১৪. স্বামী-স্ত্রীর হকের ব্যপারে অজ্ঞতা : সমাজে তালাকের ব্যাপকতার আরেকটি কারণ হ’ল স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক হক সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অবহেলা। আর একে অপরের হক পালন না করার কারণে দু’জনের মাঝে দূরত্ব তৈরী হয়। যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। স্বামীর হক সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ، ‘পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক। এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যকে প্রাধান্য দান করেছেন এবং এজন্য যে, তারা (নারীদের ভরণ-পোষণের জন্য) তাদের মাল-সম্পদ হ’তে ব্যয় করে থাকে’ (নিসা ৪/৩৪)।
স্ত্রীর হক সম্পর্কেও হাদীছে বিস্তর আলোচনা এসেছে। যেমন হাকীম ইবনু মু‘আবিয়া (রহঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! مَا حَقُّ زَوْجَةِ أَحَدِنَا عَلَيْهِ قَالَ أَنْ تُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمْتَ وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ، أَوِ اكْتَسَبْتَ، وَلاَ تَضْرِبِ الْوَجْهَ وَلاَ تُقَبِّحْ وَلاَ تَهْجُرْ إِلاَّ فِي الْبَيْتِ- ‘স্বামীদের উপর স্ত্রীদের কি হক? তিনি বলেন, যা সে খাবে তাকেও খাওয়াবে, আর সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে। আর তার (স্ত্রী) চেহারায় মারবে না এবং তাকে গালি দিবে না। আর তাকে ঘর হ’তে বের করে দিবে না’।[1]
এই বাণী ভুলে গিয়ে অনেক স্ত্রী স্বামীর উপর কর্তৃত্ব চালাতে চায়। আবার কখনো কখনো স্বামী স্বীয় স্ত্রীকে কোন মর্যাদাই দিতে চায় না। আবার স্ত্রীর ভালোর দিক লক্ষ্য না করে খারাপ দিক প্রাধান্য দেয় অথবা তুলনামূলকভাবে অধিক শাসন করে। যা কোন স্বামীর জন্য উচিৎ নয়।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,اسْتَوْصُوا بالنِِّسَاءِ خَيْراً؛ فَإِنَّ المَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلعٍ، وَإنَّ أعْوَجَ مَا في الضِّلَعِ أعْلاهُ، فَإنْ ذَهَبتَ تُقيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإنْ تَرَكْتَهُ، لَمْ يَزَلْ أعْوجَ، فَاسْتَوصُوا بالنِّساءِ، ‘তোমরা স্ত্রীদের জন্য মঙ্গলকামী হও। কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বাঁকা হ’ল তার উপরের অংশ। যদি তুমি এটাকে সোজা করতে চাও, তাহ’লে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহ’লে তো বাঁকাই থাকবে। তাই তোমরা নারীদের জন্য মঙ্গলকামী হও’।[2] অন্য বর্ণনায় আছে,إنَّ المَرأةَ خُلِقَت مِنْ ضِلَع، لَنْ تَسْتَقِيمَ لَكَ عَلَى طَريقة، فإن اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَفيهَا عوَجٌ، وإنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهَا كَسَرْتَها، وَكَسْرُهَا طَلاَقُهَا، ‘মহিলাকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে কখনোই একভাবে তোমার জন্য সোজা থাকবে না। অতএব তুমি যদি তার থেকে উপকৃত হ’তে চাও, তাহ’লে তার এ বাঁকা অবস্থাতেই হ’তে হবে। আর যদি তুমি তা সোজা করতে চাও, তাহ’লে তা ভেঙ্গে ফেলবে। আর তাকে ভেঙ্গে ফেলা হ’ল তালাক দেওয়া’।[3]
ধর্মীয় জ্ঞান না থাকায় স্বামী স্ত্রীর উপরে বেশী কর্তৃত্ব দেখায়, কোন ভুলের ছাড় দিতে চায় না। বন্ধ করে দেয় ক্ষমার দরজা। ফলে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি তালাকের দিকে গড়ায়।
১৫. মা-বোন অথবা অন্য কারো কুপরামর্শে প্রভাবিত হওয়া : আমাদের দেশের কিছু নারীর বদ অভ্যাস হ’ল অন্যকে কুপরামর্শ দেওয়া। সেই কুপরামর্শ অনেক পুরুষ গ্রহণ করে না। ফলে তাদের মাঝে অনৈক্য দেখা দেয়। অথবা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুসরণে আলাদা থাকার নীতি গ্রহণ করে। যৌথ পরিবার থেকে পরিত্রাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে স্ত্রী। অবশেষে পরিবারের পরিসমাপ্তি ঘটে ডিভোর্স অথবা তালাকের মাধ্যমে।
১৬. কুফূ বা সমতা সম্পর্কে অজ্ঞতা : বিবাহে কুফূর গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের মাঝে বংশ মর্যাদার তারতম্য রয়েছে। বংশের অহংকারে ভিন্ন পরিবারের সদস্যদের ছোট করে দেখার স্বভাব রয়েছে অনেকের মাঝে। অপরদিকে ধনী-গরীব ব্যবধান সর্বত্রই বিরাজমান। এমন বিপরীতমুখী দম্পতির মাঝে ফাঁটল ধরে অনেক ক্ষেত্রে। এজন্য সমতার প্রতি লক্ষ্য রাখা যরূরী। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَخَيَّرُوا لِنُطَفِكُمْ وَانْكِحُوا الْأَكْفَاءَ وَأَنْكِحُوا إِلَيْهِمْ ‘তোমরা ভবিষ্যত বংশধরদের স্বার্থে উত্তম মহিলা গ্রহণ করো এবং সমতা (কুফূ) বিবচেনায় বিবাহ করো, আর বিবাহ দিতেও সমতার প্রতি লক্ষ্য রাখো’।[4] তাই কুফূবিহীন বিবাহও অনেকাংশে ডিভোর্স বা তালাকের জন্য দায়ী।
১৭. বিয়ের পর পড়াশুনা ও চাকুরী : অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিয়ের সময় স্বামী অথবা স্ত্রীর যে পরিমাণ পড়াশোনা থাকে বিয়ের পর পড়াশোনা করে তাদের কেউ বেশী এগিয়ে যায়। আবার বিয়ের সময় যে যে স্তরের চাকুরী ছিল পরবর্তীতে তার চেয়ে বড় চাকুরী পেয়ে যায়। এতে দু’জনের যে কোন একজন অহংকারী হয়ে পড়ে। ফলে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। অথবা ছাত্র জীবনে অবৈধ সম্পর্ক করতে গিয়ে বিয়েতে জড়িয়ে পড়ে। হুঁশ ফিরে আসলে পড়াশুনা করে বড় হওয়ার আশায় সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়। নতুন স্বপ্ন পূরণের আশায় পাড়ি জমায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে।
১৮. প্রতারণার শিকার : বর্তমান সময়ে সরলমনা অনেক নারী প্রতারণার শিকার হয়। চাকুরীর সুবাদে নিজ যেলা ছেড়ে পাড়ি জমায় জনবহুল এলাকায়। মিলিত হয় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে। নারীর সরলতার সুযোগে কোন পুরুষ প্রলোভন দেখিয়ে টেনে নেয় নিজের দিকে। প্রেমের প্রস্তাবে রাযী হয়ে অবশেষে বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন শুরু করে। কিন্তু ছেলের মোহ যখন কেটে যায়, তখন শুরু করে নির্যাতন। বাধ্য হয়ে স্ত্রী ডিভোর্সের পথ বেছে নেয়।
১৯. রাষ্ট্রীয় বিধানে তালাক সহজীকরণ : ধর্মীয় বিধানে তিন মাসে পবিত্র অবস্থায় তিন তালাকের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায়। আল্লাহ বলেন,الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ ‘তালাক (রাজঈ) হ’ল দু’বার। অতঃপর হয় তাকে ন্যায়ানুগভাবে রেখে দিবে, নয় সদাচরণের সাথে পরিত্যাগ করবে’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিধানে কোর্টের মাধ্যমে এক বৈঠকে তিন তালাক কার্যকর হওয়ায় সহজে তালাক সংঘটিত হচ্ছে। অথবা মাযহাবী ফৎওয়ায় এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন তালাক কার্যকর করায় সহজে কেউ রাগের বশবর্তী হয়ে তিনবার তালাক বলে স্ত্রীকে বিদায় করে দেয়। এ বিধান তালাকের পথকে সুগম করেছে।
২০. পরকীয়া : সমাজে ইসলামী পর্দা না থাকার কারণে নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায়। এতে কোন কোন সময় পরনারী বা পরপুরুষে আসক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যা এক সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটায়।
এছাড়া বিবাহিত পুরুষদের অনেকে দীর্ঘদিন স্ত্রীকে একসঙ্গে থাকার দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেকে বছরের পর বছর দূর প্রবাসে জীবন কাটিয়ে দেয়। অনেক নারীই পারিবারিক নানা কারণে স্বামীকে ফিরে আসার দাবী করতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী কাছে না থাকায় অন্য পুরুষের প্ররোচনায় কিংবা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে দেখা দেয় তালাক বা ডিভোর্সের প্রয়োজনীয়তা।
২১. জৈবিক চাহিদায় অক্ষমতা : স্বামী অথবা স্ত্রীর মধ্যে যে কোন একজনের স্নায়ুবিক দুর্বলতার কারণে অপরজন তালাক বা ডিভোর্সের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। অক্ষম স্বামীর ঘর করতে চায় না স্ত্রী অথবা স্ত্রী স্বামীর চাহিদা মিটানোর মত উপযুক্ত না হ’লে তাকে নিয়ে ঘর করতে চায় না স্বামী। ফলে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
২২. ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধের অভাব : ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি ব্যাপক। বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবনদর্শন, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা- এসব ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এসবের ঘাটতির কারণে সম্পর্কের অবনতি হয়। তাছাড়া ইসলামী পর্দা রক্ষা করা এবং পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে অবাধ মেলামেশা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত, যা পালন না করা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এসব কারণে পারস্পরিক বিশ্বাসে ঘাটতি হয়। যা এক সময় বিচ্ছেদের পর্যায়ে গড়ায়।
২৩. তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব : তথ্য প্রযুক্তির কারণে বর্তমানে ঘরে বসে বহির্বিশ্বের সংবাদ ও সাংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ফলে দেশের অনুকরণপ্রিয় মানুষ বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ করে। তাদের মত খোলামেলা চলতে ও তাদের মত পোষাক পরিধান করতে চায়। আচার-আচরণে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে। ফলে এসব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরী করে। তাছাড়া পুরুষ-নারী বিদেশী চ্যানেল ও বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল দেখে সাংস্কৃতিক দিক থেকেও প্রভাবিত হচ্ছে। এসব কারণেও সংসার ভাঙছে।
২৪. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম : বর্তমানে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে দূর দেশের নারী-পুরুষের মাঝে যোগাযোগ ও পরিচয় হচ্ছে। প্রথমে পরিচয় থেকে আলাপচারিতা, অতঃপর তা মন দেয়া-নেয়ার পর্যায়ে গড়ায়। ফলে এক সময় সে নিজের আপনজন ছেড়ে নতুন সঙ্গীর সান্নিধ্য পেতে সেখানে পাড়ি জমায়। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়, ভাঙ্গে পরিবার-সংসার।
২৫. আদর্শিক ভিন্নতা : আমাদের দেশে নানা আদর্শ-বিশ্বাসের মানুষ আছে। কেউ মাযহাবী, কেউ আহলেহাদীছ, কেউবা ছূফী, কেউ অন্য কোন বিশ্বাসের। এই ভিন্ন বিশ্বাসের পুরুষ-নারীর মাঝে বিবাহ হ’লে অনেক ক্ষেত্রে একে অপরকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারে না। নতুন আক্বীদা-আমলের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর ভিন্ন বিশ্বাস ও আমলকে মেনে নেয় না। আবার স্ত্রীও হক ছেড়ে বাতিল গ্রহণ করতে রাযী হয় না। ফলে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
২৬. উচ্চাভিলাষ : অনেকে ধনী প্রতিবেশী বা পার্শ্ববর্তী সচ্ছলদের অবস্থা দেখে নিজেও তাদের মত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাদের মত অভিজাত চাল-চলন ও দামী পোষাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার ও গাড়ী-বাড়ির আকাঙ্ক্ষা করে। ফলে নারী সেটা না পেলে স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। অনেক সময় স্বামী পরের দামী গাড়ী, ভাল ব্যবসা বা চাকুরীর জন্য শশুর বাড়ী থেকে টাকা আনার জন্য স্ত্রীকে চাপ প্রয়োগ করে। এসব নিয়ে মনোমালিন্য থেকে দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদের রূপ পরিগ্রহ করে।
২৭. রূঢ় আচরণ ও বদমেজায : স্বামী-স্ত্রী দু’জনের প্রচেষ্টায় ও উভয়ের সুন্দর আচার-ব্যবহারে দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠে মধুময়, সংসার হয় শান্তি-সুখের আলয়। কিন্তু যে কোন একজনের রূঢ় আচরণ বা বদমেজায সুখের নীড়কে তছনছ করে দিতে পারে। তাই উভয়ের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার সম্পর্ক তৈরী করার চেষ্টা করা যরূরী। কিন্তু কোন একজন বা দু’জনই ভিন্ন আচরণের হ’লে দিনে দিনে আরো বেশী দূরত্ব তৈরী হয়। ভিতরের চাপা ক্ষোভ এক সময় বিষ্ফোরিত হয়ে বিচ্ছেদ আবশ্যিক হয়ে পড়ে।
তালাকের অশুভ পরিণতি :
১. সন্তানের দূরাবস্থা : পিতা-মাতার বিচ্ছিন্নতা সন্তানের জন্য দুর্বিসহ যন্ত্রণা বয়ে আনে। হয় পিতার সাথে, না হয় মায়ের সাথে থাকতে হয় সন্তানদের। এতে পিতার স্নেহ থেকে অথবা মাতার আদর-যত্ন ও লালন-পালন থেকে বঞ্চিত হয়। আবার পিতা-মাতাও নতুন সংসারের ব্যবস্থা করে। সেক্ষেত্রে অনেক সন্তান মযলূম বা অত্যাচারিত হয় সৎ পিতা অথবা সৎ মাতার দ্বারা। অথবা উভয় পক্ষ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভোগ করে দুর্বিসহ জীবন। এতে তারা পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে যায়। এভাবে মাতা-পিতার তালাক জনিত কারণে বিচ্ছিন্ন সন্তান একসময় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। জায়গা করে নেয় পথশিশুর কাতারে অথবা নেশাখোরের আস্তানায়। সারকথা হ’ল পিতা-মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সন্তানদের দুর্ভোগ, কষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক অশান্তি সীমাহীন। ফলে এসব শিশু দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
২. অসুখী দম্পতি : তালাক বা ডিভোর্সের কারণে এমন পরিবারকে কেউ ভাল চোখে দেখে না। এমনকি ঐ দম্পতি অসংলগ্ন হয়ে থাকে। চাল-চলন হয়ে থাকে অস্বাভাবিক, যা মানুষ সাধারণত আশা করে না। স্ত্রীকে হারিয়ে স্বামী অথবা স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী পূর্বের সংসারের কথা স্মরণ করে পাগলপারা হয়ে পড়ে। অশান্তিতে কাটে তাদের জীবন।
৩. পিতামাতা বা অভিভাবকের কষ্ট : তালাকের কারণে স্বামী বা স্ত্রীর পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হন। তালাক দাতা বা তালাকপ্রাপ্তা কাউকে সমাজ ভাল চোখে দেখে না। তাদের কারণে পরিবারের সদস্যরা বিশেষত পিতা-মাতা বা অভিভাবক সমাজে অসম্মানিত হয়। আবার তাদেরকে নতুনভাবে বিবাহ দিতে পিতা-মাতা বা অভিভাবককে পড়তে হয় দুশ্চিন্তায়, শিকার হন বিড়ম্বনার। তাই তালাক বা ডিভোর্স কারো জন্য সুখকর হয় না।
প্রতিকার :
তালাক থেকে পরিত্রাণের জন্য নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।-
১. উত্তম আদর্শ বাস্তবায়ন : মহান আল্লাহ বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)।
রাসূলের আদর্শে জীবন গড়ে পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়ন বা স্থায়ী করা সম্ভব। তিনি তাঁর একাধিক স্ত্রীর সাথে কি ধরনের আচরণ করতেন তা জেনে সে মোতাবেক কাজ করতে হবে। তিনি স্ত্রীদের খাবার প্রস্ত্তত করতে সহযোগিতা করতেন। তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন। এতে বুঝা যায় স্ত্রীকে নিয়ে বৈধ আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করে স্ত্রীকে আনন্দিত করতে হবে। স্ত্রীদের নিয়ে কৌতুকের বা মজাদার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। অন্যায় অপরাধ দেখলে ধৈর্যের সাথে ঠান্ডা মাথায় প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। একাধিক স্ত্রীর মাঝে ভুল সংশোধনে নম্রতার আশ্রয় নিতে হবে। আন্তরিকতার সাথে সমাধান করতে হবে। পারিবারিক কাজ-কর্মে স্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে সম্পাদন করতে হবে। এক্ষেত্রে কখনো কখনো স্ত্রীদের পরামর্শ প্রাধান্য দিতে হয়। স্ত্রীদের যথোপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করলে কখনো মনোমালিন্য সৃষ্টি হবে না। বরং আন্তরিকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। অনেকেই স্ত্রীদের পরামর্শ প্রহণ করে না, এটা উচিৎ নয়। রাসূল (ছাঃ) কখনো খাবারের ভুল ধরতেন না। খাবার উপযুক্ত হ’লে খেতেন অন্যথা বিরত থাকতেন। এমনিভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সহনশীল মনোভাব দেখালে সম্পর্কের উন্নতি হয়।
২. নারীর বৈধ অধিকার প্রদান : ইসলাম নারীকে তার ইয্যত রক্ষায় ও দাম্পত্য জীবনের শান্তি ধরে রাখতে বৈধভাবে জীবন পরিচালনার অধিকার দিয়েছে। সুতরাং স্ত্রীকে তার অধিকার প্রদান করলে সংসার সুখের হবে।
৩. স্নায়ুবিক দুর্বলতা বা শারীরিক অক্ষমতায় করণীয় : যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হয় কিংবা যৌন দুর্বলতার কারণে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হয় তাহ’লে স্ত্রী তার স্বামীকে এক বছর পর্যন্ত চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দিবে। যদি চিকিৎসার পরেও স্বামীর অবস্থার পরিবর্তন না হয় এবং নারী যদি ধৈর্যধারণ করতে না পারে তাহ’লে সে তার স্বামী বা পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে খোলা করতে পারে। তবে যেসব স্ত্রী কারণ ছাড়াই স্বামীর কাছে তালাক চায় হাদীছে তাদের ব্যাপারে কঠোর পরিণতির কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যদি কোন নারী (স্ত্রী) অহেতুক তার স্বামীর কাছে তালাক চায় তবে তার জন্য জান্নাতের সুগন্ধিও হারাম হয়ে যায়’।[5]
৪. চলাচলে সতর্কতা : অবাধ, উচ্ছৃঙ্খল ও অশালীন চলাফেরা পরিত্যাগ করতে হবে। প্রয়োজন ব্যতীত ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। কর্মক্ষেত্রের নামে যৌথ কর্মসংস্থান পরিহার করা অত্যন্ত যরূরী।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন বা দুর্বলতার সমাধানে নিমেণ বর্ণিত কিছু পরামর্শ-
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ব্যবহার শালীন হ’তে হবে। দু’জনকে ধৈর্যশীল ও পরমতসহিষ্ণু হ’তে হবে। অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। একে অপরের হক সাধ্যমত আদায় করতে হবে, রাগ দমন করতে হবে এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব সচেতন এবং সহমর্মী হ’তে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর’ (নিসা ৪/১৯)।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বণিত।,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ ‘কোন মুমিন যেন মুমিনাকে ঘৃণা না করে (বা তার প্রতি শত্রুতা পোষণ না করে); যদি তার কোন আচরণে সে অসন্তোষ প্রকাশ করে, তবে অন্য আর এক আচার-ব্যবহারে সন্তুষ্টি লাভ করবে’।[6]
অবশেষে কিছুতেই সংশোধনের সম্ভব না হ’লে উভয় পক্ষের অভিভাবকের মাধ্যমে ফায়ছালা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا، ‘আর যদি তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা চায়, তাহ’লে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে (সম্প্রীতির) তাওফীক দান করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও তোমাদের সবকিছু অবগত’ (নিসা ৪/৩৫)।
৫. খাঁটি ঈমানদার হওয়া যরূরী। অন্যথা নানামুখী গযব পাকড়াও করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوْا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُونَ، ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের দরুণ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)।
পরিশেষে বলব, সব মুদ্রারই যেমন দু’টি পিঠ আছে, তেমনি সব জিনিসেরই ভাল-খারাপ দু’টি দিক আছে। কিছু মানুষ অনেক সময় তালাকের অপব্যবহার করে। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে কি ধরনের অপরাধে তালাক দেওয়া যায় এবং তার পদ্ধতিগত ধাপগুলি ঠিকঠাক মানা হ’ল কি-না সেটা ভাবে না। সর্বোপরি দেখা দরকার পারস্পরিক সংশোধন ও সম্পর্কের পুনর্জাগরণের সুযোগ দেওয়া হ’ল কি-না। এসব কিছু না ভেবে নিছক হঠকারিতা কিংবা বহুবিবাহের লিপ্সা থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বিবাহবিচ্ছেদের সহজলভ্য ছাড়পত্র বানানো ইসলাম সমর্থন করে না। এর ফলে কত পুরুষ-নারীর জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে, কত ছেলে-মেয়ে তাদের পিতা-মাতা থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে, আর কত শত পরিবার এর অশুভ পরিণতির নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে তা অবগত হ’লে চোখ অশ্রুসিক্ত হবে, অন্তর ব্যথাতুর হবে। আবার কিছু মানুষের ভুলের জন্য ইসলামের তালাক নিয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বহু ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নিয়েছে এবং তারা ইসলামের অনেক সমালোচনা করে থাকে। এ ব্যাপারে সবারই সচেতন ও সহনশীল হওয়া এবং শেষ সময় পর্যন্ত মানবিকভাবে বিবাহ রক্ষার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে যে, সুখের সংসার ছোট ছোট এমন কিছু কারণে ভেঙ্গে যায় যেগুলোকে কখনো আমরা গুরুত্ব দেই না। তাই সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা সকল নারী-পুরুষকে ধৈর্যধারণ করার তাওফীক দান করুন। সকলকে দুনিয়া ও পরকালীন জীবনে শান্তি ও সফলতার জন্য সংশোধিত হওয়ার তাওফীক দিন-আমীন!
মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
ভেরামতলী, শ্রীপুর, গাযীপুর।
[1]. আবূদাঊদ হা/২১৪২; ৩২৫৯; ছহীহুত তারগীব হা/১৯২৯।
[2]. বুখারী হা/৫১৮৬; মিশকাত হা/৩২৩৮।
[3]. মুসলিম হা/১৪৬৮; তিরমিযী হা/১১৮৮; মিশকাত হা/৩২৩৯।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৮; ছহীহাহ হা/১০৬৭।
[5]. আবূদাঊদ হা/২২২৬।
[6]. মুসলিম হা/১৪৬৯; মিশকাত হা/৩২৪০।