পত্রিকান্তরের হিসাব মতে সরকারীভাবে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের বাইরে সাড়ে ঊনিশ শত প্রার্থীর অন্যূন দশ হাযার কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পালাবদল শেষ হ’ল গত পহেলা অক্টোবর ২০০১ সোমবারে। সরকারী দল আওয়ামী লীগের বদলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে এখন বি.এন.পি-র নেতৃত্বাধীন চার দলীয় ঐক্যজোট। ইতিমধ্যেই দু’দল থেকে ৬০ সদস্যের বিশাল এক মন্ত্রী বহর শপথ গ্রহণ করেছেন। আরও ডজন দুয়েক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম অপেক্ষমানদের তালিকায় রয়েছে, যা সত্বর ঘোষণা করা হবে। গড়ে সরকারী জোটের প্রতি তিন জন সংসদ সদস্যের বিপরীতে একজন মন্ত্রী হচ্ছেন। ফলে পুরা প্রশাসনকেই প্রায় ব্যস্ত থাকতে হবে মন্ত্রীদের প্রটোকল দিতে ও তাদের সেবাযত্ন করতে। ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২১৫টি আসনে জোটের অকল্পনীয় বিজয়কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ বলেছেন, বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ গণরায়। কেউ বলেছেন এটা জোটগতভাবে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের সুফল। কেননা সীট কম পেলেও আওয়ামী লীগের ভোটার সংখ্যা গতবারের শতকরা ৩৭.৪৪ থেকে বেড়ে এবারে ৪১% হয়েছে। যদিও এর মধ্যে ৫০ লাখ ভুয়া ভোট যোগ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও রয়েছে ভারত থেকে আগত মৌসুমী ভোটারদের বিরাট একটি সংখ্যা। দেশী-বিদেশী সকল মহলই এবারের নির্বাচনকে সর্বাধিক সুষ্ঠু-সুন্দর ও অবাধ নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। এরপরেও বিজয়ী জোট, পরাজিত দল ও স্বতন্ত্রদের পক্ষ থেকে রয়েছে নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস ও ভোট ছিনতাইয়ের অভিযোগ। আওয়ামী নেত্রী মনের দুঃখে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ৩০০ আসনেই পুনঃ নির্বাচনের দাবী জানিয়েছেন। গতবারে আওয়ামী লীগ এরশাদ ও জামায়াতের সমর্থন পেয়েছিল। এবার না পাওয়াতেই তারা হেরেছে বলে নেত্রী মনে করেন। বিশ্লেষকগণ আওয়ামী সরকারের ভরাডুবির জন্য প্রধানতঃ পাঁচটি কারণ নির্দেশ করেছেন। (১) ব্যাপক সন্ত্রাস (২) লাগামহীন দুর্নীতি (৩) নির্লজ্জ পরিবারতন্ত্র (৪) ইসলাম ও ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহের উপরে হস্তক্ষেপ ও ইসলামপন্থীদেরকে ঢালাওভাবে মৌলবাদী ও তালেবান বলে তাচ্ছিল্যকরণ এবং (৫) উৎকট ভারতপ্রীতি। বর্তমানে ক্ষমতাসীন জোট সরকার এগুলির কোন একটির প্রতি ঝুঁকে পড়লে তাদের পরিণতিও বিগত সরকারের মত হবে, একথা মনে রেখেই সম্মুখে এগোতে হবে।
উভয় দলের নেত্রী ৫ বছর করে দেশ শাসন করেছেন। ‘শিষ’নেত্রী তাঁর শাসনামলে দেশকে বিশ্বের ৪নং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত করেছিলেন। ‘নৌকা’নেত্রী ক্ষমতায় এসে দেশকে ৪নং থেকে ১নং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে উন্নীত করলেন। মানুষ এক নম্বরের হাত থেকে বাঁচার জন্য চার নম্বরকে বেছে নিয়েছে মন্দের ভাল হিসাবে। দু’দলই ইতিপূর্বে নির্বাচনী ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। দুর্নীতি বন্ধের বদলে তা বৃদ্ধি করেছেন। কেউ কালাকানূন বাতিল করেননি। বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক ও স্বাধীন করেননি। দেশের শিক্ষা ও অর্থ ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটাননি। ইসলামের পক্ষে কোন কাজ করেননি।
বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা যে এক বিশাল ব্যয়বহুল প্রহসন এবং হত্যা, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস ও সামাজিক অশান্তি সৃষ্টির সূতিকাগার, তা বুঝতে কারু বাকী নেই। কিন্তু এটা ছাড়া নেতৃত্ব নির্বাচনের বিকল্প কোন সুন্দর পথ জনগণের সামনে এখন খোলা নেই। তাই আমরা পাশ্চাত্যের চালু করা দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন প্রথাকেই আধুনিক ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা বলে ধারণা করেছি। অথচ এটা কখনোই চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত সত্য লুকিয়ে আছে কুরআন ও হাদীছের মধ্যে। আছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রদর্শিত পথে ইমারত ও শূরাভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে। কিন্তু সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চলেছি আমরা ইহূদী-খ্রিষ্টান ও মুশরিকদের আবিষ্কৃত ও গৃহীত প্রচলিত শেরেকী গণতন্ত্রের পিচ্ছিল পথে। যেখানে সার্বভৌমত্বের মালিকানা আল্লাহর হাতে নয়, বরং জনগণের নামে নেতা-নেত্রীর হাতে। যেখানে অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত। তাই সেখানে সবধরনের আইন রচিত হয় এবং হারাম-হালাল সবকিছু নির্ণীত হয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতি-মর্যির উপরে। আল্লাহর আইনকে এখানে বান্দার ইচ্ছার গোলামে পরিণত করা হয়। এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে অবশ্যই মুমিনদের দাওয়াত ও জিহাদ-এর কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশে কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন করা হবে না বলে ওয়াদা করা হয়েছিল। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আইন করবেন সেকথা বলেননি। তাছাড়া যেসব ইসলাম বিরোধী আইন দেশে চালু রয়েছে, সেগুলো বাতিল করবেন, সেকথাও তারা বলেননি। তাহ’লে কি ধরে নেব যে, দেশে সূদভিত্তিক অর্থনীতি বহাল থাকবে? পুঁজিবাদের এই প্রধান হাতিয়ারকে উৎখাত করতে না পারলে দেশ থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কখনোই দূর হবে না, একথা ডান-বাম সকল দল স্বীকার করলেও বাস্তবে কেউ এটার উৎখাত চান না কেবল পুঁজিপতিদের স্বার্থে। যে কারণে দেশের সকল পুঁজি পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের বদলে আজকে ১৫৬ পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে। জোট সরকারকে অবশ্যই এই পুঁজি দানবদের বিরুদ্ধে আপোষহীন হতে হবে। নইলে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য বিমোচনের দাবী ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে। সেই সাথে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশাসন বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন করে দিতে হবে। সেখানে পাশ্চাত্য পদ্ধতির সংস্কার নয়, বরং ইসলামী পদ্ধতির সংস্কার আনতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে। যে শিক্ষা মানুষকে আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে দেয়, যে শিক্ষা মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন না ঘটিয়ে কেবল বস্ত্তগত উন্নয়নের পথ দেখায়, সে শিক্ষায় কেবল মানুষরূপী শয়তান তৈরী হয়। যা কখনো দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ দেয় না।
কলিকাতার আনন্দবাজারী গ্রুপ নছীহত খয়রাত করেছেন যেন দেশে ‘শরীয়তী শাসন’ কায়েম করা না হয়। অথচ এটাই বাস্তব যে, শরী‘আতী শাসনই কেবল মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মানবতার সর্বাধিক কল্যাণ করে থাকে। আমরা মনে করি স্বাধীন বাংলাদেশে এবারই প্রথম সুযোগ এসেছে সংবিধান সংশোধনের। অতএব এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর এই তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রটিকে ‘ইসলামী খেলাফত’ রাষ্ট্র ঘোষণা করুন। দেশের সকল আইনকে ইসলামী বিধানের অনুকূলে সংশোধন করুন। ইতিহাস চিরকাল আপনাদের মনে রাখবে। পরকালে আপনারা ভাল থাকবেন। ইহকালে দেশের সকল নেককার মানুষের দো‘আ পাবেন, পাবেন সকলের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। আমরা জোট সরকারের নতুন যাত্রাকে অভিনন্দন জানাই। আল্লাহ তাদেরকে সত্যিকারের জনকল্যাণের স্বার্থে কাজ করার তাওফীক দান করুন -আমীন!