তাতারদের ইসলাম গ্রহণ :

তাতাররা ইসলাম ও মুসলমানদের বিনাশে যেমন অগ্রগামী ছিল তেমনি ইসলাম গ্রহণ ও ইসলাম প্রচারেও তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। বাগদাদ ধ্বংস হওয়ার পূর্বেই চেঙ্গীস খানের আরেক নাতি বারাকাত খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হালাকু কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংস এবং মুসলিম খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর শাহাদত বরণের কথা শুনলে তিনি হালাকু খানকে তিরষ্কার করেন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। একে কেন্দ্র করে তাতারদের দু’বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধও হয়। শুধু বারাকাত খানই নয় হালাকু খানের পুত্রও ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে তাতারদের নেতারা ইসলাম গ্রহণ করলে সাধারণ জনতা ও সৈন্যরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামে দীক্ষিত হয়। ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন যে, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর আমলে বিশেষত ওছমান (রাঃ) সর্বপ্রথম ৩০/৩১ হিজরী সনে চীনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। তারা সেখানকার শাসক তানেগ পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলামের দাওয়াত দেন।[1] পরবর্তীতে ৯৪ হিজরী সনে মুসলিম সেনাপতি কুতায়বা ইবনু মুসলিমের হাতে তৎকালীন চীনের রাজধানী কাশগর বিজিত হয়। এরপরে এশিয়ায় ইসলাম প্রচার হ’তে থাকে।[2]

এরপরে উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুল মালেক তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠিয়েছিলেন। ইয়াকূত আল-হামাবী বলেন, ‘হিশাম বিন আব্দুল মালেক তুর্কী রাজার কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। দূত বলেন, আমি রাজার দরবারে প্রবেশ করলাম তখন তিনি হাতে বাতি নিয়েছিলেন। তিনি দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? সে বলল, আরবের বাদশাহর দূত। তিনি বললেন, আমার গোলাম? সে বলল, হ্যাঁ। আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হ’ল যেখানে প্রচুর গোশত ও অল্প রুটি ছিল। এরপর আমাকে তলব করা হ’ল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার লক্ষ্য কী? আমি বিনয় প্রদর্শন করে বললাম, আমার বাদশাহ আপনাকে উপদেশ দিতে চান। তিনি মনে করেন, আপনি ভ্রান্ত পথের উপরে রয়েছেন। তিনি চান যেন আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম কি? তখন আমি ইসলামের শর্তসমূহ, ফরযিয়াত, হালাল-হারাম সকল বিষয় তুলে ধরলাম। অতঃপর এ অবস্থায় কয়েকদিন অতিবাহিত হ’ল। একদিন তিনি পতাকা ধারী দশজন সৈন্যের সাথে বের হ’লেন। আমাকেও সাথে নেওয়া হ’ল। অবশেষে এক টিলায় গিয়ে পৌঁছলাম। যার চার দিকে জঙ্গল ছিল। সূর্য উদিত হ’লে বাদশাহ তাদের একজনকে পতাকা উত্তোলন করে তা উদ্ভাসিত করার নির্দেশ দিলেন। পতাকা দেখে সেখানে সশস্ত্র দশ হাযার সৈন্য উপস্থিত হ’ল। এরা আবার প্রত্যেকে পতাকা উত্তোলন করে উদ্ভাসিত করল। তা দেখে এক লক্ষ সৈন্য টিলার চারপাশে সমবেত হ’ল। তখন বাদশাহ বললেন, ‘এই দূতকে বলে দাও, সে যেন তার নেতাকে বলে দেয় যে, এদের মধ্যে কোন হাজ্জাম, নাপিত এবং দর্জি নেই। এরা যখন ইসলাম গ্রহণ করবে এবং এর শর্তসমূহ জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখন তারা কোথায় রিযিক পাবে?[3]

ড. মুহাম্মাদ আলী আল-বার্র উল্লেখ করেছেন যে, মোগল কবি আহমাদ ইউসাভীর হাতে এক লক্ষ তুর্কি জনগণ ইসলাম গ্রহণ করেন যেমন মোগলদের হাযার হাযার মানুষ তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মোগল বংশদ্ভূত এবং কাজাখস্তানের অধিবাসী। তিনি ৫৬২/১১৬৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন যা চেঙ্গীস খানের আবির্ভাবের দু’বছর পূর্বের ঘটনা।[4] এখানে আমরা তাতারদের ইসলাম গ্রহণের বিভিন্ন ঘটনা উপস্থাপন করব।

একটি কুকুর ও ৪০ হাযার তাতারের ইসলাম গ্রহণ :

তাতাররা বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। কেউবা ইসলামের সঠিক মর্ম উপলদ্ধি করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) উল্লেখ করেন, শায়খ জামালুদ্দীন ইবরাহীম জনসম্মুখে বলেন, আমি হালাকু ও তার সন্তান আবাকের অর্থমন্ত্রী সুনজাকের নিকট উপস্থিত ছিলাম। সে মোঙ্গল থেকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ঘটনাটি আবগার শাসনামলের প্রথম দিকের। আমরা তখন তার তাঁবুতে ছিলাম। তার নিকটে একদল তাতার নেতা ও একদল খৃষ্টান ধর্মযাজকও ছিল। এটা ছিল ঘন কুয়াশাপূর্ণ দিন। এক অভিশপ্ত খৃষ্টান বলল, ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিসের দাওয়াত দিতেন। তিনি তো ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে অবস্থান করতেন। তিনি তাদেরকে ধন-সম্পদ দিতেন এবং সে বিষয়ে বিরাগী করতেন। আর এভাবেই তাদেরকে নিজের দলে টেনে নিতেন’। এভাবে রাসূল (ছাঃ)-কে তুচ্ছ করে বক্তব্য দিতে থাকে। সেখানে একটি শিকারী কুকুর ছিল। যাকে স্বর্ণের শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেটি সুনজাকের খুব আস্থাভাজন ছিল। রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে খৃষ্টান লোকটির কটূক্তি শুনে কুকুরটি দাঁড়িয়ে গেল এবং শিকল ছিঁড়ে তার উপর হামলা করল। সে তাকে খামচিয়ে জখম করে দিল। এ অবস্থায় সে তাকে ধরে শৃংখলাবদ্ধ করল। তখন উপস্থিত কিছু লোক বলল, এটা তোমার মুহাম্মাদ সম্পর্কে কটূক্তি করার ফল। সে বলল, তোমাদের ধারণা ভুল। বরং কুকুরটি খুবই চতুর। সে আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছিল যে আমি তাকে মারব। তখন সে আমার উপর হামলা করে। এরপর সে আবার মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে কটূক্তি করে বক্তব্য শুরু করে। এরই মধ্যে কুকুরটি আবার শিকল ছিঁড়ে তার উপর হামলা করে। অতঃপর কুকুরটি তার শাসনালী কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে। এতে অভিশপ্ত নাছারা মারা যায়। ঘটনাটি মুখে মুখে জনসমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এতে চল্লিশ হাযার তাতার ইসলাম গ্রহণ করে।[5]

মুহাম্মাদ বারাকাহ খানের ইসলাম গ্রহণ :

তাতারদের অন্যতম নেতা বারাকাহ খান (بَرَكَةُ خَانَ) রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। চেঙ্গীস খানের পুত্র জুজীর সপ্ত পুত্রের অন্যতম ও হালাকু খানের চাচাত ভাই ইসলাম গ্রহণ করে খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। তার সম্পর্কে ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَهُوَ ابْنُ عَمِّ هُولَاكُو، وَقَدْ أَسْلَمَ بَرَكَةُ خَانَ هَذَا، وَكَانَ يُحِبُّ الْعُلَمَاءَ وَالصَّالِحِيْنَ وَمِنْ أَكْبَرِ حَسَنَاتِهِ كَسْرُهُ لِهُولَاكُوْ وَتَفْرِيْقُ جُنُودِهُ...،  ‘তিনি হালাকু’র চাচাত ভাই। এই বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আলেম-ওলামা ও সৎ ব্যক্তিদের পসন্দ করতেন। তার সর্বাধিক উত্তম কাজ ছিল হালাকু ও তার সৈন্যদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি ও বিভক্তি তৈরি করা। তিনি বাদশাহ যাহের বাইবার্সকে সম্মান ও তার দূতদের সমাদর করতেন। তার পরে তার পরিবারের মানকুতামুর (مَنْكُوتَمُرُ بْنُ طُغَانَ) শাসনভার গ্রহণ করেন যিনি বারাকাহ খানের পদাংক অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ’।[6]

চেঙ্গীস পুত্র জুজী মারা গেলে তার বড় ছেলে ও বারাকাহ খানের বড় ভাই ‘বাতূ’ ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি The Golden Horde (বর্তমান রাশিয়া, ইউক্রেন, মলদোভা, কাজাখস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্রের কিছু কিছু অংশ নিয়ে গঠিত)-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ‘বাতূ’ মারা গেলে ক্ষমতায় আসীন হন তারই ছেলে ছারতাক। অল্প কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তার সন্তানদের কেউ বড় ও যোগ্যতা সম্পন্ন না থাকায় ক্ষমতায় আসীন হন তার চাচা বারাকাহ খান। এজন্য উত্তর অঞ্চলের মোগলরা ইসলামে প্রবেশের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। তাতারদের বড় রাজধানী কারাকারুম থেকে ফেরার পথে বারাকাহ খান বুখারায় অবতরণ করেন। সেখানে জনৈক আলেমের সাথে পরিচয় হয় এবং সেখানেই তিনি স্বস্ত্রীক ইসলাম গ্রহণ করেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল হুজক খাতূন। তিনি ৬৫৩ হিজরী সনে ক্ষমতায় আরোহণ করে একবছর পরে ৬৫৪ হিজরী সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণের কারণে উত্তরের বহু তাতার ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি ইসলামের খাঁটি রক্ষক ছিলেন। বাগদাদের পতনের পূর্বে তিনি খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর হাতে বায়‘আত নেন। বর্তমানে রাশিয়ার সারাই ও সারাতোভ শহর দু’টি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সারাতোভই ছিল উত্তর মোগলদের রাজধানী। তিনি বহু মসজিদও নির্মাণ করেন এবং সেগুলোকে ইসলামের প্রতীক হিসাবে নির্ধারণ করেন। তিনি মামলূক শাসকদের সাথে সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি মামলূক শাসক রুকনুদ্দীন যাহের বাইবার্সের (بَيْبَرْس) সাথে নিয়মিত পত্র আদান-প্রদান করতেন। বাইবার্স বারাকাহ খানকে তারই চাচাত ভাই ইসলামের শত্রু হালাকু খানকে হত্যা করতে উৎসাহিত করেন। তিনি উপদেশ স্বরূপ বলেন, ‘ইসলাম তার শত্রুদের হত্যা করাকে আবশ্যক করে যদিও শত্রু আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের সদস্য হয়। বাস্তবেও হালাকু খানকে হত্যার ক্ষেত্রে তিনি বাইবার্সকে সহযোগিতা করেছিলেন। এমনকি নিজেও হালাকুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ইবনু কাছীর বলেন, ‘বারাকাহ খান যাহেরকে সম্বোধন করে লিখলেন, قَدْ عَلِمْتَ مَحَبَّتِي للإسلام، وَعَلِمْتَ مَا فَعَلَ هُولَاكُو بِالْمُسْلِمِيْنَ، فَارْكَبْ أَنْتَ مِنْ نَاحِيَةِ حَتَّى آَتِيْهِ أَنَا مِنْ نَاحِيَةٍ حَتَّى نَصْطَلِمَهُ أَوْ نُخْرِجَهُ مِنَ الْبِلاَدِ وَأَعْطِيَكَ جَمِيعَ مَا كَانَ بِيَدِهِ مِنَ الْبِلَادِ، فَاسْتَصْوَبَ الظَّاهِرُ هَذَا الرَّأْيَ وَشَكَرَهُ وَخَلَعَ عَلَى رُسُلِهِ وَأَكْرَمَهُمْ- ‘অবশ্যই আপনি ইসলামের প্রতি আমার ভালোবাসার বিষয়ে জানেন। এও জানেন যে, হালাকু মুসলমানদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছে। আপনি এক দিগন্ত হয়ে এগিয়ে যান, আমি আরেক দিগন্ত হয়ে এগিয়ে যাব। যাতে আমরা তার মূলোৎপাটন করতে পারি বা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে পারি। তার হাতে যে সকল রাজ্যের ক্ষমতা রয়েছে আমি আপনাকে সবগুলো দিয়ে দিব। যাহের এই মতে সম্মতি দিলেন এবং তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার দূতদের একান্ত নির্জনে মেহমানদারী করলেন’।[7]

বারাকাহ খান ৬৬৫ হিজরী মোতাবেক ১২৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেন।[8]

৬৬৩ হিজরীতে হালাকু খান মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাগা শহরে মারা গেলে তাকে একটি উচু টিলায় দাফন করা হয়। তার উপরে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। অতঃপর তাতার সৈন্যরা তার ছেলে আবগার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রায়াস চালায়।  বারাকাহ খান এই খবর জানতে পেরে সৈন্য নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। হালাকুর গম্বুজ ভেঙ্গে ফেলেন এবং তাতার সৈন্যদের বিভক্ত করে দেন। এতে বাদশাহ যাহের খুশি হন।[9]

বারাকাহ খানের সহযোগী সুলতান যাহেরের উল্লেখযোগ্য কর্ম ছিল এই যে, উবায়দিয়াদের পরে তিনিই আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদে ৬৬৫ হিজরীতে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। যা বহুদিন যাবত বন্ধ ছিল। যদিও কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত সেটিই প্রথম মসজিদ ছিল। সেনাপতি জওহার এই জামে‘ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হাকেম অদূরে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করে জুম‘আ চালু করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জুম‘আ বন্ধ করে দেয়।[10]

হালাকুর সাথে বারাকাহ খানের বিরোধের যেমন ধর্মীয় কারণ ছিল তেমনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণও ছিল। হালাকু খান মুছেলসহ আশ-পাশের এলাকাগুলো দখল করলে বারাকাহ খান লুণ্ঠিত সম্পদ, বন্দি ও অন্যান্য জিনিস পত্রের ভাগ চেয়ে হালাকু খানকে পত্র লিখেন। এতে হালাকু ক্ষিপ্ত হয়ে দূতকে হত্যা করে। এ খবর জানতে পেরে বারাকাহ খান প্রচন্ড রাগান্বিত হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন। ৬৬১ হিজরী সনে বিশাল এক সৈন্য বাহিনী নিয়ে বারাকাহ খান হালাকুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে হালাকু বাহিনীকে আল্লাহ শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন। হালাকুর অধিকাংশ সৈন্য নিহত হয় এবং জীবিতদের অধিকাংশ ডুবে মারা যায়। হালাকু পলায়ন করে প্রাণ রক্ষা করে। এরপর বারাকাহ খান কনস্টান্টিনোপলসহ অন্যান্য রাজ্য জয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেন।[11]

কুরজুযের (Korguz) ইসলাম গ্রহণ :

তিনি তাতার নেতা আজতাঈ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত বৃহত্তর খোরাসানের গভর্ণর ছিলেন। তিনি তাতার শিশুদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে খোরাসানের গভর্ণরের দায়িত্ব পান। বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করলে তিনিও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তার অধিকাংশ সৈন্য ইসলাম গ্রহণ করে। এমনকি বলা হয়ে থাকে, তার সকল সৈন্যই মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। তার ইসলাম গ্রহণই মিসরের সুলতান বায়বার্সের সাথে বারাকাহ খানের সুসম্পর্ক সুদৃঢ় করে। ১২৪২ খৃষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[12]

তাকুদার বিন হালাকুর ইসলাম গ্রহণ :

তাকুদার হালাকু খানের সপ্তম সন্তান ছিলেন। হালাকু খান কর্তৃক ইরাক, ইরান ও সিরিয়া দখলের সময় তাকুদার চীনে অবস্থান করছিলেন। এর পরে তার ভাই আবাকা খানের শাসনামলে তাকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি ইরানে গমন করেন। উল্লেখ্য যে, হালাকু খানের স্ত্রী গোঁড়া খৃষ্টান হওয়ায় পুত্র তাকুদার বিন হালাকু মায়ের আদর্শে খৃষ্টীয় কালচারে বেড়ে উঠে। তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করে ৬৮০/৬৮১ হিজরী সনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আহমাদ বিন হালাকু (أَحْمَد بْن هُولَاكُو) নাম ধারণ করেন। কথিত আছে যে, তিনি নাছিরুদ্দীন তূসীর কথায় প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেই ধনভান্ডার থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সন্তান, নেতা ও সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন। তিনি মোগলসহ সকল প্রজাদের প্রতি মায়া-মমতা দেখিয়ে আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষত তিনি খৃষ্টান নেতাদের প্রতি আন্তরিক সম্মান প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি সুলতান মানছূর ‘কালাবূন’-এর কাছে পত্র লিখে তার ইসলাম গ্রহণের কথা অবহিত করেন এবং তাকে বিভিন্ন বিষয়ে সন্ধির প্রস্তাব দেন। সুলতান কালাবূন পত্রের জওয়াবও দেন। কিন্তু তাদের পত্রের ভাষা দেখে মনে হয় তাদের মাঝে একাধিক পত্র আদান-প্রদান হ’লেও সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। তিনি ইসলাম প্রচারে মসজিদ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। ইবনুল ইমাদ হাম্বলী বলেন, وأمر ببناء المساجد والجوامع وإقامة الشّرع الشّريف على ما كان في زمن الخلفاء ‘আর তিনি মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন এবং খোলাফায়ে রাশেদার আমলে প্রতিষ্ঠিত শারঈ আইন চালু করারও নির্দেশ দেন’।[13] উল্লেখ্য যে, সুলতান আহমাদ তাকুদার একাই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার অনুসারী বা তাতারদের তেমন কোন লোককে ইসলাম গ্রহণ করাতে সক্ষম হননি। ফলে তার নিকটতম ব্যক্তিরাই তাকে ৬৮৩ হিজরী সনে হত্যা করে।[14]

মাহমূদ কাযান বিন আরগুনের ইসলাম গ্রহণ :

মাহমূদ কাযান (১২৭১-১১ মে ১৩০৪) ছিলেন ইলাখানাতের সপ্তম শাসক। ১২৯৫ থেকে ১৩০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি আরগুন ও কুতলুক খাতুনের সন্তান এবং চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। ইলাখানদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ১২৯৫/৬৯৩ হিঃ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একবছর পর ৬৯৪ হিজরী সনে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন,وَفِيهَا مَلَكَ التَّتَرَ قَازَانُ بْنُ أَرْغُونَ، فَأَسْلَمَ وَأَظْهَرَ الْإِسْلَامَ عَلَى يَدِ الْأَمِيرِ نَوْرُوزَ، رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى، وَدَخَلَتِ التَّتَرُ أَوْ أَكْثَرُهُمْ فِي الْإِسْلَامِ، وَنَثَرَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَاللُّؤْلُؤَ عَلَى رُءُوسِ النَّاسِ يَوْمَ إِسْلَامِهِ، وَتَسَمَّى بِمَحْمُودٍ، وَشَهِدَ الْجُمُعَةَ وَالْخُطْبَةَ، وَخَرَّبَ كَنَائِسَ كَثِيرَةً، وَضَرَبَ عَلَيْهِمُ الْجِزْيَةَ، وَرَدَّ مَظَالِمَ كَثِيرَةً بِبَغْدَادَ وَغَيْرِهَا مِنَ الْبِلَادِ، وَظَهَرَتِ السُّبَحُ وَالْهَيَاكِلُ مَعَ التَّتَر، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَحْدَهُ ‘আর এতে ক্বাযান বিন আরগূন ক্ষমতায় আসীন হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আমীর নওরোযের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। অতঃপর তাতার বা তাদের অধিকাংশ ইসলামে দীক্ষিত হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার দিন স্বর্ণ-রেŠপ্য ও হিরা-যহরত লোকদের মাথার উপর ছিটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। নিজের নাম রাখেন মাহমূদ। তিনি জুম‘আ এবং খুৎবায় অংশ গ্রহণ করতেন। তিনি বহু গীর্জা ধ্বংস করেন এবং খৃষ্টানদের উপর কর আরোপ করেন। তিনি বাগদাদসহ বিভিন্ন শহরের জনগণ থেকে জবরদখলকৃত সম্পদ তাদের হাতে ফিরিয়ে দেন। তাতাররা বিভিন্ন তাসবীহ পাঠ করে এবং ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করে’।[15]

তিনি খোরাসানের রায় শহরে শা‘বান মাসে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরের রামাযানেই ছিয়াম পালন শুরু করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে গোসল করে সাধারণ মজলিসে বসে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কালেমা শাহাদত পাঠ করেন। এতে উপস্থিত আরব-অনারব ও তাতার সকলেই উচ্চকণ্ঠে তাকবীর ধ্বনি দেন। এরপর নওরোয তাকে কুরআনের শিক্ষা দান করেন। তারপর নওরোযের নেতৃত্বে তাতার সৈন্যরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করে। কারণ তিনি খাঁটি মুসলিম ছিলেন। কুরআনের বহু অংশ, উপদেশাবলী ও যিকির-আযকার তার মুখস্থ ছিল।[16] কাযানের শাসনামলে সিরিয়ার অধিকার নিয়ে তাতারদের সাথে মিশরের মামলূকদের লড়াই হয়। কাযান ইউরোপের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তিনি একাধিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মুদ্রাব্যবস্থাসহ সাম্রাজ্যে তিনি বেশ কিছু সংস্কার কাজ করেছেন। ক্ষমতার প্রশ্নে বাইদুর সাথে কাযানের দ্বন্দ্ব হয় এবং ১২৯৫ সালের ৫ই অক্টোবর বাইদুকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এতে কাযানের পূর্বের শত্রু নওরোয তাকে সহায়তা করেছিলেন। সহায়তা করার শর্ত হিসাবে কাযান ১২৯৫ সালের ১৬ জুন ইসলাম গ্রহণ করেন।[17] তাগাচারও (Taghachar) তাকে সহায়তা করেছেন। কিন্তু কাযান তাকে বিশ্বাসঘাতক বিবেচনা করে আনাতোলিয়ায় নির্বাসিত করেন। পরে তাকে হত্যা করা হয়।

ইসলাম গ্রহণের পর কাযান তার নামের পূর্বে মাহমূদ যোগ করেন। কাযান ও তার ভাই ওলজাইতুর (Oljeitur, তিনি মুহাম্মাদ খোদাবান্দাহ নামেও পরিচিত। তিনি হালাকুর নাতির ছেলে ছিলেন) শাসনামলে মোগল ইয়াসাকা আইন চালু ছিল এবং মোগল শাসকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন। ওলজাইতুর মৃত্যুর পর বিভিন্ন প্রাচীন মোগল প্রথা বিলুপ্ত হ’তে থাকে।[18] ১২৯৭ সালের মে মাসে নওরোযের সমর্থকদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে সেই বছর কাযান নিজে নওরোযের বিরুদ্ধে সেনাদল নিয়ে অগ্রসর হন। নিশাপুরের নিকটে সংঘটিত যুদ্ধে কাযানের বাহিনী বিজয়ী হয়। নওরোয হেরাতের শাসকের দরবারে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাকে কাযানের কাছে তুলে দেয়া হয়। ১৩ই আগস্ট নওরোযকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। যার হাতে কাযান ইসলাম গ্রহণ করেছিল সেই নওরোযকে হত্যা করে।[19]

এরপর কাযান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। ১২৯৮ সালে তিনি রশীদুদ্দীন হামাদানীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পরবর্তী ২০ বছর রশীদুদ্দীন এই পদে ছিলেন। মাহমূদ কাযান তাকে মোঙ্গলদের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এরপর রশীদুদ্দীন ‘জামে‘ঊত তাওয়ারিখ’ গ্রন্থ রচনা করেন। এতে আদম (আঃ) থেকে শুরু করে ওলজাইতুর শাসনামল পর্যন্ত বিবরণ রয়েছে। এর বেশ কিছু অনুলিপি প্রস্ত্তত করা হয়েছিল। তন্মধ্যে কিছু আজও বিদ্যমান রয়েছে।[20]

মাহমূদ কাযান গোল্ডেন হোর্ডের সাথে সমস্যা কমিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু ওগেদাই ও চাগাতাই (جغاتاي) নেতৃবৃন্দ তার শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে। কাযানের অভিষেকের সময় চাগাতাই খান ১২৯৫ সালে খোরাসান আক্রমণ করেছিলেন। কাযান তার দুইজন আত্মীয়কে চাগাতাই খানের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু তারা দলত্যাগ করে চলে যান। পরে তাদের গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোগল নেতা তার পক্ষ ত্যাগ করতে থাকে। ১২৯৬ ও ১২৯৯ সালে তুরস্কের ইলাখান শাসকের বিরুদ্ধে বালতু ও সুলেমিশ বিদ্রোহ করেন। সুলেমিশ মিশরের মামলূকদেরকে আনাতোলিয়ায় স্বাগত জানান। ফলে কাযানের সিরিয়া অভিযানের পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়। তবে কাযান এই দুই বিদ্রোহীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এছাড়া চাগাতাই খানাতের আক্রমণের ফলে কাযানের সিরিয়া অভিযান সমস্যার মুখে পড়ে। কাযান ইউয়ান ও গোল্ডেন হোর্ডের শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।

ক্বাযান ও ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) :

তাতাররা ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের ধর্মপালন নিয়ে তৎকালীন আলেমদের সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে মুসলিম অঞ্চলগুলোর উপর হামলা, মুসলিম এলাকা জবরদখল ইত্যাদি দিকগুলো মুসলিমদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ক্বাযান দামেশক দখলে অভিযান পরিচালনা করলে তাদের সাথে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহর সাক্ষাৎ ঘটে। এসময় ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) ক্বাযানের কর্মকান্ডের চরম সমালোচনা করেন। তিনি তাদের দেওয়া খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকেন। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, শায়খুল ইসলাম দোভাষীকে বললেন,

قُلْ لِقَازانِ: أَنْتَ تَزْعُمُ أَنَّكَ مُسْلِمٌ وَمَعَكَ مُؤَذِّنُونَ، وَقَاضٍ، وَإِمَامٌ، وَشَيْخٌ، عَلَى مَا بَلَغَنَا، فَغَزَوْتَنَا، وَدَخَلْتَ بِلَادَنَا عَلَى مَاذَا؟ وَأَبُوكَ وَجَدُّكَ هُولَاكُو كَانَا كَافِرَيْنِ، وَمَا غَزَوَا بِلَادَ الْإِسْلَامِ، بَلْ عَاهَدَا فَوَفَّيَا، وَأَنْتَ عَاهَدْتَ فَغَدَرْتَ، وَقُلْتَ فَمَا وَفَّيْتَ. قَالَ: وَجَرَتْ لَهُ مَعَ قَازَانَ، وَقُطْلُوشَاهْ، وَبُولَايْ، أُمُورٌ وَنُوَبٌ-  

‘কাযানকে বল, তুমিতো নিজেকে একজন মুসলিম মনে কর। আর আমাদের জানা মতে, তোমার সাথে মুওয়ায্যিন, কাযী, ইমাম ও শায়খগণ আছেন। অথচ তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছ। কেন তোমরা আমাদের দেশে প্রবেশ করেছ? অথচ তোমার বাপ-দাদা হালাকুরা কাফির ছিল। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। তারা ওয়াদা দিয়ে পূরণ করেছিল। অথচ তুমি ওয়াদা দিয়ে গাদ্দারী করেছ, কথা দিয়ে কথা রাখনি। এভাবে কাযান, কুত্বলুশাহ, বুলাই ও অন্যান্য নেতাদের সাথে তাঁর আলোচনা চলতে থাকে।[21] তিনি সবকিছুই আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য বলেছিলেন। এরপর তাদের সামনে খাবার পরিবেশন করা হ’ল। সবাই আনন্দের সাথে খেলেন। কিন্তু ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) খাবারে হাত দিলেন না। তাকে বলা হল কেন খাচ্ছেন না? তিনি বললেন, كَيْفَ آكُلُ مِنْ طَعَامِكُمْ وَكُلُّهُ مِمَّا نَهَبْتُمْ مِنْ أَغْنَامِ النَّاسِ، وَطَبَخْتُمُوْهُ بِمَا قَطَعْتُمْ مِنْ أَشْجَارِ النَّاسِ؟ ‘কিভাবে আমি তোমাদের খাবার গ্রহণ করব। যার সবগুলো তোমরা মানুষের সম্পদ থেকে লুণ্ঠন করেছ। আর এগুলো রান্না করেছ মানুষের গাছ কেটে?[22] এরপরে কাযান ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর দো‘আ চাইলে তিনি তাঁর দো‘আয় বলেন,اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ عَبْدُكَ هَذَا مَحْمُودٌ إِنَّمَا يُقَاتِلُ لِتَكُوْنَ كَلِمَتُكَ هِيَ الْعُلْيَا، وَلِيَكُوْنَ الدِّينُ كُلُّهُ لَكَ- فَانْصُرْهُ، وَأَيِّدْهُ، وَمَلِّكْهُ الْبِلَادَ وَالْعِبَادَ، وَإِنْ كَانَ إِنَّمَا قَامَ رِيَاءً وَسُمْعَةً، وَطَلَبًا لِلدُّنْيَا، وَلِتَكُوْنَ كَلِمَتُهُ هِيَ الْعُلْيَا، وَلِيُذِلَّ الْإِسْلَامَ وَأَهْلَهُ، فَاخْذُلْهُ، وَزَلْزِلْهُ، وَدَمِّرْهُ، وَاقْطَعْ دَابِرَهُ، ‘হে আল্লাহ! তোমার এই বান্দা মাহমূদ যদি সত্যিকারার্থে তোমার কালিমাকে সমুন্নত করার জন্য এবং তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধ করে, তাহ’লে তাকে সাহায্য কর, তাকে শক্তিশালী কর, তাকে দেশ ও জাতির রাজত্ব দাও। আর যদি যশ ও খ্যাতির জন্য, দুনিয়ার ক্ষমতা লাভের জন্য, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং ইসলাম ও মুসলমানদের লাঞ্ছিত করার জন্য যুদ্ধ করে, তাহ’লে তাকে লাঞ্ছিত কর, অপমানিত কর, তাকে ধ্বংস করে দাও ও তার বংশ নিশ্চিহ্ন করে দাও’।[23]

ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) যখন দো‘আ পাঠ করছিলেন তখন কাযান হাত উত্তোলন করে আমীন বলছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, যখন ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) এমন দো‘আ করছিলেন তখন আমরা আমাদের কাপড়গুলো গুটিয়ে নিচ্ছিলাম এই ভয়ে যে, যখন তাকে হত্যার আদেশ করা হবে তখন রক্ত প্রবাহিত হয়ে কাপড়-চোপড়গুলো ভিজে যাবে। আমরা যখন তার নিকট থেকে চলে যাচ্ছিলাম তখন কাযী নাযিমুদ্দী ও অন্যান্যরা তাকে বললেন, তুমি নিজেকে হত্যা করছিলা, সাথে আমাদেরকেও? আমরা আর তোমার সাথে থাকব না। তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর কসম আমিও তোমাদের সাথে থাকব না। আমরা চলে গেলাম। তিনি ও তার কিছু সাথী রয়ে গেলেন। পরে কাযানের বিশেষ ব্যক্তিরা তাঁর নিকট দলে দলে আগমন করে দো‘আ প্রার্থনা করে বরকত হাছিল করেছিল।[24]

মাহমূদ কাযানের মৃত্যু হ’লে ক্ষমতায় আরোহণ করেন তার ভাই উলজাতু খোদাবান্দাহ। পরে নিজের নাম দেন মুহাম্মাদ বিন আরগুন। তিনি ৭০৩ থেকে ৭১৬ হিজরী পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ক্ষমতায় আরোহণ করে মামলূকদের সাথে বিরোধ কমিয়ে আনেন। তিনি মামলূকদের নিকট পত্র লিখে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আহবান জানান। ফিৎনা অপসারণ করে সন্ধি স্থাপনের প্রস্তাব দেন। পত্রের শেষে লিখেন- পূর্বে যা ঘটেছে আল্লাহ ক্ষমা করে দিন। আর পূর্বের অবস্থায় যে ফিরে যাবে আল্লাহ প্রতিশোধ নিবেন। তার পত্রের জওয়াব দেওয়া হয় এবং দূতকে সসম্মানে হাদিয়াসহ বিদায় দেওয়া হয়।[25] কিন্তু একবছর যেতে না যেতেই এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আর তাহ’ল ওলজাতু শী‘আ মতাদর্শ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন শী‘আ রাফেযীদের মতাদর্শের। তিনি আরব অনারব সর্বত্র শী‘আ মতাদর্শ প্রচারে ব্যাপক কাজ করেন। তিনি জুম‘আর খুৎবার ধরন পরিবর্তন করে দেন। আলী ব্যতীত অন্যান্য খলীফাদের নাম মুছে দেন। সুন্নী রাজাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করেন। সুন্নীদের বিরুদ্ধে খৃষ্টানদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। অবশেষে ৭১২ হিজরীতে শামে আক্রমণ করেন। তিনি মূলতঃ শী‘আ ধর্মীয় নেতা ইবনু মুতাহ্হার হুল্লীর প্রভাবে শী‘আ মতাদর্শ গ্রহণ করেন। যে ব্যক্তি ‘কিতাবু মিনহাজিল কারামাহর’ লেখক ছিলেন। মুহাম্মাদ বিন আরগুনের নিকট তার যথেষ্ট সম্মান ছিল। ফলে এ সুযোগে তাকে সুন্নীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। পরে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) তার প্রতিবাদে ‘মিনহাজুস সুন্নাতিন নবাবিয়া ফী নাক্যে কালামিশ শী‘আ ওয়াল কাদারিয়া’ শিরোনামে গ্রন্থ রচনা করেন । এতে তিনি শী‘আ রাফেযীদের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে খুৎবায় চার খলীফার নাম চালু করার কথা বলেন।

মুহাম্মাদ বিন আরগুন মারা গেলে তার ছোট ছেলে আবু সাঈদ ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি বড় হ’লে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পরে তিনি সুন্নাত কায়েমের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং খুৎবায় চার খলীফার প্রতি সন্তুষ্ট প্রকাশ করে বক্তব্য চালু করেন। লোকেরা এতে আনন্দ প্রকাশ করে।[26]

মুহাম্মাদ বিন আরগূন ও শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ :

৭০২ হিজরী সনে মুহাম্মাদ বিন আরগুন সুন্নীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সিরিয়া আক্রমণ করে। তারা যখন দামেশকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখন লোকেরা পলায়ন করার পথ খুঁজতে থাকে। এরই মধ্যে ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) এদের বিরুদ্ধে লোকদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিনি লোকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাতারদের বিরুদ্ধে আলোচনা করতে লাগলেন। এরপরেও লোকদের আস্থা অর্জন করতে পারছিলেন না। ফলে তিনি তাদের বললেন, আমি মুসলিম সৈন্যদের সামনে গিয়ে জিহাদের আয়াত পাঠ করে তাদেরকে তাতারদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করব। তিনি আরো বললেন, প্রতিরোধের দুর্গ তৈরি করা হবে। তারা যদি আমাদের একটি একটি করে ইট খুলে নেয় তবু আমরা তাদের নিকট মাথা নত করব না। কিছু বিজ্ঞ লোক তাকে মিসরের সুলতান কালাবুনের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করার আবেদন করলে তিনি নিজে মিসরে গেলেন। সুলতান মুহাম্মাদ বিন কালাবুনকে বুঝাতে সক্ষম হ’লেন। তিনি সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। গঠন করা হ’ল মিসর ও সিরিয়ার সমন্বয়ে যেŠথবাহিনী। কিন্তু সমস্যা হ’ল ফক্বীহদের মাস‘আলা। তারা বলল, আমরা কি করে তাতারদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। অথচ তারা কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করে। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,هَؤُلَاءِ مِنْ جِنْسِ الْخَوَارِجِ الَّذِيْنَ خَرَجُوْا عَلَى عَلِيٍّ وَمُعَاوِيَةَ، ‘এরা তো সেই খারেজীদের জাতিগোষ্ঠী যারা আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল’।[27] তিনি আরো বলেন, যারা শরী‘আতের মূলধারা থেকে বের হয়ে ছালাত, ছিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত পরিত্যাগ করেছে তারাতো মুসলিম নয়। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ওয়াজিব। আমি তাদের সৈন্যদের মাঝে প্রবেশ করে দেখেছি তারা ছালাত আদায় করে না। তারা চেঙ্গীস খানের শিক্ষা ও আদর্শের রাষ্ট্র কায়েমের জন্য লড়াই করে। এরপর তিনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন,إِذَا رَأَيْتُمُوْنِيْ مِنْ ذَلِكَ الْجَانِبِ وَعَلَى رَأْسِيْ مُصْحَفٌ فَاقْتُلُوْنِيْ ‘তোমরা যদি আমাকে তাদের পক্ষ হ’তে লড়াই করতে দেখ তাহ’লে আমাকে হত্যা করবে যদিও আমার মাথার উপর কুরআন থাকে’।[28] এই বক্তব্য শুনে লোকেরা নতুনভাবে উজ্জীবিত হ’ল এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নেওয়া শুরু করল। দামেশকের ৩৬ কি.মি. দক্ষিণে শাক্বহাব ((شَقْحَبٌ[29] নামক স্থানে যুদ্ধ শুরু হ’ল। ইবনু তায়মিয়া ও তাঁর সাথীরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেন। এই যুদ্ধে মিসরের আমীর রুকনুদ্দীন বাইবার্স (رُكْنُ الدِّينِ بَيْبَرْسُ) ও হুসামুদ্দীন লাজীনও (حُسَامُ الدِّينِ لَاجِين) অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মিসরীয় সৈন্যদের আসতে দেরী হওয়ায় অনেক মুসলিম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) যুদ্ধের কৌশল হিসাবে দিক পরিবর্তন করলেন। এতে কিছু মানুষ মনে করল, তিনি হয়ত পলায়ন করছেন। এজন্য লোকেরা বলাবলি শুরু করল, যিনি আমাদের পলায়ন করতে নিষেধ করলেন তিনি নিজেই পলায়ন করছেন। কিন্তু তারা জানতে পারেনি কখন আল্লাহর সাহায্য চলে আসবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,ضَحِكَ رَبُّنَا مِنْ قُنُوطِ عِبَادِهِ وَقُرْبِ غِيَرِهِ. قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ! أَوَ يَضْحَكُ الرَّبُّ قَالَ : نَعَمْ . قُلْتُ: لَنْ نَعْدِمَ مِنْ رَبٍّ يَضْحَكُ خَيْرًا  ‘যখন আল্লাহর বান্দারা (সামান্য বিপদেই) হতাশ হয় এবং (বিপদ কেটে উঠার জন্য) আল্লাহ ভিন্ন অপরের নৈকট্য অন্বেষী হয়, তখন আমাদের প্রভু তার এ আচরণে হাসেন। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মহান প্রভু কি হাসেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, আমরা কখনো পুণ্যের কাজ ত্যাগ করব না, যাতে আমাদের প্রভু হাসেন’।[30]

এরই মধ্যে দিনের শেষ প্রান্তে দামেশকের আমীর ফখরুদ্দীন আইয়ায এসে তাদের সুসংবাদ দিলেন যে, মিসরীয় ও সিরীয় সৈন্যদের একত্রিত হওয়ার সময় হয়ে গেছে। আগামী দিন শুক্রবার তাতারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধ হবে। মিসরের সুলতান উপস্থিত হ’লেন। রামাযানের চাঁদ উদিত হ’ল। শায়খুল ইসলামের ইমামতিতে তারাবীহর ছালাত আদায় করা হ’ল। পরের দিন ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে চলে গেল। শনিবারে সবাই আতঙ্কের মধ্যে সকাল করল। সবাই আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করল। নারী ও শিশুরা ছাদে উঠে তাকবীর ধ্বনি দিল। আল্লাহর রহমত বর্ষিত হ’ল। সবাই শান্ত হ’ল। এরপর যুদ্ধ শুরু করল। যুদ্ধে তাতার সৈন্যরা পর্যুদস্ত হ’ল। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বিজয়বেশে দামেশকে প্রবেশ করলেন। তবে তিনি বাইরের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ শেষ করলেও ঘরের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। ভিতরের গাদ্দারদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি একদল সৈন্য নিয়ে লুবনান পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দিলেন। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বিজয় লাভ করলেন। বহু তাতার সমর্থক সঠিক ইসলামে ফিরে আসল। তারা মসজিদ নির্মাণ করে ছালাত আদায় শুরু করল। এরপরেও ইবনু তায়মিয়ার জিহাদ শেষ হ’ল না। তিনি লিখনীর মাধ্যমে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন।[31]

সুলতান তুঘলক তায়মুরের ইসলাম গ্রহণ :

ইসলাম এমন এক আদর্শিক ধর্ম যার কথা শুনে বহু মানুষ তা গ্রহণ করেছে। প্রয়োজন হয়নি অস্ত্র ধারনের বা যুদ্ধের। সুলতান তায়মুর লং (১৩৪৭-১৩৬৩ খৃ. তিনি তামার লিংক (تمرلنك) নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি কাশগরের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সে সময়ের ঐতিহ্য ছিল পশু শিকার করা। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন যাতে তারা তার শিকারের জন্য এলাকা নির্বাচন করে দেয় এবং তার ভিতর কেউ প্রবেশ করলে তাকে আটক করা হয়। সৈন্যরা এলাকায় ঘোষণা করে দিল। তারা একথাও বলে দিল যে, কেউ এই বাগানে প্রবেশ করলে তাকে হত্যা করা হবে। সে সময়ের প্রখ্যাত আলেম জামালুদ্দীন ফারেসী তার সাথীদের নিয়ে সে এলাকায় প্রবেশ করেন। তাদের জানা ছিল না যে, অত্র এলাকায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তারা বুখারা থেকে এসেছিলেন। সে সময় তায়মুর খান শিকারে বের হওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। সৈন্যরা শায়খ জামালুদ্দীন ও তার সাথীদের আটক করে সুলতানের নিকট নিয়ে যায়। তায়মুর খান রাগান্বিত স্বরে তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা অনুমতি ব্যতীত কোন সাহসে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করলে? শায়খ বললেন, আমরা পরদেশী। আমরা জানতাম না যে, সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়েছি। সুলতান অনুভব করলেন যে, এরা ইরানী। তখন তিনি তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, ইরানীরা কুকুর থেকেও তুচ্ছ। শায়খ বললেন, সুলতান সত্যিই বলেছেন। যদি না আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনে হক্বের দীশা দিয়ে ধন্য করতেন, আমরা কুকুর থেকে নীচু থাকতাম। তায়মুর খান তাদেরকে সে অবস্থায় রেখেই শিকারে চলে গেলেন। তিনি তাদেরকে পরবর্তীতে সাক্ষাতের আদেশ দিলেন। শিকার থেকে ফিরে আসলে তিনি শায়খের সাথে একান্ত নির্জনে মিলিত হ’লেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যে দ্বীনে হক্বের কথা বললেন, তার ব্যাখ্যা দিন। শায়খ দ্বীনে হক্বের এমন সুন্দর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলেন যে তাতে সুলতানের হৃদয় বিগলিত হ’ল। কুফরীর এমন এক রূপরেখা তুলে ধরলেন যাতে সুলতান ভয়ে প্রকম্পিত হ’লেন এবং নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, তিনি ভ্রষ্টতা ও বিপদের উপরে আছেন। তবে তিনি তখন ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন না। তিনি ভাবলেন, এখন ইসলাম গ্রহণ করলে তার জাতিকে ইসলামে দীক্ষিত করতে পারবেন না।

তাই তিনি শায়খকে বললেন, আমার পিতার মৃত্যুর পরে আমি পুরো রাজত্বের ক্ষমতায় আসীন হ’লে ইসলাম গ্রহণ করব। শায়খ সুলতানের ক্ষমতায় আসীন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে দ্বিধা করলেন না। তিনি জুগতাঈয়ার সকল রাজ্যকে একত্রিত করে পুরো রাজত্যের ক্ষমতায় আসীন হ’লেন। শায়খ জামালুদ্দীন বিদায় নিয়ে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন। তিনি বাড়িতে গিয়েই প্রচন্ড রোগে আক্রান্ত হ’লেন। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি তার ছেলে রশীদুদ্দীনকে ডেকে বললেন, তুঘলক তায়মুর খুব শীঘ্রই মহান বাদশাহ হবেন। তুমি যখন শুনতে পাবে যে তিনি বাদশাহ হয়েছেন, তখন তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করে আমার সালাম জানিয়ে তার ইসলাম গ্রহণের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। কিছুদিন পরেই তায়মুর বাদশাহ হ’লেন। লোকেরা তার হাতে বায়‘আত নিল। শায়খ রশীদুদ্দীন ছুটে গেলেন তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি সৈন্যদের বাধার কারণে দেখা করতে ব্যর্থ হ’লেন। তিনি কৌশল অবলম্বন করলেন। সুলতানের প্রাসাদের পাশে ফজরের সময় তিন দরাজ কণ্ঠে আযান দিলেন। আযানের শব্দে সুলতানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতে সুলতান তায়মুর খান রেগে গিয়ে আযান দাতাকে তলব করলেন। সৈন্যরা শায়খকে সুলতানের নিকট উপস্থিত করলে তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শায়খ রশীদুদ্দীন সুলতানকে তার বাবার সালাম ও তার সাথে কৃত অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সুলতান তখনই কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তিনি তার প্রজাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করলেন। এভাবেই জুগতাঈ বিন চেঙ্গীস খানের সন্তানদের মাঝে ইসলামের আলো প্রবেশ করল।[32] ফালিল্লাহিল হাম্দ। তিনি নিয়মিত ছালাত আদায় করতেন এবং জুম‘আয় অংশগ্রহণ করতেন। তিনি মাদরাসা ও মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তবে তার শাসনকার্য চেঙ্গীস খানের আল-ইয়াসা/ইয়াসেক সংবিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতেন বলে আল্লামা সাখাভী, শাওকানী, ইবনুল ইমাদ হাম্বলী ও ইবনু কাছীর প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ সমালোচনা করেছেন।[33] কেউ কেউ তাকে শী‘আ রাফেযী বলে অভিহিত করেছেন।[34] আবার কোন কোন ঐতিহাসিক তাকে কাফের আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইবনু আরব শাহ, হাফিযুদ্দীন, মুহাম্মাদ বাযাযী, আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ বুখারী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ[35] ইবনু খালদূন এ সকল সমালোচনার উত্তরে বলেন, আমি তায়মূরের মৃত্যুর পাঁচ বছর পূর্বে তার নিকট ৩৫ দিন অবস্থান করেছিলাম। তিনি শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। লোকেরা তাকে জ্ঞানী বলে জানত। আহলে বায়তদের প্রতি অতি সম্মান করার কারণে আবার কেউ তাকে রাফেযী বলে তিরস্কার করত। আবার কেউ যাদুকরের অপবাদ দিত। অথচ তিনিوليس من ذلك كلّه في شيء، إنّما هو شديد الفطنة والذّكاء، كثير البحث واللّجاج بما يعلم وبما لا يعلم ‘এগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। বরং তিনি খুবই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন। বরং তিনি জানা-অজানা প্রতিটি বিষয়ে অধিক গবেষণা ও চিন্তা করতেন।[36] কেউ আবার তায়মুর লিংকের ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ সমালোচনা করেছেন। কারণ তিনি জনগণের উপর যুলুম ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে চেঙ্গীস খান ও হালাকু খানের পদাংক অনুসরণ করেছিলেন।[37]

তাতার কাফেরদের বিজয়াভিযানের পরিসমাপ্তি :

আইনে জালূত ও গাযার যুদ্ধ :

অপ্রতিরোধ্য তাতার বাহিনী এগিয়ে চলেছে বীর বেশে। কেউ তাদের গতি মন্থর করতে পারছিল না। তারা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে ইহুদী ও খৃষ্টান শক্তির সাথে আতাত করেছিল। কেউবা খৃষ্টান মেয়েকে বিয়ে করে তাদের পক্ষে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মিসরের তৎকালীন সুলতান  মুযাফ্ফর কুতুয (قُطُزْ) তাতারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। অবশেষে গাযার যুদ্ধে তাতার বাহিনী পরাস্ত হয়ে আইনে জালূতে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিতে থাকে। সুলতান কুতুয সেনাপতি রুকনুদ্দীন বাইবার্সের নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী গঠন করেন। আল্লাহর প্রতি দৃঢ় আস্থা ও ঈমানী জোশে উদ্দীপ্ত হয়ে মুসলিম বাহিনী হালাকু বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়।


[1]. ড. ফাহমী হুয়াইদী, আল-ইসলাম ফিছ ছীন, পৃঃ ৩৪; আব্দুর রহমান, মুখতাছারু তারীখিল আরব, পৃঃ ১৩০

[2]. মুহাম্মাদ ফাৎহুল্লাহ যিয়াদী, যাহিরাত ইনতিশারিল ইসলাম, ২২২-২২৪ পৃঃ

[3]. মু‘জামুল বুলদান ২/২৪

[4]. মুহাম্মাদ আলী আল বার্র, কায়ফা আসলামা মোগল ১/৫৫

[5]. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, আদ-দুরারুল কামিনা ফী আ‘য়ানিল মিয়াতিছ ছামিনা ৪/১৫৩; যাহাবী, মু‘জামুশ শুয়ূখিল কাবীর ২/৫৬-৫৭; শায়খ আবু মু‘আবিয়া বায়রূতী বলেন,  ঘটনাটির বর্ণনা সূত্র ছহীহ, আরশীফ মুলতাকা আহলিল হাদীছ ১৪৭/৩৩৫

[6]. আল-বিদায়াহ ১৩/২৪৯

[7]. ঐ, ১৩/২৩৮

[8]. ঐ, ১৩/২৪৯; ড. রাগেব সারজানী, কিছ্ছাতুত তাতার

[9]. ঐ, ১৩/২৪৫

[10]. ঐ, ১৩/২৪৮

[11]. ঐ, ১৩/২৩৯

[12].   ড. মাহমূদ সাইয়েদ দাগীম, আত-তাতার ওয়াল মোগল, পৃঃ ১৫০-১৫৪; Paul Ratchnevsky, Thomas Nivison Haining, Genghis Khan: his life and legacy, p. 204,৩৩৮; The Cambridge history of Iran, Vol 5, By University of Cambridge, p. 204.

[13]. শাযারাতুয যাহাব ৭/৬৪৬

[14]. যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫১/১৩৯-১৪০; ইবনুল ইবারী, তারীখু মুখতাছারিদ দুয়াল ১/২৮৯; তারীখুল খামীস ২/৩৮০; আবুল ফিদা, মুখতাছারু ফী আখবারিল বাশার ৪/১৬; আত-তাতার ওয়াল মুগোল, পৃঃ ১৫০-১৫৪

[15]. আল-বিদায়াহ ১৩/৩৪০,৩৫১; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫২/৩৭; আল-ইবার মিন খাবরে গাবার ৩/৩৮৫; হুসাইন বিন মুহাম্মাদ, তারীখুল খামীস ২/৩৮১; ছালাহুদ্দীন, ফুয়াতুল ওয়াফিয়াত ৪/৯৭; শাওকানী, আল-বাদরুত তালে‘ ২/২

[16]. যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫২/৩৮; তারীখু ইবনুল ওয়ারদী ২/২৩৩; তারীখুল খামীস ২/৩৮১

[17]. যাহাবী, তায্কিরাতুল হুফফায ৪/১৯৯; হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী, আদ-দুরারুল কামেনা ১/৪৫; A. S. Atiya, The Crusade in the Later Middle Ages, পৃ: ২৫৬

[18]. Amitai, see Section VI–Ghazan, Islam and Mongol Tradition–P. 9 and Section VII–Sufis and Shamans, Pg 34; কাযান খ্রিষ্টানদের জিজিয়া কর থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। (See: Richard Folt, Religions of the Silk Road, p.129.

[19]. আল-বিদায়াহ ১৩/৩৫১; মুখতাছারু আখবারিল বাশার ৪/৪৩-৪৪; শাওকানী, আল-বাদরুল ত্বালে‘ ২/৩-৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা পৃ. ২০৪-২০৫

[20]. যিরাকলী, আল-আ‘লাম ৫/১৫২

[21]. আল-বিদায়াহ ১৪/৮৯

[22]. ঐ, ১৪/৮৯

[23]. ঐ, ১৪/৮৯

[24]. ঐ, ১৪/৮৯; মুহাম্মাদ আযীয বিন শামস, আল-জামে‘ পৃঃ ৩২১

[25]. আহমাদ ইবনু আলী মাক্বরিযী, আস-সুলূকু লিমা‘রিফাতি দুয়ালিল মুলূক ২/৩৭৯; আদ-দুরারুল কামেনা ৫/১১৩; আব্দুর রহমান বিন ছালেহ, মাওকেফু ইবনু তায়মিয়া মিনাল আশাঈরাহ ১/১০২

[26]. আদ-দুরারুল কামেনা ৫/১১৩; মাওকেফু ইবনু তায়মিয়া মিনাল আশাঈরাহ ১/১০২

[27]. আল-বিদায়াহ ১৪/২৪

[28]. ঐ, ১৪/২৪

[29]. جَعْفَر জা‘ফর-এর ওযনে। দামেশেকের নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম। দ্রঃ আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব ১/১০২। এছাড়াও মুহাদ্দিছদের একটি জামা‘আতকে অত্র স্থানের প্রতি সম্বন্ধ করা হয়। দ্রঃ তাজুল আরূস ৩/১৫৪।

[30]. ইবনু মাজাহ হা/১৮১; ছহীহাহ হা/২৮১০

[31]. আল-বিদায়াহ ১৪/২৩-২৬

[32]. ড. সাইয়েদ বিন হুসাইন আল-আফানী, ছালাহুল উম্মাহ ফী উলুববীল হিম্মাহ ২/৬২; রুহ্বানুল লায়ল ১/৩৯; আবুল হাসান নাদভী, রাববানিয়াতান লা রুহবানিয়াতান ১/২৭-২৯; T. W. Arnold, Preching of Islam 1/235-236; Mirza Haider, Tarikh e Rashidi, p 14.

[33]. আয-যুউল লামে‘ ৩/৪৯; আল-বাদরুত তালে‘ ১/১৭৮-৮০; শাযারাতুয যাহাব ৯/১০০; আল-বিদায়াহ ৯/৬০; তারীখুল খোলাফা ১/৩৫২

[34]. তারীখে ইবনু খালদূন ৭/৭৪১

[35]. আজায়েবুল মাক্বদূর ফী আখবারে তায়মূর ১/৪৪৫

[36]. তারীখে ইবনু খালদূন ৭/৭৪১

[37]. আল-বিদায়াহ ৯/৬০; তারীখুল খোলাফা ১/৩৫২





পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রের খলীফা হারূণুর রশীদের প্রতি ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক পত্র - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইসলামী শাসনের একটি নমুনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ধৈর্যের অনন্য দৃষ্টান্ত - আবু রাযিয়া, নিয়ামতপুর, নওগাঁ
ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর জীবনী থেকে কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আবু দাহদাহ (রাঃ)-এর দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
তাতারদের আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর মৃত্যুকালীন নছীহত - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
স্ত্রী নির্বাচনে নিয়তের গুরুত্ব - আব্দুত তাওয়াব
খলীফা হারূনুর রশীদের নিকটে প্রেরিত ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক চিঠি (২য় কিস্তি) - ইহসান ইলাহী যহীর
আইনে জালূত যুদ্ধ : তাতারদের বিজয়াভিযানের পরিসমাপ্তি - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
তাতারদরে আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
খলীফা ওমর (রাঃ)-এর অনুশোচনা
আরও
আরও
.