তাতারদের বিজয়াভিযান ও ধ্বংসলীলা :
লোকেরা তাতারদের বাগদাদ ধ্বংসের কথা জানলেও এর পূর্বে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা ও বহু শহরকে ধ্বংস করার ঘটনা অনেকে জানে না। তারা বহু শহর ধ্বংস ও দখল করে। অতঃপর তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ দখল করে। বাগদাদে পৌঁছার পূর্বে তারা যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তার ভয়াবহতা সম্পর্কে ইবনুল আছীর (রহঃ) আক্ষেপ করে বলেছিলেন,فَيَا لَيْتَ أُمِّي لَمْ تَلِدْنِي، وَيَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ حُدُوثِهَا وَكُنْتُ نَسْيًا مَنْسِيًّا ‘হায়! আমার মা যদি আমাকে জন্ম না দিতেন! হায়! আমি যদি এই ঘটনার পূর্বে মৃত্যুবরণ করতাম এবং একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম’।[1] বিশ্ববিজেতা আলেকজান্ডারও এত দ্রুত বিশ্ব জয় করতে পারেননি। তিনি বিশ্ব জয় করেন প্রায় দশ বছরে। এতে তিনি কাউকে হত্যা করেননি। লোকেরা তার আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। আর তাতাররা পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রকে মাত্র এক বছরে দখল করে নেয়।[2]
ইবনুল হাদীদ বলেন, তাতারদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আমরা তা স্বচক্ষে দেখেছি এবং আমাদের সময়ে তা ঘটেছে। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই লোকেরা এরূপ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে এটি আমাদের যুগে এসে বাস্তবায়িত হ’ল।[3] তাতার বাহিনী যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তা মানব ইতিহাসে বিরল। তারা প্রথমে মুসলিম বিশ্বের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করেনি। কিন্তু কতিপয় মুসলিম নেতার অতিলোভ ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তারা মুসলিম বিশ্বের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। তাতাররা পূর্ব চীন সীমান্তের কাছে ত্বামগাজা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করত। তাদের ও মুসলিম বিশ্বের মাঝে ছয় মাস পথের দূরত্ব ছিল।[4] খোয়ারিযম শাহ মুহাম্মাদ বিন তুকুস মা-ওয়ারাউন নাহার (বর্তমান আফগানিস্তান ও কাযাকিস্তান) রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হয়েই আশ-পাশের শহরগুলো দখল করে নেন এবং এর নেতাদের হত্যা করেন। শহরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- বুখারা, সামারকান্দ[5], বালাসাগুন[6], কাশগড়[7] প্রভৃতি। এ শহরগুলো মূলতঃ মুসলমান ও তাতারদের মধ্যে একটি বড় প্রতিবন্ধক ছিল। কিন্তু এর শাসকদের হত্যা করা হ’লে পুরো এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব চলে আসে খোয়ারিযম শাহের উপর। যা সামাল দেওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কাশগড় ও বালাসাগুনের নেতারা খোয়ারিযম শাহের ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তাদের বিশ হাযারের একটি দল সমবেত হয়। যারা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিল। যারা একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ছিল। তারা তুর্কিস্তানে চলে যায়। সেখানে খোয়ারিযম শাহের সৈন্য ও কর্মকর্তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বহু শহর দখল করে নেয়। খোয়ারিযম শাহের অবশিষ্ট সৈন্যরা ফিরে আসে এবং তারা তাতারদের হাত থেকে রক্ষা পায়। এক্ষেত্রে তিনি ধৈর্যধারণ করেন। তাছাড়া তিনি দেখলেন যে, সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে তার রাজ্য বিস্তার সম্ভব নয়। এজন্য তিনি তুর্কিস্তানকে তাদের জন্য ছেড়ে দেন। তিনি দৃঢ়ভাবে এটি স্থির করে নেন যে, তুর্কিস্তান তাদের জন্যই। আর এটা ব্যতীত মা-ওয়ারাউন নাহারের অন্যান্য রাজ্য যেমন সামারকান্দ, বুখারা এবং অন্যান্য রাজ্যসমূহ খোয়ারিযম শাহের জন্য। এভাবে চার চারটি বছর অতিক্রান্ত হ’ল। অপরদিকে চেঙ্গীস খান চিন্তা করে দেখলেন যে, তাতারদের একটি অংশের নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ড নেই। তিনি রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হ’লেন। তিনি সকলের নেতা হওয়ার মনস্কামনা করলেন। শুরু হ’ল বিজয়াভিযান। চীন সীমান্তে বসবাসরত সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে অভিযানে নেমে পড়লেন। অবশেষে তারা তুর্কিস্তানের সীমান্তে পৌঁছে যান এবং তথাকার সীমান্ত রক্ষীদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয় লাভ করেন।[8]
তাতার ব্যবসায়ীদের হত্যা :
তাতার নেতা চেঙ্গীস খান নিজ এলাকা ছেড়ে তুর্কিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। অন্য দিকে ব্যবসায়ী ও তুর্কীদের একটি দল স্বর্ণ-রৌপ্যসহ পরিধেয় বস্ত্র ক্রয়ের জন্য সামারকান্দ ও বুখারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। কোন বর্ণনায় রয়েছে, চেঙ্গীস খান তার নিজের ও পরিবার- পরিজনের জন্য পোশাকাদি ক্রয় করার জন্য ব্যবসায়ীদের পাঠিয়েছিলেন। তারা খোয়ারিযম শাহের দখলকৃত সর্বশেষ শহর আওয়াতুরারে অবস্থান গ্রহণ করে। এদের গমন সম্পর্কে জানতে পেরে তথাকার গভর্নর তাদের ব্যাপারে করণীয় জানতে চেয়ে খোয়ারিযম শাহের নিকট পত্র লিখেন। তিনি তাতে এও লিখেন যে, তাদের নিকট বহু অর্থ-সম্পদ রয়েছে। তিনি এ সংবাদ জানতে পেরে গভর্নরকে নির্দেশ দেন যে, ব্যবসায়ীদের হত্যা করে তাদের সাথে থাকা যাবতীয় সম্পদ তার নিকট পাঠিয়ে দিবে। গভর্নর তাই করলেন। খোয়ারিযম শাহের নিকট সেগুলো পৌঁছলে তিনি তা বুখারা ও সামারকান্দের ব্যবসায়ীদের মাঝে বিতরণ করে তার কিছু মূল্য নিজেও নিলেন। এদের হত্যা করে খোয়ারিযম শাহ তাতার গোষ্ঠী ও তাদের নেতা, তাদের সংখ্যা, তাদের সাথে থাকা তুর্কীদের পরিমাণ ও তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য গোয়েন্দা প্রেরণ করেন। গোয়েন্দারা দীর্ঘ দিন পর ফিরে এসে সংবাদ দিল যে, তারা সংখ্যায় অগণিত, যুদ্ধে অকুতোভয়, আল্লাহর সৃষ্টি জগতে মহা ধৈর্যশীল ও অপরাজিত। তারা নিজেরাই স্বহস্তে অস্ত্র তৈরী করে। এই বর্ণনা শুনার পর খোয়ারিযম শাহ ব্যবসায়ীদের হত্যা ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করার কথা স্মরণ করে লজ্জিত হ’লেন।[9] তিনি বিমর্ষ হয়ে তাঁর আস্থাভাজন বিশিষ্ট ফকীহ ও চিন্তাবিদ শিহাব খুয়ূফীর (الشِّهَابُ الْخُيُوفِي) নিকট গমন করে তার নিকট করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ চেয়ে বললেন, বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য সুচিন্তিত পরামর্শের প্রয়োজন। কারণ বিশাল তাতার বাহিনী আমাদের দেশে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। ফক্বীহ ছাহেব পরামর্শ দিলেন, আমাদের সৈন্যও তো অনেক। আমরা সৈন্য সমাবেশ ঘটাব এবং যুদ্ধ যাত্রায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ বৈধ করে দিব। আপনাকে জান-মাল দিয়ে সাহায্য করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হয়ে যাবে। অতঃপর সকল সৈন্যকে সাথে নিয়ে সায়হুন[10] (سَيْحُونَ) নদীর তীরে অবস্থান গ্রহণ করব। এরপর নদী পাড়ি দিয়ে শত্রুরা আগমন করলে আমরা তাদের প্রতিহত করব। তারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে থাকবে। আর আমরা নিজ ভূমিতে আরামে থেকে যুদ্ধ করব। অবশেষে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে। পরামর্শ শুনে খোয়ারিযম শাহ তার মন্ত্রীবর্গ ও সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। তাদের কাছে পরামর্শ চাইলে নেতারা ফকীহ ছাহেবের বিপরীত পরামর্শ দিল। তারা বলল, আমরা তাদের নদী পাড়ি দিয়ে তীরে উঠতে দিব। তারা এই সংকীর্ণ ভূমি ও পাহাড় অতিক্রম করবে। তারা পথ সম্পর্কে অজ্ঞাত। আর আমরা পূর্ণ জ্ঞাত। আমরা সুযোগ বুঝে তাদের উপর হামলা করতে পারব।[11]
চেঙ্গীস খানের দূতকে হত্যা :
আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্যেই চেঙ্গীস খানের দূত একদল গোয়েন্দা নিয়ে হাযির। যারা খোয়ারিযম শাহকে ধমকিয়ে বলছিল, তোমরা আমাদের সাথী ও ব্যবসায়ীদের হত্যা করেছ। তাদের থেকে আমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছ! যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর। আমরা তোমাদের নিকট এমন সৈন্য বাহিনী নিয়ে আগমন করব যা তোমরা ইতিপূর্বে দেখনি। অপরদিকে চেঙ্গীস খান তুর্কিস্তানের দিকে অভিযান পরিচালনা করে কাশগড়, বেলাসাগূন, এবং অত্র অঞ্চলের সকল শহর দখল করে পূর্ব থেকে দখলকারী আরেকটি তাতার গোষ্ঠীকে অপসারণ করেন। খোয়ারিযম শাহ এসকল সংবাদ জানতে পেরে চেঙ্গীস খানের দূতকে হত্যা করেন এবং সাথে থাকা গোয়েন্দাদের দাড়ী মুন্ডন করে পাঠিয়ে দেন। তাতার গোয়েন্দাদের এ সংবাদ দিয়ে চেঙ্গীস খানের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয় যে, হে চেঙ্গীস খান! খোয়ারিযম শাহ আপনাকে বলেছেন যে,أَنَا سَائِرٌ إِلَيْكَ وَلَوْ أَنَّكَ فِي آخِرِ الدُّنْيَا، حَتَّى أَنْتَقِمَ، وَأَفْعَلَ بِكَ كَمَا فَعَلْتُ بِأَصْحَابِكَ ‘আপনি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে অবস্থান করলেও আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রতিশোধ নিব। আপনার সাথে সেই আচরণই করব যে আচরণ আপনার সাথীদের সাথে করেছি’। অর্থাৎ আপনাকে হত্যা করা হবে।[12] খোয়ারিযম শাহ প্রস্ত্ততি নিলেন। সৈন্য নিয়ে দ্রুত চীনের পথে রওয়ানা দিলেন। চার মাসের পথ অতিক্রম করে তাদের আবাসভূমিতে পৌঁছে গেলেন। কিন্তু নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের ব্যতীত কাউকে সেখানে পেলেন না। তাদের উপর হামলা করে বহু গণীমতের সম্পদ হস্তগত করলেন এবং নারী ও শিশুদের বন্দি করলেন। তাতারদের বাড়িতে না থাকার কারণ হ’ল- তারা তুর্কী শাসক কেশলুখানের বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়েছিল। তারা তুর্কীদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করে এবং বহু গণীমতের মাল লাভ করে। তারা বাড়ি ফিরার পথে মুসলমানদের আগমন ও নারী-শিশুদের বন্দির কথা জানতে পারে। দ্রুত পথ চলা শুরু করলে তারা মুসলমানদের তাদের আবাস ভূমিতে পেয়ে যায়। মুসলমানরা তাদের আগমনের কথা জানতে পেরে সেখানেই যুদ্ধের জন্য কাতার বন্দি হয়ে গেল। উভয় দলের মধ্যে ইতিহাসের এক ভয়াবহ ও অশ্রুতপূর্ব যুদ্ধ সংঘটিত হ’ল। তিনদিন তিনরাত অনবরত যুদ্ধ চলতে থাকলেও জয়-পরাজয়ের ফলাফল নিশ্চিত হ’ল না। কিন্তু উভয় পক্ষের অসংখ্য সৈন্য নিহত হ’ল। মুসলমানগণ তাদের দ্বীন রক্ষার্থে এবং পরাজয় হ’লে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে একথা ভেবে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিলেন। অপরদিকে তাতাররা তাদের পরিবার-পরিজন ও সম্পদ রক্ষার্থে যুদ্ধে চরম ধৈর্যের পরিচয় দেয়। যুদ্ধ এমন কঠিন রূপ ধারণ করে যে, তাদের অনেকে স্বীয় ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে থাকে এবং পরস্পরকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। এতে আহত-নিহতদের রক্ত মাটিতে গড়াতে থাকে। রক্ত প্রবাহিত হয়ে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় ঘোড়া পিছলিয়ে যাচ্ছিল। উভয় দলের সৈন্যদের শক্তি ও ধৈর্য নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দেশ-জাতি ও সম্মান রক্ষার লড়াই থেকে কেউ পিছপা হচ্ছিল না। এই যুদ্ধে তাতারদের নেতৃতব দিচ্ছিল চেঙ্গীস খানের ছেলে। চেঙ্গীস খান এ যুদ্ধ সম্পর্কে জানতেন না এবং তিনি তা অনুভব করতেও পারেননি। কারণ এ সময় তিনি কেশলুখানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এ যুদ্ধে প্রায় বিশ হাযার মুসলিম শাহাদত বরণ করেন এবং অসংখ্য কাফের নিহত হয়।[13] চতুর্থ রাতে প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। কারণ উভয় পক্ষই যুদ্ধকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। রাত্রি গভীর হ’লে উভয় দলের সৈন্যরা আলো জ্বালিয়ে স্বঅবস্থানে ফিরে গেল। এরপর তাতাররা তাদের আধ্যাতিক নেতা চেঙ্গীস খানের নিকট ফিরে গেল। মুসলমানগণও বুখারায় ফিরে এসে তাতারদের অবরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করল। কারণ যেখানে চেঙ্গীস খানের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও খোয়ারিযম শাহের সৈন্যরা বিজয় লাভ করতে পারল না সেখানে চেঙ্গীস খান নিজে তার সকল সৈন্য নিয়ে মুসলিম সম্রাজ্যে প্রবেশ করলে তাদের ঠেকানো অসম্ভব। খোয়ারিযম শাহ বুখারা ও সামারকান্দবাসীকে অবরোধের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে বললেন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহে রাখার পরামর্শ দিলেন। এরপর বুখারা ও সামারকান্দ হেফাযতের জন্য বুখারায় বিশ হাযার ও সামারকান্দে পঞ্চাশ হাযার সৈন্য মোতায়েন করে বললেন, احْفَظُوا الْبَلَدَ حَتَّى أَعُودَ إِلَى خُوَارَزْمَ وَخُرَاسَانَ وَأَجْمَعَ الْعَسَاكِرَ وَأَسْتَنْجِدَ بِالْمُسْلِمِينَ وَأَعُودَ إِلَيْكُمْ ‘তোমরা দেশকে হেফাযত করবে যতক্ষণ না আমরা খোয়ারিযম ও খোরাসানে ফিরে এসে সৈন্য সমাবেশ ঘটাই এবং মুসলমানদের সাহায্য চেয়ে তোমাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করি’।[14] এভাবে উপদেশ দিয়ে তিনি খোরাসানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি জায়হুন (جَيْحُونَ) নদী পাড়ি দিয়ে বালখের সন্নিকটে সৈন্য সমাবেশ ঘটালেন।[15]
বুখারা ধ্বংসে তাতার বাহিনী :
অন্যদিকে তাতার বাহিনী চেঙ্গীস খানের নেতৃত্বে পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে মুসলিম সম্রাজ্যে প্রবেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। খোয়ারিযম শাহের বুখারায় পৌঁছার পাঁচ মাস পর তারা সেখানে উপস্থিত হ’ল। তারা শহরকে অবরোধ করে ফেলল। মুসলিম সৈন্যরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হ’ল। তিন দিন অনবরত কঠিন যুদ্ধ চলল। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা তাতার বাহিনীর সামনে টিকে থাকতে পারল না। তারা শহর ছেড়ে রাতের অন্ধকারে খোরাসানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। সকাল হ’লে শহরবাসী লক্ষ্য করে দেখল যে, কোন মুসলিম সৈন্য নেই। নিরূপায় হয়ে তারা কাযী বদরুদ্দীন খানকে (بَدْرُ الدِّينِ قَاضِي خَانْ) নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তাতার বাহিনীর কাছে প্রেরণ করল। তারা জনগণের নিরাপত্তা প্রদান করল। কিছু মুসলিম সৈন্য যারা পলায়নে সক্ষম হয়নি তারা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করল। জনগণের নিরাপত্তার কথা শ্রবণ করে তারাও বাইরে বেরিয়ে আসল এবং ৬১৬ হিজরী সনের ৪ই যিলহজ্জ সোমবার শহরের মূল ফটক উন্মুক্ত করে দিল। এরপর কাফেররা বিনা বাধায় বুখারায় প্রবেশ করল। তারা প্রবেশকালীন সময়ে মুসলমানদের সাথে কৃত্রিম ন্যায়পরায়ণতা ও সুন্দর আচরণ প্রদর্শন করল। যদিও তাদের ভিতরে বিরাট দুরভিসন্ধি ছিল। বরং তারা তখন বলছিল, সুলতানের যে সকল সম্পদ তোমাদের নিকট আছে তার সবগুলো আমাদের নিকটে জমা কর। দুর্গে অবস্থানকারী সৈন্যদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সহায়তা কর। চেঙ্গীস খান নিজে শহরে প্রবেশ করে দুর্গ অবরোধ করলেন। তিনি শহরবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, بِأَنْ لَا يَتَخَلَّفَ أَحَدٌ وَمَنْ تَخَلَّفَ قُتِلَ ‘কেউ পশ্চাৎগামী হবে না। যে ব্যক্তি পশ্চাৎগামী হবে তাকে হত্যা করা হবে’ অর্থাৎ এখানে সবাই উপস্থিত হবে। অন্যথা হত্যা করা হবে। সকলে উপস্থিত হ’লে তিনি তাদেরকে গভীর গর্ত খনন করতে নির্দেশ দেন। তারা কাঠ, শক্ত মাটি ইত্যাদি দ্বারা গর্ত খনন করলে কাফেররা মসজিদের মিম্বার ও মুসলমানদের ঘরে থাকা কুরআনের অংশগুলো এনে গর্তে নিক্ষেপ করে। ইন্না লিল্লাহ! আল্লাহ ধৈর্যশীল ও সহনশীল না হ’লে ভূমি ধ্বসিয়ে তাদের ধ্বংস করে দিতেন।[16] এরপর তারা দুর্গের দিকে মনোনিবেশ করে। সেখানে চারশত অশ্বারোহী মুসলিম সৈন্য অবস্থান করছিল। তারা বারো দিন অক্লান্ত চেষ্টা করে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখল। তাতারদের কিছু সৈন্যও নিহত হ’ল। কিন্তু তারা আক্রমণ অব্যাহত রাখলে মুসলিম সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। অবশেষে তারা সামনে অগ্রসর হয় এবং তাদের বিশেষ বাহিনী দুর্গের প্রাচীরের নিকট পৌঁছতে সক্ষম হয়। এরপর প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। কিছুক্ষণ পরে মুসলিম সৈন্যরা তাদের সাথে থাকা পাথর, আগুন ও তীর তাতারদের সামনে নিক্ষেপ করে। এতে অভিশপ্তরা রাগান্বিত হয়ে সেদিনের মত যুদ্ধ বন্ধ করে। পরের দিন নতুন করে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু দুর্গে অবস্থানকারী মুসলিম সৈন্যরা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ায় বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। কাফেররা প্রচন্ড হামলা চালিয়ে দুর্গে প্রবেশ করল। মুসলমানদের শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে শাহাদত বরণ করল। এরপর স্থানীয় ব্যবসায়ী ও নেতাদের উপস্থিত হ’তে নির্দেশ দেওয়া হ’ল। তারা উপস্থিত হ’লে চেঙ্গীস খান তাদেরকে বললেন,أُرِيدُ مِنْكُمُ النُّقْرَةَ الَّتِي بَاعَكُمْ خُوَارَزْم شَاهْ، فَإِنَّهَا لِي، وَمِنْ أَصْحَابِي أُخِذَتْ، وَهِيَ عِنْدَكُمْ ‘আমি তোমাদের থেকে ঐ স্বর্ণ-রৌপ্য চাই, যেগুলো খোয়ারিযম শাহ তোমাদের নিকট বিক্রয় করেছেন। কেননা সেগুলো আমার ও আমার সাথীদের থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেগুলো এখন তোমাদের নিকট’।[17] এই নির্দেশের পর যার নিকট যা ছিল তা তার সামনে হাযির করল। এরপর তাদের সম্বলহীন অবস্থায় শহর ছেড়ে চলে যেতে বলা হ’ল। মুসলিম জনগণ এমন অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হ’ল যে, তাদের পরণের কাপড় ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। এবার কাফেররা তাদের শহরে প্রবেশ করে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে যাদেরকে গৃহে পেল তাদের হত্যা করে সকল সম্পদ লুটে নিল। এরপর অসহায় সম্বলহীন মুসলমানদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। অতঃপর তাদেরকে হত্যা করার জন্য নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিল। সেদিন ছিল মুসলমানদের জন্য এক কঠিন দিন। সর্বত্র কান্নার রোল পড়ে গেল। তারা বুখারা নগরীতে তান্ডব লীলা চালালো। শহর এমনভাবে ধ্বংস করল যেন এখানে কোন শহর ছিল না।[18] শহরে আগুন লাগিয়ে ঘর-বাড়ি, মসজিদ, মাদরাসা পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। ফলে ইবাদত-বন্দেগী ও জ্ঞান অর্জনের সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারা নারীদেরও ভাগ করে নিল। বাবার সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করা হচ্ছিল। বাধা দেওয়ার মত ক্ষমতা মুসলমানদের ছিল না। তদুপরি অনেকে বাধা দিতে গিয়ে কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং অবশেষে শাহাদতের অমিয় শুধা পান করেন। আবার অনেকে মুসলমানদের দুরবস্থা দেখে মৃত্যু কামনা করছিলেন।[19]
সামারকান্দের পথে রওয়ানা :
তাতার বাহিনী বুখারা ধ্বংস করে সামারকান্দের পথে রওয়ানা হয়। সাথে নেয় মুসলিম বন্দিদের। উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে অন্য মুসলমানদের ভয় দেখানো। তারা বালখ ও তিরমীযের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নেয়। মুসলিম বন্দিদের কঠিন যন্ত্রণা দিয়ে নির্মমভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। যারা তাদের সাথে হেঁটে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে বা অক্ষম হয় তাদেরকে হত্যা করে। সামারকান্দের সন্নিকটে পৌঁছে তারা প্রথমে অশ্বারোহীদের পাঠিয়ে দেয় এবং পদাতিক, বন্দি ও বৃদ্ধদের পিছনে রেখে দেয়। এরপর দলে দলে তাদের পাঠাতে থাকে। যাতে মুসলমানদের হৃদয়ে ভীতি সঞ্চারিত হয়। দ্বিতীয় দিন তারা শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছল। প্রত্যেক দশজন বন্দির হাতে একটি করে পতাকা তুলে দিল। এতে শহরবাসী মনে করল তাদের প্রত্যেকেই যোদ্ধা। তারা শহর অবরোধ করল। তখন সেখানে খোয়ারিযম শাহের পঞ্চাশ হাযার সৈন্য অবস্থান করছিল। তাছাড়া অসংখ্য জনগণ তাতারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্ত্তত ছিল। কিন্তু সৈন্যদের কেউ ভয়ে তাতারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামল না। সাধারণ জনগণের মধ্যে বীর পুরুষেরা যার কাছে যা ছিল তা নিয়ে তাতারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচন্ড যুদ্ধ করে তাতারদের পিছু হটাতে সক্ষম হ’ল। কিন্তু জনগণ তাতারদের পাতানো ফাঁদে আঁটকে পড়ল। তারা যখন যুদ্ধ করতে করতে গ্রামের বাইরে মাঠে গিয়ে উপনীত হ’ল। তখন তাতারদের পিছনে থাকা অশ্বারোহী সৈন্যরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। সেখানে প্রচন্ড যুদ্ধে প্রায় সত্তর হাযার জনগণ শাহাদত বরণ করল। এ অবস্থা দেখে খোয়ারিযম শাহের সৈন্যরা আরো ভীত-সন্ত্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ল। সৈন্যদের অবস্থা দেখে সাধারণ জনতা ভীত-বিহবল হয়ে পড়ল। এদিকে সৈন্যরাও নিজেদের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল। তারা বলাবলি করছিল যে, আমরা সৈন্য হওয়া সত্ত্বেও আমাদেরকে তাতাররা হত্যা করল না! আমরাওতো তুর্কী, ফলে তারা তাদের নিকট নিরাপত্তার আবেদন করল। তারা মুসলমানদের হত্যার বিষয়টি গোপন রেখে প্রকাশ্যে নিরাপত্তা দান করল। এরপর শহরের দরজা খুলে দেওয়া হ’ল। জনগণ পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ সাথে নিয়ে কাফেরদের সামনে বেরিয়ে আসল। কাফেররা তখন তাদেরকে বলল, তোমাদের অস্ত্র, ধন-সম্পদ ও বাহন আমাদের কাছে সমর্পণ কর। আমরা তোমাদেরকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিব। মুসলমানরা তাই করল। তাদের অস্ত্র ও বাহন হস্তগত হ’লে তাতাররা হত্যাকান্ড শুরু করে দিল। মুসলমান পুরুষদের হত্যা ও নারীদেরকে বন্দি করা হ’ল। চতুর্থ দিন তারা শহরে ঘোষণা করল যে, প্রত্যেকে যেন স্বপরিবারে বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। এরপরেও যারা বাড়িতে অবস্থান করবে তাদেরকে হত্যা করা হবে। ভয়ে সকল নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাইরে বেরিয়ে আসল। তাতাররা সামারকান্দবাসীর সাথে ঐ আচরণ করল যা করেছিল বুখারাবাসীর সাথে। তারা শহরে প্রবেশ করে সকল সম্পদ লুণ্ঠন করল এবং মসজিদ ও প্রতিষ্ঠান সমূহে আগুন লাগিয়ে দিল। এই নিষ্ঠুর জাতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও হত্যা করল। ইতিহাসের এ নির্মম ঘটনা ঘটে ৬১৭ হিজরী সালের মুহাররম মাসে।[20]
খোয়ারিযম শাহের পরাজয় ও মৃত্যু :
খোয়ারিযম শাহ সামারকান্দবাসীকে সাহায্য করার জন্য প্রথমে দশ হাজার ও পরে বিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য প্রেরণ করেন কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। চেঙ্গীস খান সামারকান্দ দখল করে খোয়ারিযম শাহের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি সৈন্যদের মাঝে ঘোষণা দেন যে,اطْلُبُوا خُوَارَزْم شَاهْ أَيْنَ كَانَ، وَلَوْ تَعَلَّقَ بِالسَّمَاءِ، حَتَّى تُدْرِكُوهُ وَتَأْخُذُوهُ ‘তোমরা খোয়ারিযম শাহকে খোঁজে বের কর যেখানে অবস্থান করুক তিনি, আকাশে ঝুলে থাকলেও তোমরা তার কাছে পৌঁছবে এবং তাকে পাকড়াও করবে’। তাতারদের এই দলটিকে মুগার্রিবাহ (الْمُغَرِّبَةَ) বলা হয়। কারণ তারা খোরাসানের পশ্চিম অঞ্চলে অভিযানে বেরিয়েছিল।[21] তারা গোয়েন্দা সূত্রে খোয়ারিযম শাহের অবস্থান জানতে পেরে বাঞ্জাআব্[22] (بَنْجَ آبَ) নামক স্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা নদী পাড়ি দেওয়ার নৌকা না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। তবে তারা বসে থাকেনি। তারা কাঠ দিয়ে একটি হাওয তৈরি করে তাতে গরুর চামড়া পরিয়ে দিল। যাতে তাতে পানি প্রবেশ না করে। এরপর তার মধ্যে তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য আসবাব পত্র রেখে দেয়। তারপর হাওযকে নিজেদের সাথে বেঁধে দেয় এবং নিজেরা ঘোড়ার লেজ ধরে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে তারা একবারেই নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।[23] প্রথমে খোয়ারিযম শাহ তাদের উপস্থিতি বুঝতে পারেননি। ভীত-সন্ত্রস্ত মুসলিম বাহিনী তাতারদের প্রতিহত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পলায়ন করে। খোয়ারিযম শাহ আত্মরক্ষা করতে তার বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে নিসাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তাতাররাও তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকে। সেখানেও মুসলমানেরা তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। তিনি জীবন রক্ষার জন্য তার শাসিত মাযান্দারানের[24] পথে রওয়ানা দেন। তাতার বাহিনীও তার পিছু পিছু রওয়ানা দেয়। এরপর তিনি তাবারিস্তানের মারসায় উপনীত হন। সেখানে তিনি সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে জাহাজে আরোহণ করেন। তাতাররা তাদের পিছু নেয় কিন্তু নাগাল না পেয়ে ফিরে আসে। নদীর তীরে একটি সুরক্ষিত দুর্গ ছিল যেখানে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন। আর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। অবশেষে তাতার বাহিনী খোয়ারিযম শাহের সাক্ষাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।[25] তবে ড. হাসান ইবরাহীম হাসান ইবনুল আছীরের বরাতে বলেন, খোয়ারিযম শাহ তাতারদের ভয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে আশ্রয় নিতে থাকেন। কিন্তু তাতাররা তার পিছু ছাড়েনি। এমনকি তিনি রায় অতঃপর হামাদান হয়ে ইরাক সীমান্তে পলায়ন করেন।[26] কেউ কেউ বলেন, তিনি নদীতে ডুবে মারা যান। আবার কেউ বলেন, তিনি ভারত বর্ষে চলে আসেন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়।[27] তবে সঠিক কথা হ’ল তাতারদের ভয়ে তার সার্বিক অবস্থানকে গোপন রাখা হয়।
খোয়ারিযম শাহ্ সম্পর্কে কিছু কথা :
তার নাম আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন তিকাশ। তিনি প্রায় বাইশ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি নিজে একজন আলেম ছিলেন এবং আলেমদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। তিনি ফিক্বহ, উছূলসহ বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। বিশেষতঃ তিনি হানাফী ফিক্বহে ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন। তার রাজত্ব প্রায় অর্ধেক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ তিনি সর্বাবস্থায় এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সুলজূকী শাসনের পর তার মতো বিস্তৃত ভূমির অধিকারী আর কেউ হয়নি। ইরাক থেকে তুর্কিস্তান পর্যন্ত এবং আফগানিস্তানের গযনী, ভারতের কিছু অংশ, সিজিস্তান[28], কারমান[29], ত্বাবারিস্তান, জুরজান, বিলাদুল জিবাল, খোরাসান ও পারস্যের কিছু অংশসহ তিনি বহু এলাকার অধিকারী হন। এই অঞ্চলগুলো তার প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পরিচালিত হ’ত।[30] তিনি হানাফীদের জন্য বিরাট একটি মাদরাসাও নির্মাণ করে দেন।[31]
মাযান্দারান দখল ও অধিবাসীদের হত্যা :
তাতার মুগাররিবা বাহিনী খোয়ারিযম শাহকে পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়ে তার খোঁজে ও মাযান্দারান দখলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। খোয়ারিযম শাহ তাদের উপস্থিতি জানতে পেরে শহর ত্যাগ করে রায়ে চলে যান। তারা একধরনের বিনা বাধায় শহরটি দখল করে নেয়। এ শহরটিতে মুসলমানদের আধিপত্য থাকলেও তারা কোন সময় শহরটির দেখভাল করত না। তাতার বাহিনী শহরটি দখল করে কাউকে হত্যা কাউকে বন্দি এবং গচ্ছিত সম্পদ লুণ্ঠন করে। অতঃপর শহরে আগুন লাগিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়।[32]
রায় নগরের পথে তাতার বাহিনী :
মাযান্দারান ধ্বংস ও দখল করে তাতার বাহিনী রায়ের পথে রওয়ানা দেয়। পথে তারা বাদশাহ খোয়ারিযম শাহের মা, স্ত্রী ও অঢেল সম্পদের সন্ধান পেয়ে যায়। এ সময় খোয়ারিযম শাহের মা ছেলের করুণ অবস্থা অবলোকন করে আত্মরক্ষার্থে বাসভবন ছেড়ে হামাদান ও ইস্ফাহানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তারা তাতার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এত পরিমাণ সম্পদ তারা পেয়েছিল যে, তা দেখে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় এবং হৃদয় ভরে যায়। এরূপ দুর্লভ ও মূল্যবান বস্ত্ত তারা ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। এসকল সম্পদ তারা চেঙ্গীস খানের নিকট পাঠিয়ে দেয়।[33] ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,ثُمَّ تَرَحَّلُوا عَنْهَا نَحْوَ الرَّيِّ فَوَجَدُوا فِي الطَّرِيقِ أُمَّ خُوَارَزْمَ شَاهْ وَمَعَهَا أَمْوَالٌ عَظِيمَةٌ جِدًّا، فَأَخَذُوهَا وَفِيهَا كُلُّ غَرِيبٍ وَنَفِيسٍ مِمَّا لَمْ يُشَاهَدْ مِثْلُهُ مِنَ الْجَوَاهِرِ وَغَيْرِهَا ‘এরপর তারা রায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় এবং রাস্তায় খোয়ারিযম শাহের মাকে পেয়ে যায়। যার সাথে অঢেল সম্পদ ছিল। সেগুলো তারা নিয়ে নেয়। যাতে প্রত্যেক মূল্যবান ও দুর্লভ মনি-মুক্তার মত বহু সম্পদ ছিল যা পূর্বে দেখা যায়নি।[34]
রায় ও হামাদানে তাতার বাহিনী :
৬১৭ হিজরী সালে তাতার বাহিনী রায় শহরে পৌঁছে যায়। উদ্দেশ্য খোয়ারিযম শাহকে খোঁজে বের করা। তাতার বাহিনীর সাথে স্বার্থান্বেষী কিছু মুসলিম সৈন্য ও সাধারণ দুবৃত্তরাও অংশগ্রহণ করে। যারা সম্পদের আশায় তাতারদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। তারা এমন সময় রায়ে প্রবেশ করে যখন জনতা স্বীয় কর্মে ব্যস্ত। কেউবা ঘুমিয়ে দিনের ক্লান্তি দূর করছিল। তারা তাতারদের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে অনুভব করতেও পারেনি। তারা শহরে প্রবেশ করে সম্পদ লুণ্ঠন, নারীদের বন্দি, শিশুদের চুরি এবং পুরুষদের হত্যা করে। তারা শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে দ্রুত হামাদানের পথে রওয়ানা হয়। সেখানেও ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায় যা ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। পথিমধ্যে তারা বহু গ্রাম ও শহরে লুণ্ঠন চালায় এবং নারী-পুরুষ ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে।[35] এরপর তারা হামাদানের পথে রওয়ানা দেয়। শহরের নিকটবর্তী হ’লে নেতারা অঢেল সম্পদ, কাপড় ও বাহন ইত্যাদি নিয়ে তাদের দরবারে উপস্থিত হয়। উদ্দেশ্য নিজেদের নিরাপত্তা প্রার্থনা করা। তাতার বাহিনী বহু সম্পদ ও বাহন পেয়ে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করে। এরপর তারা হামাদান ছেড়ে যানজানের[36] পথে রওয়ানা দেয়। সেখানেও বহু মানুষকে হত্যা ও সম্পদ লুণ্ঠন করে। অতঃপর ধ্বংসলীলা চালিয়ে কাযভীনের পথে রওয়ানা হয়। কাযভীনবাসী শহরে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু তাতাররা অস্ত্রের জোরে শহরে প্রবেশ করলে শহরবাসী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এক পর্যায়ে যুদ্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারা একে অপরকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। এতে উভয় পক্ষের অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ইবনুল আছীর বলেন, এতে চল্লিশ হাযারেরও বেশী কাযভীনবাসী মুসলিম নিহত হয়।[37]
আযারবাইজানের পথে তাতার বাহিনী :
তাতার বাহিনী হামাদান ও বিলাদুল জিবালে প্রচন্ড শীতে অস্থির হয়ে পড়ে। তাছাড়া সেখানে বরফ জামে যায়। তাদের জন্য অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারা সেখান থেকে পলায়ণ করে আযারবাইজানের দিকে রওয়ানা হয়। পথে গ্রাম ও ছোট ছোট শহরগুলো অতিক্রম করার সময় অধিবাসীদের হত্যা ও ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে। গ্রাম ও শহরগুলোতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এরপর তারা তিবরীযের[38] পথে রওয়ানা হয়। যেখানে অবস্থান করছিলেন আযারবাইজানের শাসনকর্তা আওযাব্ক বিন বাহ্লাওয়ান (أَوْزَبْكُ بْنُ الْبَهْلَوَانِ)। তিনি দিন-রাত মদ্যপান ও খেল-তামাশায় লিপ্ত থাকতেন। তাই তাতারদের ব্যাপারে তার কোন মাথা ব্যথা ছিল না। জ্ঞান ফিরলে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদ, পোশাকাদি ও অগণিত বাহন পাঠিয়ে তাদের সাথে শান্তি চুক্তি করে। এরপর তারা আযারবাইজান ও তিরমীয ছেড়ে অতি ঠান্ডা, বরফ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা মুক্বানে[39] চলে যায়। সেখানে ধ্বংশলীলা চালিয়ে ‘কারাজ’[40] শহরের দিকে রওয়ানা হয়। তাদের প্রতিহত করতে দশ হাযার কারাজ বাহিনী গতিরোধ করে। কিন্তু তারা পরাজিত হয় এবং অধিকাংশই নিহত হয়। কারাজ নেতা মুসলিম ঐক্য গড়ে তুলার জন্য আওযাবকের নিকট লোক প্রেরণ করেন এবং আযারবাইজান নেতা তাতে সম্মতি দেন। অনুরূপভাবে তিনি জাযীরা ও খেলাত্বের নেতা আশরাফ বিন মালেক আল-আদেল (الْأَشْرَفُ ابْن الْمَلِكِ الْعَادِلِ)-এর নিকট পত্র প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল শীতকাল অতিবাহিত হ’লে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে তাতারদের প্রতিহত করা। কিন্তু তাতাররা এত দিন অপেক্ষা করল না। তারা শীতকালেই বরফ আচ্ছাদিত কারাজে ঢুঁকে পড়ে। তাদের সাথে যোগ দেয় আওযাবুকের অধিনস্ত তুর্কী রাজা আক্ব্ওয়াস (أَقْوَشُ)। তিনি পাহাড়ী অঞ্চলের তুর্কী, কুর্দ্দী ও অন্যান্য উপজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাতারদের সহায়তার জন্য প্রেরণ করেন। তাতার বাহিনী তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে। কারণ তারা ছিল তাদেরই জাতির মানুষ। এরপর তারা কারাজে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে বহু দুর্গ দখল করে নেয়। তারা এগুলোতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের হত্যা করে, ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং সেগুলোতে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এ ঘটনাটি সংঘটিত হয় ৬১৭ হিজরী সালের যিলহজ্জ মাসে।[41] অতঃপর তারা তিফলীসের[42] সন্নিকটে পৌঁছলে সুলতান কারাজ তার সকল সৈন্য নিয়ে তাতারদের প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে। জওয়াব দেওয়ার জন্য প্রথমে আক্বওয়াশের বাহিনী এগিয়ে আসে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। নিহত হয় আক্বওয়াশ বাহিনীর বহু সৈন্য। তারা টিকতে না পেরে তাতার বাহিনীর কাছে ফিরে যায়। অন্যদিকে কারাজ বাহিনীও ভয়াবহ যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পরে তাতার বাহিনীর প্রচন্ড হামলায় কারাজ বাহিনী পরাস্ত হয় এবং তাদের বহু সেনা নিহত হয়। তারা ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে এই শহরটিকেও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এদের ধ্বংসলীলা লিখার সময় ইবনুল আছীর আক্ষেপ করে বলেন,
وَتَاللهِ لاَ شَكَّ أَنَّ مَنْ يَجِيءُ بَعْدَنَا، إِذَا بَعُدَ الْعَهْدُ، وَيَرَى هَذِهِ الْحَادِثَةَ مَسْطُورَةً يُنْكِرُهَا، وَيَسْتَبْعِدُهَا، وَالْحَقُّ بِيَدِهِ، فَمَتَى اسْتَبْعَدَ ذَلِكَ فَلْيَنْظُرْ أَنَّنَا سَطَّرْنَا نَحْنُ، وَكُلُّ مَنْ جَمَعَ التَّارِيخَ فِي أَزَمَانِنَا هَذِهِ فِي وَقْتٍ كُلُّ مَنْ فِيهِ يَعْلَمُ هَذِهِ الْحَادِثَةَ، اسْتَوَى فِي مَعْرِفَتِهَا الْعَالِمُ وَالْجَاهِلُ لِشُهْرَتِهَا-
‘আল্লাহর কসম! যারা আমাদের পরে আগমন করবে ও সময় বহুকাল অতিক্রম করবে। আর দেখবে যে, এ ঘটনা লিপিবদ্ধ তারা অস্বীকার করবে, এটিকে দূরবর্তী ঘটনা মনে করবে। অথচ সত্য তাঁরই (আল্লাহরই) হাতে। অতএব যে ব্যক্তি উক্ত ইতিহাসকে অবিশ্বাস করবে সে যেন অবশ্যই চিন্তা করে যে, আমরা নিজেরাই তা লিখেছি। এমনকি আমাদের যুগের ঐতিহাসিকগণ যারা এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত তাদের প্রত্যেকে এ বিষয়ে ইতিহাস সংকলন করেছেন। এর ব্যাপক পরিশুদ্ধতার কারণে জ্ঞানী-মূর্খ সকলে তা অবগত।[43]
মারাগার[44] উদ্দেশ্যে তাতার বাহিনী :
৬১৮ হিজরীর ছফর মাস। তাতার বাহিনী ৬১৭ হিজরী সন পর্যন্ত কারাজ শহরেই অবস্থান করে। এরপর সেখানে অবস্থান করাকে বিপদজনক মনে করে তিবরীযের পথে রওয়ানা দেয়। কিন্তু তিবরীযের শাসনকর্তা অঢেল ধন-সম্পদ, কাপড় ও বাহনের বিনিময়ে তাতারদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা মারাগার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। তারা মারাগাহ শহরটিকে অবরোধ করে। মারাগার শাসনকর্তা নারী হওয়ায় প্রতিহত করার কেউ ছিল না। সে ‘রুওয়ান্ডেয’ (رُوَينْدِزَ) দুর্গে আত্মগোপন করে। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً ‘ঐ জাতি কখনও সফলকাম হ’তে পারে না, যারা নারীকে তাদের নেত্রী নির্বাচিত করে’।[45] তারা যখন শহরটিকে অবরোধ করে ফেলল তখন শহরবাসী তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল। তারা শহরের বাইরে মিনজানীক স্থাপন করে শহরের দিকে এগিয়ে গেল। তাতারদের নিয়ম ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে প্রথমে তারা মুসলিম বন্দিদের মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করত। তারা পলায়ণ করে চলে আসলে তাতাররা তাদের হত্যা করত। তারা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। কারণ তারা নিশ্চিতভাবে জানত যে, সামনে গেলে হত্যা করা হবে এবং পলায়ন করলেও নিশ্চিত মৃত্যু। তাতাররা তাদের পিছনে থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। এভাবে তারা নিজেদেরকে নিরাপদ রাখত। তারা শহরে প্রবেশ করে দীর্ঘদিন অবস্থান করে। অতঃপর ৬১৮ হিজরীর ৪ ছফর পুরো শহর দখল করে নেয়। এরপর শুরু করে হত্যাকান্ড। যারা বাইরে বের হয় তাদের সকলকে হত্যা করে। প্রয়োজনীয় সম্পদগুলো লুণ্ঠন করে এবং অপ্রয়োজনীয়গুলোতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। কিছু লোক বাড়ির গোপন স্থানে আত্মগোপন করে। তাতাররা তাদের বাইরে আনার জন্য এক প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা মুসলিম যুদ্ধবন্দিদের দ্বারা ঘোষণা দেয় যে, তাতার বাহিনী চলে গেছে। এই স্বস্তির ঘোষণা শুনে লোকেরা বাইরে আসলে তাদেরকে নৃশংস্বভাবে হত্যা করা হয়। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَقَتَلُوا مِنْ أَهْلِهِ خَلْقًا لَا يَعْلَمُ عِدَّتَهُمْ إِلَّا اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ ‘তারা এত সংখ্যক মানুষকে হত্যা করে যে, এদের সংখ্যা মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না’। তারা বহু সম্পদ গণীমত হিসাবে লাভ করে ও বহু লোককে বন্দি করে।[46]
একশ’জন মুসলিম তাতারদের ভয়ে আত্মরক্ষার্থে গিরিপথে আত্মগোপন করে। তাদের কেউ বাইরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছিল না। এক তাতার সৈনিক তাতে প্রবেশ করে এক এক করে তাদের সকলকে হত্যা করে। কেউ প্রতিহত করার সাহসটুকু পায়নি।[47] এটি কোন ধরনের যুদ্ধ? কেমন মানবতা? এটি কোন ধরনের যুদ্ধনীতি? এটি কাপুরুষতার কোন স্তর? কোন ধর্মই এই ধরনের হত্যাকান্ড সমর্থন করে না।
তাতার মহিলা সৈনিকের কান্ড :
জনৈক পুরুষের পোশাক পরিহিত তাতার মহিলা সৈনিক এক মুসলিমের বাড়িতে প্রবেশ করে। অতঃপর একাই বাড়ির সকলকে হত্যা করে। সকলে তাকে পুরুষ মনে করছিল। সে কিছু লোককে বন্দিও করে। তার তাবুতে ফিরে এসে যুদ্ধের পোশাক খুললে একজন বন্দি বুঝতে পারে যে, সে একজন মহিলা। তখন সেই কয়েদী তাকে হত্যা করে।[48] নারীরাও এত নিষ্ঠুর হয়, ইতিহাস অধ্যয়ন না করলে জানা যেত না।
দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনীর বর্ণনা দিয়ে ইবনুল আছীর (রহঃ) বলেন,
مَنْ حَدَّثَكُمْ أَنَّ التَّتَرَ انْهَزَمُوا وَأُسِرُوا فَلَا تُصَدِّقُوهُ، وَإِذَا حُدِّثْتُمْ أَنَّهُمْ قَتَلُوا فَصَدِّقُوهُ، فَإِنَّ الْقَوْمَ لَا يَفِرُّونَ أَبَدًا، وَلَقَدْ أَخَذْنَا أَسِيرًا مِنْهُمْ، فَأَلْقَى نَفْسَهُ مِنَ الدَّابَّةِ وَضَرَبَ رَأْسَهُ بِالْحَجَرِ إِلَى أَنْ مَاتَ، وَلَمْ يُسَلِّمْ نَفْسَهُ
‘তোমাদের নিকট যে বর্ণনা করবে যে, তাতার বাহিনী পরাজিত হয়েছে এবং বন্দি হয়েছে, তোমরা তাকে বিশ্বাস করবে না। আর যদি তোমাদের নিকট বর্ণনা করা হয় যে, তারা হত্যা করেছে তাহ’লে বিশ্বাস করবে। কারণ তারা এমন জাতি যারা কখনো পলায়ন করবে না। আমরা তাদের কাউকে কাউকে বন্দি করেছি। সে নিজেকে বাহন থেকে নিক্ষেপ করে স্বীয় মাথাকে পাথরে আঘাত করে মৃত্যুকে নিশ্চিত করেছে। তবুও নিজেকে সমর্পণ করেনি।[49]
[চলবে]
[1]. আল-কামিল ১০/৩৩৩।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ১৩/৮৭-৮৮; আল-কামিল ১০/৩৩৪।
[3]. শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২।
[4]. আল-কামিল ১০/৩৩৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৮২; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২১৯।
[5]. বুখারা ও সামারকান্দ উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত মসজিদ, মাদরাসা সহ বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা সমৃদ্ধ দু’টি শহর।
[6]. বর্তমান কিরঘিজিস্তানের চুই প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত একটি শহর।
[7]. বর্তমান চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল জিনজিয়াংয়ের অন্তর্ভুক্ত তাজিকিস্তান ও কিরঘিজিস্তান সীমান্তবর্তী মরুদ্যানবিশিষ্ট ঐতিহাসিক একটি শহর।
[8]. আল-কামিল ১০/৩৩৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৮২; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২১৮-২১৯।
[9]. আল-কামিল ১০/৩৩৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৮; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২০-২২১; ড. হাসান ইবরাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৬।
[10]. উজবেকিস্তানের বুক চিরে প্রবাহিত একটি নদী।
[11]. আল-কামিল ১০/৩৩৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৮২; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২১-২২২; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৬।
[12]. আল-কামিল ১০/৩৩৫; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২২; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৬।
[13]. আল-কামিল ১০/৩৩৮; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৮-৮৯; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২২-২২৩।
[14]. আল-কামিল ১০/৩৩৮; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৪।
[15]. আল-কামিল ১০/৩৩৮।
[16]. আল-কামিল ১০/৩৩৯; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৪; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৭।
[17]. আল-কামিল ১০/৩৪০; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৫।
[18]. আল-কামিল ১০/৩৪০-৩৪১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৫; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৭।
[19]. আল-কামিল ১০/৩৪০-৩৪১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৫; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৬।
[20]. আল-কামিল ১০/৩৪১; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৭।
[21]. আল-কামিল ১০/৩৪১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৬।
[22]. সামারকান্দের একটি এলাকা।
[23]. আল-কামিল ১০/৩৪৩; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮।
[24]. বর্তমান ইরানের অন্তর্ভুক্ত এবং কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী এলবুর্জ পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত একটি প্রদেশ।
[25]. আল-কামিল ১০/৩৪৩; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৭।
[26]. তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮।
[27]. শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৭।
[28]. বর্তমানে ইরানের সিস্তান নগরী।
[29]. ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে এক হাযার কি.মি. দূরে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর।
[30]. আল-কামিল ১০/৩৪৩; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯।
[31]. আল-বিদায়াহ ১৩/২৩।
[32]. আল-কামিল ১০/৩৪৪; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৭; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮।
[33]. আল-কামিল ১০/৩৪০-৩৪১; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৯; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮।
[34]. আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯।
[35]. আল-কামিল ১০/৩৪৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২৯।
[36]. বর্তমান ইরানের একটি প্রদেশ।
[37]. আল-কামিল ১০/৩৪৫; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৮; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩০।
[38]. বর্তমান ইরানের একটি শহর।
[39]. আরমেনিয়ার একটি ছোট শহর।
[40]. বর্তমান জর্জিয়ার প্রাচীন নাম।
[41]. আল-কামিল ১০/৩৪৬; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৯; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩০।
[42]. বর্তমান জর্জিয়ার রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর।
[43]. আল-কামিল ১০/৩৪৭; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৯; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩০।
[44]. ইরানের একটি শহর।
[45]. বুখারী হা/৪৪২৫; মিশকাত হা/৩৬৯৩,‘শাসন ও বিচার’ অধ্যায় হা/৩৬৯৩।
[46]. আল-কামিল ১০/৩৪৮; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯-৯০; তারীখুল ইসলাম ৪/১৩৯; শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২৩০।
[47]. আল-কামিল ১০/৩৪৮; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯-৯০।
[48]. আল-কামিল ১০/৩৪৮; আল-বিদায়াহ ১৩/৮৯-৯০।
[49]. আল-কামিল ১০/৩৪৮।