ইসলামের প্রথম যুগে সৃষ্ট বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ ও ফের্কাবন্দীর বিরুদ্ধে ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযামের মাধ্যমে আহলেহাদীছ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মূলতঃ ৩য় খলীফা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করেই উম্মত বিভক্ত হয়। তাদের মধ্যকার রাজনৈতিক বিভক্তি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব জন্ম দেয় উছূলী বিতর্কের ও ফিক্বহী মতপার্থক্যের। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন মাযহাবী নামে স্থায়ী সামাজিক রূপ ধারণ করে আজও বেঁচে আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে ৭২ ফের্কাই জাহান্নামে যাবে একটি ফের্কা ব্যতীত। তারা হ’ল ঐ সকল ব্যক্তি, যারা আমার ও আমার ছাহাবীগণের আজকের দিনে অনুসৃত নীতি ও আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।[1] তাবেঈ বিদ্বান ইবনুল মুবারক বলেন, প্রথমেই সৃষ্ট চারটি ভ্রান্ত ফের্কা থেকে ৭২টি ফের্কার সূচনা হয়েছে। সেগুলি হ’ল : (১) খারেজী : কিতাবুল্লাহকে বাদ দিয়ে তৃতীয় পক্ষকে শালিশ মানার কারণে তাদের মতে আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়ে কাফির। কবীরা গোনাহগার তাদের নিকটে মুসলমান কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের রক্ত হালাল। তারা বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও কর্ম তিনটিকেই ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। ফলে (২) শী‘আ : আলীই একমাত্র আইনসম্মত খলীফা। পূর্বের তিন খলীফাই ছিলেন যালিম ও কাফির। বরং মিক্বদাদ, আবু যর গিফারী ও সালমান ফারেসী ব্যতীত বাকী সকল ছাহাবী কাফির (৩) মুর্জিয়া : আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়ে মুমিন। কবীরা গোনাহগার ব্যক্তির আমলের হিসাব ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রলম্বিত থাকবে। আমল ঈমানের অংশ নয় এবং আমল ঈমানের উপরে কোন প্রভাব ফেলে না। ঈমানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। অতএব আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমান ও অন্যদের ঈমান সমান। এরা ‘শৈথিল্যবাদী’ নামে পরিচিত। (৪) ক্বাদারিয়া : তাক্বদীর অস্বীকারকারী এই দলের মতে তাক্বদীর বলে কিছু নেই। মানুষ নিজেই তার অদৃষ্টের স্রষ্টা।

বলা বাহুল্য বাংলাদেশে উপরোক্ত ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ কমবেশী চালু রয়েছে। তন্মধ্যে শৈথিল্যবাদী মুর্জিয়া আক্বীদার লোক, যারা লাগামহীনভাবে গোনাহ করে ও ভাবে যে, আমাদের ঈমান ঠিক আছে, আমরা জান্নাত পাব, এই দলের লোক সংখ্যা বেশী। সেই সাথে চরমপন্থী খারেজী আক্বীদার লোক যারা কবীরা গোনাহগার মুসলমানদের কাফির বলে ও তাদের রক্ত হালাল মনে করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করাকে প্রকৃত জিহাদ মনে করে- এদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩৭ হিজরী থেকে শুরু হওয়া আক্বীদা ভাঙ্গনের এই স্রোত প্রতিরোধের জন্য ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযাম সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরা ঈমানের সঠিক ব্যাখ্যা এবং ঈমান ও আমলের পারস্পরিক সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেন। তাঁদের ব্যাখ্যার সার-সংক্ষেপ হ’ল নিম্নরূপ :

হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম হ’ল ঈমান, যা সৎকর্মে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও গোনাহে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বাস ও স্বীকৃতিই হ’ল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা। কোন কবীরা গোনাহগার মুমিন ঈমান হ’তে খারিজ নয়। সে তওবা না করে মারা গেলেও স্থায়ীভাবে জাহান্নামী নয়। গোনাহের কারণে ঐ ব্যক্তি পাপী বা ‘ফাসিক্ব’ হ’লেও ঈমানহীন কাফির নয়। তারা বলেন, চার খলীফা নিঃসন্দেহে মুমিন ও উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয নয়; বরং তাদের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে। ভাল-মন্দ প্রত্যেক মুসলমানের পিছনে ছালাত আদায় করা জায়েয। তারা বলেন, মানুষের ভাল-মন্দ ভাগ্যলিপি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। তবে যেহেতু মানুষ তা জানে না, সেহেতু তাকে তাক্বদীরে বিশ্বাস রেখে সঠিক পথে তাদবীর করে যেতে হবে। তাদের এই ছহীহ আক্বীদা প্রচারের ফলে খারেজী ও শী‘আদের চরমপন্থী আক্বীদার হামলা থেকে যেমন মানুষ রেহাই পায়, তেমনি মুর্জিয়াদের শৈথিল্যবাদী ঈমান-এর স্বেচ্ছাচারিতা হ’তে মানুষ সতর্ক হয়। অনুরূপভাবে ক্বাদারিয়াদের ভুল ব্যাখ্যার ফলে জীবনে চলার পথে ব্যর্থতার গ্লানিতে হতাশাগ্রস্ত মানুষ আত্মহত্যার পথ ছেড়ে পুনরায় নতুনভাবে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

এভাবে বিদ‘আতী আলেমদের থেকে উক্ত ছহীহ আক্বীদার অনুসারীদের নামীয় ও দলীয় স্বাতন্ত্র্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। ইতিহাসে এঁরাই আহলুল হাদীছ, আহলুস সুন্নাহ, আহলুল আছার, আহলুল হক ইত্যাদি নামে পরিচিত। তবে ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ও তাবেঈ বিদ্বান ইমাম শা‘বী প্রমুখের বর্ণনা অনুযায়ী ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ও তাঁদের উত্তরসুরীদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। এই নামকরণের মাধ্যমে একটি বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, মুসলমানদের জন্য মূল অনুসরণীয় হ’ল কুরআন ও হাদীছ, অন্য কিছু নয়। ছাহাবায়ে কেরামের পরে যুগে যুগে যারা তাঁদেরই বুঝ অনুযায়ী কুরআন-হাদীছ বুঝবেন ও স্ব স্ব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ গড়ে তুলতে সদা সচেষ্ট থাকবেন, কেবল তাঁরাই হবেন ‘আহলেহাদীছ’ এবং জাহান্নাম হ’তে মুক্তিপ্রাপ্ত দল। এখানে রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও দুনিয়াবী পদমর্যাদার কোন মূল্য নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক আহলেহাদীছের বসবাস। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। কিন্তু এই বিশাল সম্ভাবনাময় মানবসম্পদকে আমরা দেশে তাওহীদ ও সুন্নাহর পক্ষে সত্যিকারের জনশক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে পেরেছি কি? নিশ্চিতভাবেই পারিনি। ফলে আহলেহাদীছ-এর অনেকে এখন নির্দ্বিধায় বস্ত্তবাদী আন্দোলন করেন। এমনকি ইসলামের নামে শিরকী ও বিদ‘আতী দলসমূহে যোগ দিতেও দ্বিধা করেন না। এই দুঃখজনক পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরতর পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা দাওয়াত-এর চাইতে যেন দলাদলিকেই বেশী প্রাধান্য দিচ্ছি। এদেশের রাজনৈতিক ময়দান যেমন পরলোকগত নেতার ইমেজকে পুঁজি করে চলছে, বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকা যেভাবে ব্যক্তির চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, আহলেহাদীছ আন্দোলন নিঃসন্দেহে তার বিপরীত। এখানে ছহীহ আক্বীদা ও আমলের প্রচার ও প্রসার এবং সমাজ জীবনে তার বাস্তবায়ন প্রচেষ্টাই হ’ল মূল বিষয়। লক্ষ্য থাকে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু আমরা কি সে লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছি?

এক্ষণে আমাদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, আমরা আন্দোলনের জন্য সংগঠন করব, নাকি সংগঠনের জন্য আন্দোলন করব? যদি সিদ্ধান্ত দ্বিতীয়টি হয়, তবে সেটা হবে স্রেফ ফের্কা মাত্র। আমরা মনে করি ফের্কা নয়, আন্দোলনই মুখ্য। আমরা আহলেহাদীছকে একটি আপোষহীন জিহাদী আন্দোলন বলে বিশ্বাস করি। শিরক ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটনে এবং সঠিক ইসলামের পথপ্রদর্শনে ছাহাবায়ে কেরামের রেখে যাওয়া এই পবিত্র আন্দোলনকেই আমরা আমাদের পরকালীন মুক্তির অসীলা হিসাবে বেছে নিয়েছি। এই লক্ষ্যে যারা একমত হবেন, আমরা তাঁদেরকে স্বাগত জানাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![2]


[1]. তিরমিযী হা/২৬৪১, সনদ হাসান; হাকেম হা/৪৪৪।

[2]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০০৩।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
বিব্রত সরকার বিব্রত দেশবাসী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শিশু আয়লানের আহবান : বিশ্বনেতারা সাবধান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শাসন ও অনুশাসন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পুঁজিবাদের চূড়ায় ধ্বস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চাই লক্ষ্য নির্ধারণ ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামের বিজয় অপ্রতিরোধ্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কারা সংস্কারে আমাদের প্রস্তাব সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উপযেলা নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কবিতা
আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.