
‘ধর্মীয় জঙ্গীবাদ ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা’ শীর্ষক তিনদিন ব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন গত ১১-১৩ই অক্টোবর’০৪ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ঢাকাস্থ জার্মান ও ফরাসী দূতাবাসের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ ‘বিস’ (Biiss) কর্তৃক তাদের নিজস্ব মিলনায়তনে আয়োজিত উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, জার্মানী, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ পন্ডিতগণ অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে জার্মানীর ইরফার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হ্যান্স জি কিপেনবার্গ ‘সন্ত্রাসই ইবাদত এবং ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসীদের ধর্মগ্রন্থ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। উক্ত নিবন্ধে মিঃ হ্যান্স সন্ত্রাস বলতে ‘জিহাদ’, ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী বলতে ‘মুসলিম জাতি’ এবং সন্ত্রাসীদের ধর্মগ্রন্থ বলতে মহাগ্রন্থ ‘আল-কুরআন’কে বুঝিয়েছেন। এজন্য তিনি সূরা তওবার ১ ও ৫ নং আয়াত দু’টিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেছেন। কুরআন সম্পর্কে তার পান্ডিত্য দেখানোর চেষ্টা ৭ অন্ধের হাতি দেখার গল্প মনে করিয়ে দেয়। হাতির যে অঙ্গে যে অন্ধ হাত রেখেছে, সে তাকে তেমনি কল্পনা করেছে। কেউ হাতির লেজ ধরে বলেছে হাতি লাঠির মত, কেউ শুঁড় ধরে বলেছে হাতি পাইপের মত, কেউ হাতির পা ধরে বলেছে, হাতি বিল্ডিংয়ের খাম্বার মত। কেউ হাতির কান ধরে বলেছে, হাতি পাখার মত। আসলে ৭ অন্ধের কেউই পূর্ণাঙ্গ হাতি দেখেনি। হ্যান্স জাতীয় পন্ডিতদের অবস্থা ঐ সাত অন্ধের হাতি দেখার মত। যে রাসূলকে আল্লাহ পাক ‘বিশ্ববাসীর জন্য রহমত’ (আম্বিয়া ১০৭) বলেছেন, এরা তাঁকে ‘যুদ্ধবাজ’ (War Lord) বলছে। কারণ হোদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী ১০ বছরের ‘যুদ্ধ বিরতি চুক্তি’ লংঘন করে দেড় বছরের মাথায় যখন মুশরিকরা মুসলিম মিত্র বনু খোযা‘আ গোত্রের উপরে হামলা করল, তখনই তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয় সূরা তওবা ১নং আয়াতের মাধ্যমে। চুক্তি ভঙ্গকারী ছিল সেদিন কাফির পক্ষ। অপরাধী মক্কার মুশরিকদের উসকানীদাতা মদীনার ইহূদী-নাছারারা এতে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তারা মুসলমানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ও গোপনে ষড়যন্ত্রে মেতে আছে। বর্তমানে তারা একক পরাশক্তি হওয়ার আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে মুসলিম শক্তিগুলিকে একে একে ধ্বংস করার অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেরা ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের তথা নাইন ইলেভেন-এর ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে উল্টা উসামা বিন লাদেন জুজুর নামে মুসলমানদের উপর দোষ চাপিয়ে প্রথমে আফগানিস্তান ও পরে গণবিধ্বংসী অস্ত্র উদ্ধারের নামে ইরাক দখল করে নিল। সেখানে তারা দৈনিক রক্ত ঝরাচ্ছে। সেদেশের সবকিছু একে একে ধ্বংস করে চলেছে। একই ধারায় সিরিয়া, ইরান ও সঊদী আরবের দিকে তারা এখন নিশানা তাক করেছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদূদ আহমাদকে ধন্যবাদ যে, তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের কোন অস্তিত্ব নেই’। জঙ্গীবাদের মূল উৎস রাজনৈতিক নিপীড়ন, দারিদ্র্য, শোষণ ও বঞ্চনা’। নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক নিপীড়ন, দারিদ্র্য ও শোষণ-বঞ্চনার মূল নায়ক হ’ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসর বহুজাতিক সূদী কোম্পানীগুলো। জার্মানী, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সবাই আজ মার্কিনীদের তাবেদার। তারাই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে বিশ্বব্যাপী দলাদলি, হানাহানি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে।
পক্ষান্তরে ইসলামের আহবান সর্বদা মানব কল্যাণের দিকে। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কারু উপরে যবরদস্তি করা ইসলামে নিষিদ্ধ’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। ইসলাম মানুষকে মানুষের গোলামী হ’তে মুক্ত করে আল্লাহর গোলামীর দিকে আহবান জানিয়েছে। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘কোন আরবের উপরে অনারবের, অনারবের উপরে আরবের, লালের উপরে কালোর, কালোর উপরে লালের কোন প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত। তোমরা সবাই এক আদমের সন্তান এবং আদম ছিলেন মাটির তৈরী’ (আহমাদ হা/২৩৫৩৬, সনদ ছহীহ)। রাসূল (ছাঃ) কেবল ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি বাস্তবে দেখিয়ে গিয়েছেন। তাইতো দেখি তাঁর পার্শ্বে থাকতেন যেমন কুরায়েশ নেতা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)। তেমনি থাকতেন আফ্রিকার নিগ্রো কৃষ্ণকায় গোলাম বেলাল। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর কা‘বার ছাদে উঠে প্রথম আযান দেওয়ার উচ্চ মর্যাদা তিনি বেলালকে দান করেছিলেন। যা দেখে আভিজাত্যগর্বী কুরায়েশ নেতারা বলেছিলেন, ‘এ দৃশ্য দেখার আগে আমাদের মরণ ভাল ছিল’। মৃত্যুর দু’দিন পূর্বে গোলামের পুত্র গোলাম উসামা বিন যায়েদকে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন তিনি। ওমরের জানাযা পড়ালেন ক্রীতদাস ছোহায়েব রূমী। ইসলাম মানুষের মেধা, যোগ্যতা, সততা ও সর্বোপরি আল্লাহভীরুতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যা তাকে সত্যিকারের মানুষের মর্যাদায় আসীন করে। আর এখানেই সার্বজনীন ধর্ম ইসলামের বিশ্বজয়ের গোপন রহস্য নিহিত। মূলতঃ এটাই হ’ল ইসলামের প্রকৃত দাওয়াত।
ইসলাম তার অনুসারীদেরকে কোন অবস্থায় অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত করতে শিখায়নি। আল্লাহ প্রেরিত সত্যকেই ইসলাম চূড়ান্ত সত্য বলেছে। এর বিপরীতে মানবরচিত কোন বিধানকে ইসলাম কোনই তোয়াক্কা করেনি। কারণ আল্লাহর গোলামীর মধ্যেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা নিহিত এবং মানুষের গোলামীর মধ্যে রয়েছে মানবতার প্রকৃত পরাজয়। ইসলামের এই দাওয়াতে কেউ বাধার সৃষ্টি করলে সেখানে পৃষ্ঠ প্রদর্শন কিংবা বাতিলের সঙ্গে আপোষ করতে বলা হয়নি, বরং বুক পেতে দিয়ে সার্বিক প্রচেষ্টায় সম্মুখে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আর একেই বলা হয় ‘জিহাদ’। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[1] ইসলামে জিহাদ হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য নয়। এই জিহাদ হ’ল আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য, যালিমের বিরুদ্ধে মযলূমের অধিকার কায়েমের জন্য। আর এখানেই যালেমদের যত ভয়। বিশ্বের তাবৎ যালেম ও শোষকগোষ্ঠী আজ এক হয়েছে মানবতার মুক্তি সনদ ইসলামের বিরুদ্ধে এ কারণেই।
পক্ষান্তরে ৬০ লাখ ইহূদীকে হত্যাকারী মানবতার শত্রু জার্মান নেতা এডলফ হিটলার, নাগাসাকি-হিরোশিমাতে এটমবোমা মেরে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যাকারী মার্কিন ও মিত্রবাহিনীর নেতারা এবং আজকের আফগানিস্তান ও ইরাকে হাযার হাযার বনু আদমকে হত্যাকারী নেতারা কি খ্রিষ্টান জঙ্গীবাদী নন? আফগানিস্তানের উপরে হামলাকারী রাশিয়াকে হটানোর জন্য এবং দেশের স্বাধীনতা ও ইসলামকে রক্ষার জন্য তালেবানের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাদেরকে আমরা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলব। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য মার্কিনীরাই তখন ‘বিন লাদেন’-কে কাজে লাগিয়েছিল। প্রয়োজন শেষে ‘বিন লাদেন’ এখন সন্ত্রাসী হয়ে গেল। আর নিজেরা হয়ে গেলেন সাধু ও মানবাধিকারবাদী?
‘বিস’ নেতারা তাদের সেমিনারের যে শিরোনাম নির্ধারণ করেছেন ও নির্ধারিত বিষয়বস্ত্ত দিয়ে বক্তা আমদানী করেছেন, তাতে তাদের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়। তারাই যে মূলতঃ ধর্মনিরপেক্ষতার ‘বিষ’ গিলেছেন এবং নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে পন্ডিত নামধারী কিছু চিহ্নিত লোককে আমদানী করে তাদের মুখ দিয়ে নিজেদের কথাগুলো বলিয়ে নিয়েছেন এটা পরিষ্কার। তা না হলে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে গালি দিয়ে ইহূদী হ্যান্স নির্বিবাদে বহাল তবিয়তে ঢাকা ত্যাগ করতে পারত না। ‘বিস’ নেতাদের বলছি, আপনারা এবারে দিল্লীতে অনুরূপ একটা সম্মেলন করে হিন্দু ও হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে গালি দেওয়ানোর ব্যবস্থা করুন। দেখব কেমন ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অনুসারী আপনারা। মনে রাখুন, জিহাদ ও জঙ্গীবাদ এক নয়। জিহাদ হয় স্রেফ আল্লাহর জন্য। পক্ষান্তরে জঙ্গীবাদ হ’ল দুনিয়ার জন্য। তাই পৃথিবীর যে প্রান্তে মুসলমানেরা তাদের দ্বীন, ঈমান ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, সবই জিহাদ, যদি তা স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়। মূলতঃ মানবতার মুক্তির একটাই পথ, দাওয়াত ও জিহাদ। আর এটাই ছিল নবীদের তরীকা।
আজকের বিশ্বে সর্বত্র শোষণ, নির্যাতন ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মূলে রয়েছে শোসকগোষ্ঠী ইঙ্গ-মার্কিন দুষ্টচক্র ও তাদের দোসররা। ইসলামের উত্থান তাদের বাধাহীন শোষণের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক। তাই তারা একে সর্বত্র ভয়ের চোখে দেখছে। অন্ধকারে ভূত দেখে অাঁতকে ওঠার ন্যায় তারা এখন সর্বত্র মুসলিম জঙ্গী দেখছে। মূলতঃ ইসলামের অস্ত্র লুকিয়ে আছে তার বিশ্বজয়ী আদর্শের মধ্যে। বোমা মেরে সেটাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। তাই হ্যান্সদের বলব, ইসলাম কবুল কর। ইহকাল ও পরকালের শান্তি এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তুমি ইসলামকে হেফাযত কর- আমীন![2]
[1]. আবুদাঊদ হা/২৫০৪; আহমাদ হা/১২২৬৮; মিশকাত হা/৩৮২১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[2]. ৮ম বর্ষ ২য় সংখ্যা নভেম্বর ২০০৪।