ভূমিকা : হালাল জীবিকা উপার্জন করা ইসলামে অত্যাবশ্যকীয়। হালাল জীবিকা আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তির অন্যতম উপায়। পক্ষান্তরে হারাম উপার্জনে মানবজাতির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রশান্তি দূরীভূত হয়। ফলে কারূণী অর্থনীতির ধনকুবেররা টাকার বিছানা-বালিশে শয়ন করেও অশান্তির দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। অপরদিকে হালাল উপার্জনকারী খেটে খাওয়া মানুষ দু’চারটে ডাল-ভাত খেয়েও নিশ্চিন্ত মনে শান্তিতে দিনাতিপাত করে। তাই দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ লাভের জন্য হালাল জীবিকা অর্জনে ব্রতী হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের উপর অবশ্য কর্তব্য। শরী‘আতে হালাল পন্থায় সম্পদ উপার্জনের জন্য যেমন বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। তেমনি হারাম উপার্জনের ভয়াবহ পরিনতির ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে হারাম উপার্জনের কারণ, ক্ষতিকর দিক সমূহ এবং এর স্বরূপ সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।


জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে শরী‘আতে সার্বিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلاَلاً طَيِّبًا وَلاَ تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِيْنٌ ‘হে মানবকুল! তোমরা পৃথিবীতে হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত ভক্ষণ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮)।

অন্যত্র তিনি বলেন,فَكُلُوْا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللهُ حَلاَلاً طَيِّبًا وَاشْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে হালাল ও পবিত্র যা দিয়েছেন তা হ’তে আহার কর এবং আল্লাহর নে‘মতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত কর’ (নাহল ১৬/১১৪)

ইসলাম হারাম উপার্জনকে নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এটা উপার্জনকারীর জন্য দুর্ভাগ্য ও বিপদ ডেকে আনে। পরকালীন কঠিন শাস্তির সাথে সাথে এর কারণে মানুষের হৃদয় কঠোর হয়, ঈমানী নূর নির্বাপিত হয়, আল্লাহর অসন্তোষ অবধারিত হয়। দো‘আ কবুলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অতএব হারাম আয়-উপার্জন পরিত্যাগ করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

হারাম উপার্জনের তোয়াক্কা না করার ফলে আজ সমাজে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সূদ, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা, মজুতদারী, মাপে ঠকানো, ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করা, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করা সহ বিভিন্ন প্রকার গর্হিত কাজ ব্যাপকতা লাভ করেছে।

মানুষের নিকট এমন এক সময় আসবে যখন হালাল উপার্জনের বিষয়টিকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করবে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই উপার্জনে লিপ্ত হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَأْتِى عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ، لاَ يُبَالِى الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلاَلِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ- ‘মানুষের নিকট এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ উপার্জনের ক্ষেত্রে হারাম-হালাল বিবেচনা করবে না’।[1]

আরো একশ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যারা জেনেশুনে স্বপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করে হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম বানায়। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا أَنْزَلَ اللهُ لَكُمْ مِنْ رِزْقٍ فَجَعَلْتُمْ مِنْهُ حَرَامًا وَحَلاَلاً، قُلْ آللهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى اللهِ تَفْتَرُوْنَ- ‘বল, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দিয়েছেন তোমরা এর কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বল, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করছ’? (ইউনুস ১০/৫৯)

হারাম উপার্জনের কতিপয় কারণ

(১) তাক্বওয়াশূন্য হৃদয় : হারাম উপার্জনে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল হৃদয় থেকে আল্লাহভীতি দূর হয়ে যাওয়া। আল্লাহভীতি মানবাত্মাকে হারামে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। আর আল্লাহকে লজ্জা করে অন্যায় কর্ম ত্যাগ করাই হ’ল প্রকৃত লজ্জা। রাসূল (ছাঃ) প্রকৃত লজ্জা কি তা ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

اسْتَحْيُوا مِنَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ حَقَّ الْحَيَاءِ. قَالَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّا نَسْتَحِى وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، قَالَ لَيْسَ ذَلِكَ وَلَكِنْ مَنِ اسْتَحَى مِنَ اللهِ حَقَّ الْحَيَاءِ فَلْيَحْفَظِ الرَّأْسَ وَمَا حَوَى وَلْيَحْفَظِ الْبَطْنَ وَمَا وَعَى وَلْيَذْكُرِ الْمَوْتَ وَالْبِلَى وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدِ اسْتَحْيَا مِنَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ حَقَّ الْحَيَاءِ-

‘তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে লজ্জা কর। আমরা বললাম, আল-হামদুলিল্লাহ! হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরাতো আল্লাহকে লজ্জা করি! রাসূল (ছাঃ) বললেন, বিষয়টা এমন নয়; বরং আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করা হ’ল তুমি তোমার মস্তিষ্ককে যাবতীয় অন্যায় চিন্তা-চেতনা থেকে রক্ষা করবে, পেটকে যাবতীয় হারাম খাদ্য থেকে বাঁচাবে, মৃত্যু ও তৎপরবর্তী বিপদসমূহ স্মরণ করবে। আর যে পারলৌকিক সফলতা কামনা করে, সে যেন পার্থিব চাকচিক্য পরিত্যাগ করে। আর যে ব্যক্তি এ সমস্ত কর্মকান্ড সম্পাদন করবে সেই যথাযথভাবে আল্লাহকে লজ্জা করল’।[2] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ ِممَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ الْأُوْلَى إذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَاشِئْتَ ‘মানুষ পূর্ববর্তী নবুঅতের যে সমস্ত অমীয় বাণী লাভ করেছে তন্মধ্যে একটি হ’ল যখন তুমি লজ্জা করবে না, তখন যা ইচ্ছে তাতেই লিপ্ত হবে’।[3]

হৃদয় থেকে আল্লাহভীতি দূর হয়ে গেলে মানবাত্মা অনুভূতিশুন্য হয়ে পড়ে। ফলে তার মাঝে হালাল-হারাম যাচাই-বাছাই করার কোন তাকীদ অনুভূত হয় না। ٍ

(২) ত্বরিত গতিতে উপার্জনের লালসা : হারাম উপার্জনের আরেকটি কারণ হ’ল দ্রুত উপার্জনের লালসা। কতক মানুষ রয়েছে যারা দ্রুততার সাথে অর্থোপার্জনের চেষ্টায় উন্মত্ত থাকে। যেকোন ভাবে যেকোন পন্থায় তারা আয়ের ব্যবস্থা করতেও দ্বিধান্বিত হয় না। সুতরাং স্বল্প সময়ে অধিক উপার্জন করাই তাদের অভীষ্ট উদ্দেশ্য ও ইপ্সিত লক্ষ্য হয়ে থাকে। যার ফলে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্ধারিত জীবিকা পেত, তার সীমালংঘন করে দ্রুত উপার্জন করতে চেষ্টা করে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,

اَيُّهَا النَّاسُ لَيْسَ مِنْ شَيْءٍ يُقَرِّبُكُمْ إلَى الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُكُمْ مِّنَ النَّارِ إلاَّ قَدْ أمَرْتُكُمْ بِهِ وَلَيْسَ شَيْءٌ يُقَرِّبُكُمْ مِنَ النَّارِ وَيُبَاعِدُكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ إلاَّ قَدْ نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ وَإِنَّ الرُّوْحَ الأمِيْنَ، وَفِيْ رِوَايَةٍ : وَإنَّ رُوْحَ الْقُدُسِ، نَفَثَ فِيْ رُوْعِيْ أنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوْتَ حَتَّى تَسْتَكْمِلَ رِزْقَهَا أَلاَ فَاتَّقُوْا اللهَ وَأجْمِلُوْا فِيْ الطَّلَبِ وَلاَ يَحْمِلَنَّكُمُ اسْتِبْطَاءُ الرِّزْقِ أنْ تَطْلُبُوْهُ بِمَعَاصِيْ اللهِ فَإنَّهُ لاَ يُدْرِكُ مَا عِنْدَ اللهِ إلاَّ بِطَاعَتِهِ.

‘হে লোক সকল! আমি সে সব বিষয়ে তোমাদের নির্দেশ প্রদান করেছি, যেগুলো তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। আর যেসব বিষয় তোমাদেরকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে এবং জান্নাত থেকে দূরে রাখবে সেসব বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করেছি। নিশ্চয়ই রূহুল আমীন অন্য বর্ণনায় রূহুল কুদুস (জিবরীল) আমার অন্তরে অবতীর্ণ করেছেন যে, রিযিক পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ মরবে না। অতএব হে মানবমন্ডলী! আল্লাহকে ভয় কর! আর জীবিকা অন্বেষণে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, জীবিকা আসতে বিলম্ব হ’লে অবশ্যই আল্লাহর অবাধ্যতা করে তা অর্জন কর না। কেননা আল্লাহর আনুগত্য ব্যতীত তাঁর নিকটে যা আছে তা পাওয়া যায় না।[4]

অতএব প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তির উচিত এ বিষয়টিকে অনুধাবন করা যে, পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং বান্দার রূযী-রোযগার ও আয়-ব্যয়ের হিসাব আল্লাহর কাছে অবশ্যই প্রদান করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ.

‘ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পা তার প্রভুর সামনে থেকে নড়বে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা না হবে। (ক) তার জীবন কোথায় শেষ করেছে, (খ) যৌবন কোথায় জীর্ণ করেছে (গ) সম্পদ কোন উৎস থেকে উপার্জন করেছে এবং (ঘ) কোথায় তা ব্যয় করেছে এবং (ঙ) জ্ঞানানুযায়ী আমল করেছে কি-না?[5]

উল্লিখিত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, জীবিকার বৈধ উপার্জন যেমন ইবাদত কবুলের শর্ত তেমনি পারলৌকিক কল্যাণের জন্যও হালাল উৎস থেকে উপার্জন ও বৈধ কাজে ব্যয় করা একান্ত যরূরী।

(৩) অতিরিক্ত লোভ ও অল্পেতুষ্টির অভাব : অবৈধ পন্থায় উপার্জনের অন্যতম কারণ হ’ল, মাত্রাতিরিক্ত লোভ ও অল্পেতুষ্ট না হওয়া। আর অতিরিক্ত লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ চুরি-ডাকাতি করতেও দ্বিধান্বিত হয় না। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلاَ فِى غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ ‘ছাগলের পালে দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছেড়ে দিলে তা যতটুকু না ক্ষতি সাধন করে, কারো সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চাইতে অধিক ক্ষতি সাধন করে তার দ্বীনের’।[6]

তাই লালসার বশবর্তী হওয়া উচিত নয়। কেননা লোভ জীবিকা তো বৃদ্ধি করেই না; বরং তা ব্যক্তিকে কষ্টে নিপতিত করে ও নিঃস্ব করে।

(৪) হারাম জীবিকার স্বরূপ ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অবহেলা :

আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ হারাম উপার্জনের স্বরূপ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তার হুকুম কি, ব্যক্তি ও সমাজের উপরে এর কুপ্রভাব কি, এর মাধ্যমগুলি কি কি এসব সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ একদিকে যেমন অজ্ঞ অন্যদিকে সেগুলি সম্পর্কে জানার ব্যাপারেও চরম অবহেলা। অথচ সালাফে ছালেহীন হারাম ভক্ষণের ব্যাপারে কতই না সতর্ক ছিলেন! যেমন আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন,

لأَبِى بَكْرٍ غُلاَمٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ، وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ، فَجَاءَ يَوْمًا بِشَىْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلاَمُ تَدْرِى مَا هَذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لإِنْسَانٍ فِى الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ، إِلاَّ أَنِّى خَدَعْتُهُ، فَلَقِيَنِى فَأَعْطَانِى بِذَلِكَ، فَهَذَا الَّذِى أَكَلْتَ مِنْهُ. فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ فَقَاءَ كُلَّ شَىْءٍ فِى بَطْنِهِ.

‘আবুবকর (রাঃ)-এর এক দাস ছিল, তাকে খারাজ দেওয়া হ’ত। তার খারাজ থেকে আবুবকর (রাঃ) খেতেন। একদা তার নিকটে কিছু আসল, আবুবকর (রাঃ) তা থেকে খেলেন। অতঃপর দাসটি বলল, আপনি কি জানেন, এটা কি? আবু বকর বললেন, কি সেটা? দাসটি বলল, জাহেলী যুগে আমি একজনের গণকী করেছিলাম। আর আমি যে এ বিষয়ে দক্ষ ছিলাম তাও নয়; বরং তাকে আমি ধোঁকা দিয়েছিলাম মাত্র। অতঃপর সে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে উক্ত উপঢৌকন আমাকে দেয়, যা আপনি খেলেন। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) মুখে হাত ঢুকিয়ে যা কিছু পেটে ছিল সবই উদগীরণ করে বের করে দিলেন।[7]

হারাম উপার্জনের ক্ষতিকর দিক সমূহ

(১) হৃদয় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আনুগত্যে স্থবিরতা : হারাম উপার্জনের বহু ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যা হারামের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরে আসন গেড়ে বসে। তা হ’ল অন্তরের কাঠিন্য ও আল্লাহর আনুগত্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহের স্থবিরতা। যার ফলাফল হ’ল ইহলৌকিক জীবন ও জীবিকায় বরকত হ্রাস হওয়া। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إنَّهُ لاَ يَرْبُوْ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ إلاَّ كَانَتِ النَّارُ أوْلَى َبِهِ ‘অবৈধ খাদ্যে যে গোশত বৃদ্ধি পায় জাহান্নামই তার জন্য উত্তম বাসস্থান’।[8]

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ভাল কাজের নূরানী ছাপ অন্তরে অবশ্যই গ্রোথিত হয়, মুখমন্ডল উদ্ভাসিত হয়, শরীরে শক্তি বর্ধিত হয়, জীবিকায় প্রাচুর্য আসে। অপরপক্ষে খারাপ কাজের প্রভাব মুখমন্ডলে প্রস্ফূটিত হয়, অন্তর তমসাচ্ছন্ন হয়, চেহারা হয় দুর্বল এবং জীবিকায় আসে ক্ষীণতা।

(২) দো‘আ অগ্রাহ্য হয় : হারাম জীবিকা উপার্জনের আরেক ক্ষতিকর দিক হ’ল, আল্লাহর কাছে দো‘আ করলে তা কবুল হয় না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّى بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ وَقَالَ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ. ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ.

‘হে মানুষ সকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র, তিনি পাক-পবিত্র বৈ কিছুই কবুল করেন না। আর আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন, যে নির্দেশ তিনি রাসূলদেরকে দিয়েছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যে দীর্ঘ সফর করেছে, ধূলাধূসরিত, এলোমেলো কেশবিশিষ্ট, হস্তযুগল আকাশপানে উত্তোলন করে দো‘আ করে বলে, হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য-পানীয়, পরিচ্ছদ সবই হারাম। এমনকি সে হারাম দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে। সুতরাং তার দো‘আ কিভাবে কবুল করা হবে’?[9]

এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হারাম উপার্জন দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ।

(৩) সৎকর্ম কবুলে প্রতিবন্ধক : হারাম উপার্জন হ’ল সৎকর্ম কবুলের পথে অন্তরায়। যেমন পূর্বোক্ত হাদীছে এসেছে,فَاَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَالِكَ ‘কেমন করে তার দো‘আ কবুল হবে’?[10]

ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধের দিন কতিপয় লোক নিহত হ’লে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল যে, অমুক শহীদ হয়েছে, অমুক শহীদ হয়েছে, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,

كَلاَّ إنِّيْ رَأيْتُه فِيْ النَّارِ فِيْ عَبَاءَةٍ غَلَّهَا أوْ بُرْدَةٍ غَلَّهَا ثُمَّ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا ابْنَ الْخَطَّابِ اذْهَبْ فَنَادِ فِيْ النَّاسِ إنَّهُ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إلاَّ نَفْسٌ مَؤْمِنَةٌ قَالَ : فَخَرَجْتُ فَنَادَيْتُ فِيْ النَّاسِ.

‘কস্মিনকালেও নয়! আমি তাকে অবশ্যই জাহান্নামে দেখেছি এ কারণে যে, একটি ঢিলা জামা অথবা একটি চাঁদর সে আত্মসাৎ করেছিল। অতঃপর তিনি (ছাঃ) আমাকে বলেন, হে খাত্ত্বাবের পুত্র! তুমি গিয়ে মানুষের মাঝে এ ঘোষণা দাও যে, মুমিন ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অতঃপর আমি গিয়ে জনসমক্ষে এ ঘোষণা দিলাম’।[11]

(৪) মহাশক্তিধর আল্লাহর ক্রোধ ও জাহান্নামে প্রবেশ : হারাম উপার্জন আল্লাহর ক্রোধকে বাড়িয়ে দেয় এবং জাহান্নামে প্রবেশে সহায়তা করে। আবু যার গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ قَالَ فَقَرَأَهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثَلاَثَ مِرَارٍ. قَالَ أَبُو ذَرٍّ خَابُوا وَخَسِرُوا مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.

‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এমন ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কারা? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার পুনরুল্লেখ করে বললেন, (১) টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে কাপড় পরিধানকারী (২) মিথ্যা শপথে পণ্য বিক্রয়কারী (৩) উপকারের খোটা দানকারী ব্যক্তি’।[12]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِيْنِهِ فَقَدْ أَوْجَبَ اللهُ لَهُ النَّارَ وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ. فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ وَإِنْ كَانَ شَيْئًا يَسِيْرًا يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ.

‘মিথ্যা শপথের মাধ্যমে কেউ যদি কোন মুসলিমের প্রাপ্য ছিনিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ জাহান্নাম তার জন্য অবধারিত করে দেন এবং জান্নাত হারাম করে দেন। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদিও তা সামান্য পরিমাণ হয়? তিনি বললেন, যদিও তা গাছের ডালের সামান্য দন্ড পরিমাণ হয়’।[13]

অন্য হাদীছে এসেছে, إِنَّ رِجَالاً يَتَخَوَّضُونَ فِى مَالِ اللهِ بِغَيْرِ حَقٍّ، فَلَهُمُ النَّارُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ. ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর রাস্তার সম্পদকে অন্যায়ভাবে অধিগ্রহণ করে, তাদের জন্য ক্বিয়ামতের দিবসে জাহান্নাম রয়েছে’।[14]

হারাম উপার্জনের স্বরূপ

(১) পরিমাণ ও ওযনে কমতি করা : ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও ওযনে ঠকানোর মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন জঘন্য কাজ। আল্লাহ তা‘আলা এহেন কারবারীর বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় হুঁশিয়ার বাণী নাযিল করেছেন। তিনি বলেন, وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ، الَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ- ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ। এরা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন মেপে দেয় তখন কম করে দেয়’ (তাত্বফীফ ৮৩/১-৩)

এ ধরনের কর্মকান্ড তারাই করে থাকে, যারা অত্যধিক ধূর্ত। এভাবে তারা মানুষকে ঠকিয়ে অসৎ পন্থায় আয় করে। অথচ এই অন্যায়কর্ম সম্পাদনের কারণে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيْزَانَ إِلاَّ أُخِذُوْا بِالسِّنِيْنَ وَشِدَّةِ الْمَؤُنَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ.

‘যখনই কোন জনগোষ্ঠী মাপ ও ওযনে কম দেয়, তখনই তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি ও অত্যাচারী শাসকের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়’।[15]

(২)যাকাতের সম্পদ গোপন রাখা : নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও যাকাত আদায় না করে নিঃস্ব-অভাবী লোকদের হক্ব নষ্ট করা এবং সম্পদের নিছাব গোপন করা পাপ। এর পার্থিব শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ অনাবৃষ্টি ও খরা চাপিয়ে দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلاَّ مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ وَلَوْلاَ الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوْا ‘যে সম্প্রদায় তাদের সম্পদের যাকাত প্রদান করে না, তাদেরকে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণও করা হ’ত না, যদি প্রাণীকুল না থাকত’।[16] অর্থাৎ প্রাণীদের কারণেই তাদেরকে বৃষ্টি দান করা হয়। আর পরকালীন শাস্তিতো অত্যন্ত মর্মন্তুদ ও যন্ত্রণাদায়ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

مَا صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلاَ فِضَّةٍ لاَ يُؤَدِّى مِنْهَا حَقَّهَا إِلاَّ إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحَ مِنْ نَارٍ فَأُحْمِىَ عَلَيْهَا فِى نَارِ جَهَنَّمَ فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ فِى يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ فَيُرَى سَبِيلُهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّار-

‘স্বর্ণ-রূপার মালিক যারা তার যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন তা পাত বানানো হবে, অতঃপর তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার পার্শ্বদেশ, কপাল ও পিঠে সেকা দেওয়া হবে (তাওবা৯/৩৫)। যখন তা ঠান্ডা হয়ে যাবে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে, এমন দিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। এভাবে সকল বান্দার মধ্যে ফায়ছালা হবে। অতঃপর তাকে জান্নাত অথবা জাহান্নামের দিকে রাস্তা দেখানো হবে’।[17] অনুরূপভাবে পশু-সম্পদ, অর্থসম্পদ, ওশর ইত্যাদির যাকাত অনাদায়কারীকেও পরকালে শাস্তি দেওয়া হবে।

(৩)সূদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা : বর্তমান বিশেবর অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেন-দেনে সূদের ব্যাপক ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূদ ভক্ষণকারী, সূদদাতা, সূদের লেখক ও সাক্ষীকে অভিসম্পাত করেছেন।[18] জাবের (রাঃ) বলেন,

لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ.

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূদ ভক্ষণকারী, সুদদাতা, সূদের লেখক ও সাক্ষীকে অভিসম্পাত করেছেন’।[19]

আর এ অভিশপ্ত পন্থাকে মানুষ নানান ভাষা ব্যবহার করে ছলেবলে কৌশলে সিদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে। কখনো একে Interest, কখনো মুনাফা, কখনো লাভ ইত্যাদি নামে অভিহিত করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আর বস্ত্তত বিশ্বের দারিদ্র্য, অনাহার, নিঃস্বতা ইত্যাদি হচ্ছে সূদী লেনদেনের বিষময় ফল। কেননা সূদ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন, يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ‘আল্লাহ সূদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-ছাদাক্বা বৃদ্ধি করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই বিধ্বংসী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ.

‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বেঁচে থাক। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সেগুলি কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, জাদু করা, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, সূদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা, মুমিনা সতী-সাধ্বী নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করা’।[20]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, دِرْهَمُ رِبا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَثَلاَثِيْنَ زَنْيَةً ‘সূদের একটি মাত্র দিরহাম ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চাইতেও জঘন্য’।[21]

(৪) ঠকবাজি ও জুয়াচুরি : এটা বেশি হয়ে থাকে ব্যবসার ক্ষেত্রে। যেমন খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশানো, উৎকৃষ্ট মালের সাথে নিম্নমানের মাল মিলানো, অতিরিক্ত গ্রহণ করা, এক জিনিস নির্ধারণ করে জোরপূর্বক অন্যটি দিয়ে দেয়া, মাপে কম দেয়া ইত্যাদি। অথচ এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দিল সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[22] বাস ও রেল স্টেশন এবং লঞ্চঘাটে কুলিদের উৎপীড়ন ও মালামাল উঠানো-নামানো নিয়ে দর কষাকষি এবং অতিরিক্ত আদায় ঠকবাজির শামিল।

(৫) উৎকোচ : বর্তমানে ঘুষ-উৎকোচ গোটা দেশকে জাহেলিয়াতের প্রগাঢ় অমানিশায় নিক্ষেপ করেছে। এমন বহু নযীর রয়েছে যে, কোন ব্যক্তির প্রাপ্য আদায়ে আবশ্যকিভাবে ঘুষের লেন-দেন করা হচ্ছে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়েও ব্যাপকহারে ঘুষের লেনদেন হচ্ছে প্রকাশ্যেই। কিন্তু তারা যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অমিয় বাণীর দিকে লক্ষ্য করত, তবে কখনই অভিশপ্ত এই পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করত না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, َلعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صِلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاشِيَ وَالْمُرْتَشِيَ. ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) লা‘নত করেছেন ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারীকে’।[23]

(৬)চুরি, ডাকাতির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন : এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজ ইত্যাকার কর্মকান্ড করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় নতুন ব্র্যান্ডের মোটর সাইকেল, জীপ ছিনতাইয়ের সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশ হয়ে থাকে। গভীর রাতে রাস্তায় গাছ ফেলে ডাকাতি করার ঘটনা এদেশে নতুন নয়। তাদের কি ঈমান হারানোর কথা অন্তকরণে সামান্যতমও জাগ্রত হয় না? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَلاَ يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ حِيْنَ يَنْتَهِبُهَا وَهْوَ مُؤْمِنٌ ‘চোর যখন চুরি করে তখন তার ঈমান থাকে না। ডাকাত যখন জনসমক্ষে ডাকাতি করে তখন তার ঈমান থাকে না’।[24] অর্থাৎ তার ঈমান এ অবস্থা থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত উপরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে।

(৭) আত্মসাৎ : এ ধরনের কাজের জন্য পরকালে কঠোর শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি আত্মসাৎ করবে, সে ক্বিয়ামত দিবসে আত্মসাৎকৃত বস্ত্ত নিয়েই হাযির হবে’ (আলে ইমরান ৩/১৬১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنِ اسْتَعَمَلْنَاهُ مِنْكُمْ عَلَى عَمَلٍ فَكَتَمَنَا مَخِيْطًا فَمَا فَوْقَهُ كَانَ غُلُوْلًا يَأْتِيْ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যাকে আমরা কোন কাজে নিযুক্ত করলাম, আর সে একটি সুতা বা তদুর্ধ্ব কিছু গোপন করল সেটা আত্মাসাৎ হিসাবে বিবেচিত। যা নিয়ে সে কিয়ামত দিবসে হাযির হবে’।[25]

(৮)জুয়া ও বাজি ধরা : ক্রিকেট ও ফুটবল খেলাকে ঘিরে যে কত শত কোটি টাকার বাজি ধরা হয় দেশে তার ইয়ত্তা নেই। বাজিতে জেতা অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে ধান্দাবাজ বাজিকররা। অথচ এসব হারাম। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা, ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও’ (মায়েদাহ ৫/৯০)

(৯) পণ্য বিক্রয়ে অধিক কসম করা : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الْحَلِفُ مَنْفَقَةٌ لِلسِّلْعَةِ مَمْحَقَةٌ لِلرِّبْحِ ‘কসম করলে পণ্য বিক্রয় হয় কিন্তু তাতে বরকত থাকে না’।[26] আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। রাবী বলেন, রাসূল (ছাঃ) এটা তিনবার বললেন। আবু যার (রাঃ) বলেন, তারা ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরিধানকারী, উপকার করে খোটা দানকারী, মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী’।[27]

(১০) ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা : আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, إِنَّ الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُوْنَ فِيْ بُطُوْنِهِمْ نَارًا وَسَيَسصْلَوْنَ سَعِيْرًا ‘যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের সম্পদ গ্রাস করে, তারা তো তাদের উদরে আগুন ভক্ষণ করল’ (নিসা ৪/১০)

(১১) মজুতদারি করা : মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয় পণ্য মওজুদ করে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ সময় ব্যবসায়ী বেচাকেনা বন্ধ রাখে যাতে বাজার মূল্য চড়া হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ বিষয়ে বলেন,مَنِ احْتَكَرَ طَعَاماً أَرْبَعِينَ لَيْلَةً فَقَدْ بَرِئَ مِنَ اللهِ تَعَالَى وَبَرِئَ اللهُ تَعَالَى مِنْهُ ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য গুদামজাত করে রাখল, তাহ’লে সে অবশ্যই আল্লাহ থেকে মুক্ত, আর আল্লাহ ও তার থেকে মুক্ত’।[28] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ ‘যে গুদামজাত করে সে পাপী’।[29]

গান-বাজনার উপকরণ বিক্রি করা, ভাস্কর্য, ছবি নির্মাণ করা, সেলুনে দাড়ি কামিয়ে অর্থ উপার্জন করা, নেশাজতীয় দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করা, মদ, কুকুর-শূকর বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করে অর্থের পাহাড় বানানো এসব হারাম উপার্জনের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।

সমাপনী : সকল মুমিন নর-নারীর উচিত হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إنَّهُ لَا يَرْبُوْ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ إلَّا كَانَتِ النَّارُ أوْلَى بِهِ ‘হারাম দ্বারা যে সমস্ত দেহ গঠিত হয়েছে জাহান্নামই তার জন্য অধিক উপযোগী’।[30] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, لاَ تَزُوْلُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَا فَعَلَ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَا أَنْفَقَهُ وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ- ‘কিয়ামত দিবসে কোন বান্দা তার পা সরাতে পারবে না যতক্ষণ তার বয়স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কোথায় তা নিঃশেষ করেছে; তার জ্ঞান সম্পর্কে, যাতে সে কি কাজ করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে ও তা কোথায় ব্যয় করেছে; তার দেহ সম্পর্কে, কিসে তা জীর্ণ করেছে’।[31]

তাই আসুন, আমরা হারাম থেকে বেঁচে থাকি এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক আমাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

ইহ্সান ইলাহী যহীর

বি.এ (অনার্স), ২য় বর্ষ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. ছহীহ বুখারী হা/২০৫৯, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৩৮১

[2]. আহমাদ হা/৩৬৭১; তিরমিযী হা/২৪৫৮; সনদ হাসান।

[3]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৩, ছহীহাহ হা/৬৮৪।

[4]. ছহীহাহ হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৫৩০০।

[5]. তিরমিযী হা/২৪১৬, ছহীহাহ হা/৯৪৬, সনদ হাসান, মিশকাত হা/৫১৯৭।

৬. তিরমিযী হা/২৩৭৬; মিশকাত হা/৫১৮১, সনদ ছহীহ।

[7]. বুখারী, ‘কিতাবুল মানাক্বিব’ হা/৩৮৪২,মিশকাত হা/২৭৮৬।

[8]. তিরমিযী হা/৬১৪, সনদ হাসান।

[9]. ছহীহ মুসলিম হা/১০১৫, মিশকাত হা/২৭৬০, আহমাদ হা/৮৩৩০।

১০. তিরমিযী হা/২৯৮৯।

[11].মুসলিম হা/১১৪; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৪৮৪৯।

[12]. মুসলিম, হা/১০৬; আহমাদ হা/২১৪৭৩;আবু দাঊদ হা/৪০৮৭।

[13]. মুসলিম, হা/১৩৭; মিশকাত হা/৩৭৬০।

[14]. বুখারী হা/২০৮৭; আহমাদ হা/৭২০৬; ছহীহাহ হা/৩৩৬৩।

১৫. বুখারী হা/৩১১৮; মিশকাত হা/৩৭৪৬।

১৬. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯, হাদীছ ছহীহ; ছহীহাহ হা/৪০০৯।

১৭. ছহীহ আত-তারগীব হা/১৭৬১; ছাহীহাহ হা/৪০০৯।

[18]. মুসলিম হা/৩/১২১৯ (১৫৯৮)।

১৮ মুসলিম হা/ ৯৮৭; মিশকাত হা/১৭৭৩।

১৯. মুসলিম হা/১৫৯৭;তিরমিযীহা/১২০৬ ।

২০. বুখারী হা/২৭৬৬;মুসলিম হা/৮৯।

২১. মিশকাত হা/২৮২৫; আহমাদ হা/২২০০৭; ছহীহাহ হা/১০৩৩।

২২. মুসলিম হা/২৯৫; মিশকাত হা/২৮৬০; তিরমিযী হা/১৩১৫। ।

২৩. আহমাদ হা/৬৫৩২; তিরমিযী হা/১৩৩৬, হাদীছ ছহীহ।

২৪. বুখারী হা/২৪৭৫; মুসলিম হা/৫৭।

২৫. মুসলিম হা/১৮৩৩; আহমাদ হা/১৭৭৫৩।

২৬. মুসলিম হা/ ১৬০৬; মুসনাদ আবী ইয়ালা হা/৬৪৮০।

২৭. মুসলিম হা/১০৬; আহমাদ হা/২১৫৮৪।

২৮. ছহীহাহ হা/৩৩৬২;আহমাদ হা/৪৮৮০; মিশকাত হা/২৮৯৫।

২৯. মুসলিম হা/১৬০৫; মিশকাত হা/২৮৯২।

৩০. তিরমিযী হা/৬১৪, সনদ ছহীহ।

৩১. তিরমিযী হা/২৪১৭, সনদ ছহীহ; দারেমী হা/৫৪৬।






আরও
আরও
.