অন্তরে কষ্ট পায়। মানুষকে কষ্ট দেওয়ার এটা একটা অন্যতম মাধ্যম। আর এর ফলে দানের ছওয়াব বিনষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا لَا يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِمَّا كَسَبُوا وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ-
‘হে বিশ্বাসীগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানগুলিকে বিনষ্ট করো না সেই ব্যক্তির মত, যে তার ধন-সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর জন্য এবং সে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না। ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ প্রস্তরখন্ডের ন্যায়, যার উপরে কিছু মাটি জমে ছিল। অতঃপর সেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত হ’ল ও তাকে পরিস্কার করে রেখে গেল। এভাবে তারা যা কিছু উপার্জন করে, সেখান থেকে কোনই সুফল তারা পায় না। বস্ত্ততঃ আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪)।
খোঁটা দানকারীর পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ قَالَ فَقَرَأَهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثَلاَثَ مِرَارٍ. قَالَ أَبُو ذَرٍّ خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ،
‘তিন ব্যক্তির সাথে ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের প্রতি তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না, আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। রাবী বলেন, তিনি এটা তিনবার উল্লেখ্য করলেন। আবূ যার (রাঃ) বলেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হ’ল। ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হচ্ছে যে ব্যক্তি টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে, যে ব্যক্তি দান করে খোঁটা দেয় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে’।[2]
সুতরাং দান করে খোঁটা দেওয়া যাবে না। বরং নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে দান করতে হবে। সাধ্যমত মানুষের উপকার করার চেষ্টা করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، ‘সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে ব্যক্তি মানুষের অধিক উপকার করে’।[3] আর যে ব্যক্তি মানুষের উপকার করে সে আল্লাহর কাছেও প্রিয়ভাজন হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ تَعَالَى أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، ‘আল্লাহর নিকটে সর্বাধিক প্রিয় হচ্ছে যে মানুষের সর্বাধিক উপকার করে’।[4]
দান করে খোঁটা না দেওয়ার শুভ পরিণাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِيْنَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُوْنَ مَا أَنْفَقُوْا مَنًّا وَلَا أَذًى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ
يَحْزَنُوْنَ-
‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর ব্যয় করার পর খোঁটা দেয় না বা কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে পুরস্কার। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬২)।
এছাড়া মুসলিম ভাইয়ের সহযোগিতা করলে আল্লাহ স্বয়ং তাকে সাহায্য করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ، ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে’।[5]
খ. কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া :
১. যুলুম করা :
যুলুম অর্থ অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন ইত্যাদি। এটা হক বা ন্যায়ের বিপরীত। পরিভাষায় কোন বস্ত্তকে তার অনুপযুক্ত স্থানে রাখা।[6] কেউ কেউ বলেন, যুলুম হচ্ছে অন্যের মালিকানায় হস্তক্ষেপ বা সীমালংঘন করা।[7] অনুরূপভাবে অন্যের হক নষ্ট করলে কিংবা কারো সম্পদ জবরদখল করলেও যুলুম হয়। অধীনস্তদের কাউকে অধিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া এবং কাউকে ছাড় দেওয়া; কারো দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়া এবং কারো দোষ-ত্রুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ধরা কিংবা কর্মীদের মাঝে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা যুলুম বৈকি? এগুলি মানুষকে কষ্ট দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। যুলুমের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَظْلِمْ مِنْكُمْ نُذِقْهُ عَذَابًا كَبِيْرًا، ‘বস্ত্ততঃ তোমাদের মধ্যে যারা সীমালংঘন করবে, আমরা তাদের বড় শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব’ (ফুরক্বান ২৫/১৯)। তিনি আরো বলেন, وَالظَّالِمُوْنَ مَا لَهُمْ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيْرٍ، ‘আর যালেমদের কোন বন্ধু নেই বা কোন সাহায্যকারী নেই’ (শূরা ৪২/৮)।
হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,يَا عِبَادِىْ إِنِّىْ حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِىْ وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوْا، ‘হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার ওপর যুলুম করাকে হারাম করে দিয়েছি। তাই আমি তোমাদের জন্যও যুলুম করা হারাম করে দিলাম। অতএব তোমরা (পরস্পরের প্রতি) যুলুম করো না’।[8] আরেকটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى مُوسَى رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللهَ لَيُمْلِى لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ قَالَ ثُمَّ قَرَأَ (وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهْىَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ).
আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ যালিমদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাকে ধরেন, তখন আর ছাড়েন না। (রাবী বলেন,) এরপর নবী করীম (ছাঃ) এ আয়াত পাঠ করেন, ‘আর এরকমই বটে আপনার রবের পাকড়াও, যখন তিনি কোন জনপদবাসীকে পাকড়াও করেন তাদের যুলুমের দরুন। নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও বড় যন্ত্রণাদায়ক, অত্যন্ত কঠিন’ (হূদ ১১/১০২)।[9] অপর একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ كَانَتْ عِنْدَهُ مَظْلَمَةٌ لأَخِيهِ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهَا، فَإِنَّهُ لَيْسَ ثَمَّ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُؤْخَذَ لأَخِيهِ مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ أَخِيهِ، فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ،
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর যুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়। তার ভাইয়ের পক্ষে তার নিকট হ’তে পুণ্য কেটে নেয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোন দীনার বা দিরহাম নেই। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার (মাযলূমের) গোনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে’।[10]
যুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মানুষ অনেক সময় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কিছু বলতে পারে না, তার প্রতি কৃত যুলুমের প্রতিকার করতে পারে না, নিতে পারে না প্রতিশোধ। পেশী শক্তি, বাহুবল, জনবল ও অর্থ-বিত্তের প্রভাবে অনেক মানুষ নীরবে অশ্রু ঝরায়, কেঁদে-কেটে ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর কাছে তার মনের আকুতি পেশ করে ও বিচার দায়ের করে। আল্লাহও তার দো‘আ কবুল করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ. ‘আর মাযলূমের বদদো‘আ থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা তার (বদদো‘আ) এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না’।[11] সুতরাং দুনিয়ার যালেমরা সাবধান হৌন। পরকালের কঠিন আযাবকে ভয় করুন। মাযলূমদের নিকট থেকে ক্ষমা চেয়ে নিন। অন্যথা পরকালে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে।
২. ধোঁকা-প্রতারণা :
মানুষকে কষ্ট দেওয়ার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে ধোঁকা দেওয়া বা প্রতারণা করা। ব্যবসায়ীরা ভালো পণ্যের সাথে খারাপ পণ্য মিশিয়ে, পণ্যের ত্রুটি গোপন করে, ওযনে ও পরিমাপে কম দিয়ে, মিথ্যা কসম খেয়ে ক্রেতার সাথে প্রতারণা করে থাকে। কৃষক ভালো-মন্দ দ্রব্য একত্রে মিশিয়ে কিংবা ভালো জিনিস বস্তার উপরে রেখে এবং মন্দ জিনিস নীচে রেখে ক্রেতাকে ধোঁকা দেয়। ফলমূল ও শাক-সবজিতে ফরমালিন মিশিয়ে; মাছ, মুরগী, গরু-ছাগল প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে চাষী ও খামারীরা। কোন কোন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ঠিকমত পাঠদান না করে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে কিংবা কোচিং ব্যবসা চালানোর হীন উদ্দেশ্য মনে পোষণ করে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সাথে প্রতারণা করে। সরকারী অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানুষের ফাইল আটকে রেখে উপরি লাভের আশায় মানুষকে কষ্ট দেয়, তাদের সাথে প্রতারণা করে। এভাবে সমাজের বিভিন্ন মানুষ নানাভাবে অন্যের সাথে প্রতারণা করে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى.
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্তূপীকৃত খাদ্যদ্রব্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর ভিতর হাত ঢুকালে আঙুল ভিজা অনুভব করলেন। তিনি মালিককে বলেন, এটা কি? সে উত্তর দিল, বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজে গিয়েছিল, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি বললেন, ভিজাগুলোকে স্তূপের উপরে রাখলে না কেন, যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়? যে ধোঁকা দেয় সে আমার (উম্মতের) অন্তর্ভুক্ত নয়’।[12] তিনি আরো বলেন, مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا، وَالْمَكْرُ وَالْخِدَاعُ فِي النَّارِ، ‘যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামে যাবে’।[13]
৩. দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করা :
পৃথিবীতে দোষ-ত্রুটি মুক্ত কোন মানুষ নেই। সুতরাং নিজের মাঝে দোষ রেখে অপরের ত্রুটি খুঁজতে যাওয়া বোকামী বৈকি? কিন্তু মানুষ অপরের দোষ খুঁজে বের করে নিজে শান্তি অনুভব করে। কেউ কেউ অন্যের দোষ খুঁজে বের করাকে কৃতিত্ব ভাবে। এ কাজ মানুষকে যারপরনাই কষ্ট দেয়। অপরের দোষ খোঁজা কিছু কিছু মানুষের স্বভাব। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُبْصِرُ أحَدُكُمُ الْقَذَاةَ فى عَيْنِ أخِيهِ، وَيَنْسَى الْجِذْعَ فِيْ عَيْنهِ، ‘তোমাদের কেউ তার (মুসলিম) ভাইয়ের চোখে পতিত সামান্য ময়লাটুকুও দেখতে পায়, কিন্তু নিজ চোখে পতিত খড়-কুটাও (অধিক ময়লা) দেখে না’।[14] আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বলেন,
عَجِبْتُ مِنَ الرَّجُلِ يَفِرُّ مِنَ الْقَدَرِ وَهُوَ مُوَاقِعُهُ وَيَرَى الْقُذَاةَ فِيْ عَيْنِ أَخِيْهِ وَيَدَعُ الْجِذْعَ فِيْ عَيْنِهِ وَيُخْرِجُ الضَّغْنَ مِنْ نَفْسِ أَخِيْهِ وَيَدَعُ الضَّغْنَ فِيْ نَفْسِهِ وَمَا وَضَعْتُ سِرِّيْ عِنْدَ أَحَدٍ فَلُمْتُهُ عَلَى إِفْشَائِهِ وَكَيْفَ أَلُوْمُهُ وَقَدْ ضِقْتُ بِهِ ذِرَعًا،
‘যে ব্যক্তি তাক্বদীর থেকে পলায়ন করে তার সম্পর্কে আমার অবাক লাগে। কারণ তাক্বদীরের সাথে তার সাক্ষাত ঘটবেই। সে তার (মুসলিম) ভাইয়ের চোখে পতিত সামান্য ময়লাটুকুও দেখতে পায়, কিন্তু নিজ চোখে পতিত গাছের গুঁড়িও (অধিক ময়লা) দেখে না। সে তার ভাইয়ের অন্তর থেকে ঘৃণা-বিদ্বেষ বের করার প্রয়াস পায়, অথচ নিজের অন্তরের বিদ্বেষ ত্যাগ করে না। আমি কারো কাছে আমার গোপনীয় বিষয় বলব, আর তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার জন্য তাকে তিরস্কার করব, এটা হ’তে পারে না। যে গোপনীয়তা চেপে রাখতে আমি সমর্থ হইনি, তার (ফাঁস হওয়ার) জন্য অপরকে কিভাবে তিরস্কার করতে পারি’?[15]
মানুষের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন এবং এর মন্দ পরিণতি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,وَلاَ تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِى بَيْتِهِ. ‘তোমরা দোষ-ত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষ-ত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন’।[16] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ كَشَفَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ كَشَفَ اللهُ عَوْرَتَهُ حَتَّى يَفْضَحَهُ بِهَا فِى بَيْتِهِ،
‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয় বিষয় গোপন রাখবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার গোপনীয় বিষয় গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দিবে, আল্লাহ তার গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দিবেন। এমনকি এই কারণে তাকে তার ঘরে পর্যন্ত অপদস্থ করবেন’।[17]
৪. শত্রুতা পোষণ করা :
মানুষ একে অপরকে ভাই মনে করবে এবং মুমিনও পরস্পরকে ভাই ভাববে এটাই তার করণীয়। কিন্তু কোন ক্রমেই একে অপরের সাথে শত্রুতা পোষণ করা কিংবা শত্রু ভাবা সমীচীন নয়। এগুলি মানুষকে কষ্ট দেয়। তাই এসব পরিহার করতে হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيْدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُوْنَ، ‘শয়তান তো কেবল চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত হ’তে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব এক্ষণে তোমরা নিবৃত্ত হবে কি’? (মায়েদাহ ৫/৯১)।
মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ فِى تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى- ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মায়া-মমতার দৃষ্টিকোণ থেকে গোটা মুসলিম জাতি একটি দেহের সমতুল্য। যখন তার একটি অঙ্গ ব্যথিত হয়, তখন তার গোটা শরীর জ্বর ও উত্তাপ অনুভব করে’।[18]
৫. রাস্তা বন্ধ করা :
মানুষের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া কোনভাবেই উচিত নয়। প্রতিবেশীর সাথে দ্বন্দ্ব লেগে তার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, নেতা-নেত্রী বা অভিজাত কোন লোকের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে রাস্তা বন্ধ রাখা কিংবা কোন দাবী আদায়ের নামে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া এবং অন্য যাত্রীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা কোনভাবেই বৈধ নয়। বরং জনগণের চলাচলের জন্য রাস্তা সুগম করে দেওয়া ছওয়াবের কাজ। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الإِيْمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيْمَانِ.
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঈমানের সত্তরটিরও অধিক অথবা ষাটটির অধিক শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হ’ল এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ (মা‘বূদ) নেই এবং সর্বনিম্ন শাখা হ’ল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত অপসারণ করা। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি শাখা’।[19]
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরানোকে রাসূল (ছাঃ) ভালো কাজ বলে অভিহিত করেছেন। হাদীছে এসেছে
عَنْ أَبِى الأَسْوَدِ الدِّيلِىِّ عَنْ أَبِى ذَرٍّ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ عُرِضَتْ عَلَىَّ أَعْمَالُ أُمَّتِى حَسَنُهَا وَسَيِّئُهَا فَوَجَدْتُ فِى مَحَاسِنِ أَعْمَالِهَا الأَذَى يُمَاطُ عَنِ الطَّرِيقِ وَوَجَدْتُ فِى مَسَاوِى أَعْمَالِهَا النُّخَاعَةَ تَكُونُ فِى الْمَسْجِدِ لاَ تُدْفَنُ-
আবূ যার গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের ভালো-মন্দ সকল আমল আমার কাছে উপস্থিত করা হ’ল। তখন আমি তাদের ভালো কাজগুলোর মধ্যে দেখতে পেলাম রাস্তা হ’তে কষ্টদায়ক জিনিস সরানো। আর মন্দ কাজগুলোর মধ্যে দেখতে পেলাম, কফ পুঁতে না ফেলে মসজিদে ফেলে রাখা’।[20]
অথচ বর্তমানে প্রতিবাদের নামে, দাবী আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তা বন্ধ করা যেন একমাত্র করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ রাস্তায় মুমূর্ষু রোগী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমনকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী থাকে, দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ থাকেন, আইনজীবি, ডাক্তারসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ থাকেন। এসব মানুষ হন রাস্তাবন্ধকারীদের অসহায় শিকার। নির্বিকারভাবে তারা এসব সহ্য করে যেতে বাধ্য হন।
৬. অভিসম্পাত করা :
কোন মানুষকে অভিসম্পাত করা উচিত নয়। কেননা এটা মানুষকে অত্যন্ত কষ্ট দেয়। আর অভিসম্পাত করা মুমিনের বৈশিষ্ট্যও নয়। এটা মুমিনকে হত্যা করার সমতুল্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَلَعْنُ الْمُؤْمِنِ كَقَتْلِهِ، ‘ঈমানদারকে লা‘নত করা, তাকে হত্যা করার সমতুল্য’।[21] তিনি আরো বলেন,لاَ يَنْبَغِى لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يَكُوْنَ لَعَّانًا، ‘মুমিন ব্যক্তি কখনো অভিশাপকারী হ’তে পারে না’।[22] আরেকটি হাদীছে মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلاَ اللَّعَّانِ وَلاَ الْفَاحِشِ وَلاَ الْبَذِىءِ، ‘মুমিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হ’তে পারে না, অভিসম্পাতকারী হ’তে পারে না। সে অশ্লীল কাজ করে না এবং কটুভাষীও হয় না’।[23]
রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) অভিসম্পাত করা থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,لاَ تَلاَعَنُوا بِلَعْنَةِ اللهِ وَلاَ بِغَضَبِ اللهِ وَلاَ بِالنَّارِ. ‘তোমরা আল্লাহর অভিশাপ, আল্লাহর গযব বা জাহান্নাম দ্বারা অভিশাপ দিও না’।[24]
অভিশাপ করার পার্থিব পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا لَعَنَ شَيْئًا صَعِدَتِ اللَّعْنَةُ إِلَى السَّمَاءِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ دُوْنَهَا ثُمَّ تَهِبْطُ إِلَى الأَرْضِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُهَا دُوْنَهَا ثُمَّ تَأْخُذُ يَمِيْنًا وَشِمَالاً فَإِذَا لَمْ تَجِدْ مَسَاغًا رَجَعَتْ إِلَى الَّذِى لُعِنَ فَإِنْ كَانَ لِذَلِكَ أَهْلاً وَإِلاَّ رَجَعَتْ إِلَى قَائِلِهَا،
‘যখন কোন বান্দা কোন বস্ত্তকে অভিশাপ দেয়, তখন ঐ অভিশাপ আকাশের দিকে উঠতে থাকে। অতঃপর আকাশের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন তা পুনরায় দুনিয়ায় প্রত্যার্বতনের জন্য রওয়ানা হয়। কিন্তু দুনিয়াতে আসার পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন সে ডানে বামে যাওয়ার চেষ্টা করে। অবশেষে অন্য কোন পথ না পেয়ে যাকে অভিশাপ করা হয়েছে, তার নিকটে ফিরে আসে। অতঃপর সে যদি ঐ অভিশাপের যোগ্য হয়, তাহ’লে তার উপর ঐ অভিশাপ পতিত হয়। অন্যথা অভিশাপকারীর উপরেই তা পতিত হয়’।[25]
অভিশাপ করার পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَكُونُ اللَّعَّانُونَ شُفَعَاءَ وَلاَ شُهَدَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘অভিসম্পাতকারীরা (ক্বিয়ামতে) সুপারিশকারী হ’তে পারবে না এবং সাক্ষীদাতাও হ’তে পারবে না’।[26] সুতরাং কাউকে অভিশাপ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. অন্যের সম্পদ জবরদখল করা :
অন্যায়ভাবে কারো অর্থ-সম্পদ দখল করা বা ভোগ করা মানুষকে কষ্ট দেওয়ার আরেকটি বড় মাধ্যম। অর্থবল, জনবল বা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে অন্যের সম্পদ দখল করে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়। অনেক সময় মানুষ তার ভিটা-মাটি পর্যন্ত হারিয়ে নিঃস্ব, কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে সে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে। অপরদিকে জবরদখলকারীরা সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। এটা যে অন্যায় ও হারাম, এ বিষয়ে সে কোন তোয়াক্কাই করে না। অথচ আল্লাহ এসব কাজ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ، ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)।
পরকালে জবরদখলের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَخَذَ شِبْرًا مِنَ الأَرْضِ ظُلْمًا، فَإِنَّهُ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرَضِيْنَ، ‘যে ব্যক্তি যুলুম করে অন্যের এক বিঘত যমীনও আত্মসাৎ করে, ক্বিয়ামতের দিন সাত তবক যমীন তার গলায় পরিয়ে দেয়া হবে’।[27] অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ أَخَذَ مِنَ الأَرْضِ شَيْئًا بِغَيْرِ حَقِّهِ خُسِفَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِيْنَ. ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে সামান্য পরিমাণ জমিও দখল করবে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে সাত তবক যমীনের নীচ পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেয়া হবে’।[28] অন্যত্র তিনি বলেন,أَيُّمَا رَجُلٍ ظَلَمَ شِبْراً مِنَ الأَرْضِ كَلَّفَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ يَحْفِرَهُ حَتَّى يَبْلُغَ آخِرَ سَبْعِ أَرَضِيْنَ ثُمَّ يُطَوَّقَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ. ‘যে কেউ অন্যায়ভাবে কারো এক বিঘত জমি দখল করে, আল্লাহ তাকে তার যমীনের সাত তবকের শেষ পর্যন্ত খুঁড়তে বাধ্য করবেন। অতঃপর তার গলায় তা শিকলরূপে পরিয়ে দেয়া হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের (হাশরের) বিচার শেষ করা হয়’।[29]
জবরদখলকারী জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কারণ অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ দখল করা হারাম। আর হরাম খাদ্যে দেহ পরিপুষ্ট হ’লে সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِالْحَرَامِ ‘যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে, সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[30] তিনি আরো বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنَ السُّحْتِ، وَكُلُّ لَحْمٍ نَبَتَ مِنَ السُّحْتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ، ‘হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট গোশত জান্নাতে প্রবেশ করবে না। প্রত্যেক ঐ গোশত যা হারাম দ্বারা গঠিত হয়েছে, তার জন্য জাহান্নামই উপযোগী’।[31]
৮. হত্যা করা :
কোন মানুষকে হত্যার মাধ্যমে চূড়ান্ত কষ্ট দেওয়া হয়। এতে নিহত ব্যক্তি, তার পিতা-মাতা, স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবাই কষ্ট পায়। এজন্য আল্লাহ মানুষকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ، ‘ন্যায্য কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা অনুধাবন করো’ (আন‘আম ৬/১৫১)।
আর কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা মানব জাতিকে হত্যার শামিল। আল্লাহ বলেন,مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا، ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদাহ ৫/৩২)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ. ‘প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান হারাম’।[32]
তিনি আরো বলেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ، ‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী’।[33]
অতএব কথা বা কাজ যে কোন মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। কেননা এসব বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ ও কবীরা গোনাহ। এসব পাপ থেকে বিরত না থাকলে পরকালে নেকী দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। কিংবা যাদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তাদের গোনাহ কষ্টদানকারীর উপরে বর্তাবে। অবশেষে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হ’তে হবে। তাই আল্লাহ আমাদের সকলকে ঐ পাপ থেকে হেফাযত করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/২০৩৫; মুসলিম হা/৫৮০৮।
[2]. মুসলিম হা/১০৬; মিশকাত হা/২৭৯৫।
[3]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৮৯; ছহীহাহ হা/৪২৬।
[4]. ছহীহাহ হা/৯০৬।
[5]. মুসলিম হা/২৬৯৯; আবূদাঊদ হা/৪৯৪৬; তিরমিযী হা/১৪২৫; মিশকাত হা/২০৪।
[6]. রাগেব ইছফাহানী, মুফরাদাতু আলফাযিল কুরআন, পৃঃ ৫৩৭।
[7]. আল-জুরজানী, আত-তা‘রিফাত, পৃঃ ১৮৬।
[8]. মুসলিম হা/২৫৭৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩৪৫; মিশকাত হা/২৩২৭।
[9]. বুখারী হা/৪৬৮৬; মিশকাত হা/৫১২৪; ছহীহাহ হা/৩৫১২।
[10]. বুখারী হা/৬৫৩৪, ২৪৪৯।
[11]. বুখারী হা/১৪৯৬, ৪৩৪৭; মুসলিম হা/১৯; মিশকাত হা/১৭৭২।
[12]. মুসলিম হা/১০২; আবূদাঊদ হা/৪৩৫২; তিরমিযী হা/১৩১৫; ইবনু মাজাহ হা/২২২৪; মিশকাত হা/২৮৬০।
[13]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৫৬৭; ছহীহাহ হা/১০৫৮; ছহীহুত তারগীব হা/১৭৬৮।
[14]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৫৭৬১; ছহীহাহ হা/৩৩; আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯২।
[15]. ইবনে হিববান, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৮৮৬, সনদ ছহীহ।
[16]. আবূদাউদ হা/৪৮৮০; তিরমিযী হা/২০৩২; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩৩৯।
[17]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৬; ছহীহাহ হা/২৩৪১।
[18]. মুসলিম হা/২৫৮৫; ছহীহাহ হা/১০৮৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৪৯।
[19]. মুসলিম হা/৩৫; আবূদাঊদ হা/৪৬৭৬; মিশকাত হা/৫।
[20]. মুসলিম হা/৫৫৩; মিশকাত হা/৭০৯।
[21]. বুখারী হা/৬১০৫; ৬৬৫২; মুসলিম হা/১১০।
[22]. তিরমিযী হা/২০১৯; মিশকাত হা/৪৮৪৮; ছহীহাহ হা/২৬৩৬।
[23]. তিরমিযী হা/১৯৭৭; মিশকাত হা/৩৬; ছহীহাহ হা/৩২০; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৮১।
[24]. আবূদাঊদ হা/৪৯০৬; তিরমিযী হা/১৯৭৬; ছহীহাহ হা/৮৯৩।
[25]. আবূদাউদ হা/৪৯০৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৭২।
[26]. মুসলিম হা/২৫৯৮; আবূদাঊদ হা/৪৯০৭।
[27]. বুখারী হা/৩১৯৮; মুসলিম হা/১৬১০; মিশকাত হা/২৯৩৮।
[28]. বুখারী হা/২৪৫৪; মিশকাত হা/২৯৫৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৮৩।
[29]. আহমাদ হা/১৭৫৭১; ছহীহাহ হা/২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২৭২২; মিশকাত হা/২৯৬০।
[30]. বায়হাক্বী শু‘আব হা/৫৭৫৯; ছহীহাহ হা/২৬০৯; মিশকাত হা/২৭৮৭।
[31]. আহমাদ হা/১৪৪১; শু‘আবুল ঈমান হা/৮৯৭২; দারিমী হা/২৭৭৯; মিশকাত হা/২৭৭২, সনদ হাসান।
[32]. মুসলিম হা/২৫৬৪; ছহীহুত তারগীব হা/২৯৫৮; মিশকাত হা/৪৯৫৯।
[33]. বুখারী হা/৪৮, ৬০৪৪, ৭০৭৬; মুসলিম হা/৬৪; মিশকাত হা/৪৮১৪।