ভূমিকা : আল্লাহর নিকট বান্দার ক্ষমা ভিক্ষা ও প্রার্থনা নিবেদনের যত মাধ্যম রয়েছে তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হ’ল ছালাত। ক্বিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার ছালাতের। ছালাতের হিসাব সঠিক হ’লে তার সমস্ত আমল সঠিক হবে। আর ছালাতের হিসাব বাতিল হ’লে তার সমস্ত আমল বরবাদ হবে। ছালাত প্রথমতঃ দুই ভাগে বিভক্ত যথা- ফরয ও নফল। ফরয ব্যতীত বাকী সকল ছালাতই নফল। নফল ছালাতের মাধ্যমে বান্দার ফরয ছালাতের ঘাটতি পূর্ণ হয়। এটি এমন এক মর্যাদা ও ফযীলতপূর্ণ ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মিত হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে নফল ছালাতের বিভিন্ন দিক ও কতিপয় নফল ছালাতের পরিচয় তুলে ধরা হ’ল।-
নফল ছালাতের পরিচয় : নফল (النفل) আরবী শব্দ। অর্থ-কর্তব্যের অতিরিক্ত কাজ, ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয় এমন, অতিরিক্ত।[1] পারিভাষিক সংজ্ঞায় সাইয়্যেদ শরীফ ইবনুল হাসান জুরজানী বলেন,اسم لما شرع زيادة علي الفرائص والواجبات، ‘ফরয ও ওয়াজিবের অতিরিক্ত শরী‘আত প্রবর্তিত বিষয়কে নফল বলে’।[2] কেউ কেউ বলেন,النافلة ما كان زيادة على الأصل، ‘মূলের অতিরিক্ত বিষয়ই নফল’।[3] তাই নফল ছালাত অর্থ শরী‘আত নির্ধারিত ফরয ছালাতের অতিরিক্ত ছালাত। মূলতঃ ফরয ব্যতীত সকল ছালাতই নফল বা অতিরিক্ত। তবে যেসব নফল ছালাত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত পড়তেন বা পড়তে তাকীদ করতেন, সেগুলিকে ফিক্বহী পরিভাষায় ‘সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ’ বা ‘সুন্নাতে রাতেবাহ’ বলা হয়। যেমন ফরয ছালাত সংশ্লিষ্ট সুন্নাত সমূহ।[4] এই সুন্নাতগুলি ক্বাযা হ’লে তা আদায় করতে হয়। যেমন যোহরের প্রথম দু’রাক‘আত বা চার রাক‘আত সুন্নাত ক্বাযা হ’লে তা যোহর ছালাত আদায়ের পরে পড়তে হয় এবং ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ক্বাযা হ’লে তা ফরয ছালাতের পরেই পড়তে হয়।[5]
২য় প্রকার সুন্নাত হ’ল ‘গায়ের মুওয়াক্কাদাহ’, যা করলে নেকী আছে, কিন্তু তাকীদ নেই।[6] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘দুই আযানের মধ্যে’ অর্থাৎ আযান ও এক্বামতের মাঝে ছালাত রয়েছে (২ বার)। তৃতীয়বারে বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে’।[7] যেমন আছরের পূর্বে দুই বা চার রাক‘আত সুন্নাত, মাগরিব ও এশার পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাত প্রভৃতি।[8]
নফল ছালাতের গুরুত্ব ও ফযীলত : নফল ছালাতের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল।-
১. ফরয ছালাতের ঘাটতি পূরণ : আল্লাহ তা‘আলার একান্ত সান্নিধ্য লাভের জন্য ফরয ইবাদত যেমন যরূরী, তেমনি ফরয ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করার জন্য নফল ইবাদত যরূরী। আমাদের অনেকের বিভিন্ন সময়ে ফরয ছালাতে ঘাটতি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাশরের ময়দানে ফরয ছালাতের ঘাটতি পূরণ হবে নফল ছালাত দ্বারা। যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهِ صَلاَتُهُ فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ فَإِنِ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيضَتِهِ شَىْءٌ قَالَ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِى مِنْ تَطَوُّعٍ فَيُكَمَّلَ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنَ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ يَكُونُ سَائِرُ عَمَلِهِ عَلَى ذَلِكَ، ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার ছালাতের। যদি তার ছালাতের হিসাব সঠিক হয় তাহ’লে সে সফলকাম হবে ও নাজাত পাবে। আর যদি ছালাত বিনষ্ট হয়ে যায় তাহ’লে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি ফরয ছালাতে কিছু কমতি হয়, তাহ’লে প্রতিপালক আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার বান্দার কোন নফল ইবাদত আছে কি-না? তখন নফল দিয়ে ফরযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর তার অন্যান্য সকল আমল সম্পর্কেও অনুরূপ করা হবে’ (যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদিতে)।[9]
শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার অশেষ দয়া, নে‘মত ও অনুগ্রহের অন্যতম হ’ল, তিনি আমাদের জন্য প্রত্যেক ওয়াক্তে ফরয ছালাতের আগে ও পরে নফল ছালাতের বিধান দিয়েছেন, শুধু নিষিদ্ধ ওয়াক্ত ব্যতীত। যাতে মুসলমান বান্দা তার ফরয ছালাতের ঘাটতি নফল ছালাত দ্বারা পূর্ণ করতে পারে’।[10]
২. মর্যাদা উন্নতকরণ : নফল ছালাত মুছল্লীর মর্যাদা উন্নত করে এবং তার পাপ মোচন করে তাকে আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত করে। জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভের যত মাধ্যম রয়েছে তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হ’ল নফল ছালাত। মা‘দান ইবনু ত্বালহা (রহঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মুক্তদাস ছাওবান (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে বললাম,أَخْبِرْنِى بِعَمَلٍ أَعْمَلُهُ يُدْخِلُنِى اللهُ بِهِ الْجَنَّةَ فَسَكَتَ ثُمَّ سَأَلْتُهُ فَسَكَتَ ثُمَّ سَأَلْتُهُ الثَّالِثَةَ فَقَالَ سَأَلْتُ عَنْ ذَلِكَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ فَإِنَّكَ لاَ تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً، ‘আমাকে এমন একটি কাজের সন্ধান দিন, যে কাজ আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি চুপ থাকলেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। তিনি চুপ থাকলেন। আমি তৃতীয়বার তাকে একই প্রশ্ন করলাম। তিনি উত্তরে বললেন, আমি নিজেও এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তোমার উচিত আল্লাহকে বেশী বেশী সিজদা করা। কেননা আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রতিটি সিজদার মাধ্যমে আল্লাহ তোমার সম্মানের স্তর একটি করে বৃদ্ধি করবেন ও তোমার থেকে একটি করে গোনাহ দূর করে দিবেন’।[11]
৩. আল্লাহর ভালোবাসা লাভ : মানুষ যেসব আমলের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভে ধন্য হয় তন্মধ্যে নফল ছালাত অন্যতম। এ ছালাতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ اللهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِى بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِى يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِى يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِى يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِى يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِى يَمْشِى بِهَا، وَإِنْ سَأَلَنِى لأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِى لأُعِيذَنَّهُ، ‘আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন প্রিয় বান্দার সাথে দুশমনী করল, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। আমি যেসব বিষয় ফরয করেছি, তার মাধ্যমে আমার নৈকট্য অনুসন্ধানের চাইতে প্রিয়তর আমার নিকটে আর কিছু নেই। বান্দা বিভিন্ন নফল ইবাদতের মাধ্যমে সর্বদা আমার নৈকট্য হাছিল করে, এমনকি আমি তাকে ভালোবাসি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শ্রবণ করে। চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দর্শন করে। হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধারণ করে। পা হয়ে যাই, যার সাহায্যে সে চলাফেরা করে। যদি সে আমার নিকটে কোন কিছু প্রার্থনা করে, আমি তাকে তা দান করে থাকি। যদি সে আশ্রয় ভিক্ষা করে, আমি তাকে আশ্রয় দিয়ে থাকি’...।[12]
৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে জান্নাতে থাকার সৌভাগ্য অর্জন : জান্নাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে থাকা বড়ই সৌভাগ্য ও মর্যাদার বিষয়। এই সৌভাগ্য তারাই অর্জন করতে পারবে যারা অধিক হারে নফল ছালাত আদায় করবে। এর মাধ্যমে তার ছওয়াব বৃদ্ধি পাবে এবং গুনাহ দূর হবে। রবী‘আহ বিন কা‘ব (রাঃ) বলেন,كُنْتُ أَبِيتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَأَتَيْتُهُ بِوَضُوئِهِ وَحَاجَتِهِ فَقَالَ لِى سَلْ. فَقُلْتُ أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِى الْجَنَّةِ. قَالَ أَوَغَيْرَ ذَلِكَ. قُلْتُ هُوَ ذَاكَ. قَالَ فَأَعِنِّى عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ ‘আমি রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাথে থাকতাম এবং ওযূর পানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দিতাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন, (কল্যাণের কিছু) চেয়ে নাও। আমি নিবেদন করলাম, আমি জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই। তিনি বললেন, এছাড়া আর কিছু চাও? আমি বললাম, এটাই (আমি চাই)। তিনি বললেন, তুমি বেশী বেশী সিজদা করে (এ ব্যাপারে) আমাকে সাহায্য কর’।[13]
৫. জাহান্নামের আগুন হারাম : যারা ফরয ছালাতের সাথে সাথে নফল ছালাত আদায় করেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি অত্যন্ত খুশি হন। ফলে তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়। উম্মু হাবীবা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ حَافَظَ عَلَى أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعٍ بَعْدَهَا حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ، ‘যে ব্যক্তি যোহরের ফরয ছালাতের পূর্বে চার রাক‘আত এবং পরে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ صَلَّى أَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعًا بَعْدَهَا لَمْ تَمَسَّهُ النَّارُ، ‘যে ব্যক্তি যোহরের ফরয ছালাতের পূর্বে চার রাক‘আত এবং পরে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না’।[15]
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার উপর যে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন সেটা ছাড়াও কতিপয় নফল ছালাত রয়েছে, যা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ।
কতিপয় নফল ছালাত ও তার ফযীলত :
১. দিনে রাতে ১২ রাক‘আত সুন্নাত : মুমিন বান্দা দিনে রাতে ১২ রাক‘আত সুন্নাতে মু‘য়াক্কাদাহ ছালাত আদায় করলে জান্নাতে তার জন্য ঘর নির্মিত হয়। উম্মু হাবীবা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ صَلَّى فِىْ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِى الْجَنَّةِ، أَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَهَا وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ صَلاَةِ الْفَجْرِ، ‘যে ব্যক্তি দিনে-রাতে ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। যোহরের পূর্বে চার, পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পরে দুই ও ফজরের পূর্বে দুই’।[16] ইবনু ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূলুললাহ (ছাঃ) থেকে যোহরের পূর্বে দু’রাক‘আত সহ সর্বমোট দশ রাক‘আতের কথা এসেছে।[17] আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,رَكْعَتَا الْفَجْرِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا، ‘ফজরের দু‘রাক‘আত সুন্নাত ছালাত দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু হ’তে উত্তম’।[18]
অনুরূপভাবে বিতর ছালাতও খুব ফযীলতপূর্ণ ছালাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীতে বা সফরে কোন অবস্থায় বিতর ও ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত পরিত্যাগ করতেন না।[19]
‘বিতর’ অর্থ বেজোড়। যা মূলতঃ এক রাক‘আত। কেননা এক রাক‘আত যোগ না করলে কোন ছালাতই বেজোড় হয় না। ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘রাতের নফল ছালাত দুই দুই (مَثْنَى مَثْنَى)। অতঃপর যখন তোমাদের কেউ ফজর হয়ে যাবার আশংকা করবে, তখন সে যেন এক রাক‘আত পড়ে নেয়। যা তার পূর্বেকার সকল নফল ছালাতকে বিতরে পরিণত করবে’।[20] অন্য হাদীছে তিনি বলেন, اَلْوِتْرُ رَكْعَةٌ مِّنْ آخِرِ اللَّيْلِ ‘বিতর রাত্রির শেষে এক রাক‘আত মাত্র’।[21] আয়েশা (রাঃ) বলেন,وَكَانَ يُوْتِرُ بِوَاحِدَةٍ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক রাক‘আত দ্বারা বিতর করতেন’।[22] বিতর ছালাত ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১৩ রাক‘আত পর্যন্ত (وَلاَ بِأَكْثَرَ مِنْ ثَلاَثَ عَشْرَةَ) পড়া যায় এবং তা প্রথম রাত্রি, মধ্য রাত্রি, ও শেষ রাত্রি সকল সময় পড়া চলে।[23]
২. ছালাতুল ইশরাক্ব : ছালাতুল ইশরাক্বের অপর নাম ছালাতুয যোহা। ‘শুরূক্ব’ অর্থ সূর্য উদিত হওয়া। ‘ইশরাক্ব’ অর্থ চমকিত হওয়া। আর ‘যোহা’ অর্থ সূর্য গরম হওয়া। এই ছালাত সূর্যোদয়ের পরপরই প্রথম প্রহরের শুরুতে পড়লে একে ‘ছালাতুল ইশরাক্ব’ বলা হয় এবং কিছু পরে দ্বিপ্রহরের পূর্বে পড়লে তাকে ‘ছালাতুয যোহা’ বা চাশতের ছালাত বলা হয়।[24] ইশরাক্ব, যোহা, আওয়াবীন সবই একই ছালাত। চাশতের ছালাতের সর্বনিম্ন রাক‘আত সংখ্যা দুই এবং সর্বোচ্চ আট পর্যন্ত পাওয়া যায়।[25] এছাড়া এর উপর যত খুশি আদায় করা যায়।[26] তবে নির্দিষ্টভাবে বার রাক‘আত যোহা আদায়ের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীছটি যঈফ।[27]
জীবনের গুনাহ মাফের অন্যতম বড় মাধ্যম হজ্জ ও ওমরাহ। তবে মক্কায় গিয়ে হজ্জ ও ওমরাহ করার সামর্থ্য সবার হয় না। কোন বান্দা যদি খালেছ নিয়তে ২ রাক‘আত ছালাতুল ইশরাক আদায় করে তাহ’লে সে একটি পূর্ণ হজ্জ ও ওমরার সমপরিমাণ ছওয়াব পেয়ে যায়। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَلَّى الْغَدَاةَ فِى جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ، ‘যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত জামা‘আতে পড়ে, অতঃপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত আল্লাহর যিকরে বসে থাকে, অতঃপর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য পূর্ণ একটি হজ্জ ও ওমরার নেকী রয়েছে’।[28]
আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের শরীরের প্রতিটি অস্থি প্রতিদিন নিজের উপর ছাদাক্বা ওয়াজিব করে। কারোর সাক্ষাতে তাকে সালাম দেয়া একটি ছাদাক্বা। সৎ কাজের আদেশ দেওয়া একটি ছাদাক্বা, অন্যায় থেকে নিষেধ করা একটি ছাদাক্বা। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে ফেলা একটি ছাদাক্বা। নিজ স্ত্রীর সাথে সংগত হওয়াও একটি ছাদাক্বা। তবে চাশতের ২ রাক‘আত ছালাত এসব কিছুর পরিপূরক হয়ে যাবে’।[29]
বুরায়দা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,فِى الإِنْسَانِ ثَلاَثُمِائَةٍ وَسِتُّونَ مَفْصِلاً فَعَلَيْهِ أَنْ يَتَصَدَّقَ عَنْ كُلِّ مَفْصِلٍ مِنْهُ بِصَدَقَةٍ. قَالُوا وَمَنْ يُطِيقُ ذَلِكَ يَا نَبِىَّ اللهِ قَالَ النُّخَاعَةُ فِى الْمَسْجِدِ تَدْفِنُهَا وَالشَّىْءُ تُنَحِّيهِ عَنِ الطَّرِيقِ فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فَرَكْعَتَا الضُّحَى تُجْزِئُكَ، ‘মানুষের শরীরে ৩৬০টি জোড়া রয়েছে। অতএব মানুষের কর্তব্য হ’ল প্রত্যেক জোড়ার জন্য একটি করে ছাদাক্বা করা। ছাহাবীগণ বললেন, কার শক্তি আছে এই কাজ করার, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)? তিনি বললেন, মসজিদে লেগে থাকা থুথু মুছে ফেলাও একটি ছাদাক্বা। পথ থেকে কোন কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে দেয়াও একটি ছাদাক্বা। কিন্তু (তিনশ’ ষাট জোড়ার ছাদাক্বাহ দেবার মতো) কোন কিছু না পেলে তোমরা যোহার দু’রাক‘আত ছালাত আদায় কর। এটিই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে’।[30]
৩. তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ : নফল ছালাত সমূহের মধ্যে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ছালাত হ’ল রাতের ছালাত তথা তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ। রামাযানে এশার পর প্রথম রাতে পড়লে তাকে ‘তারাবীহ’ এবং রামাযান ও অন্যান্য সময়ে শেষরাতে পড়লে তাকে ‘তাহাজ্জুদ’ বলা হয়। তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, ক্বিয়ামে রামাযান, ক্বিয়ামুল লায়েল সবকিছুকে এক কথায় ‘ছালাতুল লায়েল’ বা ‘রাত্রির ছালাত’ বলা হয়।[31] ‘রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির এই নফল ছালাত বিতরসহ ১১ রাক‘আতের বেশী পড়েনি। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন,مَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيْدُ فِيْ رَمَضَانَ وَلاَ فِيْ غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّيْ أَرْبَعًا فَلاَ تَسْأَلْْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُوْلِهِنَّ ثُمَّ يُصَلِّيْ أَرْبَعًا فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُوْلِهِنَّ ثُمَّ يُصَلِّيْ ثَلاَثًا، ‘রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির ছালাত এগার রাক‘আতের বেশী আদায় করেননি। তিনি প্রথমে (২+২)[32] চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিন রাক‘আত পড়েন’।[33]
রাতের ছালাত শ্রেষ্ঠ ছালাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ‘ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাত্রির (নফল) ছালাত’।[34]
মানব জীবন ভুল-ভ্রান্তি ও নানা পাপে জর্জরিত। তাই পাপ থেকে মুক্তি পেতে সরাসরি আল্লাহর সাথে কথোপকথনের মাধ্যম হ’ল তাহাজ্জুদ ছালাত। এ ছালাতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের জীবনকে পাপ মুক্ত করে আল্লাহর খাঁটি বান্দাতে রূপান্তরিত হ’তে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ فَيَقُوْلُ مَن يَّدْعُوْنِي فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، مَنْ يَّسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَن يَّسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ... ‘আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব’।[35]
অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، ‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[36] তিনি আরো বলেছেন,عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأَبُ الصَّالِحِيْنَ قَبْلَكُمْ وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ وَمُكَفِّرَةٌ لِّلسَّيِّئَاتِ وَمَنْهَاةٌ عَنِ الْإِثْمِ، ‘তোমাদের জন্য ক্বিয়ামুল লায়ল বা রাতের ছালাত আদায় করা উচিত। রাতে ইবাদত করা হচ্ছে তোমাদের পূর্ববর্তী নেক লোকদের রীতি। তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের পন্থা, গোনাহ মাফের উপায় এবং অপরাধ, অশ্লীলতা হ’তে বিরত থাকার মাধ্যম’।[37]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ فِي الْجَنَّةِ غُرَفًا يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا أَعَدَّهَا اللهُ لِمَنْ أَلَانَ الْكَلَامَ، وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَتَابَعَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ، ‘জান্নাতের মধ্যে এমন মসৃণ প্রাসাদ রয়েছে যার বাইরের জিনিস সমূহ ভিতর হ’তে এবং ভিতরের জিনিস সমূহ বাহির হ’তে দেখা যায়। সেসব প্রাসাদ আল্লাহ এমন ব্যক্তির জন্য প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যে ব্যক্তি মানুষের সাথে নরম কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাবার দেয়, নিয়মিত ছিয়াম পালন করে এবং রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন ছালাত আদায় করে’।[38]
৪. তাহিইয়াতুল ওযূ : ছালাতের জন্য পবিত্রতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হ’ল ওযূ করা। আর প্রত্যেক ওযূর পর দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করা মুস্তাহাব, যাকে তাহিইয়াতুল ওযূ বলা হয়।[39]
জান্নাত পাওয়ার অন্যতম সহজ মাধ্যম হ’ল তাহিইয়াতুল ওযূর দুই রাক‘আত নফল ছালাত। ওক্ববা বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوْءَهُ ثُمَّ يَقُوْمُ فَيُصَلِّى رَكْعَتَيْنِ مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ إِلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ، ‘যে কোন মুসলিম যখনই সুন্দরভাবে ওযূ করে দাঁড়িয়ে একাগ্রতার সাথে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়’।[40]
ফযীলতপূর্ণ এই নফল ছালাত নিয়মিত আদায়ের কারণেই জান্নাতে বেলাল (রাঃ)-এর পদধ্বনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শুনতে পেয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বেলাল (রাঃ)-কে বললেন,يَا بِلاَلُ، حَدِّثْنِيْ بِأَرْجَى عَمَلٍ عَمِلْتَهُ فِيْ الإِسْلاَمِ، فَإنِّيْ سَمِعْتُ دَفَّ نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَيَّ في الجَنَّةِ، قَالَ : مَا عَمِلْتُ عَمَلاً أرْجَى عِنْديْ مِنْ أَنِّيْ لَمْ أَتَطَهَّرْ طُهُوْرًا فِيْ سَاعَةٍ مِنْ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ إِلاَّ صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُوْرِ مَا كُتِبَ لِيْ أنْ أُصَلِّيَ، ‘হে বেলাল! বল দেখি তুমি মুসলমান হওয়ার পর এমন কি আমল কর, যার নেকীর আশা তুমি অধিক পরিমাণে কর? কেননা আমি জান্নাতে তোমার জুতার শব্দ আমার সম্মুখে শুনতে পাচ্ছি। তখন বেলাল (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি এছাড়া কোন আমল করি না, যা আমার নিকট অধিক নেকীর কারণ হ’তে পারে। আমি রাতে বা দিনে যখনই ওযূ করি তখনই সে ওযূ দ্বারা (দু’রাক‘আত) ছালাত আদায় করি, যা আদায় করার তাওফীক আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন’।[41]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, বুরায়দা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ছাঃ) সকালে উঠে বেলাল (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, ‘হে বেলাল! কি কাজের বিনিময়ে তুমি আমার পূর্বে জান্নাতে পৌঁছলে? আমি যখনই জান্নাতে প্রবেশ করি, তখনই আমার সম্মুখে তোমার জুতার শব্দ শুনতে পাই। বেলাল (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি যখনই আযান দিয়েছি তখনই দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেছি। আর যখনই আমার ওযূ ভেঙ্গেছে তখনই আমি ওযূ করেছি এবং মনে করেছি আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমাকে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এই দুই কাজের বিনিময়েই তুমি জান্নাতে আমার সম্মুখে চলে গেছে’।[42]
৫. তাহিইয়াতুল মাসজিদ : মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করতে হয়, যাকে ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ বলে। আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلاَ يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ. وفي رواية فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يَجْلِسَ. ‘তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করার পূর্বে বসবে না’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘সে যেন বসার পূর্বে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে নেয়’।[43]
এমনকি ইমামের জুম‘আর খুৎবারত অবস্থায় কেউ মসজিদে প্রবেশ করলেও সে ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ দু’রাক‘আত ছালাত আদায় না করে বসবে না। বরং সংক্ষিপ্তভাবে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেই বসবে। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুৎবা দেওয়ার সময় বলেছেন, إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالإِمَامُ يَخْطُبُ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ وَلْيَتَجَوَّزْ فِيهِمَا، ‘তোমাদের কেউ জুম‘আর দিন ইমামের খুৎবা চলাকালে মসজিদে উপস্থিত হ’লে সে যেন সংক্ষেপে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে নেয়’।[44]
৬. আযান ও ইক্বামতের মাঝে ছালাত : প্রত্যেক আযান ও ইক্বামতের মাঝে দু’রাক‘আত নফল ছালাত রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,بَيْنَ كُلِّ أَذَانَيْنِ صَلاَةٌ، بَيْنَ كُلِّ أَذَانَيْنِ صَلاَةٌ، ثُمَّ قَالَ فِى الثَّالِثَةِ لِمَنْ شَاءَ، ‘প্রত্যেক আযান ও ইক্বামতের মধ্যবর্তী সময়ে ছালাত রয়েছে। প্রত্যেক আযান ও ইক্বামতের মধ্যবর্তী সময়ে ছালাত রয়েছে। তৃতীয়বারে তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে’।[45] আলী (রাঃ) বলেন, كان رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّى قَبْلَ الْعَصْرِ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আছরের (ফরয ছালাতের) পূর্বে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন’।[46] অন্যত্র এসেছে,كَانَ يُصَلِّى قَبْلَ الْعَصْرِ رَكْعَتَيْنِ ‘তিনি আছরের (ফরয ছালাতের) পূর্বে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন’।[47]
জুম‘আর দিন মসজিদে প্রবেশ করে তাহিইয়াতুল মাসজিদ ছালাত আদায়ের পর ইমাম খুৎবার জন্য মিম্বরে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত সাধ্যমত নফল ছালাত আদায় করা যায়। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّىَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى وَفَضْلَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ- ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুম‘আর ছালাতে আসল, অতঃপর সাধ্যমত (নফল) ছালাত আদায় করল, অতঃপর ইমামের খুৎবা শেষ হওয়া পর্যন্ত নীরব থাকল, তারপর ইমামের সাথে (জুম‘আর) ছালাত আদায় করল, এতে তার দু’জুম‘আর মধ্যকার দিনসমূহের এবং আরো তিন দিনের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়’।[48]
৭. ছালাতুল হাজত : আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩)। তাই বিশেষ কোন বৈধ চাহিদা পূরণের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করা হয়, তাকে ‘ছালাতুল হাজত’ বলা হয়।[49] এজন্য শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর সালাম ফিরানোর পূর্বে আশু প্রয়োজনীয় বিষয়টির কথা নিয়তের মধ্যে এনে নিম্নোক্ত সারগর্ভ দো‘আটি পাঠ করতে হবে। اَللَّهُمَّ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ- (আল্লা-হুম্মা রববানা আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খেরাতে হাসানাতাঁও ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র)। ‘হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদেরকে দুনিয়াতে মঙ্গল দিন ও আখেরাতে মঙ্গল দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হ’তে রক্ষা করুন’। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ সময় এ দো‘আটিই পড়তেন’।[50]
দো‘আটি সিজদায় পড়লে বলতে হবে, اَللَّهُمَّ آتِنَا... আল্লা-হুম্মা আ-তিনা...। কেননা রুকূ-সিজদায় কুরআনী দো‘আ পড়া চলে না।[51] এ বিষয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর স্ত্রী সারা’র ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। যিনি বিপদে পড়ে ছালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দো‘আ করলে আল্লাহ তাকে বিপদমুক্ত করেন।[52] তাই আমরাও যেকোন বিপদে নফল ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে পারি। তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বিপদমুক্ত করবেন ইনশাআল্লাহ।
৮. ছালাতুত তাওবাহ : মুমিন বান্দার কোন ভুল বা পাপ কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে সে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়। তখন সে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বিশেষভাবে যে নফল ছালাত আদায় করে, তাকে ‘ছালাতুত তাওবাহ’ বলা হয়।[53] আবুবকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, مَا مِنْ رَجُلٍ يُذْنِبُ ذَنْبًا ثُمَّ يَقُومُ فَيَتَطَهَّرُ ثُمَّ يُصَلِّى ثُمَّ يَسْتَغْفِرُ اللهَ إِلاَّ غَفَرَ اللهُ لَهُ، ‘কোন লোক যদি গুনাহ করে। অতঃপর উঠে দাঁড়ায় ও পবিত্রতা অর্জন করে এবং দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে। অতঃপর আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন’।[54] তওবার জন্য নিম্নের দো‘আটি বিশেষভাবে সিজদায় ও শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে পাঠ করতে হবে।-أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ ‘আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে’ ‘আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি সেই আল্লাহর নিকটে যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক এবং তাঁর দিকেই আমি ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি’।[55]
৯. সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের ছালাত : আমরা দৈনন্দিন জীবনে দেশে বা দেশের বাইরে অনেক সময় সফর করে থাকি। ব্যক্তিগত সফর, সাংগঠনিক সফর, হজ্জ সফর ইত্যাদি। সফর সুখের জায়গা নয়, বরং নানাবিধ ঝামেলা ও কষ্টের জায়গা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, السَّفَرُ قِطْعَةٌ مِنَ الْعَذَابِ، ‘সফর আযাবের অংশ’।[56] সফর থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসা আল্লাহর বিশেষ রহমতের বহিঃপ্রকাশ। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সফর থেকে ফিরে সাধারণতঃ প্রথমে মসজিদে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে তারপর বাড়ীতে প্রবেশ করতেন।[57]
১০. ছালাতুল ইস্তেখা-রাহ : আল্লাহর নিকট থেকে কল্যাণ ইঙ্গিত প্রার্থনার জন্য যে নফল ছালাত আদায় করা হয়, তাকে ‘ছালাতুল ইস্তেখা-রাহ’ বলা হয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় কোন্ শুভ কাজটি করা মঙ্গলজনক হবে, সে বিষয়ে আল্লাহর নিকট থেকে ইঙ্গিত পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে এই ছালাত আদায় করা হয়। কোন দিকে ঝোঁক না রেখে সম্পূর্ণ নিরাবেগ ও খোলা মনে ইস্তেখা-রার ছালাত আদায় করতে হবে। অতঃপর যেদিকে মন টানবে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। এজন্য ফরয ছালাত ব্যতীত ইস্তেখারার নিয়ত সহ দু’রাক‘আত নফল ছালাত দিনে বা রাতে যেকোন সময়ে পড়া যায়।[58] জাবের (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُعَلِّمُنَا الاِسْتِخَارَةَ فِى الأُمُورِ كَمَا يُعَلِّمُنَا السُّورَةَ مِنَ الْقُرْآنِ يَقُولُ إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالأَمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ لِيَقُلِ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে সকল কাজে ‘ইস্তেখা-রাহ’ শিক্ষা দিতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কোন কাজের সংকল্প করবে, তখন ফরয ব্যতীত দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। অতঃপর (দো‘আয়) বলবে,
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوْبِ، اَللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِّيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاقْدِرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِّيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ وَاقْدِرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِيْ بِهِ، قَالَ: (وَيُسَمِّي حَاجَتَهُ)
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তোমার জ্ঞানের সাহায্যে কল্যাণের বিষয়টি প্রার্থনা করছি এবং তোমার শক্তির মাধ্যমে (সেটা অর্জন করার) শক্তি প্রার্থনা করছি। আমি তোমার মহান অনুগ্রহ ভিক্ষা চাইছি। কেননা তুমিই ক্ষমতা রাখ। আমি ক্ষমতা রাখি না। তুমিই জান, আমি জানি না। তুমিই যে অদৃশ্য বিষয় সমূহের মহাজ্ঞানী। হে আল্লাহ! যদি তুমি জান যে, এ কাজটি আমার জন্য উত্তম হবে আমার দ্বীনের জন্য, আমার জীবিকার জন্য ও আমার পরিণাম ফলের জন্য, তাহ’লে ওটা আমার জন্য নির্ধারিত করে দাও এবং সহজ করে দাও। অতঃপর ওতে আমার জন্য বরকত দান কর। আর যদি তুমি জান যে, এ কাজটি আমার জন্য মন্দ হবে আমার দ্বীনের জন্য, আমার জীবিকার জন্য ও আমার পরিণাম ফলের জন্য, তাহ’লে এটা আমার থেকে ফিরিয়ে নাও এবং আমাকেও ওটা থেকে ফিরিয়ে রাখ। অতঃপর আমার জন্য মঙ্গল নির্ধারণ কর, যেখানে তা আছে এবং আমাকে তা দ্বারা সন্তুষ্ট কর’। এখানে হা-যাল আম্রা (এই কাজ) বলার সময় কাজের নাম উল্লেখ করা যায় বলে রাবী বর্ণনা করেন। যা উপরোক্ত হাদীছের শেষে বর্ণিত হয়েছে’।[59]
উক্ত দো‘আটি ছালাতের শেষ বৈঠকে করা ভালো। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের মধ্যেই বিশেষ করে সিজদায় এবং শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সময়ে বিশেষ দো‘আ সমূহ করতেন।[60] সে হিসাবে ইস্তেখা-রার দো‘আটিও শেষ বৈঠকে বসে ধীরে-সুস্থে করা বাঞ্ছনীয়। আর যদি সালাম ফিরানোর পরে উক্ত দো‘আ করেন, তাহ’লে বেশী দেরী না করে এবং অহেতুক কোন কথা না বলে সত্বর দু’হাত উঠিয়ে দো‘আ করবেন এবং শুরুতে হাম্দ ও দরূদ পাঠ করবেন। যেমন আল-হামদুলিল্লাহি রবিবল ‘আ-লামীন, ওয়াছছালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহিল কারীম, অতঃপর দো‘আ পাঠ করবেন।[61]
১১.ছালাতুয যাওয়াল : ছালাতুয যাওয়াল বা সূর্য ঢলে পড়ার ছালাত মূলতঃ ৪ রাক‘আত বিশিষ্ট নফল ছালাত। আব্দুল্লাহ ইবনুস সায়েব (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূর্য ঢলার পর হ’তে যোহরের পূর্ব পর্যন্ত ৪ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন এবং বলতেন,إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ فَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِي فِيهَا عَمَلٌ صَالِحٌ، ‘এ সময় আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয়। আমার একান্ত ইচ্ছা, এ সময় আমার কোন সৎকর্ম আল্লাহর দরবারে পৌঁছাক’।[62] অন্য হাদীছে আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) সূর্য ঢলে পড়লে ৪ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি সূর্য হেলে গেলে (গুরুত্বের সঙ্গে) ৪ রাক‘আত ছালাত আদায় করেন কেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সূর্য ঢলার পর আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং যোহর পর্যন্ত তা খোলা থাকে। আমি চাই এ সময় আমার কোন ভাল কাজ আকাশে পৌঁছাক। আমি বললাম, এর প্রতি রাক‘আতেই কি ক্বিরাআত পড়তে হয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, ২ রাক‘আতের পর সালাম ফিরাতে হয় কি? তিনি বললেন, না’।[63] একদল বিদ্বানের মতে এই ছালাত ছিল যোহরের পূর্বের ৪ রাক‘আত সুন্নাত ছালাত।[64] তবে ইবনুল ক্বাইয়িম, ইরাক্বী ও মুবারকপুরী সহ কতিপয় বিদ্বানের মতে এটি স্বতন্ত্র ছালাত, যাকে ‘ছালাতুয যাওয়াল’ বা সূর্য ঢলে পড়ার ছালাত বলা হয়। এটি যোহরের ছালাতের পূর্বের চার রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ নয়।[65] অতএব আকাশের দরজা খুলে দেওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আল্লাহর নিকট দো‘আ কবুলের আশায় নফল ছালাত হিসাবে এটি আদায় করা যায়।
উপসংহার : ফরয ইবাদত ছাড়াও আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য কিছু নফল ইবাদতের সুযোগ রেখেছেন। নফল ইবাদতের মধ্যে ছালাত আল্লাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় আমল। দিন-রাতের নফল ছালাত মুমিন জীবনের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি এবং উন্নত মর্যাদা লাভের মাধ্যম। নফল ছালাতের মাধ্যমে বানদা আল্লাহর অধিকতর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করে। জান্নাত পিয়াসী মুমিন বান্দাগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে নফল ছালাত সমূহ আদায় করেন। তাই আসুন! আমরা সত্যিকারের আল্লাহ ওয়ালা বান্দা হওয়ার লক্ষ্যে অধিক হারে নফল ছালাত সমূহ আদায়ের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১৬), পৃ. ১০৭৯।
[2]. মু‘জামুত তা‘রীফাত (কায়রো, দারু ইবনুল জাওযী ১৪৩৯ হি./২০১৮খ্রি.), পৃ. ২৬৬।
[3]. আত-তাফসীরুল বাসীত, ১০/৮।
[4]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৪র্থ সংস্করণ, অক্টোবর ২০১১ খ্রি.), পৃ. ১৩৫।
[5]. বুখারী হা/১২৩৩; মিশকাত হা/১০৪৩-৪৪; আবূদাঊদ হা/১২৬৫-৬৭।
[6]. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), ঐ, পৃ. ১৩৫।
[7]. বুখারী হা/৬২৪; মিশকাত হা/৬৬২।
[8]. তিরমিযী হা/৪২৯; মিশকাত হা/৬৬২, ১১৬৫, ১১৭১-৭২, ১১৭৯-৮০; বুখারী হা/১১৮৩, ৬২৪।
[9]. আবূদাঊদ হা/৮৬৪; তিরমিযী হা/৪১৩; মিশকাত হা/১৩৩০।
[10]. শরহু রিয়াযিছ ছালেহীন, ২/১৩২৪।
[11]. মুসলিম হা/৪৪৮; মিশকাত হা/৮৯৭।
[12]. বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬।
[13]. মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৬।
[14]. আবূদাঊদ হা/১২৬৯; তিরমিযী হা/৪২৮; মিশকাত হা/১১৬৭।
[15]. আহমাদ হা/২৬৮০৭; নাসাঈ হা/১৮১৭।
[16]. তিরমিযী হা/৪১৫, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৫৯।
[17]. বুখারী হা/৬১৮, ১১৮১; মুসলিম হা/৭২৯; মিশকাত হা/১১৬০।
[18]. মুসলিম হা/৭২৫; মিশকাত হা/১১৬৪।
[19]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আ-দ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৯ সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) ১/৪৫৬।
[20]. বুখারী হা/৪৭৩, ৯৯০; মিশকাত হা/১২৫৪।
[21]. মুসলিম হা/৭৫২; মিশকাত হা/১২৫৫।
[22]. ইবনু মাজাহ হা/১১৯৬; মিশকাত হা/১২৮৫।
[23]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৫; বুখারী হা/৯৯৬; আবূদাঊদ হা/২২৬; মিশকাত হা/১২৬৩-৬৫।
[24]. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ২৫৪।
[25]. মুসলিম হা/৩৩৬।
[26]. উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৪/৮৫।
[27]. তিরমিযী; মিশকাত হা/১৩১৬, সনদ যঈফ।
[28]. তিরমিযী হা/৫৮৬; মিশকাত হা/৯৭১।
[29]. মুসলিম হা/৭২০; আবূদাঊদ হা/১২৮৫, সনদ ছহীহ।
[30]. আবূদাঊদ হা/৫২৪২; মুসলিম, মিশকাত হা/১৩১৫, ১৩১১।
[31]. নায়লুল আওত্বার ২/২৯৫ পৃ.; মির‘আতুল মাফাতীহ ২/২২৪ পৃ.; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ১৭১-৭২।
[32]. বুখারী হা/৯৯৪; মুসলিম হা/৭৩৬; মিশকাত হা/১১৮৮।
[33]. বুখারী হা/১১৪৭; মুসলিম হা/১৭২৩।
[34]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৯।
[35]. বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮, ১৭৭৩।
[36]. বুখারী হা/২০০৯; মুসলিম হা/৮৫৯, মিশকাত হা/১২৯৬।
[37]. তিরমিযী হা/৩৫৪৯; মিশকাত হা/১২২৭।
[38]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫০৯; বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান হা/২৮২৫; মিশকাত হা/১২৩২, হাদীছ ছহীহ।
[39]. নববী, আল-মাজমূ‘ ৩/৫৪৫; ফাতাওয়াল কুবরা ৫/৩৪৫; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ১৭১-৭২।
[40]. মুসলিম হা/২৩৪; আবু দাঊদ হা/৯০৬; তিরমিযী হা/১০৫৯।
[41]. বুখারী হা/১১৪৯; মুসলিম হা/২৪৫৮; মিশকাত হা/১৩২২।
[42]. তিরমিযী হা/৩৬৮৯; মিশকাত হা/১৩২৬।
[43]. বুখারী হা/৪৪৪, ১১৬৩; মুসলিম হা/১৬৮৭; মিশকাত হা/৭০৪।
[44]. মুসলিম হা/৮৭৫; আবুদাঊদ হা/১১১৬; মিশকাত হা/১৪১১।
[45]. বুখারী হা/৬২৭; মিশকাত হা/৬৬২।
[46]. তিরমিযী হা/৪২৯, ১১৬১; মিশকাত হা/১১৭১।
[47]. আবু দাঊদ হা/১২৭২; মিশকাত হা/১১৭২, সনদ হাসান।
[48]. মুসলিম হা/৮৫৭; মিশকাত হা/১৩৮২।
[49]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৫; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ২৬১।
[50]. বুখারী হা/৪৫২২, ৬৩৮৯; মিশকাত হা/২৪৮৭, ৮১৩।
[51]. মুসলিম, মিশকাত হা/৮৭৩।
[52]. বুখারী হা/২২১৭; আহমাদ হা/৯২৩০।
[53]. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ২৬২।
[54]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৯৫; তিরমিযী হা/৪০৬; মিশকাত হা/১৩২৪; আলে ইমরান ৩/১৩৫; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৫৯।
[55]. তিরমিযী হা/৩৫৭৭; আবুদাঊদ হা/১৫১৭; মিশকাত হা/২৩৫৩।
[56]. বুখারী হা/১৮০৪, ৩০০১; মুসলিম হা/১৯২৭; মিশকাত হা/৩৮৯৯।
[57]. বুখারী হা/৪৪৩, ৪৬৭৭।
[58]. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ২৬৩।
[59]. বুখারী হা/১১৬২, ৬৩৮২,৭৩৯০; মিশকাত হা/১৩২৩।
[60]. মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৪, ৮১৩।
[61]. আবুদাঊদ হা/১৪৮১, ৮৮-৯০; নায়ল ৩/৩৫৪-৫৫; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৫৮; মির‘আত ৪/৩৬২, ৬৪।
[62]. তিরমিযী হা/৪৭৮; আহমাদ হা/২৩৫৯৭; মিশকাত হা/১১৬৯।
[63]. তিরমিযী, মুখতাছারুশ শামায়েল হা/২৪৯; ছহীহুল জামে‘ হা/১৫৩২।
[64]. মানাভী, ফায়যুল ক্বাদীর ১/৪৬৭।
[65]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/২৯৮-৯৯; মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/১৪৬; আওনুল মা‘বুদ ৪/১০৪; তোহফাহ ২/৪৭৯।