পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।
ভূমিকা :
তাতারদের ইতিহাসে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তাদের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে’ (ইউসূফ ১২/১১১)। তিনি আরো বলেন, ‘অতএব এদের কাহিনী বর্ণনা কর যাতে তারা চিন্তা করে’ (আ‘রাফ ৭/১৭৬)। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ যত ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তার সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাবে তাতারদের ধ্বংসযজ্ঞ। বাগদাদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে বহু কবি কবিতা রচনা করেছেন। কেউবা গেয়েছেন শোকগাঁথা। অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন ইতিহাস গ্রন্থ। কিন্তু এর ভয়াবহতা বর্ণনা করে কেউ পরিসমাপ্তি টানতে পারেননি। বাদশাহ বখতে নছর বায়তুল মাকদাস ধ্বংস ও তার অধিবাসী বনু ইসরাঈলদের হত্যা করেছিলেন। কিন্তু বাগদাদ ধ্বংসের সাথে তার তুলনা হবে না। দাজ্জাল পৃথিবীতে এসে মানুষ হত্যা করবে। কিন্তু তার অনুসারীদের রেহাই দিবে। পক্ষান্তরে তাতার এমন এক রক্তপিপাসু জাতি ছিল, যারা নারী-পুরুষ ও শিশু সবাইকে হত্যা করেছে। এমনকি গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ঘটিয়ে ভ্রূণকেও হত্যা করেছে। বিশ্ব হয়তো ইয়াজূজ-মাজূজ ব্যতীত কারো দ্বারা এরূপ হত্যাকান্ড কখনো দেখেনি এবং ভবিষ্যতেও দেখবে না।[1]
অনেক ঐতিহাসিক তাদের ধ্বংসযজ্ঞকে ইয়াজূজ-মাজূজের ধ্বংসলীলার সাথে তুলনা করেছেন। তারা ছিল সূর্যের পূজারী। তারা কুকুর-শূকরসহ সকল প্রাণীর গোশত খেত। তাদের বৈবাহিক কোন ভিত্তি ছিল না। ফলে নারী-পুরুষ যে যাকে ইচ্ছা ভোগ করত। সন্তানদের কোন পরিচয় ছিল না।[2] এ কারণে হয়তো তারা এত হিংস্র ছিল। তাদের নারী সৈন্যরাও শত শত মানুষকে হত্যা করত। তাদের যুদ্ধ কৌশল দেখে লোকেরা তাদেরকে পুরুষ মনে করত।[3] তাতারদের অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, একদা আমি তাতারদের শাসন আমলে কতিপয় সাথীসহ তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন তারা মদ পান করছিল। আমার সঙ্গী-সাথীরা তাদেরকে তিরস্কার করল। আমি সাথীদের ধমক দিয়ে বললাম, আল্লাহ তো এজন্য মদ হারাম করেছেন যে, এটি আল্লাহর যিকির ও ছালাত আদায়ে বাধা দেয়। আর মদ এ সকল লোককে মানব হত্যা, সন্তানদের বন্দি ও সম্পদ লুণ্ঠন থেকে বিরত রেখেছে।[4] এই তাতাররা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাদের অনেকে ইসলামের খিদমতে নিজেদের নিয়োজিত করে।
তাতারদের পরিচয় :
তাতার ও মোগল বলতে ঐ সকল সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা উত্তর চীনের জূবী হীম-শিতল মরু এলাকায় বসবাস করত। মোগল আসলে তাতারদের একটি শাখা গোত্র। অনুরূপ তুরকী, সুলজূকী ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী তাতারদেরই অংশ। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতেন চেঙ্গীস খান। তারা মোগল নামেই পরিচিতি লাভ করেছিল। এদের রাজত্ব এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তারা পূর্বে কোরিয়া থেকে পশ্চিমে ইসলামী রাজ্য খাওয়ারিযম এবং উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে চীন সাগর প্রর্যন্ত তাদের রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়। যা বর্তমানে চীন, মোঙ্গলিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও সাইবেরিয়ার কিছু অংশ থেকে লাউস, মায়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে শামিল করে।
সপ্তম হিজরী শতকে মোগলদের যে বিজয় বন্যা চলছিল তাতে তারা ‘তাতার’ নামে পরিচিত ছিল। চীন, ইসলামী ভূখন্ড বা ইউরোপে অথবা রাশিয়া সর্বত্র তাতাররা পরিচিত ছিল। এজন্য ইবনুল আছীর (রহঃ) চেঙ্গীস খানের পূর্ব পুরুষদের তাতার বলে অভিহিত করেছেন।[5] অপরদিকে প্রাচীন জাপানীরা তাদেরকে সাকীছিয়া (Sacythia) বা সাকীতিয়া নামে চিনত।[6]
আল্লামা আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী (১৯৬৩) বলেন, পশ্চিমে ইউরোপ মহাদেশ, পূর্বে জাপান ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত এবং উত্তরে সাইবেরিয়া ও বাল্টিক সাগর, দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ, সিরিয়া ও ফিলিস্তীন পর্যন্ত তাতারদের রাজত্ব বিস্তার লাভ করে।[7] তিনি আরো বলেন, হিজরী দ্বিতীয় শতকে তাতাররা প্রধানতঃ দু’টি দলে বিভক্ত ছিল। যাদের একটিতে নয়টি কাবীলা ছিল। আর অপরটিতে ত্রিশটি কাবীলা ছিল বা গোত্র ।
হিজরী চারশ’ শতকের পূর্বে (১০০০ খৃঃ) ইতিহাসের পাতায় মোগল নামের অস্তিত্ব ছিল না। গ্রহণযোগ্য মতের ভিত্তিতে বলা যায় যে, এ গোত্রসমূহ তাতারদের কোন এক নেতার নেতৃত্বে একীভূত হয়, যে ঐ নামের পরিচয় বহন করছিল। অতঃপর ঐ নেতা তার রাজত্ব চুক্তিবদ্ধ সকল গোত্রের উপর বিস্তার করে এবং এভাবে মোগল নামটি পরিচিত হয়ে উঠে।[8] এরপর একদল যোদ্ধা তাদেরকে ছেড়ে এশিয়া মায়নরে চলে যায়। যাদের পরবর্তীরাই তুর্কী তাতার বা কারা’তাতার নামে পরিচিতি লাভ করে। তারা তায়মুর লঙের হামলার সময় আমাসীয়া ও কায়ছারিয়ার মধ্যে অবস্থিত গ্রাম-গঞ্জে যাযাবরী জীবন-যাপন শুরু করে। এ সময় সংখ্যায় তারা প্রায় তিন হাযার থেকে চার হাযারটি পরিবার ছিল। পরে তায়মুর লঙ তাদেরকে মধ্য এশিয়ায় বিতাড়িত করেন। উছমানীয় শাসক দ্বিতীয় বায়েযীদ তাদেরকে কাশগর ও খাওয়ারিযমে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। তায়মূর লঙের মৃত্যুর পরে এই তুর্কী তাতাররা পুনরায় এশিয়া মায়নরে ফিরে আসে এবং নতুনভাবে বসতী স্থাপন করে। এজন্য রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে বসবাসরত তাতার বলতে সকল তুর্কী জনগোষ্ঠীকে বুঝায়।[9]
কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন তাতাররা তুর্কীদেরই একটি বড় জনগোষ্ঠী। অন্যান্য গোত্র তাতারদের শাখা। ফলে তারা পুরো তুর্কী জাতিকে তাতার হিসাবে গণ্য করেন। অতএব মোগলরা তাতারদেরই একটি অংশ। বিশেষতঃ মানকূস (Manchos) জাতি। যেমনটি বর্তমানে চীনে তাদের অবস্থান। তুর্কী ঐতিহাসিকগণ বলেন, পূর্বযুগে আলান্জা খান নামে তাতারদের একজন বাদশাহ ছিলেন। তাতারখান ও মোগল খান নামে তার দু’জন সন্তান ছিল। যেমনটি আরবে মুযার ও রাবী‘আ দু’জন ব্যক্তির নামে দু’টি গোত্র পরিচিতি লাভ করে। এভাবে তাদের জীবন ইতিহাস চলতে থাকে। এক পর্যায়ে মোগল সম্রাট ইলাখান ও তাতার সম্রাট সুনজু খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে রূপ নিলে তাতার সম্রাট সুনজু খান বিজয় লাভ করেন। মোগলরা পরাজিত হয়। এতে পুরো ক্ষমতা চলে আসে তাতারদের হাতে। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যায়নি। যুগের পর যুগ ধরে যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। অবশেষে চেঙ্গীস খানের পিতা ইয়াসুকী বাহাদুর খান ক্ষমতা লাভ করেন।[10]
তাতারদের ধর্মীয় পরিচয় :
তাতাররা সম্রা্ট আকবরের দ্বীনে এলাহীর ন্যায় এক বিস্ময়কর ধর্মের অনুসরণ করত। এটি বিভিন্ন ধর্মের সমন্বিত ধর্ম ছিল। চেঙ্গীস খান ইসলামী শরী‘আত, খ্রিষ্টীয় শরী‘আত ও বৌদ্ধ ধর্মের কিছু নিয়ম নীতির সমন্বয় ঘটিয়ে তাতারদের জন্য নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন, যার নাম ছিল ‘আল-ইয়াসাক্ব’।[11] কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তাতারদের কেউ ইহুদী কেউবা খৃষ্টান আবার কেউ সবগুলো মেনে চলত। তাদের কেউ আবার মূর্তিপূজার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করত। মোটকথা চেঙ্গীস পুত্রদের এই নীতি ছিল যে, যার যে ধর্ম পসন্দ সে তা গ্রহণ করতে পারবে। অন্যরা সেটিকে অবজ্ঞা করবে না।[12]
ইসলাম পূর্ব তাতাররা তারকা পূজা করত। সূর্য উদয়ের সময় তাকে সিজদা করত। কোন কিছুকে হারাম মনে করত না। তারা সকল প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করত। এমনকি কুকুর-শূকরের গোশত ভক্ষণ করতেও কুণ্ঠিত হ’ত না। তাদের কোন পিতৃ পরিচয় ছিল না। মোগল-তাতারদের শামানিয়া (Shamaniasm) নামে এক পুরাতন ধর্ম ছিল। তারা বহু ক্ষমতাধর ইলাহে বিশ্বাসী ছিল। তাদের ছালাত আদায় করা লাগত না। পারস্পরিক কোন ভালোবাসা ছিল না। তারা ঐ সকল নিকৃষ্ট প্রাণীরও ইবাদত করত যেগুলোকে তারা তাদের মহাক্ষমতাধর ইলাহের জন্য উৎসর্গ করত। তারা বিশ্বাস করত যে, এগুলো বিপদের সময় তাদেরকে সাহায্য করবে। অনুরূপভাবে তারা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মারও দাসত্ব করত।[13]
হাফেয ইবনু কাছীর, ইবনুল আছীর প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ তাদের ধর্ম সম্পর্কে বলেন,
وَأَمَّا دِيَانَتُهُمْ، فَإِنَّهُمْ يَسْجُدُوْنَ لِلشَّمْسِ عِنْدَ طُلُوْعِهَا، وَلَا يُحَرِّمُوْنَ شَيْئًا، فَإِنَّهُمْ يَأْكُلُوْنَ جَمِيْعَ الدَّوَابِّ، حَتَّى الْكِلَابَ، وَالْخَنَازِيْرَ، وَغَيْرَهَا، وَلَا يَعْرِفُوْنَ نِكَاحًا بَلِ الْمَرْأَةُ يَأْتِيْهَا غَيْرُ وَاحِدٍ مِنَ الرِّجَالِ، فَإِذَا جَاءَ الْوَلَدُ لَا يَعْرِفُ أَبَاهُ-
‘আর তাদের ধর্মকর্ম ছিল যে, তারা সূর্য উদয়ের সময় তাকে সিজদা করত। তারা কোন কিছুই হারাম মনে করত না। তারা সকল প্রাণীকে ভক্ষণ করত। এমনকি কুকুর, শূকর ইত্যাদি প্রাণীর গোশতও খেত। বিবাহের সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান ছিল না। বরং একজন নারীর কাছে বহু পুরুষের গমনাগমন হ’ত। ফলে সন্তান জন্মিলে পিতৃ পরিচয় মিলত না।[14]
তাতারদের বিস্তারকালে সমসাময়িক অবস্থা :
হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষের (১২০০ খৃষ্টাব্দ) দিকে তাতারদের আবির্ভাব ঘটে এবং একশ’ বছরের মধ্যে তাদের ধ্বংসলীলা ও রাজ্য জয়ের কারণে ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। হিজরী চতুর্থ শতকে চিনের ক্ষমতায় ছিল তান্জ। অতঃপর সমগ্র চীনকে দশটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। এরপর চীনের ক্ষমতায় চলে আসেন তাতার নেতা ‘সুন্জ’। যিনি গোটা চীনকে একীভূত করতে সক্ষম হন। তার রাজত্ব চলে ৯৬০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১১২৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময় দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা নিয়ম-নীতির পরিবর্তন হয়। ক্ষমতা চলে যায় রাজাদের হাতে। উত্তর চীনের ক্ষমতায় আসীন হন রাজা কীন। এতে সুন্জু পরিবারের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে দক্ষিণে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এজন্য ১১২৭ খৃষ্টাব্দ থেকে ১২৯০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সুন্জু পরিবারের শাসনকে ‘মামলাকাতু সুনজিল জুনবিয়া’ বলা হয়ে থাকে। আর ৭ম হিজরী শতকের প্রারম্ভে ভারতবর্ষে ক্ষমতায় আসীন হন রাজা খাওয়ারিযম শাহ। কুতুবুদ্দীন আইবেক ৬০৩ হিজরী সনে ভারত জয় করেন। যদিও তিনি একজন গোলাম ছিলেন। এরপর তিনি দিল্লীতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানেরা ভারতে ক্ষমতায় আসলেও বহু দিন থেকে চলে আসা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের তেমন কাছে টানতে পারেনি।[15]
হিজরী সপ্তম শতকের শুরুতে মুসলিম শাসিত রাজ্যসমূহের অবস্থা :
এ সময় ইসলমী সম্রাজ্য বিভিন্ন ছোট ছোট দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এর নেতারা অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই শাসকেরা খাওয়ারিযম রাজ্যর উপর ভয়ংকর মোগল সৈন্যদের হামালার পূর্বে তাদের রনকৌশল ও সমর দক্ষতা সম্পর্কে জানতে পারেননি। এদিকে রাজ্য জয়ে মোঙ্গল তাতারদের হামলা অব্যাহত থাকে। পরে চীন ও তুরকিস্তান এবং ভারত, ইরান, এশিয়া মায়নর ও পূর্ব ইউরোপের কিছু অংশ তারা দখল করে নেয়। এরপরেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত মুসলিম শাসকেরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার চিন্তা করেনি। যাতে তারা সর্বধ্বংসী মোগলীয় যুদ্ধ স্রোতকে প্রবল হওয়ার পূর্বে বাধা দিতে পারে। স্বয়ং বাগদাদে ক্ষমতা লোভী নেতারা স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। শী‘আ-সুন্নী দ্বন্দ্ব বিপদজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। দজলা নদীর প্লাবন অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইরাকের অর্ধভূমি ধ্বংসে নিপতিত হয়েছিল।[16] আরো বলা যায় যে, আববাসীয় শাসনের দ্বিতীয় যুগের শুরু থেকেই রাষ্ট্রের নিয়ম-শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ে। ইরাকের দক্ষিণ অঞ্চলের বহু এলাকা জলাভূমিতে পরিণত হয়। অথচ ইতিপূর্বে এই ভূমি ছিল আববাসীয় সম্রাজ্যের প্রাচুর্যের ভিত্তি এবং সভ্যতার ধারক। যেমন প্রথম দিকে প্রাচ্যের খাওয়ারিযমের বাদশাহগণ নিজেদের সৈন্যদেরকে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে আববাসীয় খিলাফত রক্ষার কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কিন্তু পরে আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ খাওয়ারিযমশাহ বাগদাদ দখলে নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। যেমনটি ইতিপূর্বে বনু বুওয়াইহ ও সুলজুকীরা করেছিল। কিন্তু তিনি দু’টি কারণে তার ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ হন। প্রথমতঃ প্রবল তুষার ঘূর্ণীঝড়ের কারণে ফিরে যেতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়তঃ মোগল সৈন্যরা তার রাজ্যের উপর প্রচন্ড হামলা করে। অবশেষে তিনি কাযবীন সাগরে পলায়নে বাধ্য হন এবং কোন এক দ্বীপে ৬২০ হিজরী সনে মারা যান। এই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও প্রবল যুদ্ধের পর মোগলরা তাদের দেশে ফিরে আসে। অপরদিকে আলাউদ্দীন মুহাম্মাদের সন্তান জালালুদ্দীন মানকাবারতী ভারত থেকে ৬২২ হিজরী সনে নিজ দেশে ফিরে আসেন। তিনি ইতিপূর্বে চেঙ্গীস খানের সৈন্যের সামনে টিকতে না পেরে ভারতে পলায়ন করেছিলেন। দেশে ফিরে এসেই তিনি মোগলদের বিপদ দূর করার কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রথমেই তিনি তার পিতার সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করেন। অতঃপর ইরাকীয় আরব ও অনারবদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। তাদের ভূমি দখল ও সম্পদ লুণ্ঠন করেন। অবশেষে তিনি বাগদাদের জন্য বড় হুমকী হয়ে দাঁড়ান। এ কারণে মুসলিম নেতারা ঐ বছরই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এজন্য আশরাফ বিন মালাক আল-আদিল আয়ূবী ও রোমের শাসক কীফান বিন কায়খসরু ঐক্যবদ্ধ হয়ে জালালুদ্দীন মানকাবারতীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাকে পরাস্ত করেন। অপরদিকে ৬২৮ হিজরী (১২৩১/১২৩২) সনে মোগলররা জালালুদ্দীন মানকাবার্তীর উপর প্রচন্ড ও ন্যক্কারজনক আক্রমণ করে। এতে তিনি পাহাড়ের দিকে পলায়ন করেন। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। কোন এক কুর্দীর হাতে তিনি নিহত হন।[17]
এতো ছিল পূর্ব ইসলামী বিশ্বের অবস্থা। কিন্তু অন্যান্য ইসলামী বিশ্বের অবস্থা ছিল ভিন্নতর। আরব উপদ্বীপ, মিসর এবং সিরিয়ার একটি বড় অংশ সুলতান ছালাহুদ্দীন আইউবীর কর্তৃত্বে ছিল। কিন্তু ৬১৫ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানরা রাজ্য ভাগ নিয়ে পরস্পরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে মুসলিম শক্তি দুর্বল হ’তে থাকে। অপরদিকে খৃষ্টান অপশক্তি বারংবার সিরিয়া, ফিলিস্তীন ও মিসরে আঘাত হানতে থাকে। মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও তাদের উপর খৃষ্টানদের অব্যাহত হামলা মোগলরা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তারা যখন বুঝতে পারে যে, মুসলমানগণ এখন পুরোপুরি দুর্বল তখনই তারা বাগদাদে হামলা করে ধ্বংসলীলা চালায়।[18]
তাতারদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাতারদের ব্যাপারে কিছু অমরবাণী রেখে গেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি হাদীছ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
عَنْ عَمْروِ بْنُ تَغْلِبَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : بَيْنَ يَدَىِ السَّاعَةِ تُقَاتِلُوْنَ قَوْمًا يَنْتَعِلُوْنَ الشَّعَرَ، وَتُقَاتِلُوْنَ قَوْمًا كَأَنَّ وُجُوْهَهُمُ الْمَجَانُّ الْمُطْرَقَةُ-
আমর ইবনু তাগলিব (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা ক্বিয়ামতের আগে এমন এক জাতির সঙ্গে যুদ্ধ করবে যারা পশমের জুতা ব্যবহার করে এবং তোমরা এমন এক জাতির সঙ্গে লড়াই করবে যাদের মুখমন্ডল হবে পিটানো ঢালের মত’।[19]
عَنِ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه، قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: لاَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى تُقَاتِلُوا التُّرْكَ صِغَارَ الأَعْيُنِ، حُمْرَ الْوُجُوْهِ، ذُلْفَ الأُنُوْفِ، كَأَنَّ وُجُوْهَهُمُ الْمَجَانُّ الْمُطَرَّقَةُ، وَلاَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى تُقَاتِلُوْا قَوْمًا نِعَالُهُمُ الشَّعَرُ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ততদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতদিন তোমরা এমন তুর্কী জাতির বিপক্ষে যুদ্ধ না করবে, যাদের চোখ ছোট, চেহারা লাল, নাক চেপ্টা এবং মুখমন্ডল পেটানো চামড়ার ঢালের মত। আর ততদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতদিন না তোমরা এমন এক জাতির বিপক্ষে যুদ্ধ করবে, যাদের জুতা হবে পশমের’।[20]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামত ততদিন সংঘটিত হবে না, যতদিন না মুসলিমগণ তুর্কী (কাফিরদের) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তুর্কীরা এমন এক জাতি, যাদের চেহারা ঢালের মত এবং তারা পশমের জুতা ব্যবহার করবে’।[21]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : اتْرُكُوا الْحَبَشَةَ مَا تَرَكُوكُمْ فَإِنَّهُ لاَ يَسْتَخْرِجُ كَنْزَ الْكَعْبَةِ إِلاَّ ذُو السُّوَيْقَتَيْنِ مِنَ الْحَبَشَةِ-
আব্দুল্লাহ্ ইবনু আমর (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ‘তোমরা হাবশীদের অবকাশ দাও, যতদিন তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। কেননা কা‘বা ঘরের সম্পদ তো সে ক্ষুদ্র পায়ের গোছা বিশিষ্ট হাবশী লোকটি বের করে নেবে’।[22]
এ সকল হাদীছ বর্ণনা করার পর ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, মুসলমানগণ উমাইয়া শাসন আমলে এ সকল তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। মুসলমানদের হাতে একটির পর একটি দেশ বিজয়ের জন্য তারাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানদের হাতে তাদের অনেকে বন্দি হয়। তাদের ক্ষমতা ও শক্তির কারণে তাদেরকে দলে আনার জন্য রাজা-বাদশারা প্রতিযোগিতা করতে থাকেন। এমনকি খলীফা মু‘তাছিমের অধিকাংশ সৈন্য তাদের বংশভূত হয়ে যায়। এরপর শাসন ক্ষমতা তুর্কীদের হাতে চলে গেলে তারা মু‘তাছিমের উত্তরাধিকারী মুতাওয়াক্কিল ও তার সন্তানদের একের পর এক হত্যা করে। অবশেষে তুর্কী কুর্দীদের রাজত্বের সাথে সংমিশ্রণ ঘটে। সিরিয়ার শাসন ক্ষমতাও তুর্কীদের হাতে চলে যায়। তারা অনারব রাষ্ট্রসমূহও দখল করে নেয়। অতঃপর এসব রাজ্যসমূহের উপর বিজয় লাভ করে সুবক্তগীনের বংশধররা। অতঃপর সুলজুকের বংশধররা। আর তাদের রাজত্ব ছড়িয়ে পড়ে ইরাক, সিরিয়া ও রোমে। অতঃপর সিরিয়ায় থাকা তাদের অবশিষ্ট অনুসারীগণ নূরুদ্দীন জঙ্গীর বংশধর ছিল। আর এ সকল অনুসারীগণই ছিল ছালাহুদ্দীন আইউবীর পরিবার। এক সময় এরাও তুর্কীদের তুলনায় সংখ্যায় বেড়ে যায় এবং তারা মিসর, সিরিয়া ও হিজায দখল করে নেয়। গুয্য তুর্কীরা হিজরী ৫ম শতকে সুলজুকদের উপর হামলা করে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায় এবং লোকদের সাথে নির্মম আচরণ করে। এরপর তাতারদের মাধ্যমে মুসলমানদের উপর নেমে আসে মহাবিপদ। কারণ হিজরী ষষ্ঠ শতকের পরে চেঙ্গীস খানের আবির্ভাব ও পুরো পৃথিবীকে বিশেষতঃ সমগ্র প্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে, যাতে এমন কোন দেশ ছিল না যেখানে তাদের অনিষ্ট প্রবেশ করেনি। অতঃপর তাদের হাতে বাগদাদের পতন এবং ৬৫৬ হিজরীতে খলীফা মুসতা‘ছিম বিল্লাহ নিহত হন। এরপর চেঙ্গীস খানের বাকী অনুসারীরা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। তাদের সর্বশেষ শাসক তায়মুর লঙ সিরিয়ার বাড়ি-ঘরকে পদদলিত করে তাতে ধ্বংসলীলা চালায়। সে রাজধানী দামেষ্ককে আগুন জ্বালিয়ে এমনভাবে পুড়িয়ে দেয় যে, শহরটির ঘরবাড়ির ছাদ সমূহও ভিতের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে। সে রোম, ভারত ও এ দু’টির মাঝে বহু রাষ্ট্রে ক্ষমতা বিস্তার করে। তার মৃত্যু অবধি তার শাসনকাল দীর্ঘায়িত হয়। অতঃপর তার সন্তানরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু দেশ জয় করে। যা রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব প্রতিফলন’।[23] রাসূল (ছাঃ) বলেন, বনু কান্ত্বুররা আমার উম্মতের রাজত্ব প্রথম ছিনিয়ে নিবে।[24] আর বনু কান্ত্বুর দ্বারা উদ্দেশ্য তুর্কীরা।[25] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা হাবাশীদের অবকাশ দাও, যতদিন তারা তোমাদের অবকাশ দেয়। আর তোমরা তুর্কীদের অব্যাহতি দাও যতদিন তারা তোমাদের অব্যাহতি দেয়’।[26]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এ সকল ঘটনা রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা। এই তুর্কীদের যুদ্ধ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেভাবেই ঘটনাসমূহ ঘটেছে। যেমন তাদের চোখ ছোট, চেহারা লাল, নাক চেপ্টা, মুখমন্ডল পেটানো চামড়ার ঢালের মত, পশমের জুতা পরিধান করা ইত্যাদি নিদর্শন আমাদের সময়ে দেখতে পেয়েছি। মুসলমানগণ তাদের সাথে বহুবার যুদ্ধ করেছে এবং এখনও করছে।[27] এটি ছিল ইমাম নববী (রহঃ)-এর সময়কার ঘটনা।
চেঙ্গীস খানের পরিচয় :
১১৫৮ খৃষ্টাব্দে ইয়াসূজাঈ মারা গেলে ক্ষমতায় আসে তার ছোট ছেলে তায়মূজীন। কর্মদক্ষতা ও চাতুরতার কারণে মাত্র তের বছর বয়সে তিনি চেঙ্গীস খান পদবী লাভ করেন। ক্ষমতায় এসেই তায়মূজীন বিভক্ত মোগল ও তাতারদের ঐক্যবদ্ধকরণে সচেষ্ট হন। ত্রিশ বছর যাবৎ তিনি অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমন ও বিক্ষিপ্ত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে অতিবাহিত করেন। ১২০৬ সালে তায়মূজীন গোত্র প্রধানদের জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করেন। সেখানে উপস্থিত করা হয় গণক, জাদুকর, বক্তা ও পুরোহিতদের। তারা জনসম্মুখে ঘোষণা করেন যে, আজ তায়মূজীনের এমন এক সম্মানজনক উপাধির জন্য আকাশ খুলে গেছে যা তার পূর্ববর্তীদের জন্য খুলেনি। আজ থেকে তার নাম হয়ে গেল চেঙ্গীস খান। অর্থাৎ ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে তিনি তেতালিলশ বছর বয়স অবধি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্য পরিচালনা করেন। চেঙ্গীস খান অভ্যন্তরীণ শত্রুদের থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করলে দেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে একটি নিয়মের আওতায় আনতে সচেষ্ট হন। আর এজন্য ‘ইয়াসাক্ব’ বা ‘ইয়াসাহ’ নামে একটি নীতিগ্রন্থ রচনা করা হয়। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন ইয়াসাহ অর্থ রাজনীতি। পরবর্তীতে মিসরীয়রা এর পূর্বে সীন ও তারও পূর্বে আলিফ-লাম যুক্ত করে। ফলে এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা শব্দটিকে আরবী বলেই মনে করতে থাকে।[28] ইয়াসাহ তুর্কী অর্থে ‘আল-কানূনুল মুজতামাঈ’ বা সামাজিক বিধিবিধান।
চেঙ্গীস খান যে সকল বিষয় এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন তা হ’ল- যে ব্যভিচার করবে তাকে হত্যা করা হবে। যে ব্যক্তি মিথ্যা বলবে, যাদু করবে, কাউকে বিনা দোষে আটকে রাখবে বা বিবদমান দুই দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে একদলের পক্ষ নিবে ও সাহায্য করবে তাকে হত্যা করা হবে। যে ব্যক্তি পানি বা ছাইয়ে পেশাব করবে তাকে হত্যা করা হবে। যাকে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে মালপত্র দেওয়া হ’ল তৃতীয়বারের পরেও যদি সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহ’লে তাকে হত্যা করা হবে। যদি কোন লোক কোন বন্দিকে সে গোত্রের অনুমতি ব্যতীত খাবার দেয় বা বস্ত্র দেয় তাহ’লে তাকে হত্যা করা হবে। যদি কোন দাস বা বন্দি পলায়ন করে অতঃপর অন্য কোন ব্যক্তি তাকে আশ্রয় দেয় ও মূল মালিককে ফিরিয়ে না দেয় তাহ’লে তাকে হত্যা করা হবে।
প্রাণী যবেহ করার ব্যাপারে উক্ত গ্রন্থে বলা হয়, পশুটির চার পা শক্ত করে বেঁধে দিবে এরপর সেটি না মরা পর্যন্ত তার হার্টে আঘাত করতে থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মুসলমানদের ন্যায় প্রাণী যবেহ করবে তাকেও যবেহ করা হবে। যুদ্ধের সময় যে ব্যক্তির বস্ত্র বা কোন মাল-সামান পড়ে যাবে। তার পিছনে থাকা ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হবে সেখানে নেমে তা কুড়িয়ে নেওয়া। এটি না করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড।
শিষ্টাচার সম্পর্কে উক্ত গ্রন্থে বলা হয়, কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি ব্যতীত সকলকে সমানভাবে সুবিধা দিতে হবে। যেমনভাবে শর্ত করা হয়েছিল যে, আলী (রাঃ)-এর পরিবারের প্রতি কোন বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হবে না। তাদের প্রতি কোন ধরনের অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হবে না। অনুরূপভাবে কোন আলেম-ওলামা, ক্বারী, ফক্বীহ, চিকিৎসক, যাহিদ, আবেদ, মুওয়াযযিন, মৃত্যুকে গোসলদানকারী এমনকি ফক্বীর-মিসকীনদেরকেও বিশেষ কোন সুবিধা দেওয়া হ’ত না।[29]
পারস্পরিক চলা-ফেরার ক্ষেত্রে তাদের নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল এই যে, মেহমান ততক্ষণ পর্যন্ত খানা খেতে পারবে না, যতক্ষণ না মেযবান খাবার গ্রহণ করবে। যদিও মেযবান আমীর হয় এবং মেহমান বন্দি হয়। কেউ একাকি খাবার গ্রহণ করতে পারবে না। বরং তার যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাবে এবং যতজন লোকজন দেখবে ততজন লোককে সাথে নিয়ে খাবার গ্রহণ করবে। প্রজারা যতক্ষণ না খেয়ে পরিতৃপ্ত হবে, ততক্ষণ আমীর খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হবে না। বরং আমীর এবং মা‘মূর সকলের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে। যদি কোন লোক কোন খাদ্যগ্রহণরত গোত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তাহ’লে তাদের সাথে বসে তাদের অনুমতি ব্যতীত তাদের খাবার গ্রহণ করতে পারবে। কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। তাদের অন্যতম নীতি ছিল এই যে, তারা পানির ভিতর হাত প্রবেশ করিয়ে পানি ব্যবহার করত না। বরং তারা পানি তুলে হাত ও মুখ ধৌত করত। তারা তাদের পোশাক কখনো ধৌত করত না। এমনকি পোশাকটি ছিড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা ধৌত করার প্রয়োজন বোধ করত না। তারা পবিত্র ও অপবিত্রতার মধ্যে কোন পার্থক্য করত না।
তাদের কিতাবে এও ছিল যে, তারা কেউ নামের সাথে উপাধি ব্যবহার করতে পারবে না। বরং আমীর ও মন্ত্রীবর্গ কেবল মূল নামে পরিচিত হবেন। তারা নিজেদের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছিল যে, তারা প্রতিবছর তাদের কুমারী মেয়েদের বাদশার নিকট উপস্থাপন করবে। বাদশাহ যাদেরকে ইচ্ছা নিজের বা নিজ সন্তানদের ভোগ্যবস্ত্ত হিসাবে গ্রহণ করবেন। তাতে এও লিখা ছিল যে, যদি কোন বড় নেতাও অপরাধ করে ফেলেন আর তার শাস্তি বাস্তবায়ন করার জন্য সুলতান প্রতিনিধি প্রেরণ করেন, তাহ’লে উক্ত নেতার জন্য আবশ্যক হবে বিনয় ও নম্রতার সাথে দূতের আনুগত্য করা, যাতে তিনি বাদশার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারেন। যদি এক্ষেত্রে নিজের প্রাণও চলে যায় তবুও। তিনি দ্রুততম ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। যাতে দেশের যেকোন স্থানের সংবাদ দ্রুত জানতে পারেন। মৃত্যুর পূর্বে চেঙ্গীস খান তার সন্তান জিগতাঈকে ‘ইয়াসাকে’ বর্ণিত বিধান সমাজে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি মারা গেলে তার সন্তান ও অনুসারীরা তাদের সংবিধান ‘ইয়াসাক’ বা ‘ইয়সার’ বিধান সমাজে চালু করেন যেমনভাবে মুসলমানেরা কুরআনের বিধান সমাজে চালু করে। তারা ঐক্যমতে এটিকে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করে।[30] এগুলো ছাড়াও অনেক নিয়ম-নীতি ছিল যেগুলোর কিছু ভাল, কিছু মন্দ। তাদের বিধানসমূহ ভালো-মন্দ যাই হৌক না কেন, সমাজে এর প্রচলন তাতারদের ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যাপক সহায়তা করে। এ থেকেই তারা একের পর এক মুসলিম বিশ্বের উপর হামলা করে বহু মুসলিম এলাকা দখল করে নেয়।
[চলবে]
[1]. ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত তারীখ ১০/৩৩৩ পৃঃ।
[2]. আল-কামিল ফিত তারীখ ১০/৩৩৫ পৃঃ।
[3]. ঐ, ১০/৩৪৮ পৃঃ।
[4]. ইবনুল কাইয়িম, ই‘লামুল মু‘আক্কিঈন ৩/১৫; আর-রাহীকুল মাখতূম ১/৩৪ পৃঃ।
[5]. আল-কামিল ফিত তারীখ ১০/৩৩৩ পৃঃ।
[6]. হাসান ইবরাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম ৪/১২৫ পৃঃ।
[7]. দাওলাতুল মোগল ওয়া তাতার বায়নাল ইন্তিছারে ওয়াল ইনকিসারে ১/২৭ পৃঃ।
[8]. তারীখুল ইসলাম ৪/১২৫ পৃঃ।
[9]. ঐ, ৪/১২৫ পৃঃ।
[10]. ঐ, ৪/১২৬ পৃঃ।
[11]. ড. রাগেব সারজানী, কিছ্ছাতু তাতার মিনাল বিদায়াতি ইলা আয়নে জালূত ১/১৬ পৃঃ।
[12]. কালকাশান্দী, ছুবহুল আ‘শা ফী ছানা‘আতিল ইনশা ৪/৩১৫ পৃঃ।
[13]. তারীখুল ইসলাম ৪/১২৬ পৃঃ।
[14]. আল-বিদায়া ১৩/৮৮; আল-কামিল ১০/৩৩৫ পৃঃ।
[15]. তারীখুল ইসলাম ৪/১২৮ পৃঃ।
[16]. রশীদুদ্দীন, জামেউত্ তাওয়ারীখ ১/২৬২; তারীখুল ইসলাম ৪/১২৯ পৃঃ।
[17]. তারীখুল ইসলাম ৪/১৩০ পৃঃ।
[18]. ঐ, ৪/১৩০ পৃঃ।
[19]. বুখারী হা/৩৫৯২।
[20]. বুখারী হা/২৯২৮; মিশকাত হা/৫৪১১ পৃঃ।
[21]. মুসলিম হা/২৯১২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৪২৪ পৃঃ।
[22]. হাকেম হা/৮৩৯৬; আবুদাউদ হা/৪৩০৯; ছহীহাহ হা/৭৭২; মিশকাত হা/৫৪২৯ পৃঃ।
[23]. ফাতহুলবারী ৬/৬০৯ পৃঃ।
[24]. মু‘জামুল কাবীর হা/১০৩৮৯; আওসাত্ব হা/৫৬৩৪; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১২৩৮৩, সামহুদীর সূত্রে মানাবী, সনদ হাসান, আলবানী, সনদ জাল, যঈফাহ হা/১৭৪৭; ফাতহুলবারী ৬/৬০৯ পৃঃ।
[25]. ফাতহুলবারী ৬/৬০৯ পৃঃ।
[26]. নাসাঈ হা/৩১৭৬; মিশকাত হা/৫৪৩০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৮৪।
[27]. শারহুন নববী আলা মুসলিম ১৮/৩৭-৩৮ পৃঃ।
[28]. খুতাত ২/২০২; ছুবহুল আ‘শা ছানা‘আতিল ইনশা ৪/২২০ পৃঃ।
[29]. ছুবহুল আ‘শা ফী ছানা‘আতিল ইনশা ৪/৩১৪-১৫ পৃঃ।
[30]. কালকাশান্দী, ছুবহুল আ‘শা ফী ছানা‘আতিল ইনশা ৪/৩১৫-১৬; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩২-১৩৩ পৃঃ।