প্রারম্ভিকা :
একটি বিশেষ সময়সীমায় নিবদ্ধ আমাদের এ জীবন। জীবন রেখাটি একদিন বিলীন হবে মৃত্যুর পরিসমাপ্তি বিন্দুতে। এরপর অপেক্ষা পরকালের অনন্ত জীবনের। সেখানে আর মৃত্যু নেই। কিন্তু সব জীবন তো আর সফল হয় না। মৃত্যুর পর যে জীবন পরকালের অনাবিল সুখ লাভে ধন্য হবে সে জীবনই মূল্যবান। আর যে ব্যক্তি তার যৌবনকালকে আল্লাহর দাসত্বে অতিবাহিত করবে, ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময়, ছায়াহীন, রৌদ্রতপ্ত প্রান্তরে তিনি আল্লাহর আরশের ছায়া পাবেন।[1] এই আরশের ছায়া প্রাপ্তির আশাকে পাথেয় করে যদি যুবসমাজ কুরআন ও সুন্নাহর বিশ্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে, তাহ’লে মানবতার উন্নয়ন মোটেই অসম্ভব নয়। অসম্ভব নয় জীবনের দর্পণে চিরন্তন মনুষ্যত্ববোধের আদর্শ প্রতিবিম্বিত হওয়া। এক কথায় কুরআন ও সুন্নাহর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলে সমাজ তথা পৃথিবী থেকে মুছে যাবে সব রকম হতাশা ও নৈরাশ্যের কালো মেঘ। মুছে যাবে দুঃখ, লাঞ্ছনা আর অত্যাচার। কুরআন-সুন্নাহর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের করণীয় সম্পর্কে নিম্নে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
(১) তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও শিরক দূরীকরণ : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাববুল আলামীন ঘোষণা করেন- وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ ‘আমি জিন ও মানুষকে এজন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা কেবল আমারই ইবাদত করবে’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর এবং ত্বাগূত বর্জন করো’ (নাহল ১৬/৩৬)।
শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ‘নিশ্চয়ই শিরক বড় অন্যায়’ (লোকমান ৩১/১৩)। তিনি আরো বলেন, وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً بَعِيْدًا ‘আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শিরক করে, সে সুদূর ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়’ (নিসা ৪/১১৬)।
আল্লাহর যমীনে শুধুমাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা এবং অন্যের দাসত্ব বর্জন করা মানব ও জিন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই বিশ্বের বৃহত্তর অংশে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে আল্লাহর একত্বের বিপরীতে শিরকের তড়িৎগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে। সর্বত্র দেখা যাচ্ছে, মানব রচিত বিধানের গোলামী। ফলস্বরূপ অহর্নিশ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে অমানবিক নিষ্ঠুরতা। এই অবস্থায় পৃথিবীর বুকে তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় মুসলিম যুবকদেরকে এগিয়ে আসতে হবে দুর্বার গতিতে। কারণ তারাই হ’ল জাতির চির-জাগ্রত অগ্রগামী সৈন্যদল। তারাই শোনাতে পারে ব্যথিত মানবতাকে নতুন আশা ও আশ্বাসের বাণী, দিতে পারে নতুন আলোকের সন্ধান। উপহার দিতে পারে তাওহীদ ও শিরক বর্জিত আদর্শ সমাজ।
(২) সুন্নাত প্রতিষ্ঠা ও বিদ‘আত দূরীকরণ : এ প্রসঙ্গে কুরআন ও সুন্নাহর ঘোষণা সমূহ হ’ল- মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাকো’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন,مَنْ يُطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে মুখ ফিরিয়ে নিল আমরা তার জন্য তোমাকে তত্ত্বাবধায়করূপে প্রেরণ করিনি’ (নিসা ৪/৮০)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু সৃষ্টি করবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2] অন্যত্র তিনি বলেন,
مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ.
‘আমার মৃত্যুর পর তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে অচিরেই তারা অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে এবং তাকে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখবে। আর তোমরা (দ্বীনের মধ্যে) নতুন সৃষ্টি হ’তে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন কাজই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী’।[3]
নবী করীম (ছাঃ) আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আজও স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে তাঁর বিশ্বজনীন আদর্শ। তাঁর অমর বাণী চির নীরব হয়ে যায়নি। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যাবেও না। তাঁর বাণী যুবকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে যদি আবারও এ পৃথিবীর কোণায় কোণায় পৌঁছে যায়, তাহ’লে এ পৃথিবী পাবে যথার্থ আলোর ঠিকানা। বহুদিনের পুঞ্জীভূত বেদনার অবসান হবে। দূরীভূত হবে মানব সভ্যতার অন্ধকার। সার্থক হবে যুব জীবন।
(৩) উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ ও তার সম্প্রসারণ : শিক্ষা মানব মনের সকল আবিলতা দূর করে, মানবাত্মাকে নিষ্কলুষ ও নির্মল করতে পারে; হক-বাতিলের পার্থক্য নিরূপণে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। তাকে মানবতার শীর্ষস্তরে উন্নীত করতে পারে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? জ্ঞানী ব্যক্তিরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (যুমার ৩৯/৯)। এজন্য আল্লাহ প্রথমে পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন,اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (‘আলাক ৯৬/১)। শিক্ষার প্রতি রাসূল (ছাঃ)ও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন,مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّيْنِ ‘আল্লাহ যার জন্য কল্যাণ চান তাকে দ্বীনী জ্ঞান দান করেন’।[4] তিনি আরো বলেন,نَضَّرَ اللهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَ ‘আল্লাহ সেই ব্যক্তির শ্রীবৃদ্ধি করেন, যে ব্যক্তি আমাদের নিকট কিছু শ্রবণ করে তা অন্যের নিকট ঠিক সেভাবেই পৌঁছিয়ে দেয়, যেভাবে সে শ্রবণ করেছে’।[5]
শিক্ষা যেকোন জাতির মেরুদন্ড। আর মুসলিম উম্মাহর মেরুদন্ড হ’ল কুরআন ও হাদীছ। ইসলামী সংস্কৃতির উত্থান ও পতন নির্ভর করে কুরআন ও হাদীছের উপর। মুসলিম জাতির জীবন ও ভাগ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে কুরআন ও হাদীছের সঙ্গে। সুতরাং মুসলিম যুবক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সাথে ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন করবে, যা দিয়ে বর্তমান বিশ্বের গতি-প্রকৃতির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে তার মূল্যায়ন করতে শিখবে। একই সাথে এই মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অন্ততঃপক্ষে ইসলামের পঞ্চমস্তম্ভের দাবীগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করবে এবং সেগুলির প্রচার ও প্রসারে নিরন্তর দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করবে। যদি মুসলিম যুবক তার বুদ্ধি ও মনন দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহর বিশ্বজনীন আদর্শের প্রচার ও প্রসার না করে, তাহ’লে জাতির হৃৎপিন্ডে প্রবাহিত হ’তে পারে অপূরণীয় ক্ষতির বিষবাষ্প।
(৪) সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ : ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নতি-অগ্রতি ও সমৃদ্ধির জন্য সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা অপরিহার্য। এটা না থাকলে জাতি সংশোধিত হয় না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর নির্দেশ-وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ‘তোমাদের মধ্যে এরূপ একটি সম্প্রদায় থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করে এবং ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারাই সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)।
পৃথিবীতে যুগে যুগে এমন অনেক মহামানব এসেছেন, যাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শকে পাথেয় করে মানবজাতিকে সৎকাজের আদেশ দিয়েছেন এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। আর মুসলিম যুবকের দল এই ঐতিহ্যের ঋণকে অস্বীকার করতে পারে না। আজ এই অধঃপতিত সমাজে তথা সমগ্র পৃথিবীতে প্রকট হয়ে উঠেছে মনুষ্যত্বের দুর্বিষহ অবমাননা। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, মুসলিম উম্মাহ সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য কর্মে কাঙ্খিত সক্রিয়তা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলস্বরূপ সমগ্র জাতির আত্মসম্ভ্রমবোধ ভূ-লুণ্ঠিত প্রায়। বর্তমান সমাজে মানব-পীড়ন, মানব নির্যাতন যখন দৈনন্দিন ভাগ্যলিপি, জাতির আকাশে যখন জমে উঠেছে ঘন মেঘের তমিস্রা, তখন এই অভিশপ্ত অবস্থার লজ্জা থেকে মানব সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে মুসলিম যুবকদেরকে। আর এটা সম্ভব হবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে মুসলিম যুবকের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আর তাদেরকে এটা করতেই হবে। কারণ এটাই বিশ্বনবী (ছাঃ)-এর বিশ্বজনীন আদর্শ। ধীরে ধীরে এই আদর্শের যথার্থ বাস্তবায়নে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে মিথ্যা, অন্যায় ও অবিচার। প্রতিষ্ঠিত হবে সত্য, ন্যায় ও সুবিচার। পৃথিবীতে প্রতিভাত হবে মুসলিম যুবকের অম্লান মহিমা।
(৫) সত্যের জয়গান : মুসলিম যুবক মূল্যায়ন করবে আল্লাহর এই ঘোষণা- جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا ‘সত্য সমাগত হয়েছে এবং মিথ্যা অপসৃত হয়েছে; মিথ্যা তো অপসৃত হওয়ারই বিষয়’ (বাণী ইসরাঈল ১৭/৮১)।
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। মুসলিম যুবক তার জীবনকে মূল্যবান করতে পারে সত্যের ঝান্ডা বহন করে পৃথিবীতে নতুন প্রভাত আনয়নের মাধ্যমে। মানবজাতির দুঃখ-বেদনা, শোষণ-পীড়ন, লাঞ্ছনা-অপমান ইত্যাদি মিথ্যাশ্রিত মানবতাবিরোধী উপাদানগুলির অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে সত্য উষার স্বর্ণদ্বার উন্মুক্ত করতে পারে। সর্বশোষণমুক্ত, লাঞ্ছনা-পীড়ন ও অপমান বর্জিত এক ঝলমলে সমাজ প্রতিষ্ঠার মানসে মুসলিম যুবক সবার অগ্রগামী হবে। এটাই জাতির প্রত্যাশা।
(৬) জনকল্যাণমুখী কাজে অংশগ্রহণ : সমাজের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য যুবকের উদ্যম ও প্রয়াস অপরিহার্য। যুবক সতত স্মরণ করবে আল্লাহর এই নির্দেশ-وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُوْا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘণের কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)।
এ জগতের দুঃখ অন্তহীন। যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা, অগ্নুৎপাত এবং রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি পৃথিবীর মানুষকে বেষ্টন করে আছে। এই আর্ত-পীড়িত, ক্ষুধার্ত মানুষদের সেবার মধ্যে আদর্শ মুসলিম যুবকের অন্তরে উদ্ভাসিত হবে অনাবিল তৃপ্তি ও আনন্দ। এই বিশ্বব্যাপী দুর্দিনে মুসলিম যুবক যদি মানবসেবার মহৎ আদর্শটি ধরে রাখে তাহ’লে ইসলামের স্বতঃস্ফূর্ত মানব সেবার মহত্ত্বের প্রতি পুনরায় বিশ্ববাসীর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসবে।
(৭) মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠা : মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠার মানসে প্রতিটি শিক্ষিত মুসলিম যুবক নিম্নে প্রদত্ত আল্লাহর ঘোষণাসমূহের বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে-وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَّلاَ تَفَرَّقُوْا ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে মযবূত করে ধর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। তিনি আরো বলেন, وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَلاَ تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ ‘আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করবে না। অন্যথা তোমরা সাহস হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে’ (আনফাল ৮/৪৬)। তিনি আরো বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ ‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনের মধ্যে নানা মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়’ (আন‘আম ৬/১৫৯)।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মুসলিম উম্মাহ আজ খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দলভুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ খাঁটি ইসলামী আদর্শ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ঐক্য ও সংহতির পরিবর্তে মুসলিম সমাজে আজ সৃষ্টি হয়েছে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। কিন্তু এই অবাঞ্ছিত ভেদ-বৈষম্য এক বড় ধরনের মূঢ়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক মনে রাখবে মুসলিম তো মুসলিমই। সে কুরআন মানে, ছহীহ হাদীছ মানে। তার আবার ভেদাভেদ কিসের? এই ভেদাভেদের মূঢ়তা ঘুচাবার জন্য মুসলিম যুবক কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করবে আল্লাহর এই ঘোষণা সম্পর্কে-
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যকার আদেশদাতাগণের। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে সেটাকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণামে প্রকৃষ্টতর’ (নিসা ৪/৫৯)। তিনি আরো বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا- ‘কিন্তু তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা কিছুতেই ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে সালিশ মেনে নেবে। অতঃপর তুমি যে ফায়ছালা করবে সে সম্পর্কে তারা কুণ্ঠাবোধ করবে না; বরং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)।
সমাপনী : এ হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর বিশ্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের ভূমিকার কতিপয় দিক। আজ বিশ্বজুড়ে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মহামারী চরম আকার ধারণ করেছে। দেড় হাযার বৎসরের প্রাচীন সোনালী ইতিহাস ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলেছে। পৃথিবী জুড়ে শুধুই রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধিতা। কাজেই অশান্তির ঘূর্ণিবাত্যা পরিদৃষ্ট হচ্ছে জীবনের স্রোতে পলে পলে। প্রভুত্ববাদী সম্প্রসারণবাদীর দল সমরতৃষ্ণা নিবারণে সদা মত্ত। মানব ভাগ্যে তা বহন করে এনেছে অপরিসীম দুঃখ ও ক্ষয়ক্ষতির সুবিশাল খতিয়ান। একেবারে গ্রাম্য স্তর থেকে আন্তর্জাতিক স্তর পর্যন্ত শুধুই মহাবিনাশ আর সর্বনাশ। পরিবার থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতার নগ্ন প্রমত্ত আস্ফালন। ফলে মানবতার বক্ষ্যস্থলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল ক্ষত। কাঁদছে মানুষ; কাঁদছে মানবতা। এহেন পরিস্থিতিতে মুসলিম যুবকের দল চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কারণ মানবতার মুক্তি, স্বাধীনতা, উন্নতি-অগ্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে ইসলামী শরী‘আহ নির্দেশিত পথ ও পন্থায় আত্মোৎসর্গের জন্য তারা চির অঙ্গীকার বদ্ধ। আর চিরকালের মুক্তি-পাগল হ’ল এই আদর্শ যুবকের দল। তাই তো যুব-জীবনের বর্ণ বিচিত্র পাতায় পাতায় থাকবে কুরআন ও সুন্নাহর চিরশুভ্র মূল্যবোধ। জীবনকে বাজি রেখে তারা ছুটে যাবে মানব জীবনের সুখ ও শান্তির মধুর প্রলেপ অন্বেষণে। বাতিলের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তারা অন্তরের অন্তঃস্থলে নিগূঢ়রূপে উপলব্ধি করবে কুরআনে লিপিবদ্ধ সব বাধাজয়ী দুর্দমনীয় শক্তির অাঁধার এই আয়াতটির সুগভীর তাৎপর্য- إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু বিশ্বজাহানের রব আল্লাহর জন্য’ (আন‘আম ৬/১৬২)।
এভাবে একদিন তারা সফল হবেই ইনশাআল্লাহ। প্রতিষ্ঠিত হবে কুরআন ও সুন্নাহর সহজ-সরল সুমহান আদর্শ। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
শেখ ইমরান ইবনু মুয্যাম্মিল
নূরপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭০১।
[2]. বুখারী হা/২৬৯৭ ‘বিবাদ মীমাংসা’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৩০০।
[3]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/৩৮৫১; মিশকাত হা/১৬৫।
[4]. বুখারী হা/৭১; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/২০০।
[5]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, ছহীহ তারগীব হা/৮৩।