ইহূদী ও খৃষ্টান জাতি উভয়ে বনু ইস্রাঈলের অন্তর্ভুক্ত। ইস্রাঈল হ’ল হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর দ্বিতীয় নাম। যার অর্থ আল্লাহর দাস। তাঁর অধস্তন পুরুষ হযরত মূসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে ‘ইহূদী’ বলা হয়। যিনি ছিলেন বনু ইস্রাঈলের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ রাসূল। অতঃপর সর্বশেষ রাসূল ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে ‘নাছারা’ বা খৃষ্টান বলা হয়। সূরা ফাতেহায় বর্ণিত ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) এবং ‘যা-ল্লীন’ (পথভ্রষ্টগণ) কারা, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তারা হ’ল ইয়াহূদ ও নাছারাগণ’।[1] ইবনু আবী হাতেম বলেন, এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে কোন মতভেদ আছে বলে আমি জানি না’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ইহূদীরা তাদের নবীদেরকে হত্যা করে এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অভিশপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে নাছারারা তাদের নবী ঈসা (আঃ)-কে অতিরঞ্জিত করে আল্লাহর আসনে বসিয়ে এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা করে পথভ্রষ্ট হয়েছে।

বস্ত্ততঃ যারা যিদ ও অহংকার বশে অভিশপ্ত হয়েছে, তাদের সেরা হ’ল ইহূদী জাতি। আর যারা মূর্খতা ও অজ্ঞতা বশে পথভ্রষ্ট হয়েছে, তাদের সেরা হ’ল খৃষ্টান জাতি। ফলে ইহূদী ও খৃষ্টান উভয় জাতিই এক স্তরে চলে গেছে। অতঃপর সর্বযুগে মুক্তিপ্রাপ্ত দল হ’ল তারাই, যারা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের অনুসারী হয়েছে। আখেরী যামানায় তারা হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমগণ। যে বিষয়ে বিদায় হজ্জে আইয়ামে তাশরীক্বের ২য় দিনের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘হে জনগণ! আমি তোমাদের নিকট এমন বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[2]

(১) মূসা (আঃ)-এর অবাধ্যতা :

মূসা (আঃ)-এর দো‘আয় মিসরের অত্যাচারী সম্রাট ফেরাঊনের সাগরডুবির মাধ্যমে তার হাতে নির্যাতিত বনু ইস্রা্ঈলদেরকে নিরাপদে উদ্ধার করার পর শাম যাওয়ার পথে একস্থানে জাঁকজমকপূর্ণ মূর্তিপূজা দেখে তারা আবদার করে বলে, ‘হে মূসা! আমাদের জন্যেও এরূপ উপাস্য বানিয়ে দাও, যেমন এদের অনেক উপাস্য (মূর্তি) রয়েছে! জবাবে মূসা তাদের বলেন, ‘তোমরা তো একটা মূর্খ জাতি’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮)। তিনি বলেন, ‘এসব লোক যে কাজে লিপ্ত রয়েছে তাতো ধ্বংস হবেই। আর যা কিছু তারা করছে, তাতো ফালতু কাজ’। ‘তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহকে ছেড়ে অন্য উপাস্য তালাশ করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে বিশ্ববাসীর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ ৭/১৩৯-১৪০)

হিত্ত্বাহর স্থলে হিনত্বাহ : বনু ইস্রাঈলগণ যখন জান্নাতী খাদ্য বাদ দিয়ে দুনিয়াবী খাদ্য খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যিদ ধরে বসলো, তখন আল্লাহ তাদের পার্শ্ববর্তী জনপদে যেতে বললেন। যেখানে তাদের চাহিদামত খাদ্য-শস্যাদি তারা সর্বদা প্রাপ্ত হবে। উক্ত জনপদে প্রবেশের সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য তিনি কতগুলি আদব ও শিষ্টাচার মান্য করার নির্দেশ দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন আমরা বললাম, তোমরা প্রবেশ কর এ নগরীতে এবং এতে যেখানে খুশী খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ কর। আর নগরীর ফটক দিয়ে প্রবেশ করার সময় সিজদা কর ও বলতে থাক (হে আল্লাহ!) ‘আমাদের ক্ষমা কর’- তাহ’লে আমরা তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং সৎকর্মশীলদের আমরা সত্বর অতিরিক্ত আরও দেব’ (বাক্বারাহ ২/৫৮)। কিন্তু বেআদবীর চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে তারা হিত্ত্বাহ-এর বদলে ‘হিন্ত্বাহ’ অর্থাৎ ক্ষমা প্রার্থনার বদলে ‘গমের দানা’ বলতে বলতে এবং সিজদা বা মাথা নীচু করার পরিবর্তে পিছন দিকে পিঠ ফিরে প্রবেশ করল।[3] এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আল্লাহ পূজারীর বদলে পেটপূজারী বলে প্রমাণ করল। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উক্ত প্রধান ফটককে আজও ‘বাব হিত্ত্বাহ’ বলা হয়ে থাকে (কুরতুবী)। পরে তাদের উপর নানাবিধ গযব নাযিল হয় (বাক্বারাহ ২/৫৯)। যা আজও হচ্ছে।

অথচ যদি তারা প্রথমেই মূসা (আঃ)-এর হুকুম মেনে নিয়ে জিহাদে অবতীর্ণ হ’ত, তাহ’লে তখনই তারা বিজয়ী হয়ে নগরীতে প্রবেশ করত। কিন্তু নবীর অবাধ্যতা করার কারণেই তাদের ৪০ বছর কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হ’ল। পরিশেষে তাদেরকে সেই জিহাদই করতে হ’ল, যা তারা প্রথমে করেনি ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে। বস্ত্ততঃ ভীরু ব্যক্তি ও জাতি কখনো সম্মানিত হয় না।

‘হিনত্বাহ’ ও ‘হিত্ত্বাহ’ বলার মাধ্যমে আল্লাহ বস্ত্তবাদী ও আদর্শবাদী দু’প্রকার মানুষের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। বস্ত্তবাদীরা বস্ত্তর লোভে মানবতাকে ও মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে। পক্ষান্তরে ধার্মিক ও আদর্শবাদীরা তাদের ধর্ম ও আদর্শ রক্ষার জন্য বস্ত্তকে উৎসর্গ করে। ফলে মানবতা রক্ষা পায় ও মানব সভ্যতা স্থায়ী হয়। বাস্তবিক পক্ষে সে যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বস্ত্তবাদীগণ মানবতার ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং বর্তমানে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় স্রেফ তেল লুটের জন্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্রেফ নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তথাকথিত গণতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী রাষ্ট্রনেতাদের হুকুমে টন কে টন বোমা মেরে লাখ লাখ নিরীহ বনু আদমের জান-মাল ও ইযযত লুটে নেওয়া এরই প্রমাণ বহন করে। অথচ কেবলমাত্র তাওহীদ ও আখেরাত বিশ্বাসই মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখে। 

অবাধ্যতার পরিণতি :

মূসা (আঃ)-এর অবাধ্যতা করার ফল স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে মিসর ও শামের মধ্যবর্তী একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ বন্দী রাখেন। যাকে ‘তীহ্’ প্রান্তর বলা হয়। এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’ত। আর সারাদিন চলার পর রাতে আবার সেখানেই ফিরে আসত, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘এই স্থান (বায়তুল মুক্বাদ্দাস) তাদের জন্য চল্লিশ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হ’ল। তারা যমীনে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরবে। অতএব তুমি এ অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্য আক্ষেপ করো না’ (মায়েদাহ ৫/২৬)

তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দী জীবন কাটানোর পর নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বিজয় লাভ করে ও নগরীতে প্রবেশ করে (ইবনু কাছীর)। এভাবে তাদের দীর্ঘ বন্দীত্বের অবসান ঘটে।

(২) দাঊদ (আঃ)-এর অবাধ্যতা ও তার পরিণতি :

বনু ইস্রাঈলের দ্বিতীয় রাসূল দাঊদ (আঃ) নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন তারা শনিবারে ইবাদতের দিন সাগরে মাছ না ধরে। কিন্তু তারা বিভিন্ন কৌশলে মাছ ধরতে থাকে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে বানর ও শুকরে পরিণত করে দেন (বাক্বারাহ ২/৬৫-৬৬)। এজন্য এদেরকে ‘আছহাবুল ক্বেরাদাহ ওয়াল খানাযীর’ অর্থাৎ বানর ও শুকরের বংশ বলা হয়।

(৩) ঈসা (আঃ)-এর অবাধ্যতা ও তার পরিণতি :

মূসা ও দাঊদের ন্যায় বনু ইস্রাঈলগণ তাদের বংশের শেষনবী ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত করে। তারা প্রথমেই ঈসা (আঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে আখ্যায়িত করে (মায়েদাহ ৫/১১০)। অতঃপর তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা (আঃ)-এর সদৃশ হয়ে যায়। ফলে ইহূদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলে, আমরা মারিয়াম-পুত্র ঈসা মসীহ আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করেছি। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছিল, না শূলে চড়িয়েছিল। বরং তাদের জন্য সদৃশ বানানো হয়েছিল। আর যারা এতে মতভেদ করেছিল, তারা ঈসার বিষয়ে অবশ্যই সন্দেহে পতিত ছিল। এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই কেবল ধারণা ব্যতীত। আর নিশ্চিতভাবেই তারা তাকে হত্যা করেনি’। ‘বরং তাকে আল্লাহ নিজের পানে উঠিয়ে নিয়েছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১৫৭-১৫৮)। এ যুগেও অনেক মুসলমান ঈসা (আঃ) সম্পর্কে সন্দেহে পতিত আছেন। সবকিছু লৌকিক জ্ঞান দিয়ে বুঝতে গিয়ে এই অলৌকিক বিষয়ে তারা ভ্রমে পতিত হয়েছেন।

ইস্রাঈলীদের বিভক্তি : ঈসার ঊর্ধ্বারোহনের পর তার অনুসারীরা চার দলে বিভক্ত হয়ে যায়। (১) ইয়াকূবিয়া। যারা বলত, তিনি ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। কিছুদিন দুনিয়ায় থেকে এখন তিনি আকাশে উঠে গেছেন। (২) নুস্তূরিয়া। যারা বলত, তিনি ছিলেন আল্লাহর পুত্র (তওবা ৯/৩০)। (৩) ইস্রাঈলিয়া। যারা বলত, তিনি ছিলেন তিন উপাস্যের অন্যতম (মায়েদাহ ৫/৭৩, ১১৬)। আল্লাহ একজন, ঈসা একজন এবং তার মা মারিয়াম একজন। (৪) মুসলিম। যারা বলেন, তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল (নিসা ৪/১৭১)। আর এটাই হ’ল সঠিক (কুরতুবী; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মারিয়াম ৩৭ আয়াত)

পক্ষান্তরে হকপন্থী ইহূদী ও খৃষ্টানগণ ছিলেন মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম আসার পর প্রকৃত মুসলিমরাই হ’ল মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর যথার্থ অনুসারী। যেমন হিজরতের পর মদীনার ইহূদী ধর্মনেতা আব্দুল্লাহ বিন সালাম মুসলমান হয়ে যান। অন্যদিকে হাবশার খৃষ্টান সম্রাট নাজাশী ইসলাম কবুল করেন।[4] সূরা ছফ ১৪ আয়াতে ‘বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করলেন ও তারা বিজয়ী হ’ল’ বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে (ইবনু কাছীর)। যারা ঈসা ও মুহাম্মাদ উভয় নবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ও দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হয়েছেন (ফুরক্বান ২৫/৭০)। আজও যেসব ইহূদী ও খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবেন তারা উক্ত সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন। নইলে জাহান্নামী হবেন (মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০)

ইস্রাঈলীদের বিষয়ে আল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী : আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা কিতাবে ফায়ছালা করে রেখেছিলাম যে, তোমরা জনপদে (শামে) দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অত্যন্ত বড় ধরনের বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হবে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪)। অর্থাৎ ইহূদী নেতারা সেখানে চরম বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয় এবং সর্বত্র বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর মিসরের আমালেক্বা সম্রাট জালূতকে অধিষ্ঠিত করেন। সে ছিল শক্তিশালী ও দুর্ধর্ষ। পরবর্তীতে আল্লাহ তালূতকে পাঠিয়ে জালূতকে ধ্বংস করে দেন বরং এককভাবে দাঊদের হাতে জালূত নিহত হন (বাক্বারাহ ২/২৫১)। কিন্তু ইহূদীরা আবার বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয় এবং সর্বত্র ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে থাকে। তখন ইরাকের মাওছেল সম্রাট সানজারীব অথবা বাবেল সম্রাট বুখতানছর তাদের উপর চড়াও হন। তিনি বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ পুরা শামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। ইহূদী নেতাদের হত্যা করেন ও বাকীদের বন্দী করে নিজ দেশে নিয়ে যান। এভাবে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে তিনি ইহূদী শূন্য করে দেন (কুরতুবী; ইবনু কাছীর)

ইহূদীদের অভিশপ্ত হওয়ার ১০টি কারণ : ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করায় আল্লাহ ইহূদীদের উপর নানাবিধ দুনিয়াবী গযব নাযিল করেন (বাক্বারাহ ২/৫৯)। তাদেরকে কেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল সূরা নিসা ১৫৫-৬১ আয়াতে সেগুলি বর্ণিত হয়েছে, যা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

(১) তাদের ব্যাপক পাপাচার (২) আল্লাহর পথে বাধা দান (৩) সূদী লেনদেন (৪) অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ (৫) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা (৬) নবীগণকে হত্যা করা (৭) আল্লাহর পথে আগ্রহী না হওয়া এবং অজুহাত দেওয়া যে, আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন (৮) কুফরী করা (৯) মারিয়ামের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া (১০) ঈসাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার মিথ্যা দাবী করা (দ্র. নবীদের কাহিনী ২/২০১ পৃ.)

উল্লেখ্য যে, ঈসা (আঃ) তাঁর উপরে বিশ্বাসী সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খৃষ্টানদের দাবী স্রেফ প্রতারণা ও অপপ্রচার বৈ কিছুই নয়। আল্লাহ বলেন, ‘একের বোঝা অন্যে বহন করবে না’ (আন‘আম ৬/১৬৪)

(৪) শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা :

বাবেল সম্রাট বুখতানছর কর্তৃক কেন‘আন (ফিলিস্তীন) থেকে উৎখাত হওয়ার পর বাকী ইহূদীরা ইয়াছরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছে। অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাছিল করবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তাঁর আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তাঁর দ্বীন কবুল করবে এবং তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারণা ছিল যে, আখেরী নবী অবশ্যই তাদের নবী ইসহাক-এর বংশে হবেন। কিন্তু তা না হয়ে ইসমাঈল-এর বংশে হওয়াতেই তারা তাঁকে অস্বীকার করল ও তাঁকে ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত হ’ল।

মদীনায় ইহূদীদের আধিক্য ছিল এবং নাছারা ছিল খুবই কম। তাদের মূল অবস্থান ছিল মদীনা থেকে নাজরান এলাকায়। যা ছিল ৭৩টি পল্লী সমৃদ্ধ খ্রিষ্টানদের একটি উন্নত নগরীর নাম। বর্তমানে সড়কপথে এটি মদীনা থেকে ১২০৫ কি.মি. দক্ষিণে ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত। 

ইহূদী ও নাছারাদের মধ্যে তাওরাত-ইনজীলের কোন শিক্ষা অবশিষ্ট ছিল না। তাদের ধর্ম ও সমাজনেতারা ভক্তদের কাছে ‘রব’-এর আসন দখল করেছিল। ইহূদীরা ওযায়েরকে ‘আল্লাহর পুত্র’ এবং নাছারারা মসীহ ঈসাকে ‘আল্লাহর পুত্র’ দাবী করেছিল (তওবা ৯/৩০-৩১)। বরং তারা মারিয়াম, ঈসা ও আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তাদের পীর-আউলিয়ারা ধর্মের নামে অবৈধ পন্থায় মানুষের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করত এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতো (তওবা ৯/৩৪)। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারা তা হালাল করত এবং তাদের মন্দকর্মগুলি তাদের নিকট শোভনীয় বলে গণ্য হ’ত (তওবা ৯/৩৭)। এক কথায় তাওরাত-ইনজীলের বাহক হবার দাবীদার হ’লেও তারা ছিল পুরা স্বেচ্ছাচারী ও প্রবৃত্তিপূজারী।

রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা রটনা :

কা‘ব বিন আশরাফ ছিল মদীনার খ্যাতনামা ইহূদী পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। বদর যুদ্ধে কুরায়েশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সে কবিতা বলতে থাকে এবং কুরায়েশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে ৩য় হিজরীর ১৪ই রবীউল আউয়াল তাকে হত্যা করা হয় (বুখারী হা/৪০৩৭ প্রভৃতি)। বর্তমান যুগে ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গকারী ব্লগারদের জন্য একই শাস্তি বিধেয়। যা কার্যকরী করা মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের কর্তব্য।

শেষনবীর বিরুদ্ধে ইহূদীদের চক্রান্ত : মদীনার তিনটি ইহূদী গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যার নেতারা সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত থাকত। এসময় বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ে তারা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত শুরু করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, সম্পদশালী ও মুসলমানদের প্রতি সর্বাধিক বিদ্বেষপরায়ণ ছিল বনু ক্বায়নুক্বা। বদর যুদ্ধের পর ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দুর্গ অবরোধ করেন ও দু’সপ্তাহ অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর তাদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর একই কারণে ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে বনু নাযীরকে এবং ৫ম হিজরীর যিলহজ্জ মাসে বনু কুরায়যাকে বিতাড়নের মাধ্যমে মদীনাকে ইহূদীমুক্ত করা হয়।

বনু নাযীর খায়বরে নির্বাসিত হয়ে সেখান থেকে কুরায়েশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে মদীনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। ফলে তাদেরকে পুনরায় বিতাড়নের জন্য ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তারা সেখানে রাসূল (ছাঃ)-কে দাওয়াত দিয়ে তাঁকে বকরীর বিষমাখানো ভূনা রান খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে।[5] কিন্তু আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান।

একইভাবে তাদের চক্রান্তে মদীনায় রোমক হামলার আশংকা দেখা দেয়। ফলে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে মুতার যুদ্ধ ও ৯ম হিজরীর রজব মাসে সর্বশেষ তাবূক অভিযান সংঘটিত হয়। এমনকি ১১ হিজরীতে মৃত্যুর দু’দিন আগেও রোমক হামলা প্রতিরোধের জন্য রাসূল (ছাঃ) ওসামা বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন। এভাবে দেখা যায়, মদীনায় হিজরতের শুরু থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত অধিকাংশ যুদ্ধের পিছনে ইহূদী চক্রান্ত সক্রিয় ছিল। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।

সূদী কারবারী ইহূদী :

পৃথিবীর সকল এলাহী ধর্মে সূদ নিষিদ্ধ। অথচ মদীনার ইহূদীরা ছিল সূদী কারবারী ও দক্ষ ব্যবসায়ী। সেকারণ তারা ছিল সর্বাধিক সচ্ছল। সেই সাথে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও কূট কৌশলের মাধ্যমে এরা স্থানীয় আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখতো এবং ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে উভয় গোত্রের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতো। আসলে তারা উভয় গোত্রেরই শত্রু ছিল। তাদেরকে তারা সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করত। এজন্য তাদের মূর্খতার প্রতি তাচ্ছিল্য করে তারা বলত, ‘মূর্খদের ব্যাপারে আমাদের কোন দায়িত্ব নেই’ (আলে ইমরান ৩/৭৫)। অর্থাৎ মূর্খদের সম্পদ ও মানবাধিকার হরণ করায় আমাদের কোন পাপ নেই।

বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলি উন্নয়নশীল ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তাদের সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসা পূর্বের ন্যায় বজায় রেখে চলেছে। মুসলমানদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের মানবাধিকার বিনষ্ট করায় কোন পাপ নেই বলে আজও তাদের আচরণে প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূগর্ভের তৈল লুট করার জন্য তারা ভূপৃষ্ঠের মানুষের রক্ত পান করছে গোগ্রাসে। কিন্তু এই রক্তচোষাদের রক্ত নেশা মিটছে না মোটেই। এজন্যেই এরা ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) ও ‘যা-ল্লীন’ (পথভ্রষ্ট) বলে কুরআনে অভিহিত হয়েছে।[6] অতএব মুসলিম রাষ্ট্রগুলির উচিৎ পুঁজিবাদী সূদী অর্থনীতি ছেড়ে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ইসলামী অর্থনীতি কায়েম করা।

ওছমানী খেলাফত ধ্বংসের কারণ ছিল ফিলিস্তীন ইস্যু :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মদীনা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে ইহূদীরা মুসলমানদের স্থায়ী শত্রুতে পরিণত হয়। খেলাফতে রাশেদাহ, খেলাফতে উমাইয়া, আববাসীয়া, স্পেনীয় ও সর্বশেষ ওছমানী খেলাফতের সকল যুগে এরা বাহ্যিকভাবে মুসলিম সেজে ভিতর থেকে অন্তর্ঘাত মূলক কাজ করেছে। ওছমানী খেলাফত কালে তারা খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খেলাফত ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হয় এবং সেই সাথে ফিলিস্তীন দখলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।

এই সময় আন্তর্জাতিক ইহূদী সংস্থার প্রধান থিওডোর হার্জেল (১৮৬০-১৯০৪ খৃ.) জার্মানী, বৃটেন ও ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক তৈরী করেন। তিনি তাদের কাছ থেকে ওছমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। এসময় খেলাফতে চলছিল চরম আর্থিক দৈন্য। এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে হার্জেল ওছমানী খলীফা ২য় আব্দুল হামীদের (১৮৭৬-১৯০৯ খৃ.) দরবারে ১৮৯৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী তার বন্ধু নিওলনস্কিকে প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, হে খলীফা! আমরা আপনার আর্থিক সংকট মোকাবিলার জন্য ২০ মিলিয়ন লীরা (তুর্কী মুদ্রা) দান করব। এর মধ্যে ২ মিলিয়ন থাকবে ফিলিস্তীনের জন্য এবং বাকী খেলাফতের ঋণ পরিশোধের জন্য। এছাড়া খলীফাকে প্রয়োজনে আমরা যেকোন ঋণ সহায়তা দেব’। তিনি বলেন, যদি আমরা ফিলিস্তীন পাই, তাহ’লে আমরা তুরস্কের জন্য আরও বহু অর্থ ও উপঢৌকন প্রদান করব’। জওয়াবে খলীফা বললেন, ‘আমি এই পবিত্র ভূমির এক বিঘত পরিমান মাটিও হ্রাস করতে পারব না।...আমি আমার দেহে ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে দেব না, যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি’।

সুলতানের এই কড়া জবাব পাওয়ার পর ইহূদী নেতারা অন্য পথ ধরেন। তারা তুরস্কে তাদের দোসর নব্য তুর্কীদের দিয়ে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তাদের ইঙ্গিতে নতুন সংগঠনের জন্ম হয় ‘জমঈয়াতুল ইত্তিহাদি ওয়াত তারাক্কী’ বা ‘ঐক্য ও উন্নয়ন সংস্থা’।

তারা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করেন। সাথে সাথে তরুণদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উস্কানী দিয়ে তাদেরকে খলীফার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। তারা ইসলামী জাতীয়তাবাদের স্থলে তুর্কী জাতীয়তাবাদের স্লোগান ও বিভিন্ন গান তৈরী করেন। বস্ত্ততঃ এই লোকগুলি ছিল ইস্রাঈলের গুপ্ত বাহিনী ‘মোসাদ’-এর চর। যারা ইসলামকে মুমিনের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চায়। অতঃপর তারা খলীফাকে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং তাকে গ্রীসের সালানীক দ্বীপে নির্বাসনে পাঠায়। তারা তাঁর ভাই ৫ম মুহাম্মাদকে (১৯০৯-১৯১৮ খৃ.) ক্ষমতায় বসায়।

এভাবে রাজধানী ইস্তাম্বুল যখন পুরাপুরি ইংরেজদের করতলগত হয়, তখন তাদের ইঙ্গিতে কামাল পাশাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান সেনাপতি করা হয়। ইহূদীরা কামালকেই তাদের উদ্দেশ্য হাছিলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। কিছুদিন পর তারা সুলতান ৫ম মুহাম্মাদকে সরিয়ে তার ভাই ৬ষ্ঠ মুহাম্মাদকে ক্ষমতায় বসায় (১৯১৮-১৯২২ খৃ.)। অতঃপর তাঁকে সরিয়ে ২য় আব্দুল মজীদ বিন সুলতান আব্দুল আযীযকে ক্ষমতায় বসায় (১৯২২-১৯২৪ খৃ.)। তিনি ছিলেন ওছমানী খেলাফতের ৩৭তম ও সর্বশেষ খলীফা। মুছতফা কামাল তাকে গৃহবন্দী করে রাখেন। এমনকি ছালাতের জন্য মসজিদে যেতে দিতেন না। কেননা তিনি বের হ’লেই মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় হুমড়ি খেয়ে পড়ত। অতঃপর ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ তারিখে ‘জমঈয়তুল ইত্তিহাদ’-এর এক সম্মেলনে চিরতরে ‘খেলাফত’ বিলুপ্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়। এভাবে কামাল পাশার হাতেই খেলাফতের (৬৮০-১৩৪২ হি./১২৮১-১৯২৪ খৃ.) আলো নির্বাপিত হয়। যে আলোর নীচে মুসলমানেরা ৬৬২ বছর ধরে বসবাস করে আসছিল। ইংরেজরা কামাল পাশাকে ‘আতাতুর্ক’ অর্থাৎ ‘তুর্কী জাতির পিতা’ উপাধি দিয়ে ক্ষমতায় বসায়।[7]

এভাবে ওমর (রাঃ) কর্তৃক ১৫ হিজরীতে ফিলিস্তীন অধিকারের পর থেকে ১৩৪২ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩২৭ বছর ফিলিস্তীন মুসলিম অধিকারে থাকে। যদিও মাঝে ক্রুসেড যুদ্ধের সময় কিছু সাময়িক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। যা ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে গাযী ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর (১১৩৮-১১৯৩ খৃ.) হাতে শেষ হয়ে যায়। অতঃপর ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে পরাশক্তিগুলির মাধ্যমে কথিত ‘ইস্রাঈল’ রাষ্ট্র জন্ম নেয়। যা মূলতঃ তেল সম্পদে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের উপর ছড়ি ঘুরানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। সূরা আ‘রাফ ১৬৭ ও ১৬৮ আয়াতের মর্ম অনুযায়ী নিশ্চিতভাবেই এটি সাময়িক ঘটনা। এরা মিসকীনদের মত পরাশক্তিগুলির দয়ায় বেঁচে থাকবে এবং সর্বত্র লাঞ্ছিত হবে। অতএব কখনোই রাষ্ট্র হিসাবে এটি স্থায়ী হবে না। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

ইস্রাঈলীদের মন্দ পরিণতি :

আল্লাহ বলেন, ‘যেখানেই তারা থাকুক না কেন তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হবে, কেবলমাত্র আল্লাহর অঙ্গীকার ও মানুষের অঙ্গীকার ব্যতীত। তারা আল্লাহর ক্রোধ অপরিহার্য করে নিয়েছে এবং তাদের উপর পরমুখাপেক্ষিতা আপতিত হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। কারণ ওরা অবাধ্য হয়েছে ও সীমালংঘন করেছে’ (আলে ইমরান ৩/১১২)। এখানে ইহূদীদের স্থায়ী লাঞ্ছনার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা বাঁচবে কেবল দু’ভাবে। এক- আল্লাহর অঙ্গীকার। আর সেটি হ’ল তাদের নারী-শিশুরা। দুই- মানুষের অঙ্গীকার। আর সেটি হ’ল মুসলমান বা অন্যদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। যেমন তারা এখন টিকে আছে কতিপয় পরাশক্তির উপর ভর করে। তাদের স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ইহূদীদের লাঞ্ছনা বৃদ্ধি পাবে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়েই থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসূল! তুমি স্মরণ কর) যখন তোমার পালনকর্তা (ইহূদীদের) জানিয়ে দেন যে তিনি তাদের উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশ্যই এমন সব লোকদের প্রেরণ করবেন, যারা তাদেরকে নিকৃষ্টতম শাস্তি দিতে থাকবে। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদাতা এবং তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। ‘আর আমরা তাদেরকে দলে-উপদলে বিভক্ত করে টুকরা টুকরা করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেই। তাদের মধ্যে কেউ ভাল কেউ অন্য রূপ। আমরা তাদেরকে ভাল ও মন্দ দ্বারা পরীক্ষা করি যাতে তারা ফিরে আসে’ (আ‘রাফ ৭/১৬৭-৬৮)

ইতিপূর্বে তারা মিসরের আমালেক্বা সম্রাট জালূত ও পরে ইরাকের বাবেল সম্রাট বুখতানছরের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তারা জার্মান নেতা এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) কর্তৃক জার্মান অধিকৃত ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। যা ‘হলোকস্ট গণহত্যা’ (Holocaust genocide) বলে খ্যাত। যেখানে ২য় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে ৬০ লক্ষ ইহূদীকে হত্যা করা হয় বলে প্রসিদ্ধি আছে। যা ইউরোপের দুই তৃতীয়াংশ ইহূদীর সমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, নাৎসি গণহত্যার সকল ঘটনা আমলে নিলে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে নববই লক্ষ থেকে এক কোটি দশ লক্ষের মত।

এই ইহূদী নির্মূলকরণের পিছনে রাজনৈতিক কারণ যেটাই থাক না কেন, জার্মানীকে ইহূদীশূন্য করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তাদের সূদী কারবার ও দাদন ব্যবসা। যা সে দেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের রক্ত শোষণ করত। দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও তারাই দেশের অর্থনীতির একচ্ছত্র অধিকারী ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইহূদী বিদ্বেষ চরমে উঠেছিল। তাই হিটলার তাদের পরিচালিত ব্যাংক, ব্যবসা ও সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিনেমা, ভিডিও গেমস, ধূমপান ও মাদক সহ নৈতিকতা বিরোধী সকল কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করেন। অবশেষে তিনি তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। যে সিদ্ধান্ত ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামে খ্যাত। যার পরিণতিতে ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে কয়েক বছরে ইহূদী নির্মূল অভিযান বাস্তবায়িত হয়। যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম সেরা নিকৃষ্টতম গণহত্যা।

কিন্তু এত কিছুর পরেও ইহূদীদের চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা এখন বিভিন্ন দেশে তাদের গুপ্ত বাহিনী ‘মোসাদ’-এর মাধ্যমে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে এবং ফিলিস্তীনীদের উপর অব্যাহত হামলা চালাচ্ছে। কথিত ইস্রাঈল রাষ্ট্রে তারা জমা হ’তে থাকলেও তাদের ধ্বংস অত্যাসন্ন। কেবল আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা।[8]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আঃ) অবতরণ করবেন’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৫০৫) এবং মাহদীর নেতৃত্বে সাত বছর পৃথিবী সুন্দর শাসনে ও সুবিচারে ভরিয়ে দিবেন।[9] এসময় মুসলিমগণ তাঁর অনুসারী হবেন এবং ইহূদীরা দাজ্জালের অনুসারী হবে।[10] তিনি বায়তুল মুক্বাদ্দাসের ‘লুদ’ নামক দরজার পাশে দাজ্জালকে হত্যা করবেন।[11] তখন মুসলমানরা ইহূদীদের ব্যাপকভাবে হত্যা করবে। তারা পাথর ও গাছের পিছনে লুকাবে। সে সময় গাছ ও পাথরগুলি বলবে, এই যে আমার পিছনে একটা ইহূদী লুকিয়ে আছে।[12] উক্ত হাদীছে বুঝা যায় যে, পৃথিবীতে যালেম-মযলূম আছে, কিন্তু দাজ্জাল নেই। কেননা অন্য হাদীছে বর্তমানে শিকলবন্দী দাজ্জালের বক্তব্য এসেছে এভাবে যে, যদি আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহ’লে আমি পুরা পৃথিবী ধ্বংস করে দেব মদীনা ব্যতীত’ (মুসলিম হা/২৯৪২ (১২১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, মক্কা ও মদীনা ব্যতীত’ (মুসলিম হা/২৯৪৩ (১২৩); মিশকাত হা/২৭৪২)।

ইহূদী-খৃষ্টান ও কাফিরদের বিষয়ে আল্লাহর হুঁশিয়ার বাণী

ইহূদী জাতি তাদের নবীদের হত্যা করেছে ও নানাবিধ কষ্ট দিয়েছে (বাক্বারাহ ২/৬১)। যা থেকে সাবধান করে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা মূসাকে কষ্ট দিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ তাকে মুক্ত করেন যা তারা রটনা করেছিল। বস্ত্ততঃ সে ছিল আল্লাহর নিকট অতীব মর্যাদাবান’ (আহযাব ৩৩/৬৯)

আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহূদী-নাছারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। তবে দুনিয়াবী ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য কাফির-মুশরিকদের সাথে বাহ্যিকভাবে সম্পর্ক রাখার অনুমতি রয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন ছাড়া কোন কাফিরকে মুমিনগণ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে না। যদি কেউ এটা করে, তবে তাদের সঙ্গে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি কি-না তোমরা তাদের থেকে কোনরূপ অনিষ্টের আশংকা কর (তবে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখা যাবে)। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজ সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন। (মনে রেখ) সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। একারণে ইসলাম ও ইসলামী খেলাফতের মৌলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণকারী বিষয় সমূহ বাদে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরী-বাকুরী ইত্যাদি বিষয়ে অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই। মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানগণ উপরে বর্ণিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সতর্ক বাণী সমূহ অনুধাবন করবেন কি?

[নিবন্ধটি দৈনিক ইনকিলাব ৩১শে মে ও ১লা জুন ২০২১ রবিবার ও সোমবার ‘সম্পাদকীয়’ কলামে কিছুটা সংক্ষেপে প্রকাশিত হয়।-সম্পাদক]


[1]. তিরমিযী হা/২৯৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৮২০২।

[2]. হাকেম ১/১৭১ পৃ. হা/৩১৮; মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮; মিশকাত হা/১৮৬; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৭২৩-২৪ পৃ.।

[3]. বুখারী হা/৩৪০৩ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়।

[4]. দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ২৫৮, ৫৮৬ পৃ.।

[5]. বুখারী হা/৩১৬৯; মিশকাত হা/৫৯৩৫ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[6].সূরা ফাতেহা ৭ আয়াত; তিরমিযী হা/২৯৫৪।

[7]. দ্র. ড. আলী ছাল্লাবী ‘আদ-দাওলাতুল ওছমানিইয়াহ’ বই।

[8]. এ বিষয়ে বিস্তারিত পাঠ করুন : লেখক অনূদিত ও হাফাবা প্রকাশিত ‘আরব বিশ্বে ইস্রাঈলের আগ্রাসী নীল নকশা’ বই।

[9]. আবুদাঊদ হা/৪২৮৫; মুসলিম হা/১৫৬; মিশকাত হা/৫৪৫৪; ৫৫০৭।

[10]. মুসলিম হা/২৯৪৪; মিশকাত হা/৫৪৭৮।

[11]. মুসলিম হা/২৯৩৭; তিরমিযী হা/২২৪৪; মিশকাত হা/৫৪৭৫।

[12]. মুসলিম হা/২৯২২; মিশকাত হা/৫৪১৪।






ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
নিয়মের রাজত্ব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
শবেবরাত : কতিপয় ভ্রান্ত ধারণার জবাব - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলামে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ও শ্রমিকের অধিকার - ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
কুরআন ও হাদীছের আলোকে ‘সোনামণি’র ৫টি নীতিবাক্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
অছিয়ত নামা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পেরেনিয়ালিজম এবং ইসলাম - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
ঈদুল আযহা : গুরুত্ব ও তাৎপর্য - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর সাথে একটি শিক্ষণীয় বিতর্ক - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আরও
আরও
.