তাতার বাহিনী পুনরায় হামদানে :

মুসলিম বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতার বাহিনী হামদানের পথে ফিরে আসে। তারা শহরের সন্নিকটে অবস্থান নেয়। ইতিপূর্বে তারা হামদানে একজন শাসক নিয়োগ করে গিয়েছিল। তারা তার কাছে হামদানবাসীর নিকট থেকে সংগৃহীত ধন-সম্পদ ও পোশাক-পরিচ্ছদ চেয়ে পাঠায়। শহরবাসী তাদের সহায়-সম্পদ পূর্বেই হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। এ সময় হামদানের নেতা ছিলেন শরীফ নামে একজন ব্যক্তি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই শহরটির দেখভাল করছিলেন। তিনি তাতারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় সম্পদ তাদের কাছে পাঠাতেন। এমন সময় তাতার বাহিনীকে কিছু দেওয়ার মত সম্পদ এলাকাবাসীর কাছে ছিল না। ফলে তারা তাদের নেতার নিকট গিয়ে বলল, এই কাফেররা সকল সম্পদ গ্রাস করে নিয়েছে। দেওয়ার মত আমাদের ঘরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমরা সকলে শেষ সম্বলটুকুও হারিয়েছি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আপনি আমাদের জন্য কি করবেন? তখন শরীফ বললেন, এক্ষণে আমাদের জন্য তাদেরকে কিছু দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। জনগণ তাকে বলল, আপনি আমাদের প্রতি বেশী কঠোরতা প্রদর্শন করছেন। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরই একজন। তোমরা যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তখন পাশে থাকা ফক্বীহগণ তাতার প্রশাসককে বহিষ্কারের আদেশ দেন। জনতা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে হত্যা করে। এ সংবাদ জানতে পেরে তাতার বাহিনী শহর অবরোধ করে। শহরবাসী তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে আপামর জনগণ সকলে অংশগ্রহণ করে। এ যুদ্ধে বহু তাতার সৈন্য নিহত হয়। এতে ফক্বীহ ছাহেবও চরমভাবে আহত হন। লোকেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও পুনরায় সমবেত হয়ে তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম দিন অপেক্ষা কঠিনতর যুদ্ধ হয়। এতে পূর্বের দিনের চেয়ে তাতারদের বেশী সৈন্য নিহত হয়। এদিনও ফক্বীহ ছাহেব চরমভাবে আহত হন। কিন্তু তিনি অধৈর্য হননি। তৃতীয় দিনও তিনি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন, কিন্তু বাহনে আরোহণ করতে পারলেন না। লোকেরা যুদ্ধের সময় ফক্বীহ ছাহেবের অপেক্ষায় থাকল। কিন্তু তারা তাকে দেখতে পেল না। এদিকে ফক্বীহ ছাহেব স্বপরিবারে উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করলেন। জনগণ ফক্বীহকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কারণ তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ ছিল না। অথচ আমৃত্যু যুদ্ধ করার জন্য তারা প্রস্ত্তত ছিল। তারা শহরের মধ্যেই অবস্থান করল। নেতার অভাবে তারা শহরের বাইরে বের হওয়ার সাহস পেল না।

এদিকে বহু সৈন্য নিহত হওয়ার কারণে তাতার বাহিনী ফিরে যাওয়ার সংকল্প করল। কিন্তু যখন তারা লক্ষ্য করল যে, শহরের কোন সৈন্য বাইরে আসছে না, তখন তারা ধারণা করল, এরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে হামলা করে শহরবাসীকে ঘায়েল করা যাবে। তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। ৬১৮ হিজরী সনের রজব মাসে তাতার বাহিনী শহরে প্রবেশ করল। ঘরে ঘরে প্রবেশ করে লোকদের হত্যা করা শুরু করল। নগরবাসীরাও ঘরের মধ্যে অবস্থান করেই সাধ্যমত লড়াই চালিয়ে গেল। গৃহের ভিতরে তরবারী ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়লে তাতাররা ছোট চাকু দিয়ে মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকল। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। তাতারদের হাত থেকে কেবল তারাই রক্ষা পেয়েছিল, যারা জীবিকা অন্বেষণে বাইরে গিয়েছিল এবং সেখানেই আত্মগোপন করেছিল। মুসলমান ও তাতারদের মধ্যে কয়েকদিন যুদ্ধ চলল। এরপর তারা শহরে আগুন দিয়ে শহরটিকে জ্বালিয়ে দিল।[1]

আরদাবীলের ধ্বংসলীলায় তাতার বাহিনী :

তাতার বাহিনী হামদান ত্যাগ করে আযারবাইজানের ‘আরদাবীল’[2] শহরের পথে রওয়ানা হয়। আরদাবীলে পৌঁছে শহরটি দখল করে তারা সেখানে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়ে অধিকাংশ অধিবাসীকে হত্যা করে এবং সম্পদ লুণ্ঠন করে। এরপর আবার তিবরীযে ফিরে যায়। তারা চলে গেলে এখানকার শাসক হিসাবে শামসুদ্দীন তুগরাঈকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পূর্বের নেতা উযবাক বিন বাহ্লাওয়ান তাতারদের হামদান থেকে আযারবাইজানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার খবর শুনে তিবরীয ছেড়ে ‘নাকজুয়ান’[3] শহরে পলায়ন করেন এবং স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে খুওয়াই[4] নামক শহরে পাঠিয়ে দেন। এই সুযোগে তুগরাঈ দেশের রাজত্ব পেয়ে যান। তবে তিনি সর্বদা জনগণকে তাতারদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতেন। তিনি জনগণকে তাদের যুলুম-নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। তিনি নিজ চেষ্টা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে শহরকে সুরক্ষিত করে তুলেছিলেন। শহরের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ ও পরিখা খনন করেন। তাতাররা শহরের সন্নিকটে এসে দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও জনগণের যুদ্ধের প্রস্ত্ততি জানতে পেরে শহর আক্রমণের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। বরং তারা দূত মারফত খাদ্যসামগ্রী ও পোশাকাদি চেয়ে পাঠায়। তুগরাঈ সার্বিক বিষয় চিন্তা করে তাতারদের জন্য কিছু সম্পদ ও পোশাক পাঠিয়ে দেয়। তারা তা গ্রহণ করে ‘সারাওয়া’[5] শহরে চলে যায়। তারা শহরটিতে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায় এবং  এর অধিবাসীদেরকে হত্যা করে।[6]

অতঃপর তারা ৬১৭ হিজরীতে আর্রানের ‘বায়লাক্বান’[7] শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। যাওয়ার পথে শহর ও গ্রামগুলোতে লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চালায়।  বায়লাক্বানে গিয়ে তারা শহরটিকে অবরোধ করে। শহরবাসী সন্ধি করার জন্য তাতারদের পক্ষ থেকে একজন লোককে আহবান করে। তাতাররা তাদের নেতৃস্থানীয় ও বুযুর্গ  এক লোককে পাঠায়। শহরবাসী তাতারদের ন্যায় যুদ্ধের নীতি ভঙ্গ করে তাদের দূতকে হত্যা করে। এতে তাতার বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে শহরে ঢুকে পড়ে। ভয়ংকর যুদ্ধের মাধ্যমে শহরটির পতন ঘটে। তাতার বাহিনী ৬১৮ হিজরীর রামাযান মাসে শহরটি দখল করে নেয়। এই শহরে তারা এমন হত্যাকান্ড চালায় যে, তাদের হাত থেকে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর কেউ রেহাই পায়নি। এমনকি গর্ভবতী নারীর পেট কেটে বাচ্চা বের করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা করে। কিছু লোক আত্মরক্ষার্থে গিরিপথে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাদেরকে এক এক করে হত্যা করা হয়।[8]

এরপর তারা আর্রানের কেন্দ্রভূমি ‘কাঞ্জা’[9] শহরের দিকে রওয়ানা হয়। তারা সেখানে শহরবাসীর আধিক্য ও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর কথা জানতে পেরে আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু তারা লোক মারফত ধন-সম্পদ ও পোশাক চেয়ে পাঠায়। শহরবাসী কোন ঝামেলা না করে কিছু অর্থ ও পোশাক পাঠিয়ে দেয়। তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত মাল-সামগ্রী পেয়ে গেলে পুনরায় কারাজের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়। সেখানে গিয়ে তারা আবার হামলা চালায়। শহরবাসী প্রতিরোধের চেষ্টা করে চরমভাবে পরাজিত হয়। এতে প্রায় ত্রিশ হাযার মুসলিম সৈন্য শাহাদত বরণ করে। এরপর তারা তাফলীসে[10] চলে যায়। সেখানেও লুণ্ঠন ও হত্যাকান্ড চালায়।[11]

দারবান্দা শিরাওয়ানের উদ্দেশ্যে তাতার বাহিনী :

তাতার বাহিনী কারাজ ছেড়ে ‘দারবান্দা শিরাওয়ান’[12]-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে তারা ‘শামাখী’[13] শহর অবরোধ করে এবং অবরোধকে দীর্ঘায়িত করে। এরপর তারা মই ব্যবহার করে শহর রক্ষা প্রাচীর অতিক্রম করে। কোন কোন ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন যে, শহরের প্রাচীর অতিক্রম করার কোন উপায় না পেয়ে তারা উট, গরু ও ছাগলসমূহ একত্রিত করে। সেখানে তাদের এবং বিরোধীদের লাশগুলো একটি আরেকটির উপর জমা করে স্তূপে পরিণত করে। যা একটি টিলার মত হয়ে যায়। এতে আরোহণ করে তারা শহর রক্ষা প্রাচীর অতিক্রম করে। এরপর তারা শহরে প্রবেশ করে শহরবাসীর সাথে যুদ্ধ করে। তিনদিন পর্যন্ত কঠিন যুদ্ধ চলতে থাকে। শহরবাসী ধৈর্যের সাথে মুকাবিলা করতে থাকে। এরই মধ্যে লাশগুলো পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। অন্য তাতারদের পথ অতিক্রম করার সকল পথ বন্ধ হয়ে  গেলে তারা যুদ্ধের শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ভিতরে থাকা তাতাররা হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এতে শহরবাসী অবসাদ ও ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে তাতাররা শহর দখল করে নেয়। এরপর তারা হত্যাকান্ড ঘটায় এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করে।[14]

এরপর তারা ‘দারবান্দা’ পৌঁছার পথ খুঁজতে থাকে। কিন্তু পাহাড় অতিক্রম করার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই তারা কৌশল অবলম্বন করল। দারবান্দের নেতা শিরাওয়ানের নিকট পত্র লিখল যে, আপনি আমাদের সাথে সন্ধি করার জন্য কিছু লোক পাঠান। যারা সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করবে। পত্র পাওয়ার পর তিনি নিকটতম দশ ব্যক্তিকে পাঠালেন। তারা সেখানে পৌঁছা মাত্র তাতার নেতা একজনকে হত্যা করে বাকীদের বলল, তোমরা আমাদেরকে ‘দারবান্দা’ পৌঁছার পথ বাতলিয়ে না দিলে তোমাদের সাথীর ন্যায় তোমাদের একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। আর পথ দেখিয়ে দিলে তোমরা নিরাপদ। তখন তারা বলল, দারবান্দে পৌঁছার কোন পথই নেই। তবে একটি স্থান আছে যেখান দিয়ে পৌঁছা যেতে পারে। তারা দারবান্দাকে পশ্চাতে রেখে তাদের সাথে সে পথ ধরে চলে গেল।[15]

লান ও কুফজাকে তাতারদের ধ্বংসলীলা :

তাতাররা দারবান্দা শিরাওয়ান অতিক্রম করে ‘লান’[16] শহরে প্রবেশ করে। সেখানে ‘লান’, ‘লিকয’ ও কিছু তুর্কী জাতি বসবাস করত। তারা সংখ্যায় ছিল অনেক। তাদের কেউ মুসলিম আবার অনেকে অমুসলিমও ছিল। তাতাররা সেখানেও লুণ্ঠন শুরু করে ‘লিকয’ জাতির অনেককে হত্যা করে। ‘লান’ জাতি তাতারদের আগমনের সংবাদ জানতে পেরে সতর্কতার সাথে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা কুফজাকের সৈন্যদেরও সমবেত করে। দু’দলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হ’লে কোন দলই জয় লাভ করতে পারল না। তাতাররা যুদ্ধের নীতি ভঙ্গ করে কৌশল অবলম্বন করল। তারা কুফজাকবাসীর কাছে এ মর্মে পত্র লিখল যে, আমরা ও তোমরা একই জাতি গোষ্ঠী। আর ‘লানে’রা তোমাদের কেউ নয় যে, তোমরা তাদের সাহায্য করবে। তোমাদের ধর্মের সাথে তাদের ধর্মের মিল নেই। আমরা তোমাদের কথা দিচ্ছি যে, তোমাদের ব্যাপারে আমরা কোন হস্তক্ষেপ করব না। বরং তোমাদের ইচ্ছামত আমরা বহু ধন-সম্পদ ও পোশাক তোমাদের দিব। শর্ত হ’ল তোমরা তাদেরকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে।

কুফজাকবাসী তাতারদের সাথে একমত হ’ল। তারা ‘লান’দের ছেড়ে চলে গেল। এবার তাতার বাহিনী লান বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের বহুসংখ্যক লোককে হত্যা করল, কাউকে বন্দি করল এবং ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করল। এরপর গাদ্দার তাতার বাহিনী কুফজাকের পথে রওয়ানা হ’ল। শহরবাসী নিজেদের নিরাপদ মনে করে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিল। কারণ তারা মনে করেছিল যে, সন্ধি করে তারা নিরাপদ হয়ে গেছে। কিন্তু যাদের ইতিহাসই বিশ্বাসঘাতকতা তাদের হাত থেকে কোলের শিশুও রক্ষা পায় না। তারা শহরে প্রবেশ করে। প্রথমে তারা কুফজাকবাসীকে দেওয়া সম্পদ ছিনিয়ে নিল। এরপর হত্যাকান্ড ও ধ্বংসলীলা চালাল। যারা ঘরের বাইরে ছিল তারা আর বাড়িতে ফিরে আসার সাহস করল না। বরং কেউ বনে-জঙ্গলে, আবার কেউ রাশিয়ায় পলায়ন করল। কুফজাক শহরের পাশে বহু চারণভূমি থাকায় তাতার বাহিনী এখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করে। এরপর তারা ‘খাযার’[17] নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ‘সুদাক’[18] এলাকায় চলে যায়। যেখানে বড় বড় বাজার ছিল।[19]

রাশিয়ার পথে তাতার বাহিনী :

কুফজাকে অভিযান সমাপ্ত করে তাতার বাহিনী বিশাল আয়তনের দেশ রাশিয়া জয়ে মনোনিবেশ করে। তখনকার রুশেরা খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিল। তাতাররা সেখানে পৌঁছলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মুকাবেলা করার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করল। তাতাররা ৬২০ হিজরীতে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রুশ বাহিনী তাতারদের আগমনের কথা জানতে পেরে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিয়ে তাদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে গেল। তাদের সাথে পরাজিত কুফজাকবাসীও যোগদান করল। তাতার বাহিনী এ সংবাদ জানতে পেরে কৌশলে পিছনে ফিরে গেল। তাদের পশ্চাদগামিতা লক্ষ্য করে রুশ বাহিনী মনে করল যে, তাতাররা ভয়ে পলায়ন করেছে। তাই তারা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে তাতারদের পিছু ধাওয়া করল। বারো দিন পথ চলার পর রুশ বাহিনী তাতারদের সাক্ষাৎ পেল। এদিকে তাতাররা সুকৌশলে তাদের সৈন্য-সামন্ত বাড়াতে থাকে। যেটি রুশ বাহিনী বুঝতে পারিনি। উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল। উভয় দলই ব্যাপক ধৈর্যের পরিচয় দিল। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলতে থাকল। অবশেষে কুফজাক ও রুশ বাহিনী অপমানজনকভাবে পরাজিত হ’ল। তাদের অল্প সংখ্যক সৈন্যই প্রাণে রক্ষা পেল। যারা কোন মতে রক্ষা পেল তাদের উপর আরেক বিপদ আপতিত হ’ল। আর তা হ’ল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে রাশিয়ায় পৌঁছা। তারা সেখানে পৌঁছতে অত্যন্ত ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ল। অধিকন্তু রুশ বাহিনীর কাছে যে মাল-সামান ও অস্ত্র-শস্ত্র ছিল তাতার বাহিনী সেগুলো লুট করে নিল। তারা রুশদের পিছু ছাড়ল না। তারা শহরে শহরে প্রবেশ করে হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখল। ব্যবসায়ী ও সম্পদশালীগণ সাধ্যমত তাদের সম্পদ নিয়ে জাহায যোগে মুসলিম ভূখন্ড ‘মারসা’-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। কিন্তু তাদের একটি জাহায ডুবে যায়। তবে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল হওয়ায় লোকেরা প্রাণে রক্ষা পায়।[20]

বিলগার ও সাক্বসীনে তাতার বাহিনী :

তাতার বাহিনী রাশিয়ায় ধ্বংসলীলা চালিয়ে ৬২০ হিজরীর শেষের দিকে ‘বিলগার’[21] শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল। বিলগারবাসী তাদের সন্নিকটে আসার সংবাদ শুনে বিভিন্ন বাঙ্কারে আত্মগোপন করল। এরপর কিছু সৈন্য বেরিয়ে এসে তাদেরকে সুকৌশলে বাঙ্কারের সামনে আসার সুযোগ দিল। এবার আত্মগোপনকারী সৈন্যরা বেরিয়ে এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিলগার বাহিনী তাদের অধিকাংশ সৈন্যকে হত্যা করতে সক্ষম হ’ল। বলা হয়ে থাকে সেদিন তাতারদের চার হাযার সৈন্য নিহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যরা ‘সাক্বসীন’[22] হয়ে চেঙ্গীস খানের রাজ্যে চলে যায়।[23] এসব ছিল তাতার মুগাররিবা বাহিনীর ইতিহাস। যাদের নেতা ছিল জুরমাগূন। নিম্নে চেঙ্গীস খানের সাথে থাকা বাহিনীর বর্ণনা দেওয়া হ’ল।

চেঙ্গীস খান তার সৈন্যদেরকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে প্রেরণ করে। একদলকে ‘ফিরগানা’[24], আরেক দলকে তিরমিয ও অন্য একদলকে ‘কালানা’[25]-এর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। এরা সফলভাবে অভিযান শেষ করে চেঙ্গীস খানের কাছে ফিরে আসে। এরপর খোরাসান দখল করার জন্য বিরাট সৈন্য বাহিনী গঠন করেন।

বালখের উদ্দেশ্যে তাতার বাহিনী :

৬১৭ হিজরী। তাতারদের বিশাল বাহিনী জায়হুন নদী পাড়ি দিয়ে ‘বালখ’[26] শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল। বালখবাসী ভয়ে তাদের থেকে নিরাপত্তা কামনা করে। তারা ঝামেলা  না করে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করে। তাদের হত্যা বা সম্পদ লুণ্ঠনও করল না। বরং তারা নিজেদের পক্ষ থেকে বালখ নগরী পরিচালনা করার জন্য শাসক নিয়োগ করল।

এরপর তারা ‘যূযান’, ‘মীমান্দা’, ‘আন্দাখুয়া’ এবং অন্যান্য গ্রাম ও  শহরগুলোর দখল নিশ্চিত করার জন্য অগ্রসর হ’ল। বাস্তবে তারা যুদ্ধ ছাড়াই বিজয় নিশ্চিত করল। তারা সেগুলোতে কোন লুণ্ঠন বা হত্যাকান্ডও চালায়নি। তারা তাদের পসন্দনীয় ব্যক্তিদের শহরগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে সামনে অগ্রসর হ’ল। তবে এসকল শহরের যোদ্ধাদেরকে তাদের সাথে যেতে বাধ্য করল। উদ্দেশ্য তারা তাদের পক্ষে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।[27]

ত্বালক্বানের উদ্দেশ্যে তাতার বাহিনী :

‘ত্বালক্বান’[28] বহু শহর বিশিষ্ট রাজ্য ছিল। এখানে ‘মানছূরকূহ্’ নামে একটি সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। এ শহরের লোকজন নির্ভীক, অকুতোভয় ও বীর সেনানী ছিল। তাতার বাহিনী শহরে প্রবেশ করে দুর্গটি অবরোধ করে। তাদের এই অবরোধ ছয় মাস পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হল। দুর্গবাসীর সাথে দিন-রাত যুদ্ধ করে বিজয়ী হ’তে না পেরে তাতার বাহিনী নিজেদের দুর্বলতার কথা জানিয়ে চেঙ্গীস খানের কাছে পত্র লিখল। চেঙ্গীস খান বিজয় চূড়ান্ত করার জন্য নিজে একদল সৈন্য নিয়ে দুর্গের দিকে ছুটে গেলেন। পুনরায় দুর্গ অবরোধ করা হ’ল। তখন তাতার বাহিনীতে বহু মুসলিম বন্দি যোদ্ধা হিসাবে কাজ করছিল। এদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছিল যে, সরাসরি সামনে থেকে যুদ্ধ না করলে তাদেরকে হত্যা করা হবে। আরো চার মাস অবস্থান করেও দুর্গের পতন ঘটাতে পারল না তাতার বাহিনী। বরং বহু তাতার সৈনিক নিহত হ’ল। চেঙ্গীস খান অবস্থা খারাপ দেখে নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি সৈন্যদের সাধ্যমত গাছ ও ডালপালা সংগ্রহ করে দুর্গের পাশে রাখার নির্দেশ দিলেন। কিছু ডালপালা রেখে তাতে মাটি চাপা দেওয়া হ’ল। এরপর আবার তার উপর ডালপালা রেখে মাটি দিয়ে উঁচু করা হ’ল। এভাবে দুর্গের প্রাচীর বরাবর উঁচু করল। এরপর পদাতিক বাহিনী তার উপর আরোহণ করে তাতে মিনজানীক স্থাপন করল। সেখান থেকে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপ শুরু করলে দুর্গের সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। এই সুযোগে তাতার পদাতিক বাহিনী দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করে হত্যাকান্ড চালায়। দুর্গের ভিতরের পদাতিক বাহিনী নিহত হ’ল। আর অশ্বারোহী বাহিনী পাহাড় ও গিরিপথে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করল। সকল তাতার সৈন্য দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করে নারী ও শিশুদের বন্দি ও মালামাল লুণ্ঠন করল।[29]

মার্ভের উদ্দেশ্যে তাতার বাহিনী :

চেঙ্গীস খানের নেতৃত্বে ত্বালক্বান রাজ্য দখল হ’লে তিনি অন্যান্য দখলকৃত শহরের লোকদের সমবেত করে তার পুত্রের নেতৃত্বে তাদেরকে ‘মার্ভ’[30] দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। ঐদিকে মুসলিম-অমুসলিম, আরব ও তুর্কীদের সমন্বয়ে দু’লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করা হয়। তাদের সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তারা নিজেরা বিজয়ী হওয়ার কল্পনা-জল্পনা করছিল। তারা নিজেদেরকে অপরাজেয় ভাবছিল। তাতার বাহিনী মার্ভের সন্নিকটে পৌঁছলে তাদের সাথে যুদ্ধ বেঁধে গেল। উভয় বাহিনী ব্যাপক ধৈর্যের পরিচয় দিল। তাতারদের এক সৈনিক মুসলমানদের হাতে বন্দি হ’লে সে বলে, إِنْ قِيلَ إِنَّ التَّتَرَ يَقْتُلُوْنَ فَصَدِّقُوْا، وَإِنْ قِيلَ إِنَّهُمُ انْهَزَمُوْا فَلَا تُصَدِّقُوْا ‘যদি বলা হয়, তাতাররা হত্যা করে তাহ’লে বিশ্বাস করবে। আর যদি বলা হয় তারা পরাস্ত হয়েছে, তাহ’লে বিশ্বাস করবে না’।[31]

যুদ্ধে তাতারদের ধৈর্য ও বীরত্ব দেখে মুসলমান সৈন্যরা পলায়ন করল। তখন তাতাররা তাদের বহু মুসলিম সৈন্যকে হত্যা ও অনেককে বন্দি করে, ধন-সম্পদ, অস্ত্র-সস্ত্র ও বাহন লুণ্ঠন করে। এরপর তাতার বাহিনী পার্শ্ববর্তী শহরের লোকদের সমবেত করে মার্ভ অবরোধ করল। শহরবাসী অগ্রগামী সৈনিকদের পরাজয়, হত্যা ও বন্দির মত দুর্দশা দেখে দুর্বল হয়ে পড়ল। অবরোধের পঞ্চম দিনে তাতার নেতা মার্ভ রক্ষকের কাছে পত্র লিখে বলল যে, لَا تُهْلِكْ نَفْسَكَ وَأَهْلَ الْبَلَدِ، وَاخْرُجْ إِلَيْنَا فَنَحْنُ نَجْعَلُكَ أَمِيْرَ هَذِهِ الْبَلْدَةِ وَنَرْحَلُ عَنْكَ- ‘নিজেকে ও শহরবাসীকে ধ্বংস কর না। আমাদের নিকট চলে এস! আমরা তোমাকে শহরের আমীর নিয়োগ করে ফিরে যাব’। তখন তিনি নিজের ও শহরবাসীর নিরাপত্তা চেয়ে তাতারদের কাছে পত্র লিখেন। ফলে তারা তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়। ফলে শহরকর্তা তার নিকট উপস্থিত হন। চেঙ্গীসপুত্র তাকে কাছে ডেকে বলেন, ‘আমি চাই আপনি আপনার সাথীদের আমার নিকট পেশ করবেন, যাতে আমি তাদের মধ্যে উপযুক্ত ব্যক্তিকে খাদেম হিসাবে নিযুক্ত করতে পারি। তাকে আমরা জমিদারী দিব এবং আমাদের সঙ্গী বানিয়ে নিব’। তারা তাতারদের সামনে উপস্থিত হ’লে এবং আয়ত্তের মধ্যে চলে আসলে শহরের আমীরসহ তাদেরকে আটক করে। এরপর তারা বলল, দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী, সম্পদশালী ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন পেশার কারিগর ও শিল্পীদের নিকট পত্র লিখে এখানে আসার নির্দেশ দেওয়া হোক। তারা তাই করলেন। শিল্পীরা সামনে উপস্থিত হ’লে শহরের সকল লোককে স্বপরিবারে সেখানে উপস্থিত হ’তে নির্দেশ দিলেন। শহরের সকল লোক সেখানে উপস্থিত হ’লে চেঙ্গীস পুত্র সোনার চেয়ারে বসে নির্দেশ দিলেন যে, বন্দি মুসলিম সৈন্যদের উপস্থিত করা হোক। তাদের উপস্থিত করা হ’লে সকল মুসলমানের সামনে তাদেরকে বেঁধে হত্যা করা হ’ল। সাধারণ লোকেরা তা প্রত্যক্ষ করছিল ও নীরবে অশ্রু প্রবাহিত করছিল।[32]

অবশিষ্ট নারী-পুরুষ, শিশু ও তাদের সম্পদগুলোকে তাতার বাহিনী ভাগ করে নিল। সেদিনের অবস্থা আছহাবে উখদূদের মত হয়েছিল। ধনীদের থেকে ধন-সম্পদ লুটে নেওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দিল। অথচ তাদের কাছে তেমন কোন মাল ছিল না, যা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করবে। এরপর তারা শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিল। এভাবে তিনদিন চলে গেল। চতুর্থ দিনে সাধারণ জনগণকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হ’ল। তারা বলল, এরা আমাদের অবাধ্যতা করেছে। অতএব এদের হত্যা কর। এদিন তারা নিরাপরাধ সত্তর হাযার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।[33] সম্রাজ্যবাদীদের কালো থাবা থেকে সেদিন কোলের শিশুরাও রক্ষা পায়নি।

নিসাপুরের পথে তাতার বাহিনী :

মার্ভে ধ্বংসলীলা চালিয়ে তাতার বাহিনী নিসাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তারা পাঁচদিন যাবৎ শহরটিকে অবরোধ করে রাখে। সেখানে কিছু মুসলিম সৈন্য ছিল। কিন্তু তাতারদের সাথে লড়াই করার মত শক্তি তাদের ছিল না। তারা শহর দখল করে নিল। তারা জনগণকে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। বৃদ্ধদেরকে বন্দি করল। মার্ভের ন্যায় এখানেও সম্পদ আদায় করার জন্য জনগণকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রদান করল। তারা পনের দিন ধরে ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখল। বাড়িগুলোতে তন্নতন্ন করে সম্পদ খুঁজতে থাকল। এ সময় কিছু মানুষ সুকৌশলে প্রাণে বেঁচে যায়। এজন্য নিসাপুরে হত্যাকান্ড চালানোর সময় সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে লোকদের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এরপর তারা একদল সৈন্যকে ‘তূসে’[34] প্রেরণ করে। সেখানেও তারা পূর্বের ন্যায় ধ্বংসলীলা চালায়।[35]

হারাতের উদ্দেশ্যে তাতার বাহিনী :

তূসে ধ্বংসলীলা চালিয়ে তাতার বাহিনী ‘হারাত’[36] দখলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এটি খুবই সুরক্ষিত শহর ছিল। তারা শহরটিকে দশদিন যাবৎ অবরোধ করে রাখে। এরপর শহরটিকে দখল করে জনগণকে নিরাপত্তা দান করে। অতঃপর এখানে একজন শাসক নিয়োগ করে গযনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এদিকে তাতার বাহিনী চলে গেলে হারাতবাসী প্রশাসককে হত্যা করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা পুনরায় হারাতে ফিরে এসে শহরে অনুপ্রবেশ করে জনগণের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। অঢেল সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং বৃদ্ধদের বন্দি করে। এরপর আগুন দিয়ে শহর জ্বালিয়ে দেয়। অতঃপর তারা চেঙ্গীস খানের নিকট ত্বালক্বান শহরে চলে যায়।[37]

গযনী ও গূরের পথে তাতার বাহিনী :

হারাতে ধ্বংসলীলা চালিয়ে তারা ত্বালক্বানে ফিরে এসে বড় ধরনের প্রস্ত্ততি নিয়ে ‘গযনীর’[38] উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখানকার শাসক ছিলেন খোয়ারিযম শাহের পুত্র জালালুদ্দীন শাহ। তার পিতার অবশিষ্ট সৈন্যরা গযনীতে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদেরকে নিয়ে জালালুদ্দীন ষাট হাযার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন। গযনীর সন্নিকটে তাতার বাহিনী পৌঁছলে গযনীর নেতা নিজে সৈন্যদের নিয়ে তাদের মুকাবেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসেন। তারা ‘বালক’ নামক স্থানে অবস্থান নেন। সেখানে উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ হয়। তিনদিন কঠিন যুদ্ধ চলার পর মুসলমানদের উপর আল্লাহর সাহায্য নেমে আসল। এরপর মুসলমানেরা তাদের ইচ্ছামত প্রতিশোধ নিল। বেঁচে থাকা তাতার সৈন্যরা ত্বালক্বানে পলায়ন করল।

এরপর প্রকাশ্যে যুদ্ধ করার জন্য জালালুদ্দীন শাহ তাতারদের নিকট পত্র লিখেন। যাতে যুদ্ধের স্থান ও সময় জানতে চাওয়া হয়। চেঙ্গীস খান ক্ষিপ্ত হয়ে বিশাল বাহিনী গঠন করে তার পুত্রদের নেতৃত্বে কাবুলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনী তাদের মুকাবেলা করার জন্য কাবুলের সন্নিকটে কাতার বন্দি হয়। শুরু হয় মহাযুদ্ধ। এবারও তাতার বাহিনী পরাস্ত হয়। মুসলমানগণ অঢেল সম্পদ গণীমত হিসাবে লাভ করে। এ যুদ্ধে যে সকল মুসলিম বন্দি তাতারদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ করতে এসেছিল তাদের মুক্ত করা হয়। এ যুদ্ধে বিজয়ের বড় কারণ হিসাবে ধরা হয় তুর্কী নেতা সায়ফুদ্দীন বুগরাক ও খোয়ারিযম শাহের বংশধর মালেক খানকে। তারা মুসলমানদের হয়ে যুদ্ধ করেন। কিন্তু গণীমতের সম্পদ নিয়ে এই দুই নেতার মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এক পর্যায়ে যুদ্ধে রূপ নিলে বুগরাকের ভাই নিহত হন। এতে ক্ষোভে ও দুঃখে বুগরাক যুদ্ধ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। তার সাথে সাথে আরো ত্রিশ হাযার সৈন্য চলে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। জালালুদ্দীন শাহ অবস্থা অনুধাবন করে বুগরাককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এজন্য সবকিছুই করেন। অবশেষে নিজে তার কাছে গিয়ে উপদেশ, আল্লাহর বাণী স্মরণ ও তার সামনে অনুনয় করেও তাকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হ’লেন। ইতিমধ্যে সংবাদ আসল যে, চেঙ্গীস খান বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি মুসলমানদের দুর্বলতার কথা চিন্তা করে ভারতের দিকে রওয়ানা হন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল সিন্ধু নদী। তখন সেখানে কোন জাহাযও ছিল না। এরই মধ্যে তাতার বাহিনী উপস্থিত হয়। মুসলমানেরা নিরূপায় হয়ে যুদ্ধের জন্য কাতারবন্দি হয়। এমন কঠিন ও ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হ’ল যে, পূর্বের যুদ্ধ তাদের কাছে খেল-তামাশা মনে হচ্ছিল। তিনদিন যুদ্ধ চলতে থাকল। ইতিমধ্যে সেনাপতি মালেক খান শাহাদত বরণ করলেন। এতে কাফেররাও চরমভাবে আহত হ’ল। ফলে তারা ময়দান ছেড়ে চলে গেল। মুসলমানেরা এই সুযোগে জাহায যোগে নদী পাড়ি দিল। পরের দিন তাতার বাহিনী নতুন উদ্যমে গযনীতে ফিরে আসল। ময়দান সৈন্য মুক্ত দেখে তারা শহরটি দখল করে নিল। অধিবাসীদের হত্যা, সম্পদ লুণ্ঠন, বৃদ্ধদের বন্দি এবং আগুন দিয়ে শহরটিকে জ্বালিয়ে দিল। শহরটির অবস্থা এমন হ’ল যে, এখানে যেন কোন বসতি বা লোকালয় ছিল না।[39]

খোয়ারিযমের রাজধানীতে তাতার বাহিনী :

খোয়ারিযম শাহের রাজধানী ছিল খোয়ারিযম। যেখানে তার অকুতোভয় বহু বীর সৈনিক অবস্থান করছিল। তাছাড়া রাজধানীবাসীও বীরত্বে প্রসিদ্ধ ছিল। চেঙ্গীস খান সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী বাহিনীকে খোয়ারিযম দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। তারা সেখানে গিয়ে পাঁচ মাস ধরে শহরটিকে অবরোধ করে রাখল। দফায় দফায় ভয়ংকর যুদ্ধ সংঘটিত হ’ল। কিন্তু তারা শহর দখল করতে পারল না। উভয় দলের বহু সৈন্য মারা গেল। অবস্থা করুণ দেখে তাতাররা চেঙ্গীস খানের কাছে সাহায্য চেয়ে পত্র লিখল। চেঙ্গীস খান তাদের সাহায্যে আরেক দল ˆসন্য পাঠিয়ে দিল। তাতার বাহিনী নতুন উদ্যমে হামলা করে শহরের একটি অংশ

দখল করে নিল। শহরবাসী ঐক্যবদ্ধ হামলার মাধ্যমে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হ’ল। যুদ্ধ চলতে থাকল। তাতাররা একটির পর একটি মহল্লা দখল করতে থাকল। এদিকে মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশুরা অধিকৃত মহল্লার পাশে অবস্থান করে যুদ্ধ চালিয়ে গেল। কিন্তু আর কতক্ষণ এই দুর্বল নারী ও শিশুরা যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকবে? এভাবে পুরো শহরটিকে দখল করে ফেলল। এরপর শুরু করল হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা। তারা জায়হূন নদীর শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে দিলে শহর পানিতে ডুবে গেল। এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হ’ল যে, যারা গিরিপথে বা বাড়ির নিভৃত কোণে আত্মগোপন করেছিল তারা সেখানেই পানিতে ডুবে মারা গেল। যারা নিহতদের মধ্যে নিজেকে আত্মগোপন করে রেখেছিল তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল। এরূপ ভয়ংকর ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। না প্রাচীন যুগের ইতিহাসে, না আধুনিক কোন ইতিহাসে। তবে বর্তমানে মিয়ানমার, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, ফিলিস্তীন বা ফিলিপাইনে মুসলমানদের উপর যা করা হচ্ছে তার অনেক কিছুই অভূতপূর্ব। হয়ত একদিন তাতারদের মতই তাদেরই ইতিহাস লিখিত হবে।[40]

[চলবে]


[1]. আল-কামিল ১০/৩৫০-৩৫১; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩১

[2]. বর্তমান ইরানের একটি ঐতিহাসিক শহর। এটি পূর্বে আযারবাইজানের অংশ ছিল। ১৯৯৩ সালে এটি ইরানের অংশ হয়ে যায়।

[3]. বর্তমান আযারবাইজানের একটি শহর, যা রাজধানী বাকু থেকে পশ্চিমে ৪৫০ কি.মি. দূরে অবস্থিত।

[4]. এটি ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৮০৭ কি.মি দূরে অবস্থিত একটি শহর।

[5]. আযারবাইজানের একটি শহর, যা আরদাবীল ও তিবরীযের মধ্যে অবস্থিত।

[6]. আল-কামিল ১০/৩৫২-৩৫৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩২; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৪৪/৪৫; ইয়াকূত আল- হামাবী, মু‘জামুল বুলদান ৩/২০৪

[7]. আযারবাইজানের একটি শহর, যা দারবান্দা শিরাওয়ানের নিকট অবস্থিত।

[8]. আল-কামিল ১০/৩৫২; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩২; মু‘জামুল বুলদান ১/৫৩৩

[9]. এটি আযারবাইজানের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শহর।

[10]. তাফলীস বর্তমানে তিবলীসি নামে পরিচিতি, যা কুরা নদীর তীরে অবস্থিত জর্জিয়ার রাজধানী এবং সবচেয়ে বৃহত্তম শহর।

[11]. আল-কামিল ১০/৩৫৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩২; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৩৫; মু‘জামুল বুলদান ৪/৪৮২

[12]. এটি বর্তমান রাশিয়ার দাবিস্তানের একটি প্রাচীন শহর। আযারবাইজান সীমান্তের উত্তরে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত একটি বড় শহর।

[13]. বর্তমান আযারবাইজানের রাজধানী বাকুর পশ্চিমে ৬৬ মাইল দূরে অবস্থিত একটি বড় শহর।

[14]. আল-কামিল ১০/৩৫৩-৩৫৪; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩২-২৩৩ তারীখুল ইসলাম ৪৪/৪৫; মু‘জামুল বুলদান ৩/৩৬১

[15]. আল-কামিল ১০/৩৫৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩২-২৩৪

[16]. দারবান্দের কাবক পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি প্রশস্ত শহর।

[17]. বালখের একটি নদীর নাম।

[18]. এটি বর্তমান রাশিয়ার নিতাশ নদীর তীরে অবস্থিত একটি শহর।

[19]. আল-কামিল ১০/৩৫৪-৩৫৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০,১০৪; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩২-২৩৪; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৩৯,৪৫-৪৮; মু‘জামুল বুলদান ২/৩৬৪; ইবনু সাঈদ মাগরিবী, আল-জুগরাফিয়া ১/৭০

[20]. আল-কামিল ১০/৩৫৫-৩৫৬; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩৪

[21]. বর্তমান বুলগেরিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। এর পূর্বে কৃষ্ণ সাগর, দক্ষিণে গ্রিস ও তুরস্ক, পশ্চিমে সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও ম্যাসিডোনিয়া এবং রোমানিয়া অবস্থিত। এখানে প্রায় ৭৭ লক্ষ লোকের বাস। সোফিয়া বুলগেরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।

[22]. এটি বর্তমান তুরস্কের একটি শহর।

[23]. আল-কামিল ১০/৩৫৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩৪; মু‘জামুল বুলদান ১/১৮২

[24]. বর্তমান উযবেকিস্তানের একটি শহর ও উপত্যকার নাম। ৯৪ হিজরীতে উমাইয়া খলীফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালেক শহরটি জয় করেন।

[25]. বর্তমান মালির দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহরের নাম।

[26]. বালখ (ওয়াযীরাবাদ নামেও পরিচিত) উত্তর আফগানিস্তানে অবস্থিত একটি শহর। যদিও বালখ বর্তমানে একটি ছোট শহর, কিন্তু প্রাচীনকালে এটি একটি বড় শহর ছিল।

[27]. আল-কামিল ১০/৩৫৩

[28]. বর্তমান ইরানের আলবিরুয যেলার একটি শহর।

[29]. আল-কামিল ১০/৩৫৭; আল-বিদায়াহ ১৩/৯০; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৫১

[30]. এটি মধ্য এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মরুদ্যান শহর ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, দ্বাদশ শতকে সংক্ষিপ্তকালের জন্য মার্ভ বিশ্বের বৃহত্তম শহর ছিল।

[31]. আল-কামিল ১০/৩৫৩

[32]. ঐ ১০/৩৫৫, তারীখুল ইসলাম ৪৪/৫২; আল-বিদায়াহ ১৩/৯১

[33]. আল-কামিল ১০/৩৫৬

[34]. ইরানের একটি প্রাচীন শহর।

[35]. আল-কামিল ১০/৩৫৬ আল-বিদায়াহ ১৩/৯১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩৪; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৫২

[36]. আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রদেশ।

[37]. আল-কামিল ১০/৬০; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৫২

[38]. এটি পূর্ব আফগানিস্তানের একটি শহর ও গযনী প্রদেশের রাজধানী। শহরটি সমুদ্র সমতল থেকে ২২২০ মিটার উচ্চতায় একটি মালভূমির উপর অবস্থিত।

[39]. আল-কামিল ১০/৩৫৭; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৫৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৯১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩৬-২৩৭

[40]. আল-কামিল ১০/৩৬১; তারীখুল ইসলাম ৪৪/৫৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৯১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩৫-৩৬)মিরআতুল জিনান ৪/৪০৪১; তারীখ ইবনু খালদূন ৩/৫৩৪-৫৩৫; তারীখুল খুলাফা ১/৪৬৭-৪৭০।





বিরোধীদের প্রতি ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর ক্ষমাসুন্দর আচরণ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ধৈর্যের অনন্য দৃষ্টান্ত - আবু রাযিয়া, নিয়ামতপুর, নওগাঁ
একজন কৃষ্ণকায় দাসের পরহেযগারিতা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
সততা ও ক্ষমাশীলতার বিরল দৃষ্টান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইসলামী শাসনের একটি নমুনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
অভাবী গভর্ণরের অনুপম দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
তাতারদরে আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দিলালপুর : আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র - এডভোকেট জারজিস আহমাদ
নীলনদের প্রতি ওমর (রাঃ)-এর পত্র - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর জীবনী থেকে কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
খলীফা ওমর (রাঃ)-এর অনুশোচনা
আবু দাহদাহ (রাঃ)-এর দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.