সফলতা মানব জীবনে উত্তরণের একটি অন্যতম হাতিয়ার। ইহলৌকিক জীবনের নানা স্তরে প্রতিষ্ঠা অর্জন করার জন্য আমরা অবিরত সংগ্রাম করি। সংগ্রামী চেতনা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অতুলনীয় সাহায্য করে। দীর্ঘ অধ্যবসায় বা নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে সফলতা লাভ করা যায় তার একটা সুমিষ্ট স্বাদ আমরা আস্বাদন করি। সফলকাম কৃতি ব্যক্তির প্রতি সামাজিক যে দৃষ্টিভঙ্গি তার সাথে বিফল ব্যক্তির আসমান যমীন তফাৎ। সফল ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি পৃথিবীতে সম্মান ও মর্যাদার পাত্র। অপরদিকে ব্যর্থ ব্যক্তি সর্বত্র অবহেলা ও তুচছ-তাচিছল্যের বস্ত্ত। আমরা সাধারণত পার্থিব জগতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির নিরিখে একজনের সফলতা বিচার করি। অর্থ, জশ, বিত্ত, বৈভব-শৌর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও খ্যাতির মাপকাঠিতেই সফলতা যাচাই করি।
উন্নত চরিত্র, মানবিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ প্রভৃতি বিষয়গুলো আমাদের সফলতার গন্ডির বাইরে থাকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যে যতটা অর্থ, খ্যাতি ও প্রভাবের অধিকারী সে ততই সফল। কেউ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করলে আমরা তাকে সফল ব্যবসায়ী বলি। অভিনয় জগতে যিনি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি সফল অভিনেতা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যার যত বেশী রোগী তিনি তত বেশী সফল চিকিৎসক। অতি সম্প্রতি যে বক্তার যত বেশী দাবী কিংবা যার ফেসবুক লাইকারের সংখ্যা সর্বাধিক এবং ইউটিউব এ ফলোয়ার ও সাবস্ক্রাইবার-এর সংখ্যা অধিক তিনি ততই সফল ব্যক্তিত্ব। এসবই প্রধানত আমাদের চোখে সফলতার নির্ণায়ক, যদিও শরী‘আত বলে অন্য কথা।
ইসলামের দৃষ্টিতে পার্থিব জগতের সফলতা চূড়ান্ত সফলতা নয়, বরং পারলৌকিক জীবনের সার্থকতাই সর্বাপেক্ষা মহা সফলতা। দীর্ঘ পড়াশুনা ও বিরাট গবেষণার পর একজন ছাত্র জীবনে প্রতিষ্ঠা না পেলে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন, তার মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। নিজের নৈরাশ্যকে আপন করে পরিবার ও সমাজ থেকে আলাদা করে নেয়। তার বন্ধু-বান্ধবরা সরকারী চাকুরী পেয়ে প্রতিষ্ঠিত ও সফল হয়েছে, অথচ চাকুরী না পেলেও আত্মসম্মানের সাথে জীবন-যাপন করতে কোন অসুবিধা নেই। দুর্নীতির যাঁতাকলে অনেক মেধাবী ছাত্রের জীবন পিষ্ট। জালিয়াতির করাল গ্রাসে অনেক প্রতিভাবান জীবন নির্মম পরিহাসের শিকার। তেজদীপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মুখে হাসি ফোঁটানোর তীব্র ইচছা দিন দিন নিস্প্রভ হয়ে পড়েছে। এমন ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। সদা মনে রাখা উচিত চরম ব্যর্থতা অপেক্ষা করছে পরলোকে। এ জীবনের ব্যর্থতা ক্ষণিকের মাত্র। তথাপি প্রতিভার সাথে অর্থ-সম্পদের বোঝার দায়িত্ব আরও অনেক বেশী। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٍ رَزَقَهُ اللهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِى فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِى مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِى مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لاَ يَتَّقِى فِيهِ رَبَّهُ وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلاَ يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللهُ مَالاً وَلاَ عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِى مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ-
‘নিশ্চয়ই দুনিয়া চার শ্রেণীর মানুষের জন্য। ১ম শ্রেণীর ব্যক্তি হ’লেন তিনি, আল্লাহ যাকে অর্থ ও জ্ঞান উভয়ই দান করেছেন। সে বিষয়ে তিনি তার রবকে ভয় করেন, তার সম্পদ তিনি তার আত্মীয়-পরিজনদের কাছে পৌঁছে দেন। আর সে ব্যাপারে তিনি আল্লাহর হক সম্পর্কে অবগত। তিনি সর্বোচচ স্তরের অধিকারী। ২য় শ্রেণীর ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন, কিন্তু অর্থ দান করেননি, তিনি সঠিক সংকল্পকারী। তিনি মনে মনে বলেন, যদি আমার অর্থ থাকতো তবে আমিও অমুক ব্যক্তির মতো (সৎ) কাজ করতাম। সেটা তার নিয়তের উপর নির্ভর করছে। ফলে তাদের দু’জনের নেকী সমান। ৩য় শ্রেণীর ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ দান করেছেন কিন্তু জ্ঞান দান করেননি। সে অজ্ঞতাবশত তার সম্পদ তছনছ করে। সম্পদের ক্ষেত্রে নিজ রবকে ভয় করে না। নিজ সম্পদ নিকটাত্মীয়দের পৌঁছে দেয় না এবং সম্পদে আল্লাহর হক জানে না। সে হচেছ সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্তরের অধিকারী। ৪র্থ শ্রেণীর ব্যক্তি, যাকে অর্থ ও জ্ঞান কিছুই দান করা হয়নি, অতঃপর সে বলে, যদি আমাকে অর্থ দান করা হ’ত, তবে আমি অমুক ব্যক্তির ন্যায় কাজ করতাম। বস্ত্তত এটা নির্ভর করছে তার নিয়তের উপর। ফলে তাদের দু’জনের পাপ সমান’।[1]
অর্থাৎ এ জগতের সফলতা আখেরাতের জীবনের সফলতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং এ জগতে যেটা সুখ-শান্তির উৎস ভাবছি পরলোকে তাই দুঃখ-দুর্দশার কারণ হ’তে পারে। ডেকে আনতে পারে স্থায়ী ব্যর্থতার চরম অন্ধকার।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সফলতার অসংখ্য বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। পার্থিব জগতের সুখ-সমৃদ্ধি, আননদ-বিলাস, বিত্ত-বৈভবকে তুচছ বস্ত্ত হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ، ‘তুমি তাদেরকে মন্দ কাজসমূহ থেকে রক্ষা কর। আর যাকে তুমি মন্দ কাজ সমূহ থেকে রক্ষা করলে তাকে তো তুমি ক্বিয়ামতের দিন অনুগ্রহ করলে। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (গাফের ৪০/৯)।
উল্লিখিত আয়াতের শেষাংশে বর্ণিত ‘মহাসাফল্য’ বিষয়টির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ‘ত্বাকওয়া’ বা আল্লাহভীরুতা। কারণ ‘ত্বাকওয়া’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ বেঁচে থাকা বা রক্ষা করা। ‘ত্বাকওয়া’ শব্দটি বিশেষত রক্ষাকবচ অর্থে ব্যবহৃত হয়। সমস্ত অমঙ্গল, অনিষ্টতা ও অশালীন কর্ম থেকে সুরক্ষিত থাকাই হ’ল ‘ত্বাকওয়ার’ মূল লক্ষ্য। যে ব্যক্তি অন্যায়-অপকর্ম থেকে যতটা সুরক্ষিত তিনি ততটা আল্লাহভীরু। আর ত্বাকওয়াশীল ব্যক্তিই হবে বড় সফলকাম। এদের জন্যই তো আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا ‘নিশ্চয়ই মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে সফলতা’ (নাবা ৭৮/৩১)।
ত্বাকওয়াই সফলতার অন্যতম উপায় এবং প্রধান নিয়ামক। বৈধ-অবৈধ পন্থার পরোয়া না করে অপরের হক গ্রাস ও যাবতীয় অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যে সফলতা নেই, বরং তা নিহীত আছে অন্যায়-অপকর্ম থেকে বিরত থাকার মধ্যে। যদিও সমাজ তাকে ব্যর্থ বা বিফল ব্যক্তির দৃষ্টিতে দেখে। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,فَوَاللهِ لاَ الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ، ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দরিদ্রতার ভয় করি না, বরং ভয় করছি যে দুনিয়াকে তোমাদের জন্য সম্প্রসারিত করে দেওয়া হবে, যা তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করা হয়েছিল। ফলে তোমরা তার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যাবে, যেমন তা পাওয়ার জন্য তারা করেছিল। আর তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করেছিল’।[2]
প্রসঙ্গত নবী করীম (ছাঃ) বাহরাইনের অধিবাসীদের সাথে সন্ধি করেছিলেন এবং তাদের জন্য আলা-ইবনুল হাজরামীকে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-কে কর আদায়ের জন্য বাহরাইন পাঠিয়েছিলেন। তিনি করের মাল নিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হ’লেন। ফজরের ছালাত শেষে আনছারগণ নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে উপস্থিত হ’লে তিনি তাদের দেখে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ করো, আশা রাখ যা তোমাদের খুশি করবে। এমন মুহূর্তে তিনি সম্পদ বণ্টন না করে আগে পূর্বোক্ত জাতির ধ্বংসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আনছারদের সামনে দুনিয়ার মোহ, মায়া ও প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে সম্যকভাবে সতর্ক করে দেন। যে আশঙ্কার কথা তিনি আমাদের ব্যাপারে প্রকাশ করেছিলেন বর্তমানে তা পদে পদে প্রতিফলিত হচেছ, দুনিয়ার সফলতাই যেন আমাদের শেষ কথা। এজন্য আমরা কোন কিছুর তোয়াক্কা করি না। অর্থ সর্বস্ব দৃষ্টি দিয়েই আমরা সফলতার বিচার করি। একজন ব্যক্তির যাবতীয় ধর্মীয় গুণাবলী, উজ্জ্বল প্রতিভা, উন্নত চরিত্র সব ধরনের বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকার পরও আজকের সভ্য সমাজ তাকে মেয়ে দিতে ভয় পায়। শুধু চাকুরী পেয়ে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে। সমাজের চোখে এমন ব্যর্থ বিফল হবার কারণে যারা দুনিয়ায় সাফল্য লাভের প্রতিযোগিতায় মগ্ন আখেরাত ভুলে আমরা তাদের হাতে সফলতার সার্টিফিকেট তুলে দেই। অথচ এমন কোন স্থান নেই, যেখানে নবী করীম (ছাঃ) আমাদের দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক করেননি।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِى إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِى النِّسَاءِ. ‘নিশ্চয়ই এই দুনিয়া সুমিষ্ট সবুজ বস্ত্ত। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের এখানে প্রতিনিধি হিসাবে পাঠিয়েছেন, তোমরা কি কর্ম করছো তা প্রত্যক্ষ করার জন্য। অতএব তোমরা দুনিয়া থেকে বেঁচে থাক ও নারী থেকে দূরে থাক। কারণ বাণী ইসরাঈলদের মাঝে সর্বপ্রথম ফিতনার উদভব হয়েছিল নারীকে কেনদ্র করেই’।[3]
উক্ববা বিন আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ يَوْمًا فَصَلَّى عَلَى أَهْلِ أُحُدٍ صَلاَتَهُ عَلَى الْمَيِّتِ، ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيْدٌ عَلَيْكُمْ، وَإِنِّى وَاللهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ، وَإِنِّى أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ أَوْ مَفَاتِيْحَ الأَرْضِ وَإِنِّى وَاللهِ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوا بَعْدِىْ، وَلَكِنْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا-
‘একদা নবী করীম (ছাঃ) বের হ’লেন এবং ওহোদের শহীদদের উপরে ছালাত আদায় করলেন। যেমন তিনি মৃতদের জন্য ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি মিম্বরে ফিরে গেলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের অগ্রগামী, আমি তোমাদের জন্য সাক্ষী হব। আল্লাহর শপথ! আমি এখন আমার হাউজ (হাউজে কাওছার) দেখতে পাচিছ। আমাকে পৃথিবীর যাবতীয় ধনভান্ডারের চাবিকাঠি দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর শপথ! আমার মৃত্যুর পর তোমাদের জন্য আমি শিরকের ভয় করি না; বরং আমার আশঙ্কা হচেছ তোমরা পৃথিবী নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে’।[4]
দুর্ভাগ্য যে, স্থায়ী সফলতার পথে যা প্রধান প্রতিবন্ধক তা অর্জনের জন্য আমরা অতি তৎপর। কোনভাবেই যেন আমরা দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত হ’তে পারছি না। ক্ষণিকের সুখ সমৃদ্ধির পেছনে ছুটতে গিয়ে আসল সফলতাকে নষ্ট করা কোন বিচক্ষণ ব্যক্তির কাজ হ’তে পারে না। আল্লাহ বলেন, وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى، ‘নিশ্চয়ই পরকাল তোমার জন্য ইহকালের চাইতে কল্যাণকর’ (যোহা ৯৩/৪)।
পার্থিব জগতে সফলতার লক্ষ্যে সম্পদের প্রতিযোগিতা মানুষকে যে পরকালীন সফলতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে এ নিয়ে আমাদের মোটেও দ্বিধা নেই। সেজন্য মহান আল্লাহ বলেন, أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ، حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ، ‘অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তোমাদেরকে (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/১-২)।
যারা পার্থিব যশ-অর্থ-খ্যাতি অর্জন করে সাফল্য পায়নি কিংবা প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারেনি, তাদেরই দেখা যাবে ক্বিয়ামতের দিন দুনিয়ার নামী সফল ব্যক্তিদের তুলনায় অনেক আগেই জান্নাতের প্রবেশাধিকার অর্জন করেছে। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,يَدْخُلُ فُقَرَاءُ الْمُسْلِمِيْنَ الْجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَائِهِمْ بِنِصْفِ يَوْمٍ وَهُوَ خَمْسُمِائَةِ عَامٍ. ‘দরিদ্র মুসলিমগণ ধনীদের তুলনায় অর্ধ দিবস আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর তা হবে (দুনিয়ার দিন গণনা অনুযায়ী) পাঁচশত বছরের সমান’।[5]
অন্যত্র নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِنَّ فُقَرَاءَ الْمُهَاجِرِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَائِهِمْ بِخَمْسِ مِائَةِ سَنَةٍ، ‘দরিদ্র মুহাজিরগণ তাদের ধনীদের তুলনায় পাঁচশত বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[6]
সম্পদের আধিক্য ও প্রাচুর্য মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। সম্পদের সাথে সম্পৃক্ত মানুষের হক সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা ভ্রূক্ষেপ করি না। একদিকে উপার্জিত সম্পদের উৎস যেমন পরিশুদ্ধ হ’তে হবে, অন্যদিকে সম্পদ ব্যয়ের খাত সমূহ তেমনি বিশুদ্ধ হ’তে হবে। সম্পদের সাথে সংযুক্ত হকসমূহ সঠিকভাবে আদায় না করলে ক্বিয়ামতের দিনে তা ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হ’তে পারে।
অর্থ সম্পদ ধোঁকা ও প্রতারণার বস্ত্ত। মানুষকে আল্লাহ বিমুখ করার অন্যতম হাতিয়ার। এজন্য ছহীহ মুসলিমের এই হাদীছটি আমাদের ইহলৌকিক জীবনে সুপথ দেখাতে পারে। আব্দুল্লাহ বিন ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
جَاءَ ثَلَاثَةُ نَفَرٍ إِلَى عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ وَأَنَا عِنْدَهُ، فَقَالُوا: يَا أَبَا مُحَمَّدٍ، إِنَّا وَاللهِ مَا نَقْدِرُ عَلَى شَيْءٍ لَا نَفَقَةَ، وَلَا دَابَّةَ، وَلَا مَتَاعَ، فَقَالَ لَهُمْ: مَا شِئْتُمْ إِنْ شِئْتُمْ رَجَعْتُمْ إِلَيْنَا فَأَعْطَيْنَاكُمْ مَا يَسَّرَ اللهُ لَكُمْ، وَإِنْ شِئْتُمْ ذَكَرْنَا أَمْرَكُمْ لِلسُّلْطَانِ، وَإِنْ شِئْتُمْ صَبَرْتُمْ، فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ فُقَرَاءَ الْمُهَاجِرِينَ يَسْبِقُونَ الْأَغْنِيَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِأَرْبَعِينَ خَرِيفًا-
‘তিনজনের একটি দল আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর কাছে আসে, তখন আমি তার কাছে ছিলাম। তারা বলল, হে আবু মুহাম্মাদ! (আমর ইবনুল আছের উপাধি) আল্লাহর শপথ, আমাদের ভরণ-পোষণ, বাহন ও পাথেয় বস্ত্ত হিসাবে খরচ করার কোন ক্ষমতা আমাদের নেই। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা কী চাও? যদি তোমরা চাও আমাদের কাছে ফেরত এসো আমরা এমন কিছু তোমাদের দিব, যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের জীবিকা নির্বাহের রাস্তা সহজ করে দিবেন। আর যদি তোমরা চাও তবে তোমাদের বিষয়টা শাসকের (সুলতান) নিকট উপস্থাপন করবো। আর তোমরা যদি চাও তো ধৈর্যধারণ করতেও পার। কেননা আমি আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, দরিদ্র মুহাজিরগণ ক্বিয়ামতের দিন তাদের ধনীদের পেছনে ফেলে চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ কথা শুনে তারা বলল, তবে আমরা ধৈর্যধারণ করব, আমরা কোন কিছু চাই না’।[7]
আজ যারা পার্থিব জগতে আমাদের চোখে ব্যর্থ, এ হাদীছে তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে। আখেরাতে তাদের হিসাবের বোঝা অনেকটাই কম। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তাটাও অনেকটা সহজ ও সুগম। যদি তারা অভাব-অনটনে ধৈর্যধারণ করতে পারেন। যিনি জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পাবেন তিনিই তো পরকালের সবচেয়ে বড় সফল ব্যক্তি। এজন্যই আল্লাহ বলেন,فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ، ‘অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই সফলকাম হবে। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন ধোঁকার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫)।
উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত (زحزح) যাহযাহা শব্দটি একটু আলাদাভাবে ব্যাখ্যার দাবী রাখে। মূল চার অক্ষর বিশিষ্ট শব্দটির অর্থ হ’ল- একটু একটু করে দূরে সরিয়ে দেওয়া, স্থানচ্যুত করা। পাঠকগণ নিশ্চয়ই শব্দটির মধ্যে তরঙ্গ অনুভব করেছেন। যেহেতু শব্দটি নিস্ক্রিয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই তার অর্থ দাঁড়ায় ব্যক্তি নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে থাকতে পারে না যদি না তাকে আগুন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। আর সেটাই হবে সবচেয়ে বড় সফলতা। সুতরাং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাওয়াটাই হবে নিঃসনেদহে বিরাট সফলতা। এই জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার বিষয়টি উপরে বর্ণিত ‘যাহযাহা’ শব্দ থেকে উদভূত। পবিত্র কুরআনে আরেকটি মাত্র স্থানে তার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়, সেখানেও দীর্ঘ জীবন লাভ করাটা যে মানুষকে আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে না তা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ- ‘তুমি তাদেরকে দীর্ঘ জীবনের ব্যাপারে অন্যদের চাইতে অধিক আকাঙ্ক্ষী পাবে, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে যেন সে হাযার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। আর তারা যা করে, আল্লাহ সবই দেখেন’ (বাক্বারাহ ২/৯৬)।
এমর্মে হাদীছে এসেছে, আদি ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
مَا مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلاَّ سَيُكَلِّمُهُ رَبُّهُ، لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ تَرْجُمَانٌ، فَيَنْظُرُ أَيْمَنَ مِنْهُ فَلاَ يَرَى إِلاَّ مَا قَدَّمَ مِنْ عَمَلِهِ، وَيَنْظُرُ أَشْأَمَ مِنْهُ فَلاَ يَرَى إِلاَّ مَا قَدَّمَ، وَيَنْظُرُ بَيْنَ يَدَيْهِ فَلاَ يَرَى إِلاَّ النَّارَ تِلْقَاءَ وَجْهِهِ، فَاتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ-
‘তোমাদের প্রত্যেকের সাথে আল্লাহ কথা বলবেন, যেখানে উভয়ের মাঝে কোন অনুবাদক থাকবে না। সে তার ডানে দৃষ্টিপাত করবে, তখন পূর্বে প্রেরিত কর্ম ছাড়া সে আর কিছু দেখতে পাবে না। বামে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, তখন তার প্রেরিত কর্ম ব্যতীত আর কিছু দেখতে পাবে না। তারপর সে তার সামনে দৃষ্টিপাত করবে, অতঃপর সম্মুখে জাহান্নামের আগুন ছাড়া অন্য কিছু দেখবে না। অতঃপর তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ, যদিও তা খেজুরের একটা অংশ দিয়েও হয়’।[8]
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়াটাই যে সবচেয়ে বড় সফলতা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভয়াবহ শাস্তির খেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দুনিয়াতে আমরা যে যতটুকু প্রস্ত্ততি নিতে পেরেছি তিনি ততটাই সফলকাম। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবু মালিক আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيْمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيزَانَ. وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلآنِ أَوْ تَمْلأُ مَا بَيْنَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَالصَّلاَةُ نُوْرٌ وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا.
‘পবিত্রতা ঈমানের একটি অবিচেছদ্য অংশ। আলহামদুলিল্লাহ (যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর) মীযানকে পরিপূর্ণ করে দেয়। আর সুবহানাল্লাহ, ওয়াল হামদুলিল্লাহ (আল্লাহর পবিত্রতা ও আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন) ভরপুর করে দেয়, অথবা আকাশ ও যমীনের মাঝে যা কিছু আছে তা পূর্ণ করে দেয়। ছালাত আলো, ছাদাক্বা (দান) প্রমাণ, ধৈর্য জ্যোতি, আর কুরআন তোমার পক্ষে অথবা তোমার বিপক্ষে দলীল। প্রতিটি ব্যক্তি প্রভাত করছে মুক্তির বিনিময়ে (জাহান্নামের আগুন থেকে) নিজেকে বিক্রি করে অথবা নিজেকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করার বিনিময়ে’।[9] আল্লাহ বলেন,لَا يَسْتَوِي أَصْحَابُ النَّارِ وَأَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَائِزُونَ، ‘জাহান্নামের অধিবাসী ও জান্নাতের অধিবাসী কখনো সমান নয়। জান্নাতের অধিবাসীগণই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/২০)।
উপরোক্ত আলোচনার নিরিখে বিষয়টি স্পষ্ট যে, জাহান্নামের আগুন থেকে যিনি পরিত্রাণ পাবেন এবং জান্নাত লাভ করবেন তিনিই প্রকৃত সফলকাম ব্যক্তি। পৃথিবীর সফলতার পরিধিটা অনেকটা বিস্তৃত এবং পরিসরটাও অনেকটা বহুমুখী। দুনিয়ার সফলতার চাবি হাতে পেয়ে আত্মসুখে বিভোর হয়ে চূড়ান্ত ও মহা সফলতা থেকে যেন বিস্মৃত না হয়ে পড়ি। সেজন্য সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই ভয়ানক দিনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্ত্ততি নেওয়ার তাওফীক দিন-আমীন!
মুহাম্মাদ ওয়ারেছ মিয়াঁ
পিএইচ.ডি গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
[1]. তিরমিযী হা/২৩২৫; আহমাদ হা/১৮০৬০, সনদ হাসান।
[2]. বুখারী হা/৩১৫৮; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩।
[3]. মুসলিম হা/২৭৪২; তিরমিযী হা/২১৯১; মিশকাত হা/৩০৮৬।
[4]. বুখারী হা/৬৪২৬; মুসলিম হা/২২৯৬।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০৭৬।
[6]. তিরমিযী হা/২৩৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪২২৮।
[7]. মুসলিম হা/২৮৭৯।
[8]. বুখারী হা/৭৫১২।
[9]. মুসলিম হা/২২৩।