(১) মীরজাফর : ৮০
বছর বয়সে তাকে নবাব করা হয়। তাকে ‘ক্লাইভের গাধা’ বলা হ’ত। দুর্নীতির দায়ে
২ বছর পর বহিষ্কার করা হয় এবং তার জামাতা মীর কাশিমকে নবাব করা হয়। ২ বছর
পর মীর কাশিমকে সরিয়ে মীরজাফরকে পুনরায় নবাব করা হয়। ২ বছর পর আবার হটানো
হয় এবং ইংরেজরা সরাসরি ক্ষমতায় বসে। মীরজাফর কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়। তখন
পরিবারের লোকেরা তাকে জঙ্গলে ফেলে আসে। রাজা নন্দকুমার তাকে কিরিটেশ্বরী
দেবীর পা ধোয়া পানি খাওয়ায়। আর এভাবেই সবশেষে ঈমানটুকুও হারিয়ে সে
প্রাণত্যাগ করে।
(২) মীরণ : ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক মীরজাফর পুত্র মীরণ বজ্রাঘাতে মারা যায় অথবা জনৈক ইংরেজ সেনাপতির গুলিতে সে নিহত হয়।
(৩) ঘসেটি বেগম : সিরাজুদ্দৌলার আপন খালা ঘসেটি বেগম। সিরাজের উচ্চ মর্যাদায় তিনি ঈর্ষাকাতর ছিলেন এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মীরণ তার ফুফু ঘসেটি বেগমকে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করে।
(৪) মোহাম্মদী বেগ : রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এই বেওয়ারিশ বাচ্চাকে সিরাজের পিতা-মাতা পুত্র স্নেহে লালন-পালন করেন। মাত্র ১০ হাযার টাকার লোভে সে ১৭৫৭ সালের ২রা জুলাই মীরণের হুকুমে মুর্শিদাবাদ কারাগারে ঢুকে তার মনিব সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যা করে। পরে সে পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে পানিতে পড়ে ডুবে মরে।
(৫) মীর কাশিম : আপন ফুফাতো ভগ্নিপতি ও মীরজাফরের জামাতা এই ব্যক্তি ভগবানগোলা থেকে সিরাজুদ্দৌলাকে ধরিয়ে দেয়। মীরজাফরের পরে সে নবাব হয়। ২ বছর পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরে সে পথে পথে ঘুরতে থাকে। একদিন সকালে তার লাশ মুঙ্গের দুর্গের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
(৬) রায়দুর্লভ ও জগৎশেঠ : এদেরকে মীর কাশিম গঙ্গায় নিক্ষেপ করে হত্যা করে। রাজা রাজবল্লভকে গলায় বালুর বস্তা বেঁধে গঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ইয়ার লতিফ খাঁ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। উমিচাঁদ প্রতিশ্রুত ২০ লাখ টাকা না পেয়ে পাগল হয়ে যায়। অবশেষে সে কুষ্ঠরোগে মারা যায়।
(৭) ক্লাইভ : মাত্র ৮০ টাকা বার্ষিক বেতনে ১৭৪৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চাকুরী নিয়ে মাদ্রাজে আসা এই ব্যক্তি ১৭৬০ সালে যখন দেশে ফেরেন, তখন তার ছিল নগদ ২ কোটি টাকা সহ স্ত্রীর বিরাট গহনার বাক্স। যাতে ছিল মণি-মুক্তা সহ বহু মূল্যবান অলংকারাদি। পরে স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্য যুবকের সাথে চলে যায়। বাংলা লুণ্ঠনের দায়ে ১৭৬৭ থেকে ৭ বছর জেল খেটে কপর্দক শূন্য অবস্থায় ১৭৭৪ সালে বের হন। অতঃপর নিজ বাড়ীতে মতান্তরে লন্ডনের টেম্স নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে। অথচ তার হাতেই বাংলার সাড়ে ৫শ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান হয় এবং সারা ভারতে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়।
শিক্ষণীয় :
(১) নেতৃত্বের সরলতা অনেক সময় জাতীয় দুর্যোগ ডেকে আনে। যেমন নবাব আলীবর্দী খাঁ তাঁর আপন ভগ্নিপতি মীরজাফরকে প্রধান সেনাপতি করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, তিনি তরুণ নবাব সিরাজুদ্দৌলার মুরববী হবেন ও তাকে সার্বিক সুরক্ষা দিবেন। যেভাবে জাহাঙ্গীরের প্রধান সেনাপতি বৈরম খাঁ তরুণ সম্রাট আকবরকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু হয়েছিল তার বিপরীত।
একইভাবে প্রশাসনের প্রধান ৭টি পদের ৬টি পদেই তিনি হিন্দুদের বসিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এর ফলে তারা কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু হয়েছিল তার বিপরীত। মূল পদগুলি নিজেদের হাতে না রেখে অতি উদারতা দেখিয়ে তিনি ভুল করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর নির্দেশ উপক্ষো করেছিলেন (মায়েদাহ ৫/৫৭)। যার ফল ভোগ করেছেন সিরাজুদ্দৌলা এবং সাথে সাথে বাংলার মানুষ। অতএব সর্বদা বিচক্ষণ ও দূরদর্শী হ’তে হবে এবং কোন অবস্থাতেই আত্মবিস্মৃত হওয়া যাবে না।
(২) ইসলামের মূলনীতির উপর সর্বদা দৃঢ় থাকতে হবে এবং অমুসলিম নেতাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
(৩) অর্থনৈতিক স্বার্থ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। অতএব মাল ও মর্যাদালোভী ব্যক্তিদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।
(৪) পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের ৩৫০০ সৈন্যের কাছে নবাবের ৫০,০০০ সৈন্যকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। যার মূল কারণ ছিল জাতির মধ্যে অনৈক্য এবং ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। সেকারণ পলাশীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ধর্মীয় ও জাতীয় স্বার্থে যেকোন মূল্যে সর্বদা সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে (স.স.)।