যেসব কাজ শোকর আদায়ে সহায়ক :

কুরআনুল কারীম ও সুন্নাতে নববী আমাদের এমন কিছু পথ ও পন্থা দেখিয়েছে যা ধরে পথ চললে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রদত্ত অসংখ্য নে‘মত ভোগের দরুন তার শোকর আদায়ে সক্ষম হব। সেসব পন্থা থেকে নিম্নে কিছু তুলে ধরা হল :

নিজের থেকে নীচে অবস্থানকারীকে লক্ষ্য করা :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ- ‘তোমাদের থেকে যারা নীচু অবস্থানে আছে তোমরা তাদেরকে লক্ষ করো; তোমাদের থেকে উপরে অবস্থানকারীদের দিকে লক্ষ করো না। কেননা তা তোমাদের উপর আল্লাহর নে‘মত অবারিত থাকার পক্ষে বেশী সহায়ক হবে’।[1]

হাসান (রহঃ) হ’তে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন,لَمَّا عُرِضَ عَلَى آدَمَ ذُرِّيَّتُهُ رَأَى فَضْلَ بَعْضِهِمْ عَلَى بَعْضٍ، فَقَالَ: رَبِّ، لَوْ سَوَّيْتَ بَيْنَهُمْ؟ قَالَ: يَا آدَمُ، إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أُشْكَرَ، يَرَى ذُو الْفَضْلِ فَضْلَهُ فَيَحْمَدُنِي وَيَشْكُرُنِي- ‘যখন আদম (আঃ)-এর সামনে তাঁর বংশধরদের তুলে ধরা হ’ল এবং তিনি তাদের পরস্পরের মধ্যে তারতম্য দেখতে পেলেন তখন বললেন, হে প্রভু! আপনি যদি তাদের মাঝে সমতা স্থাপন করতেন! আল্লাহ বললেন, হে আদম, আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে আমি ভালবাসি। বেশী অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার প্রাপ্ত অনুগ্রহ দেখবে, তারপর আমার প্রশংসা করবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে’।[2]

আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, মহান আল্লাহর শোকর আদায় করাকে তিনি (আল্লাহ) ভালবাসেন। বিবেক-বুদ্ধি, শরী‘আত ও প্রকৃতিগতভাবেও আল্লাহর শোকর আদায় করা ফরয। আর তাঁর শোকর আদায় ফরয হওয়া যে কোন ফরযের থেকে বেশী স্পষ্ট। বান্দার উপর আল্লাহর প্রশংসা, তার একত্ববাদের স্বীকৃতি, তাকে ভালবাসা, তার নে‘মত, অনুগ্রহ, শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের আলোচনা, তার আনুগত্য স্বীকার করা এবং তার নে‘মত প্রচার ও স্বীকার করা কেনইবা ফরয হবে না?

এ কারণেই শোকর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়, তার ছওয়াবও গুণগত মানে সবার ঊর্ধে। এই শোকরের জন্যই তিনি সৃষ্টিজগৎকে সৃষ্টি করেছেন, আসমানী গ্রন্থসমূহ নাযিল করেছেন এবং শারঈ বিধি-বিধান নির্ধারণ করেছেন। এর জন্যই নানা উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। যাতে পূর্ণরূপে শোকর আদায় করা যায়। যেমন- মানুষের মাঝে আল্লাহ তা‘আলা বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলীতে নানা বৈচিত্র্য তৈরী করেছেন। এ বৈচিত্র্য রয়েছে তাদের সৃষ্টিতে, তাদের চরিত্রে, তাদের দ্বীন-ধর্মে, তাদের জীবন-জীবিকায়, তাদের আয়ুষ্কালে ইত্যাকার অন্যান্য ক্ষেত্রে।

সুতরাং যখন কোন সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখবে, ধনী লোক গরীব লোককে দেখবে এবং মুমিন কাফিরকে দেখবে তখন সে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতিতে আল্লাহর শোকর আদায় করবে; তার উপর তাঁর নে‘মতের মূল্য বুঝতে পারবে; তাকে যে বিশেষভাবে এ অনুগ্রহ করা হয়েছে এবং অন্যদের উপর তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তা সে এড়িয়ে যেতে পারবে না। এসব ভাবনার ফলে তার শোকরগুযারী আরো বেড়ে যাবে, কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নুয়ে পড়বে এবং সে স্বীকার করবে যে, আল্লাহ আমাকে এসব নে‘মত দিয়েছেন।[3] বান্দা যখন তার থেকে বেশী অনুগ্রহপ্রাপ্ত কাউকে দেখবে তখন আল্লাহর নাশুকরী থেকে নিজেকে হেফাযত করতে একথা ভাববে যে, এ আল্লাহর বণ্টন। আল্লাহর ফয়ছালায় সে আস্থা রাখবে এবং শোকর করবে। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ নিজের থেকে উপরের অবস্থানে কাউকে দেখতে পেলে তার প্রভুর শোকরের কথা ভুলে যায়, নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে থাকে। তার তো জানা উচিত যে আল্লাহ বলেছেন,وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন এবং তোমাদের একের উপর অপরের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে পরীক্ষা নিতে পারেন’ (আন‘আম ৬/১৬৫)

আল্লাহর অনুগ্রহরাজি স্মরণ :

বান্দার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ বেশুমার। তা গুণে কখনই শেষ করা যাবে না। আল্লাহ বলেছেন,وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ اللهَ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (নাহল ১৬/১৮)। বান্দা যখন তার প্রাপ্ত এসব নে‘মত মনে করে আর ভাবে তখন নে‘মতগুলোই আপনা থেকে তাকে আল্লাহর শোকর করতে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন, নে‘মতের স্মরণ উহার শুকরিয়া আদায়ের একটি প্রেরণাদায়ী মাধ্যম’।[4]

আবার তার বিপরীতে প্রাপ্ত নে‘মত সম্পর্কে অজ্ঞতা শোকর না করার কারণ। ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, বান্দার জন্য শোকরের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, বিশেষ-সাধারণ ইত্যাদি নানা ধরনের নে‘মত সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা’।[5]

প্রথম যে নে‘মত আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দিয়েছেন তা হ’ল সৃষ্টি ও তৈরীর নে‘মত। তিনি দয়া করে আমাদের অস্তিত্ব দান করেছেন, অস্তিত্বহীন করেননি।

তারপর তিনি আমাদেরকে মানুষ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন- আমাদেরকে তিনি জড়বস্ত্ত কিংবা ইতর প্রাণী বা পশু-পাখি, বৃক্ষ-লতা করেননি। তিনি আমাদেরকে ঈমান ও ইসলাম নামক নে‘মত দ্বারা ধন্য করেছেন; আমাদেরকে তিনি ইহুদী, খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ বানাননি। অতঃপর তিনি আমাদেরকে হিদায়াতের নে‘মত দ্বারা সিক্ত করেছেন। তাইতো তিনি আমাদেরকে পাপাচারী ফাসিক ও পথভ্রষ্ট বিদ‘আতী মুসলিম বানাননি।

তারপর তিনি আমাদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি আমাদেরকে বিদ‘আতী বাতিল ফিরকাগুলোর ভেতরে শামিল করেননি।

হে আমার মুসলিম ভাই/বোন, আপনি যখন জানবেন, এর প্রত্যেকটিই আল্লাহর নে‘মত, যা তিনি আপনার উপর বর্ষণ করেছেন তখন আপনি দ্রুতই তার শোকরকারী, যিকরকারী, অনুগত, অভিমুখী ও সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে তার আনুগত্যশীল বান্দায় রূপান্তরিত হবেন।

আর সাধারণ জনগণকে তাদের উপর আল্লাহর নে‘মত স্মরণ করিয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতী কাজ। এই সূর্যটাকেই লক্ষ করুন। কিভাবে তিনি তাকে যথাস্থানে সৃষ্টি করেছেন এবং কিভাবে সে নির্দিষ্ট সময় অন্তর উদিত হয়। সূর্যের অবস্থান যদি পৃথিবী থেকে বহু দূরে হ’ত তাহলে সকল সৃষ্টি ঠান্ডায় জমে যেত। আবার যদি বেশ কাছে হ’ত তাহলে সকল সৃষ্টি পুড়ে ছারখার হয়ে যেত।

চাঁদকেও দেখুন, সে যদি তার বর্তমান অবস্থান থেকে পৃথিবীর দিকে একটু বেশী নিকটে অবস্থান করত তাহ’লে জোয়ার উথলে উঠত এবং সারা পৃথিবী তলিয়ে যেত। আবার যদি বর্তমান অবস্থান থেকে দূরে সরে যেত তাহ’লে ভাটার টানে পৃথিবী শুকিয়ে যেত।

আবার ভাবুন, বায়ুমন্ডলে যদি ওযন স্তর না থাকত তাহ’লে কিভাবে আমরা সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা পেতাম?

হে মানুষ, তোমার উপর আল্লাহর বড় অনুগ্রহ যে, তিনি তোমাকে স্বহস্তে মানুষ করে সৃষ্টি করেছেন। অন্য কোন সৃষ্টিকে তিনি স্বহস্তে সৃষ্টি করেননি। তিনি বলেছেন,قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে আমার দু’হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি, তাকে সিজদা করতে তোমাকে কোন বস্ত্ত বাধা দিল?’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)

সৃষ্টি সংক্রান্ত আয়াতগুলো নিয়েই ভাবুন। আললাহ কতভাবে আপনাদেরকে তার নে‘মত দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে-أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً ‘তোমরা কি দেখ না, নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?’ (লোকমান ৩১/২০)

অন্য সূরায় এসেছে,اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهَارَ- وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ- وَآتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ- ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা থেকে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-শস্যাদি উৎপাদন করেন। আর নৌযানকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর হুকুমে ওটা সাগরে বিচরণ করে এবং তিনি নদী সমূহকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন সর্বদা একই নিয়মে গতিশীল করার মাধ্যমে এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত্রি ও দিবসকে। আর তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন যা কিছু তোমরা চেয়েছ। যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহসমূহ গণনা কর, তাহ’লে তোমরা তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ অতিবড় যালেম ও অকৃতজ্ঞ’ (ইবরাহীম ১৪/৩২-৩৪)

সূরা নাহল, অধিক পরিমাণে নে‘মত উল্লেখ থাকার কারণে যার অপর নাম সূরা নি‘আম, যার মধ্যে আল্লাহ বলেছেন,

وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ- وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا وَسُبُلاً لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ- وَعَلاَمَاتٍ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ- أَفَمَنْ يَخْلُقُ كَمَنْ لاَ يَخْلُقُ أَفَلاَ تَذَكَّرُونَ- وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ اللهَ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ-

‘তিনিই সমুদ্রকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা সেখান থেকে তাযা মাছ ভক্ষণ করতে পার এবং সেখান থেকে তোমাদের পরিধেয় রত্নালংকার আহরণ করতে পার। তুমি তার বুক চিরে নৌযান চলতে দেখ যাতে তোমরা সেখান থেকে তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। আর তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বতসমূহ স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে হেলা-দোলা না করে এবং স্থাপন করেছেন নদী-নালা ও রাস্তাসমূহ যাতে তোমরা গন্তব্যে পৌঁছতে পার। আর সৃষ্টি করেছেন পথ নির্দেশক চিহ্নসমূহ এবং ওরা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথের দিশা পায়। অতএব যিনি সৃষ্টি করেন তিনি কি তার মত যে সৃষ্টি করে না? তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না? যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (নাহল ১৬/১৪-১৮)

পাক পরওয়ারদিগার একই সূরার অন্য আয়াতে বলেন,وَاللهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلاَلاً وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ- ‘আর আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা থেকে তিনি তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড় সমূহে তোমাদের জন্য আশ্রয়ের স্থান করেছেন। আর তিনি তোমাদের জন্য এক প্রকার পোষাকের ব্যবস্থা করেছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্মের খরতাপ থেকে এবং আরেক প্রকার পোষাকের ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে যুদ্ধে হামলা থেকে রক্ষা করে। এভাবে তিনি তোমাদের উপর তাঁর অনুগ্রহকে পূর্ণ করেন যাতে তোমরা (আল্লাহর প্রতি) অনুগত হও’ (নাহল ১৬/৮১)

দ্বীনের পরিপূর্ণতাও আমাদের উপর আল্লাহর মহা অনুগ্রহের অন্যতম। আল্লাহ বলেন,الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِينًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)

কিছু মানুষ আল্লাহর দেওয়া নে‘মতকে নিজের যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতাবলে অর্জিত হিসাবে প্রচার করে। এটা স্পষ্ট গুমরাহী। যেমন কারূন এমন করেছিল। আল্লাহ বলেন, قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي ‘সে বলল, এই সম্পদ আমি আমার নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছি’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৮)। অনেকে আবার যন্ত্রপাতির দোহাই দিয়ে আল্লাহর নে‘মতকে নিজেদের নামে বলে থাকে। যেমন- আধুনিক যুগের অনেক জাহিল লোক যান্ত্রিক উন্নয়নকে আল্লাহর নে‘মত বলে স্বীকার করতে চায় না। তারা মনে করে এসব যন্ত্র তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও গবেষণার ফসল। উন্নয়ন যা কিছু হচ্ছে তা সবই তাদের কারিশমায়। অথচ আল্লাহ বলেছেন, وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللهِ  ‘তোমাদের কাছে যেসব নে‘মত আছে, তা সবই আল্লাহর পক্ষ হ’তে’ (নাহল ১৬/৫৩)

মহান আল্লাহ আরো বলেন,أَفَرَأَيْتُمُ الْمَاءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ- أَأَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ- لَوْ نَشَاءُ جَعَلْنَاهُ أُجَاجًا فَلَوْلاَ تَشْكُرُونَ- ‘আর তোমরা ভেবে দেখেছ কি- তোমরা যে পানি পান কর তা কি তোমরা মেঘমালা থেকে নিজেরা নামিয়ে আন, না আমি তা নামিয়ে থাকি? আমি তো ইচ্ছে করলে ঐ পানি লবণাক্ত করতে পারতাম। তাহ’লে কেন তোমরা শুকরিয়া আদায় কর না’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৬৮-৭০)

পূর্বসূরীদের কেউ কেউ এমন কামনা ও আফসোস প্রকাশ করেছেন যে, তারা যদি মৃত মানুষ হ’তেন! তাদের যদি সৃষ্টি করা না হ’ত! কিংবা তারা যদি গাছ-পাথর ইত্যাদি হ’তেন!! তাদের এমন কামনা ও আফসোসের কারণে অনেকের মনে প্রশ্ন দাঁড়ায়- তারা যখন মানবরূপে সৃষ্টি হওয়া নিয়ে এত আফসোস করেছেন তখন তো এরূপভাবে সৃষ্টি হওয়া এবং এভাবে বেঁচে থাকা কোনই নে‘মত নয়। প্রকৃত সত্য হ’ল এসব পূর্বসূরী শোকরকারীদের উচ্চ পর্যায়ের লোক ছিলেন। কিন্তু কোন কোন সময় তাদের ভেতর ভীতিকর কোন অবস্থার উদয় হ’ত, ফলে তাদের মনে কামনা জাগত যদি তারা পার্থিব এ জীবন না পেতেন তাহ’লে তাদের হিসাবের মুখোমুখি হ’তে হ’ত না। সাধারণভাবে মানুষ হিসাবে জীবন লাভ না করা কখনই তাদের কামনা-বাসনা ছিল না।

নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার বিষয়ে বান্দার জানা থাকা :

বান্দা আল্লাহ তা‘আলার দেওয়া যেসব নে‘মত ভোগ করেন সে সম্পর্কে তার জানা-বুঝা থাকলে আল্লাহর শোকর আদায়ে তা সহায়ক হবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (তাকাছুর ১০২/৮)

সে যখন উপলব্ধি করতে পারবে যে, কিয়ামতের দিন সে নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ঠান্ডা শীতল পানি পর্যন্ত প্রতিটি নে‘মত সম্পর্কে তাকে হিসাব দিতে হবে। তখন এই হিসাব দেওয়ার ভয়েই সে শোকর আদায়ে তৎপর হবে। অবশ্য নে‘মতের শোকর অনুধাবনে মানুষে মানুষে তারতম্য লক্ষ করা যায়। কিছু মানুষ ক্বিয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসার দায় থেকে অব্যাহতি লাভের আশায় নিজেদেরকে নে‘মত ভোগ থেকে বঞ্চিত রাখে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নে‘মত ভোগে খুশি হন এবং নে‘মত ভোগের পর আমরা যেন তার শোকর আদায় করি সে সম্পর্কে তিনি আমাদের আদেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে,كُلُوا وَاشْرَبُوا مِنْ رِزْقِ اللهِ وَلاَ تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ ‘(আমরা বললাম) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক থেকে খাও এবং পান কর। আর তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারীরূপে বিচরণ করো না’ (বাক্বারাহ ২/৬০)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই দাসত্ব করে থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। বরং এসব নে‘মতের শোকর তো কেবল ভোগের পরেই হ’তে পারে।

অনেকে আছে কিছু নে‘মত ভোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখে কিন্তু তা থেকে পরিমাণে অধিক নে‘মত যে সে ভোগ করছে তার খবর সে রাখে না। এক ব্যক্তি হাসান বাছরী (রহঃ)-এর নিকট এসে বলল, ‘আমার এক প্রতিবেশী আছে, যে ফালুদা (الفالوذج) খায় না। তিনি বললেন, কেন? সে বলল, তার ধারণা যে, সে ফালুদার শোকর আদায় করতে পারবে না, তাই খায় না। হাসান (রহঃ) বললেন, সে কি ঠান্ডা পানি পান করে? সে বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তোমার প্রতিবেশী নিশ্চয়ই একজন মূর্খ। কেননা ঠান্ডা পানিতে তো ফালুদার তুলনায় আল্লাহ তা‘আলা তার উপর বেশী নে‘মত বর্ষণ করছেন’।[6]

এ ধরনের লোকদের আমরা এ কথাও বলি যে, এমন বহু নে‘মত আছে যা উপভোগ না করে তোমরা থাকতে পারবে না। যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের নে‘মত, হৃৎপিন্ডের সঞ্চালনজনিত নে‘মত, রক্ত সঞ্চালনজনিত নে‘মত- তবে কি তোমরা এগুলির শোকর আদায়ে সক্ষম? আমরা তাদের বলছি, হাঁ, বান্দার উপর আল্লাহর অনুগ্রহরাজির একটি অনুগ্রহেরও বান্দা শোকর আদায়ে সক্ষম নয়। তারপরও বান্দা নে‘মত ভোগ করবে; তার উপর আল্লাহর দেওয়া নে‘মত স্বীকার করবে এবং শোকর আদায়ে নিজের অক্ষমতাও প্রকাশ করবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন,أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِى ‘হে প্রভু, আমার উপর আপনার বর্ষিত নে‘মত আমি আপনার কাছে স্বীকার করছি এবং আপনার কাছে আমার পাপও স্বীকার করছি’।[7]

সারকথা এই যে, যে ব্যক্তি নিজের উপর উপাদেয় উৎকৃষ্ট জিনিস নিষিদ্ধ করবে এবং শারঈ ওযর ব্যতীত তা পানাহার থেকে বিরত থাকবে, সে একজন বিদ‘আতী ও নিন্দার পাত্র। আর যে ফরয শোকর আদায় না করে তা পানাহার করবে সেও নিন্দনীয়। যারা হকপন্থী তারা উপাদেয় নে‘মত সমূহ অপব্যয় না করে ভোগ করে এবং তার শোকর আদায়ের চেষ্টা করে।[8]

শোকর আদায়ে সাহায্যের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ :

আমাদের যেন শোকর আদায়ে আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করেন সেজন্য আমরা তার নিকট দো‘আ করতে পারি। اللَّهُمَّ أَعِنِّى عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার যিকর, আপনার শোকর এবং সুন্দরভাবে আপনার ইবাদতের জন্য সাহায্য করুন’।[9]

আল্লাহর শোকরপ্রিয়তা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা :

আল্লাহ তা‘আলা শোকর এবং শোকর আদায়কারীদের ভালবাসেন। একথা বান্দার জানা থাকলে তার ভালবাসা পাওয়ার স্বার্থে সে শোকর আদায়ে ভালমতো চেষ্টা করবে। ক্বাতাদা (রহঃ) বলেন, إِنَّ رَبَّكُمْ مُنْعِمٌ يُحِبُّ الشُّكْرَ ‘তোমাদের রব নে‘মতদাতা, তিনি শোকর ভালবাসেন’।[10]

শোকরের ফল :

শোকরের বহু ফল ও উপকারিতা রয়েছে। এসব ফলের কোনটাই কিন্তু আল্লাহর বরাবরে নয়; বরং তার সবই বিশেষভাবে মানুষ লাভ করে থাকে। সুতরাং মানুষ যখন শোকর করে তখন নিজের কল্যাণার্থেই শোকর করে। আবার যখন অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তখন সেই অকৃতজ্ঞতার কুফলও তার উপর বর্তাবে। যেমন আল-কুরআনে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে-فَلَمَّا رَآهُ مُسْتَقِرًّا عِنْدَهُ قَالَ هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّي لِيَبْلُوَنِي أَأَشْكُرُ أَمْ أَكْفُرُ وَمَنْ شَكَرَ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّي غَنِيٌّ كَرِيمٌ ‘অতঃপর সুলায়মান যখন সেটিকে তার সামনে দেখল, তখন বলল, এটি আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ। যাতে তিনি পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই সেটা করে থাকে। আর যে ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ হয়, সে জানুক যে আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত ও মহান’ (নামল ২৭/৪০)

শোকরের কিছু ফল ও উপকারিতা নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।

আল্লাহর আযাব থেকে নাজাত :

আল্লাহ তার কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, বান্দা যখন শোকর আদায় করবে এবং ঈমান আনবে, তখন তাকে শাস্তি দেওয়ার আল্লাহর কোনই ইচ্ছে নেই। তিনি বলেন,مَا يَفْعَلُ اللهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآمَنْتُمْ وَكَانَ اللهُ شَاكِرًا عَلِيمًا ‘তোমাদের শাস্তি দিয়ে আল্লাহ কি করবেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও ও বিশ্বাসে দৃঢ় হও? আর আল্লাহ হ’লেন গুণগ্রাহী ও সর্বজ্ঞ’ (নিসা ৪/১৪৭)

ইবনু জারীর ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ جَلَّ ثَنَاؤُهُ لاَ يُعَذِّبُ شَاكِرًا وَلاَ مُؤْمِنًا ‘মহা প্রশংসার অধিকারী আল্লাহ তা‘আলা না শোকরকারীকে আযাব দিবেন, না মুমিনকে’।[11] হাসান বাছরী (রহঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ لَيُمَتِّعُ بِالنِّعْمَةِ مَا شَاءَ، فَإِذَا لَمْ يُشْكَرْ قَلَبَهَا عَلَيْهِمْ عَذَابًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ভোগের জন্য যথেচ্ছ নে‘মত দান করেন। কিন্তু তার শোকর আদায় না করা হ’লে তিনি সেই নে‘মতকে তাদের জন্য আযাবে রূপান্তরিত করেন’।[12]

আল্লাহর সন্তোষ লাভ :

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার ঐ বান্দার উপর সন্তুষ্ট, যে এক লোকমা খাবার খায়, অতঃপর সেজন্য তার প্রশংসা করে অথবা এক ঢোক পানি পান করে, তারপর সেজন্য তার প্রশংসা করে’।[13]

হিদায়াতের অনুগ্রহ দ্বারা বিশেষভাবে ধন্য :

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আল-কুরআনে জানিয়েছেন যে, তার বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল শোকরকারীরা হিদায়াতের অনুগ্রহ দ্বারা বিশেষভাবে বিভূষিত। তিনি বলেন, وَكَذَلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لِيَقُولُوا أَهَؤُلَاءِ مَنَّ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنْ بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ ‘আর এভাবেই আমরা তাদের কারু দ্বারা কাউকে পরীক্ষায় ফেলি। যাতে তারা বলে যে, আমাদের মধ্য থেকে আল্লাহ এই লোকগুলির উপরেই কি অনুগ্রহ করেছেন? অথচ আল্লাহ কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত নন’? (আন‘আম ৬/৫৩)

ইবনু জারীর ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, উক্ত আয়াতের শেষ বাক্য সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমার সৃষ্টিকুলের মধ্যে কারা আমার নে‘মতের শোকর আদায় করে এবং কারা করে না সে সম্পর্কে আমিই বেশী জ্ঞাত। ফলে যারা আমার নে‘মত পেয়ে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রতিদানে আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে হিদায়াতের অনুগ্রহ দ্বারা ভূষিত করা হয়। আর যারা আমার নে‘মতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রতিদানে আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে হিদায়াত থেকে (عَنْسَبِيلِ الرَّشَادِ) দূরে সরিয়ে অপমানিত করা হয়’।[14]

নে‘মতের হেফাযত :

নে‘মত হাত ছাড়া হওয়ার যত কারণ আছে তার সবগুলো থেকে শোকর সুরক্ষা দান করে। এজন্য কোন কোন বিদ্বান শোকরকে নে‘মতের বেড়ি (قيد النعم) বলে উল্লেখ করেছেন। শোকর নে‘মতকে বেড়ি পরিয়ে রাখে, যাতে সে পালাতে না পারে।

ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেছেন, قَيِّدُوا نِعَمَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ بِالشُّكْرِ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘তোমরা আল্লাহর নে‘মতরাজিকে আল্লাহর শোকর দ্বারা শৃঙ্খলিত করে রাখো’।[15]

নে‘মত বৃদ্ধি :

আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় গ্রন্থে শোকরকারীদের জন্য নে‘মত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন,وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ‘আর যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)

অতএব দেখা যাচ্ছে শোকরের ফলে নে‘মত বৃদ্ধি পায় এবং তা হাতছাড়া হওয়া থেকে রক্ষা পায়। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেছেন, بَلَغَنِي أَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا أَنْعَمَ عَلَى قَوْمٍ سَأَلَهُمُ الشُّكْرَ، فَإِذَا شَكَرُوهُ كَانَ قَادِرًا على أَنْ يَزِيدَهُمْ، فَإِذَا كَفَرُوهُ كَانَ قَادِرًا على أَنْ يَقْلَبَ نِعْمَتَهُ عَلَيْهِمْ عَذَابًا-  ‘আমার নিকট এ বার্তা পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন জাতির উপর অনুগ্রহ করেন তখন তাদের কাছে শোকর করার আবেদন জানান। যদি তারা শোকর করে তবে আল্লাহ তাদের নে‘মত বাড়িয়ে দিতে পারেন। আর যদি তারা অকৃতজ্ঞতা দেখায় তাহ’লে তাদের নে‘মতকে আযাবে রূপান্তরিত করতে পারেন’।[16]

রাবী‘ বিন আনাস (রহঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ ذَاكِرٌ مَنْ ذَكَرَهُ، وَزَائِدٌ مَنْ شَكَرَهُ وَمُعَذِّبٌ مَنْ كَفَرَهُ ‘নিশ্চয়ই যে আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন। যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি তার প্রতি নে‘মত বৃদ্ধি করে দেন এবং যে তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি তাকে শাস্তি দেন’।[17] এজন্যই পূর্বসূরীরা শোকরকে দু’টি নামে আখ্যায়িত করতেন। (১) আল-হাফিয (الْحَافِظُ) বা সংরক্ষণকারী। কেননা তা বিদ্যমান নে‘মতগুলোকে হেফাযত করে। (২) আল-জালিব (الْجَالِبُ) বা আনয়নকারী। কেননা তা হারানো নে‘মতকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসে।[18] অতএব হে বন্ধু, প্রতিটি নে‘মতে আল্লাহর শোকর আদায় করতে ভুলো না। কেননা শোকর নে‘মত টেনে আনে।

[চলবে]




[1]. তিরমিযী হা/২৫১৩, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন

[2]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫২২৭

[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম, শিফাউল আলীল, পৃ. ২২১

[4]. ইমাম শাওকানী, ফাতহুল কাদীর ২/৩১৭

[5]. ইমাম গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/১২৬

[6]. তাফসীরে কুরতুবী ৬/২৪৩

[7]. বুখারী হা/৬৩০৬; মিশকাত হা/২৩৩৫

[8]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩২/২১২ পৃ.

[9]. আবুদাঊদ হা/১৫২২, হাদীছ ছহীহ।

[10]. তাফসীরে ত্বাবারী ৬/২১৮

[11]. তাফসীরে ত্বাবারী ৪/৩৩৮

[12]. ইবনু আবিদ্দুনিয়া, আশ-শুকর, পৃ. ১৭

[13]. মুসলিম হা/২৭৩৪; মিশকাত হা/৪২০০

[14]. তাফসীরে ত্বাবারী ৫/২০৪

[15]. শু‘আবুল ঈমান হা/৪৫৪৬

[16]. শুআবুল ঈমান হা/৪৫৩৬

[17]. তাফসীরে ত্বাবারী ২/৩৯।

[18]. ইবনু তায়মিয়াহ, উদ্দাতুছ ছাবেরীন, পৃঃ ৯৮।c





মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৯ম কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
তাওফীক্ব লাভের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
মুসলিম উম্মাহর পদস্খলনের কারণ - মীযানুর রহমান মাদানী
পারিবারিক অপরাধ : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন
ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দাওয়াত ও সংগঠন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
লজ্জাশীলতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মিথ্যা সাক্ষ্য দানের ভয়াবহতা - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ওযূর আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.