২৯ শে মার্চ বুধবার বেলা প্রায় সোয়া ৩-টা। চট্টগ্রাম যেলার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও শিশুবিষয়ক বিশেষ আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌসের আদালত। বিচারকের আহবানে এজলাসের সামনে একে একে জড়ো হ’লেন ১২ জন নারী। দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও তখন যেন হারিয়ে ফেলেছেন তারা। তাঁরা আদালতে এসেছেন ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত শিশুটির মা হওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে। তাদের একজনও খালি হাতে ফিরে যেতে চান না।

লিখিত আদেশ পড়তে শুরু করেন মহিলা বিচারক। সাত মিনিটে আদেশটি পড়ে শেষ করেন তিনি। কিন্তু এর আগেই কাঁদতে শুরু করেন মা হ’তে আসা নারীরা। তাদের মধ্যে শাকীলা আখতারই ব্যতিক্রম। তিনিও কেঁদে চলেছেন। কিন্তু তার কান্না ছিল আনন্দের। কারণ তিনিই পেয়েছেন শিশুটিকে।

এই মুহূর্তটির অপেক্ষায় ১৯ বছর পার করেছেন নিঃসন্তান শাকীলা আখতার। স্বামী মুহাম্মাদ যাকের ইসলাম পেশায় চিকিৎসক। কুড়িয়ে পাওয়া শিশু ‘একুশ’কে তাদের যিম্মায় দিয়েছেন আদালত। আদালতের আদেশে তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটল। শিশু একুশও জন্মের ৩৭ দিন পর পেল একটি অভিভাবক পরিবার।

আদেশে আদালত বলেন, শিশুটিকে পেতে আগামী ৫ই এপ্রিলের মধ্যে শিশুটির নামে ১০ লাখ টাকার শিক্ষাবীমা করতে হবে এবং তার প্রকৃত পিতা-মাতার সন্ধান পাওয়া গেলে এবং তারা নিতে চাইলে প্রমাণ সাপেক্ষে শিশুটিকে ফেরৎ দিতে হবে। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আদালত বলেন, ১২ জন আবেদনকারীর মধ্যে সবাই সচ্ছল। কিন্তু ১১ জনই নিঃসন্তান। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে হত্যা মামলার চেয়েও বেশী খাটতে হয়েছে। এক্ষেত্রে আবেদনকারীদের অবস্থা মূল্যায়ন করে শিশুটির সার্বিক কল্যানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেন, ‘আমি কোন মহামানব নই। সন্তান আবেদনকারীদের আকুতি মানুষ হিসাবে আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি খুব অসহায় বোধ করছি সাধ্যের সীমাবদ্ধতার জন্য। আমার হেফাযতে যদি একাধিক শিশু থাকত, তাহ’লে নিঃসন্তান দম্পতিদের প্রত্যেককে একটি করে শিশু যিম্মায় দিতাম।

আদালতের আদেশের পরও কান্না থামছিল না শাকীলা আখতারের। তার স্বামীর মুখেও তখন বিশ্বজয়ের আনন্দ। উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে শাকীলার আকুতি- আল্লাহর প্রতি অশেষ শুকরিয়া। তিনি আমার ভাগ্যে আদালতের মাধ্যমেই সন্তান প্রাপ্তি লিখে রেখেছিলেন। এ আনন্দ মুখে বলে বুঝাতে পারব না।

আদেশ শেষে সেদিন বিকেলে আদালতকক্ষের ভিতরে অঝোরে কাঁদছিলেন আবেদনকারী এক নারী। তিনি বলেন, অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে আবেদন করেছিলাম।

উল্লেখ্য, গত ১৯ শে ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম মহানগরীর কর্ণেল হাট এলাকার লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন লিপি নামের জনৈকা মহিলা। অজ্ঞাত কারণে শিশুটিকে পার্শ্ববর্তী ডাস্টবিনে ফেলে সরে যায় প্রকৃত মা। মধ্যরাতে কান্না শুনে এগিয়ে আসে এলাকার ক’জন তরুণ। দ্রুত তারা বিষয়টি জানায় আকবর শাহ থানাকে। খবর পেয়ে থানার ওসি আলমগীর মাহমূদ শিশুটিকে উদ্ধার করে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে নিবিড় পরিচর্যায় ডাক্তার, নার্স আর অন্যান্য রোগীদের পরিচর্যা ও ভালোবাসায় অবশেষে সুস্থ হয়ে ওঠে শিশুটি। ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে উদ্ধার হওয়ায় তার নাম রাখা হয় ‘একুশ’।

এদিকে ঠিকানাহীন শিশুটিকে দত্তক নিতে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই যোগাযোগ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে। ফলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। আদালত আগ্রহী নিঃসন্তান নারীদের আবেদনপত্র দাখিলের নির্দেশ দেন।   

ফলে জন্ম হয় মর্মস্পর্শী এ ঘটনার। যার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার অকৃত্রিম বাস্তবতা। অথচ ঘটনার প্রেক্ষাপট ছিল মনুষ্যরূপী একজন দানবী মায়ের কঠোর নির্মমতা।



[আমরা সমাজকে ধর্ম মুখী করার জন্য দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি এবং শিশুটিকে উদ্ধার ও পুনর্বাসন তৎপরতায় যুক্ত সকলের জন্য আল্লাহর নিকট উত্তম প্রতিদান কামনা করছি। সেই সাথে বাচ্চাটির নাম ‘একুশ’ রাখার প্রতিবাদ করছি। কেননা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ এদেশে একটি স্বতন্ত্র ইতিহাসের নাম। এর সাথে অন্য কারু নাম যোগ করা ঠিক নয় (স.স.)]




আরও
আরও
.