ইরাক,
ইরান ও অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মত ইয়েমেনও মধ্যপ্রাচ্যের একটি
স্বাধীন রাষ্ট্র, যার জন্ম হয়েছিল ২০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে। বর্তমানে এর
রাষ্ট্রীয় নাম হচ্ছে ‘প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন’। এটি আরব সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে
অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইয়েমেন একটি গুরুত্বপূর্ণ
ভূখন্ড। ইয়েমেনের সংলগ্ন উত্তরে সঊদী আরব ও দক্ষিণে এডেন উপসাগর। পূর্বে
ওমান। ওমানের সাথে রয়েছে সঊদী সীমান্ত। এর আরেক সীমানা মিলিত হয়েছে আরব
আমিরাতের সাথে। আরব আমিরাতের সাথে কাতার। কাতারের সাথে কুয়েত। কুয়েতের সাথে
জর্ডান। এক সারিতে অনেকগুলো মুসলিম দেশ। আর এই সব দেশের সীমানা সঊদী আরবের
সাথে সংলগ্ন। যা মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রবিন্দু। ইয়েমেন ভূখন্ডটি কারো
হস্তগত হ’লে অতি সহজেই আসল টার্গেট বাস্তবে রূপ নিবে। তাই এসব কারণে ইয়েমেন
সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। যেকোন মূল্যে তারা এই
দেশটিকে করতলগত করার জন্য আফগানিস্তান, ইরাক ও পাকিস্তানের ধারাবাহিকতায়
তাদের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের কালো থাবা এখন ইয়েমেনের দিকে প্রসারিত করছে।
সুতরাং বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের বর্বরতার মুখোশ উন্মোচন ও তার
আসল টার্গেট কি? তা আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
সাম্রাজ্যবাদীদের আচরণ ও বর্বরতা :
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন হ’তেই সাম্রাজ্যবাদকে স্বীয় মুখ্য উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছে। তার ইতিহাস যুলুম-অত্যাচার, অন্যায়-অবিচার, অধিকার হরণ ও মুসলিম জাতির উপর কদাচরণ ও বর্বর আগ্রাসনের নানা কাহিনীতে ভরপুর।
১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানকার শাসকগোষ্ঠী স্বীয় রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধি ও ক্ষমতা জোরদার করতে প্রচেষ্টা শুরু করে। তাদের আগ্রাসন ও বর্বরতা শুরু হয় স্বীয় ভূ-খন্ডের প্রকৃত নাগরিক রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকেই। এফ. হেনরি বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরই রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে তাদের অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল’। ১৮০৩ খৃষ্টাব্দে তারা লোজিয়ানা অঞ্চলে সর্বপ্রথম মার্কিন পতাকা উড্ডীন করে। ১৮১০ খৃষ্টাব্দে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার দখলদারিত্বের চাদরে পশ্চিম ফ্লোরিডাকেও করায়ত্ত করে নেয়। ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে তারা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গুলবাস ব্রি’র নেতৃত্বে জাপান পৌঁছে। সেখানে তারা জাপানীদেরকে তাদের অঞ্চল ‘আদূ’ হ’তে বের হয়ে যেতে বাধ্য করে। আর এটাই তাদের বহির্বিশ্বে আগ্রাসনের প্রথম ধাপ। তৎপরবর্তীতে তারা ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে ফিলিপাইন ও কিউবায় হামলা চালায়। ১৯০০ খৃষ্টাব্দে তারা চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার তারা কিউবার উপর আক্রমণ করে। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে নিকারাগুয়া অঞ্চল তাদের বর্বরতার শিকার হয়। ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে হাইতিতে আগ্রাসন চালায়। ১৯২৪ সালে মধ্য আমেরিকান রাষ্ট্র সানডেমাঙ্গোর উপর আক্রমণ চালায়। ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার হাইতিতে আগ্রাসন চালায়। ১৯৪৪ খৃষ্টাব্দে হিরোশিমা ও নাগাসারিক উপর আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে যা বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নৃশংস আক্রমণ। ১৯৬১ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার কিউবার উপর আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা করে। ১৯৬২ খৃষ্টাব্দে জামাইকাকে টার্গেট বানায়। ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দে কম্বোডিয়া, ১৯৮৬ খৃষ্টাব্দে লিবিয়া ও ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে ইরাক ধ্বংস করার জন্য সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করে (ইয়াসির নাদীম, বিশ্বায়ন: সাম্রাজ্যবাদীদের নতুন স্ট্র্যাটেজি, শহীদুল ইসলাম ফারূকী অনূদিত (ঢাকা: প্রফেসরস পাবলিকেশন্স, ২০০৫), পৃঃ ৯৫-৯৯)। ২০০১ খৃষ্টাব্দে World trade centre ও মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের উপর হামলার অজুহাতে আফগানিস্তানের উপর ইতিহাসের এক নৃশংস আগ্রাসন চালায় এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র জর্জ বুশ সুস্পষ্ট ভাষায় একে ‘ক্রসেড’ বলে আখ্যা দেন। অতঃপর ২০০৩ খৃষ্টাব্দে পুনরায় ইরাক মার্কিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়। এই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনরাই গত শতকে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করে পাকিস্তানকে মেরুদন্ডহীন করার অপপ্রয়াস চালায়। ২০০৭ খৃষ্টাব্দে বেনজির ভুট্টোকে হত্যার ঘটনাও সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনার অংশ।
তারা এমনিভাবে তাদের কুদৃষ্টি বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহে ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে নিক্ষেপ করছে। এখন তাদের শ্যেনদৃষ্টি ইয়েমেন হয়ে সঊদী আরবের প্রতি। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনরা অদ্যাবধি যেসব অঞ্চল কিংবা দেশকে আক্রমণ করেছে তার পিছনে তাদের পরিকল্পিত কৌশল ও ছক এঁকেছে। তারা আল-কায়দা’র অজুহাতে মুসলিম দেশ ইরাক ও আফগানিস্তানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও আগ্রাসন চালিয়েছে। তেমনি সম্প্রতি তাদের মূল লক্ষ্য সঊদী আরব করায়ত্ত করতে ইয়েমেনকে ঘাঁটি বানাতে পাঁয়তারা করছে।
ইয়েমেনে আগ্রাসনের লক্ষ্য :
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের মূল টার্গেট হ’ল সঊদী আরব। আর এ কারণেই তারা নানা অজুহাত সৃষ্টি করে ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরুর পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তারা ইয়েমেন দখলে সক্ষম হ’লে পুরো আরব ভূখন্ড ওদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা ছিল মুসলিম ভূখন্ড ইরাক, আফগানিস্তানের পর ইরান-পাকিস্তান দখলে নিবে। কিন্তু এ পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে তারা এবার নতুন ছকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা প্রথমে ইয়েমেন দখল করে মূল টার্গেট সঊদী আরবে হামলা করবে। তাই তারা মেজর নাদাল মালিক হাসান ও ওমর ফারুক আব্দুল মুত্তালিবের ঘটনাকে ইস্যু করে আগ্রাসনে প্রস্ত্তত হচ্ছে।
অ্যারিজোয়ানার নাগরিক মেজর নাদাল মালিক আমেরিকার সবচেয়ে বড় সেনানিবাস ‘ফোর্ড হুড’ এ কর্মরত ছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর ঘটনার কয়েকদিন আগে অর্থাৎ ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর এখানে সন্ত্রাসী হামলায় ১৩ জন সেনা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায়। মেজর নাদালও তাতে মারাত্মক আহত হন। তবুও ১৩ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ও ২২ নভেম্বর এ মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। আমেরিকার সুদক্ষ গোয়েন্দা বাহিনী অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত জাতিকে উপহার দিয়েছে। তদন্তে বলা হয়েছে, ‘নাদালের সাথে হিযবুত তাহরীরের যোগাযোগ রয়েছে এবং সে তাদের চর’। তারা তদন্তে আরো বলেছেন, ‘নাদাল আনোয়ারুল আওলাকির ঘনিষ্ঠ সহযোগী’। আনোয়ারুল ইয়েমেনের একজন বিখ্যাত আলিম। তাকে আল-কায়েদার শিখন্ডি ধারণা করা হয়। আর ‘ফোর্ড হুড’-এর ঘটনার নায়ক যেহেতু নাদাল সেহেতু আল-কায়েদাও এর সাথে জড়িত। আর আওলাকি ইয়েমেনের নাগরিক। তাই ইয়েমেন এখন আল-কায়েদার দেশ। এই হ’ল ইয়েমেনে আক্রমণের নাটকীয় পরিকল্পনার প্রথম ছক।
২৬ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে আমেরিকায় আরো একটি ঘটনা ঘটেছে। হল্যান্ড হ’তে ডেট্রয়েটগামী বিমানটির যাত্রী সংখ্যা ছিল ২৭৮ জন। বিমানটি বন্দরে অবতরণের মাত্র ২০ মিনিট আগে একটি সিটের নিচ হ’তে ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছিল। মুহূর্তেই সিকুরিটি অফিসার সিটে বসা লোকটিকে ধরে ফেলে। পরবর্তীতে মিডিয়াগুলো বিভিন্ন আঙ্গিকে রিপোর্ট প্রকাশ করতে শুরু করে। রিপোর্টে বলা হয়, ‘বিমানে হামলার চেষ্টাকারী নাইজেরিয়ান যুবকের বয়স ২৩ বছর। যুবকের নাম ওমর ফারুক আব্দুল মুত্তালিব। যুবকের দেশ ইয়েমেন। ‘রিপোর্টে আরো প্রকাশ করা হয়, ‘তার সাথে আল-কায়েদার যোগাযোগ আছে। ইয়েমেনের ‘আল-কায়েদা’ তাকে বিমানে হামলা চালাতে বোমা সরবরাহ করেছে’। এই ঘটনার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘটা করে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, ‘আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইয়েমেনসহ যে কোন উগ্রবাদী দেশের উপর আক্রমণ চালানোর অধিকার আমেরিকার আছে।’
ঘটনা দু’টি পর্যালোচনা করলে বিষয়টি সাজানো নাটক মনে হবে। কোন দেশকে আক্রমণ করার আগে আমেরিকা এমন সব নাটকীয় কার্যকলাপ করে থাকে। আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণের সময় পৃথিবী তাই প্রত্যক্ষ করেছে। সিংহের পানি ঘোলা করার গল্প আর কি! এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র, না হয় সব দুর্ঘটনার কেন্দ্ররূপে ইয়েমেনকে নির্বাচিত করা হবে কেন? ইয়েমেনকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরাট পরিকল্পনা আছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তারা পাকিস্তান স্টাইলে ইয়েমেন হামলা শুরু করতে যাচ্ছে। জোসেফ লিবারম্যান ইয়েমেন সফর করে গিয়ে এমনটিই বললেন, ‘ইয়েমেন এখন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণতি হয়েছে’। তাই সাম্রাজ্যবাদীরা ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য সহযোগিতার নামে ইয়েমেন দখলে আনার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আর ইয়েমেন তাদের মুঠোয় পৌঁছলে তাদের আসল উদ্দেশ্য সফল হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হবে।
উপসংহার :
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনরা কি তাহ’লে চূড়ান্ত পর্যায়ে Crusade শুরু করতে যাচ্ছে? নাদাল মালিক ও ওমর ফারুকদের নিয়ে এতসব কাহিনী রটানোর মতলব কি? এসব সাজানো নাটকের দৃশ্য দুনিয়ার মানুষের জানা। আমরা তাদেরকে যুদ্ধমুক্ত শান্তিময় বিশ্বের জন্য এবং মানবাধিকার সমুন্নত করার অনুরোধ জানাই। অন্যদিকে এহেন সংকট মুহূর্তে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার রূপী ওআইসি ও আরব লীগের মত ইসলামী সংস্থাগুলো কিছু করবে বলে মনে হয় না। তারপরও আপামর মুসলিম জনতার আয়তলোচন এখন মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের দিকেই নিবদ্ধ। মহান আল্লাহ তাদের সুমতি দান করুন- আমীন!!
মুহাম্মাদ ফরীদুল ইসলাম
আলিম পরীক্ষার্থী, নওদাপাড়া মাদরাসা, রাজশাহী।