
ভূমিকা :
আমরা প্রত্যেকেই মানসিক প্রশান্তি চাই। দুনিয়াবী জীবনে আমরা যা কিছু করি না কেন, তার কাঙ্খিত বস্ত্ত হ’ল মানসিক প্রশান্তি। কিন্তু মানসিক প্রশান্তিটা আসলে কোথায়? আমাদের চিরস্থায়ী প্রকৃত সুখের মৌলিক উৎস কী? অনেকে ধন-সস্পদের প্রাচুর্য, সামাজিক পদমর্যাদা ও ক্ষমতার মাঝেই মানসিক প্রশান্তি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত। এর মূল কারণ হ’ল- মানুষ অন্তরের খোরাক বুঝে উঠতে পারেনি। তারা এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি যে, আসলে মানসিক প্রশান্তি কোথায় নিহিত? একজন মানুষকে যদি দুনিয়ার সকল সম্পদ, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণী, সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি দেওয়া হয়, তারপরেও সে মানুষ কখনোই মানসিক প্রশান্তি লাভে সক্ষম হবে না। কারণ মানুষের অন্তরের প্রশান্তির উৎস হ’ল আল্লাহ্র ভালোবাসা। মহান আল্লাহ মানব হৃদয়কে এত সম্ভ্রান্ত, নিষ্কলুষ-পবিত্র করে সৃষ্টি করেছেন যে, দুনিয়ার কোন প্রাচুর্য বা কোন মোহই তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারবে না। কিন্তু যখন হৃদয় আল্লাহ্র পবিত্র ভালোবাসায় সিক্ত হবে তখন তার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিলেও তার কোনই আফসোস থাকবে না। সেই ভালোবাসার অমিয় সুধা পান করেছিলেন ইসলামের মর্দে মুজাহিদ ছাহাবীগণ। কোন সে শক্তি, যার বলে তারা আল্লাহ্র ভালোবাসায় নিজেদের অন্তরকে প্রশান্ত করতে পেরেছেন? তার উত্তর একটাই আল-কুরআন। কুরআন আল্লাহ্র ভালোবাসা অর্জনের উত্তম মাধ্যম। যা মানুষের হৃদয়কে আল্লাহ্র ভালোবাসা দিয়ে প্রশান্ত করে দেয়। নিমেণ এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
প্রশান্ত আত্মার পরিচয় :
যে আত্মা তার রবের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে সেটাই প্রশান্ত আত্মা। যার জীবন জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখী হওয়ার তীব্র বাসনা। যার দুনিয়া পরিচালিত হয় আখেরাত কেন্দ্রিক। প্রশান্ত আত্মা সেটাই, যা তার মহান রবের যেকোন সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট থাকতে পারে, হোক তা তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। সেটাকে সে আল্লাহ্র দেওয়া কল্যাণকর ফায়ছালা হিসাবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়। মহান আল্লাহ্র ইবাদতে যে হৃদয়ে চরম ভালো লাগার অনুভূতি ছুঁয়ে যায়। যে অন্তর তার রবের একত্ববাদকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। যে অন্তর জানে যে, তার যাবতীয় রিযিকের মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর উপরেই দৃঢ় পদে স্থির থাকার সক্ষমতা রাখে, সেটাই প্রকৃত প্রশান্ত অন্তর। আর মৃত্যুর সময় তাদেরকেই এই উপাধিতে ডেকে বলা হবেيَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ، ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً ‘হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে, সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়’ (ফাজর ৮৯/২৭-২৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বছরী (রহঃ) বলেন,إن الله تعالى إذا أراد أن يقبض روح عبده المؤمن، اطمأنت النفس إلى الله تعالى، واطمأن الله إليها، ‘আল্লাহ যখন কোন মুমিন বান্দার রূহ কবয করার ইচ্ছা করেন, তখন সেই রূহ আল্লাহ অভিমুখী হয়ে প্রশান্তি লাভ করে এবং আল্লাহও তার প্রতি সন্তুষ্ট হন’।[1]
আলী ত্বানত্বাবী (রহঃ) বলেন, ‘প্রশান্ত আত্মা হ’ল যে তার বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলে ছলেহের কারণে ক্বিয়ামতের দিন যাবতীয় ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে’।[2] সর্বোপরি আল্লাহ্র শাস্তির ভয়ে সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত থাকাও প্রশান্ত আত্মার একটি অন্যতম গুণ।
এটা এমন আত্মা, যার উপরে তার প্রভু সন্তুষ্ট থাকেন এবং সেও তার প্রভুর দেওয়া যেকোন সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট থাকে। সে সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তার প্রভুকে স্মরণ করে। বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং নে‘মতে শুকরিয়া আদায় করে। যে আত্মাকে নেওয়ার জন্য ফেরেশতারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় যে, এই সম্মানিত আত্মাকে কে আল্লাহ্র সামনে নিয়ে যাবেন। এই সেই আত্মা, যার সুঘ্রাণে সুবাসিত হবে পুরো আসমান এবং আসমানে সুনাম ছড়িয়ে পড়বে তার। অবশেষে তাকে ‘ইল্লিয়্যিন’ নামক সবচেয়ে সম্মানিত এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থানে রাখা হবে (মুত্বাফফিফীন ৮৩/১৯)। তার কবরকে আলোকিত করে দেওয়া হবে। তার জন্য কবরে জান্নাতের বিছানার ব্যবস্থা করা হবে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার কাছে জান্নাতের সুঘ্রাণ পেŠঁছতে থাকবে।[3] কতই না সৌভাগ্যবান এই অন্তরের অধিকারীরা! দুনিয়া ও আখেরাতে এই অন্তরের চেয়ে দামী আর কী হ’তে পারে? এই অন্তরের মালিকের চেয়ে সফলকাম ব্যক্তি আর কে হ’তে পারে? সে তার প্রিয় রবের ভালোবাসায় এতটাই মোহদীপ্ত হবে যে, দুনিয়ার ন্যূনতম কোন মূল্য তার কাছে থাকবে না। সে তার প্রিয়তমা স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, তার কলিজার ধন, নয়নের পুত্তলি সন্তান-সন্ততিকেও ছেড়ে যেতেও দ্বিধাবোধ বা আফসোস করবে না। আল্লাহ্র ভালবাসার প্রতি মানব হৃদয়ের এত টান আর কোন কিছুতেই নেই। আর এটাই হ’ল প্রশান্ত আত্মার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আর এই আত্মার অধিকারী হওয়ার জন্য কুরআন হবে উত্তম সঙ্গী।
প্রশান্ত আত্মার বৈশিষ্ট্য :
১. তার ঈমান ও আমলে সমতা থাকা এবং কথা কাজে মিল থাকা। সেটা প্রকাশ্যে হোক বা অপ্রকাশ্য।
২. যেকোন ফরয বা ওয়াজিব ইবাদতের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া।
৩. বান্দা তার পার্থিব জীবনে সহজেই পাপ থেকে বাঁচতে পারে এবং নেকীর কাজে অগ্রগণ্য হ’তে পারে।
৪. প্রত্যেকটা কাজে আল্লাহ্র সন্তুষ্টিকেই প্রাধান্য দেয়া। মানুষের সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহ্র বিরাগভাজন না হওয়া।
বরং সবার উপরে আল্লাহকেই প্রাধান্য দেয়া।
৫. অন্যের ব্যাপারে অনুমান ভিত্তিক কথা না বলা। গীবত বা অপবাদ না দেয়া। কোন বান্দার হক নষ্ট না করা। বরং আত্ম সমালোচনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং নিজেকে শুধরিয়ে নেয়া।
৬. আত্মীয়দের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা।
৭. অন্যের জৌলুস দেখে প্রতারিত না হওয়া। নিজের যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা। বলা যেতে পারে, এই বৈশিষ্ট্য বা গুণগুলো যে ব্যক্তির মাঝে থাকে, তিনিই মূলত সেই মহান প্রশান্ত আত্মার অধিকারী।
অন্তরের উপর কুরআনের প্রভাব :
অন্তরের উপর কুরআনের প্রভাব ব্যাপক। অন্তরে শান্তি নির্ভর করে কুরআনের উপর। মানুষ যেমন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়। তেমনি মানুষ অন্তরের রোগেও রোগাক্রান্ত হয়। যার মহেŠষধ হ’ল পবিত্র কুরআন। যে ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ، ‘হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের ব্যধিসমূহের উপশম। আর বিশ^াসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭-৫৮)। ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘অন্তরের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্য হ’ল কুরআনের উপদেশমালা। হেদায়াত অন্বেষণের জন্য যথেষ্ট হ’ল কুরআনের দলীলসমূহ। নিরাপত্তা ও সুস্থতার পথচারীরা কোথায়? নিশ্চয়ই কুরআনের উপদেশমালা লোহাকেও বিগলিত করে। কুরআনের মাঝে এমন শক্তি আছে, যা কঠিন শক্ত প্রস্তরখন্ডকেও নরম করে দেয়। যদি পাথর সেটা বুঝতো, তাহ’লে পাথরও নুয়ে পড়তো। অথচ আলোকিত হৃদয় প্রতিদিন এই কুরআনের মাধ্যমে নিজেকে প্রফুল্ল রাখে। তবে যারা উদাসীন তারা শুধু তেলাওয়াত করে কিন্তু কুরআন থেকে কোন উপকার লাভ করতে পারে না।[4]
এখানে কুরআনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্য বুঝে বুঝে পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ، ‘আর আমরা কুরআন নাযিল করেছি, যা বিশ^াসীদের জন্য আরোগ্য ও অনুগ্রহ স্বরূপ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮২)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,إنما الشفاء في شيئين: العسل شفاء للناس، والقرآن شفاء لما في الصدور، ‘দুইটা জিনিসে রোগের আরোগ্য রয়েছে, মানুষের শারীরিক রোগের আরোগ্য রয়েছে মধুতে। আর অন্তরের রোগের শিফা রয়েছে কুরআনে’।[5] যদিও কুরআন মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় রোগের জন্যই আরোগ্য। আমরা জানি কাফেরদের অন্তর হ’ল অসুস্থ অন্তর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি। আল্লাহ তাদের হঠকারিতার মাধ্যমে তাদের অন্তরের রোগকে আরোও বাড়িয়ে দেন’ (বাক্বারাহ ২/১০)। পক্ষান্তরে এই কুরআন শুনেই তাদের মৃত অন্তর আবার সজীব হয়েছে। তাদের অন্তর হেদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। মালেক বিন দীনার (রহঃ) বলেছেন,أقسم لكم، لا يؤمن عبد بهذا القرآن إلا صدع قلبه، ‘আমি তোমাদেরকে কসম করে বলতে পারি, যে বান্দা কুরআনের প্রতি ঈমান রাখে, কুরআনের মাধ্যমে তার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হবেই’।[6] ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফগণ যখন কুরআন তেলাওয়াত করতে বসতেন তখন তাদের চেহারার রং পাল্টে যেত। শোনা যেত কান্নার আওয়ায। কুরআনের বাণী তাদের ঘুম কেড়ে নিত। কেউ কেউ একটা আয়াত বার বার তেলাওয়াত করেই পুরো রাত্রি কাটিয়ে দিতেন। আবার কেউ আয়াতের মর্ম বুঝতে পেরে তেলাওয়াত করতে করতে বেহুঁশ হয়ে পড়তেন। আবূ হুমামা (রহঃ) বলেন, আমি ঈসা ইবনে দাঊদ (রহঃ)-কে বললাম, দুনিয়ার প্রতি আপনার আগ্রহ কতটুকু? তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘আমার ইচ্ছা হয় বুকটা চিরে অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখি যে, সেখানে কুরআন কী কাজ করেছে? তিনি যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। ফলে তার দীর্ঘশ^াস উঠে যেত। আর আমার মনে হ’ত, এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে গেল।[7]
বিশিষ্ট তাবেঈ ছাবেত বিন আসলাম আল-বুনানী (মৃ. ১২৭ হি.) বলেন,كابدت القرآن عشرين سنة وتنعمت به عشرين سنة، ‘আমি বিশ বছর কুরআন নিয়ে পরিশ্রম করেছি এবং বিশ বছর এর মাধ্যমে (প্রশান্তি) উপভোগ করেছি’।[8]
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ছালাতে সূরা তূর তেলাওয়াত করতেন। যখন তিনি এই আয়াতে পৌঁছতেন,إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَاقِعٌ، مَا لَهُ مِنْ دَافِعٍ، ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি অবশ্যই আসবে। একে প্রতিহত করার কেউ নেই’ (তূর ৫২/৭-৮)। তিনি আয়াত দু’টো বার বার তেলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহ্র আযাবের ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এমনকি ছালাতে যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হ’ত এবং আল্লাহ্র আযাব ও জাহান্নাম সংক্রান্ত আয়াত আসত তখন তিনি ভয়ে কাঁপতে থাকতেন। একেবারে পিছনের কাতারে অবস্থানকারী লোকেরাও তাঁর কাঁন্নার আওয়ায শুনতে পেত।[9] অথচ তিনি ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ছাহাবী। যাকে দেখে শয়তান পালাত। এমনকি তার জীবদ্দশাতেই তার জন্য জান্নাতে প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও কুরআন তার হৃদয়কে এতটা আন্দোলিত করত। এ যেন কুরাআনের এই আয়াতেরই প্রতিফলন, যেখানে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُون، ‘মুমিন কেবল তারাই, যখন তাদেরকে আল্লাহ্র কথা স্মরণ করানো হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। বলা যেতে পারে একজন বান্দার মানসিক শান্তি নির্ভর করে তার ঈমানের উপর। যার ঈমান যত মযবূত তার অন্তর তত প্রশান্ত। আর এই ঈমানকে বৃদ্ধি এবং মযবূত করে মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন।
মানসিক প্রশান্তি লাভে কুরআনের ভূমিকা :
কুরআনের মাধ্যমে মানব হৃদয়ে যে প্রশান্তি লাভ হয়, সেটা মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল।-
কুরআন তেলাওয়াত একটি ইবাদত এবং যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য যিকিরের মাধ্যমে যেমন বান্দাকে প্রতিদান দেওয়া হয়, তেমনি কুরআন পাঠকারীকেও মহান আল্লাহ অশেষ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হ’ল- এর মাধ্যমে বান্দার অন্তরে প্রশান্তি লাভ করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘যারা আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করলে যাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। মনে রেখ, আল্লাহ্র স্মরণেই কেবল হৃদয় প্রশান্ত হয়’ (রা’দ ১৩/২৮)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ্র যিকির বলতে এখানে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। এটা মহান আল্লাহ্র সেই যিকির, যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। এর মাধ্যমেই মুমিনদের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। কেননা ঈমান ও ইয়াক্বীন ছাড়া হৃদয় প্রশান্ত হয় না। আর কুরআন ছাড়া ঈমান ও ইয়াক্বীন লাভেরও কোন পথ নেই’।[10] বোঝা যায় মানসিক প্রশান্তির জন্য ঈমান ও ইয়াক্বীন উভয়টিই প্রয়োজন। আর ঈমান ও ইয়াক্বীন লাভ হয় কুরআনের মাধ্যমে। যদিও ঈমান ও ইয়াক্বীনের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। হযরত আলী (রাঃ) বলেন,اليقين ما رأته عينك، والإيمان ما سمعته أذنك، وصدقت به ‘ইয়াক্বীন হ’ল তুমি স্ব-চক্ষে দেখে যা বিশ^াস কর। আর ঈমান হ’ল তুমি নিজ কানে শোনার পর যা বিশ^াস কর’।[11]
আবার এই ঈমানটা যখন মযবূত হয় তখন তা ইয়াক্বীনে পরিণত হয়। যেমন আমরা আল্লাহকে, আখেরাতকে না দেখে বিশ^াস করেছি। রাসূল (ছাঃ)-কে না দেখে বিশ^াস করেছি। কিন্তু কুরআন ও হদীছের মাধ্যমে আমাদের বিশ^াস ইয়াক্বীনে পরিণত হয়েছে এবং হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে। এজন্য হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, বিশ^াসযোগ্য কোন সংবাদ শোনার পর হৃদয়ের প্রশান্তিকেই ইয়াক্বীন বলা হয়।[12] হাফেয ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন, ঈমানের মাধ্যমেই কেবল মানসিক শান্তি লাভ করা যায়।[13] আর ঈমান বৃদ্ধি পায় কুরআনের মাধ্যমেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا ‘আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়’ (আনফাল ৮/২)। আর এই ঈমানের বরকতেই তারা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে। অন্যত্রে মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ، ‘হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের ব্যধিসমূহের উপশম। আর বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭-৫৮)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অত্র আয়াতে রহমত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল কুরআন।[14] ইবনুল খাত্বীব (রহঃ) বলেন, কুরআন হ’ল অন্তরের রোগের শিফা। আর অন্তরের রোগ শারীরীক রোগের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ বিশুদ্ধ ঈমান থাকলে শারীরিক রোগ বান্দাকে জান্নাতে নিয়ে যায়। আর অন্তরের রোগ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য একমাত্র উপায় হ’ল হৃদয়ের সুস্থতা। আর হৃদয় তখনই সুস্থ হয়, যখন তা যাবতীয় কু-প্রবৃত্তি ও খারাবী থেকে দূরে থাকে। আর সেই অন্তরকে সুস্থ রাখার উপযুক্ত হাতিয়ার হ’ল কুরআন। যা হৃদয়কে যাবতীয় অসুস্থতা ও পথভ্রষ্টতা থেকে চিরস্থায়ী সুখী এবং প্রশান্তির জীবন দান করে।[15] ইবনু কাছীর (রহঃ) কুরআন পরিত্যাগকারীর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি কুরআনকে পরিত্যাগ করে, দুনিয়াতে তার জন্য কোন মানসিক প্রশান্তি বা প্রফুল্লতা নেই। বিপথগামীতার জন্য তার জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। যদিও বাহ্যিকভাবে সে নে‘মতপ্রাপ্ত হয়- যখন যা মন চায় খেতে পারে, যে পোষাক মন চায় পরিধান করতে পারে, যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে। এতদসত্ত্বেও তার হৃদয় যদি হেদায়াত ও ঈমানের ব্যাপারে নিশ্চিত হ’তে না পারে, তাহ’লে মন সর্বদা সন্দেহ, দুশ্চিন্তা, পেরেশানিতে জর্জরিত থাকে। আর এই মানসিক প্রশান্তিবিহীন জীবনই সবচেয়ে কষ্টের জীবন’।[16]
কুরআনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভের উপায় :
১. অর্থ বুঝে তেলাওয়াত করা :
কুরআন বুঝে পড়ার অর্থ কুরআনের মধ্যে নিহিত মর্মার্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, দুনিয়ার গরযে, দুনিয়ায় ক্ষণস্থায়ী কিছু পাওয়ার আশায় আমরা কত প্রকারের ভাষাই না শিখি। কিন্তু কুরআন বুঝে পড়ার মত ভাষাজ্ঞান অর্জন করার তাকীদ অনুভব করি না। যদি কোন ব্যক্তি কুরআনের মাধ্যমে নিজে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে চায়, তাহ’লে তার জন্য যরূরী হ’ল- কুরআন বুঝে তেলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের অসংখ্য জায়গায় কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوْا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ، ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। তিনি আরো বলেন,أَفَلاَ يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا ‘তবে কি তারা কুরআন গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ’? (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা কবিতার মতো দ্রুত কুরআন পাঠ করো না এবং এটাকে নষ্ট খেজুরের মতো ছিটিয়ে দিয়ো না। এর আশ্চর্য বিষয় নিয়ে একটু ভাবো। কুরআন দিয়ে দিলকে একটু নাড়া দাও। (তেলাওয়াতের সময়) সূরা শেষ করাই যেন তোমাদের একমাত্র চিন্তা না হয়’।[17] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,الْقِرَاءَةُ الْقَلِيلَةُ بِتَفَكُّرٍ أَفْضَلُ مِنْ الْكَثِيرَةِ بِلَا تَفَكُّرٍ، ‘না বুঝে অনেক বেশী কুরআন তেলাওয়াত করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে অল্প তেলাওয়াত করা অতি উত্তম’।[18] বান্দা যখন চিন্তা-গবেষণা করে কুরআন তেলাওয়াত করে এবং এর বিধি-বিধান উপলব্ধি করার চেষ্টা করে, তখন তার হৃদয়ে কুরআনের প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাবে তার হৃদয়ে অর্জিত হয় মানসিক প্রশান্তি।
৩. সাকীনার আয়াত তেলাওয়াত করা বা শোনা :
কুরআন মাজীদে এমন কিছু আয়াত আছে, যেগুলো সাকীনাহ্র আয়াত নামে পরিচিত। ‘সাকীনাহ’ অর্থ হ’ল- আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এক গায়েবী মানসিক প্রশান্তি। মানসিক প্রশান্তি লাভে সাকীনাহ্র আয়াত সমূহের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়া (রহঃ) বলেন, শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) যখন কোন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হ’তেন, তখন সাকীনাহ্র আয়াতগুলো তেলাওয়াত করতেন’।[19] অসুস্থতা, অক্ষমতা, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা, শয়তানী ওয়াসওয়াসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি সাকীনাহ্র আয়াত তেলাওয়াত করতেন এবং বলতেন, ‘কোন কঠিন পরিস্থিতি যখন আমার উপর জেকে বসে, তখন আমি আমার আত্মীয়-স্বজন এবং আমার আশপাশের কাউকে বলি, আমাকে সাকীনাহ্র আয়াতগুলো পড়ে শুনাও। তারপর (আয়াতগুলো শুনে) আমার থেকে সেই কঠিন অবস্থা দূর হয়ে যায় এবং আমি এমন হয়ে যাই যে আমার অন্তরেরও কোন রোগ থাকে না’। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,وَقَدْ جَرَّبْتُ أَنَا أَيْضًا قِرَاءَةَ هَذِهِ الْآيَاتِ عِنْدَ اضْطِرَابِ الْقَلْبِ بِمَا يَرِدُ عَلَيْهِ. فَرَأَيْتُ لَهَا تَأْثِيرًا عَظِيمًا فِي سُكُونِهِ وَطُمَأْنِينَتِهِ، ‘আমিও মনের অস্থিরতা ও অশান্তির মুহূর্তে এই আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে দেখেছি এবং খেয়াল করেছি যে, মনের সুস্থিরতা ও প্রশান্তি লাভে এই আয়াতগুলির বিরাট প্রভাব রয়েছে’।[20] সুতরাং সাকীনাহ্র আয়াত তেলাওয়াত করে অথবা শুনে আমরা আমাদের হৃদয়কে প্রশান্ত করতে পারি।
৪. মনোযোগ দিয়ে কুরআন তেলাওয়াত শোনা :
পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহ তা‘আলার এমন এক মু‘জেযা, যা শুনলেও মানুষের হৃদয় নরম হয়। অন্তরে এক অপর্থিব প্রশান্তি অনুভূত হ’তে পারে। এই কুরআন শুনেই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কাফেরদের অন্তর থাকে সর্বদা অশান্ত, হতাশাগ্রস্থ। কিন্তু তাদের অনেকের অন্তর এই কুরআন শুনে প্রশান্ত হয়েছে। যার ফলে তারা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমন ঘটনা রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ থেকে অদ্যাবধি চলমান। মক্কার কাফের মুশরিকরা লোকদের কুরআন শুনতে দিতো না। তারা লোকদেরকে কুরআন শুনতে নিষেধ করতো’ (ফুছছিলাত ৪১/২৬)। তারা মনে করতো, কুরআনে এমন মোহনীয় শক্তি আছে, যা শুনলে মানুষ মুহাম্মাদের (ছাঃ)-এর ধর্ম গ্রহণ করে ফেলবে। অথচ দেখা গেছে, ঐসব নেতারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর তাহাজ্জুদের ছালাতের তেলাওয়াত শুনত। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)। কিন্তু যখন তারা জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত।[21]
তুফায়েল ইবনু আমের আদ-দাওসী (রাঃ) বলেন, আমি যখন মক্কায় আসি, তখন কুরায়েশ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। তারা সবাই আমাকে সতর্ক করে বলে, ‘তুমি একজন কবি সম্রাট। আমাদের ভয় হয় যে, তুমি মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে, তার কথা শুনে তুমি যাদুগ্রস্ত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। কারণ তার কথা যাদুর মত। সুতরাং তার ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। তা না হ’লে, সে আমাদের গোত্রে যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে তা তোমাদের মাঝেও সৃষ্টি করবে। আল্লাহ্র কসম! তারা আমাকে এমনভাবে নিষেধ করতে লাগলো যে, তাদের এসব কথা শুনে আমি শপথ করলাম যে, আমি ঐ মসজিদে কান বন্ধ না রেখে প্রবেশই করবো না। পরের দিন আমি মসজিদে গেলাম। আমি আমার কানে কিছু কাপড় চেপে কান বন্ধ করে মসজিদে গেলাম। যাতে আমার কানে রাসূল (ছাঃ)-এর কথার কোন আওয়ায না আসে। মসজিদে ঢুকেই আমার দৃষ্টি পড়ল রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে। তিনি ছালাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মসজিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু মহান আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ যে, আমার কানে শুধু রাসূল (ছাঃ)-এর আওয়াজই ভেসে আসছিল। কান এতো বন্ধ রাখা সত্ত্বেও অন্য কোন আওয়ায আমার কানে না এসে, শুধু তাঁর আওয়াজটাই আসছে। আমি কুরআন শুনে মুগ্ধ হ’লাম, বিস্মিত হ’লাম। মনে মনে বললাম, ‘আল্লাহ্র কসম এটা কোন মানুষের বানানো কথা হ’তে পারে না।
আমি আমার কানের পট্টি খুলে ফেলে মনযোগ দিয়ে শুনতে থাকলাম। আমি এমন ব্যক্তি; যে ভালো মন্দের পার্থক্য করতে পারি। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করবো। যদি খারাপ কিছু হয় বর্জন করবো। আর ভালো কিছু হ’লে গ্রহণ করবো। তারপর আমি রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করতে করতে তাঁর বাড়িতে গেলাম। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে সবকিছু খুলে বললাম এবং বললাম, আপনি আপনার ধর্ম সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বললেন। তখনই আমি ইসলাম কবুল করলাম’।[22]
কুরআন তেলাওয়াত শোনার মাধ্যমেও অন্তর প্রভাবিত হয়। রাসূল (ছাঃ) নিজেও কুরআন তেলাওয়াত শুনতে ভালোবাসতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, তুমি আমাকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাও। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) আমি আপনাকে কুরআন শুনাবো, অথচ তা আপনার উপরে নাযিল হয়েছে’? তিনি বললেন, ‘আমি অন্যের কাছ থেকে কুরআন শুনতে বেশী পসন্দ করি’। তখন আমি সূরা নিসা তেলাওয়াত করতে লাগলাম। যখনই وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلاَءِ شَهِيدًا এই আয়াতে পৌঁছলাম, লক্ষ্য করলাম রাসূল (ছাঃ)-এর দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেছে।[23]
ইসমাঈল আস্ফাহানী বলেন, আরবে রাসূল (ছাঃ)-এর এমন অনেক শত্রু ছিল যারা তাঁকে হত্যা করার জন্য আশেপাশে ওঁত পেতে থাকতো, তখন কুরআন তেলাওয়াতের মিষ্টি ধ্বনি তারা শুনতে পেতো। ফলে কুরআন তাদের অন্তরে এমন অনুভূতি সৃষ্টি করতো যে, মুহূর্তেই তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ইসলাম কবুল করত। ফলে তাদের শত্রুতা-বন্ধুত্বে পরিণত হতো এবং কুফরী ঈমানের সাজে সুসজ্জিত হ’ত।[24]
ইতালির বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ৩৮ বছর বয়স্ক রোকসানা ইলিনা নেগ্রা ইসলাম গ্রহণের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছি। যতই পড়েছি, ততই আমি মুগ্ধ হয়েছি। এই মুগ্ধতা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী। আমি সব সময় প্রশান্তির জন্য, অসুস্থতা থেকে নিরাময়ের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা ও গবেষণা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ! আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ইসলামেই রয়েছে সবকিছুর সঠিক সমাধান’।[25] সুতরাং আলোচ্য বর্ণনাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, কুরআন শুনার মাধ্যমেও মানব হৃদয় অনাবিল প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে পারে।
৬. নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা :
কুরআনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভের অন্যতম উপায় হ’ল প্রতিদিন তেলাওয়াতের জন্য কিছু সময় বরাদ্দ রাখা। সর্বোপরি হৃদয়কে বেশী বেশী তেলাওয়াতের মাধ্যমে উজ্জীবিত রাখা। তেলাওয়াতের সময় যে আয়াতগুলোর মর্মার্থ গভীর, সে আয়াতগুলো বার বার তেলাওয়াত করলে, অন্তর আরো বেশী বিগলিত হয়। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম বলেন,كَانَتْ قِرَاءتُهُ (الفُضَيْلِ) حَزِيْنَةً، شَهِيَّةً، بَطِيئَةً، مُتَرسِّلَةً، كَأَنَّهُ يُخَاطِبُ إِنْسَاناً، وَكَانَ إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيْهَا ذِكْرُ الجَنَّةِ، يُرَدِّدُ فِيْهَا، ‘ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) দুঃখভরা কণ্ঠে, প্রবল অনুরাগ নিয়ে এবং ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। মনে হ’ত যেন তিনি কোন মানুষকে সম্বোধন করে কিছু বলছেন। যখন জান্নাতের আলোচেনা সম্বলিত কোন আয়াত তিনি অতিক্রম করতেন, তখন সেই আয়াত বার বার তেলাওয়াত করতেন’।[26] মালেক ইবনু দীনার (মৃ. ১৪০ হি.) বলেন,من لم يأنس بحديث الله عَن حديث المخلوقين فقد قل علمه وعمي قلبه وضيع عمره، ‘যে ব্যক্তি মানুষের সাথে কথা বলার পরিবর্তে আল্লাহ্র সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত হবে না, তার ইলম হ্রাস পাবে, হৃদয় অন্ধ হয়ে যাবে এবং সে তার হায়াতকে সংকুচিত করবে’।[27] সুতরাং অধিকাংশ সময় মানুষের গীবতে ব্যস্ত না থেকে, যে হৃদয় আল্লাহ্র যিকিরে ব্যস্ত থাকতে পারে, কেবল সে হৃদয়ই প্রশান্তির ছোঁয়া পেয়ে ধন্য হ’তে পারে। আফসোস! আমরা হরহামেশা অন্যের দোষ চর্চায় আমাদের দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করি, কিন্তু আল্লাহ্র কালাম পড়ার সময় পাই না। ফলে মানসিক প্রশান্তি আমাদের কাছে ধরা দিতে চায় না।
পরিশেষে বলা যায়, কুরআনের মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম জাতির মর্যাদাকে উচ্চকিত করেছেন। আর এই কুরআনের মাঝেই বান্দার জন্য যাবতীয় কল্যাণ নিহিত আছে। দুনিয়া যদি কারো উপর সংকীর্ণ হয়ে যায়, যদি সুখে থাকার দুনিয়াবী সকল রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, পাশের মানুষের বিশ^াস-ঘাতকতায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়, যদি কেউ তার একাকীত্ব ঘুচাতে চায়, যদি দুনিয়াবী নানা রকম দুশ্চিন্তা-হতাশার কালো মেঘে হৃদয় আচ্ছাদিত হয়, যদি সীরাতে মুস্তাক্বীমের অন্বেষী ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যায়, তাহ’লে এই সবকিছুর সমাধান হিসাবে সে যেন কুরআনকেই আপন করে নেয়। কুরআনকে যে যত বেশী আপন করে নেবে, কুরআন তাকে তত বেশী মানসিক প্রশান্তি এনে দিবে তার রবের পক্ষ থেকে ইনশাআল্লাহ। তাই আসুন! আমরা আমাদের জীবনকে অহি-র আলোয় আলোকিত করি। জীবনের হতাশা, দুশ্চিন্তা-পেরেশানি দূরীভুত করণে কুরআনকেই উপযুক্ত হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!
মুজাহিদুল ইসলাম
অনার্স (অধ্যয়নরত), ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তাফসীরে কুরতুবী ২০/৫৮।
[2]. মুহাম্মাদ সাইয়েদ ত্বানত্বাবী, আত-তাফসীরুল ওয়াসীত ১৫/৩৯৪।
[3]. তিরমিযী হা/ ১০৭১; মিশকাত হা/১৩০, সনদ হাসান।
[4]. ইমাম ইবনুল জাওযী, আত-তাবছিরাহ ১/৬৩।
[5]. ত্ববারনী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৮৯১০; ছহীহাহ হা/১৬৩৩, সনদ হাসান।
[6]. ইবনু রজব হাম্বলী, আয-যিল্লু ওয়াল ইন্কিসার পৃ. ২৯৮।
[7]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আল-মুতামান্নীন, পৃ. ৪৮।
[8]. আবূ তালেব মাক্কী, কূতুল কুলূব ফী মু‘আমালাতিল মাহবূব ২/৮৯।
[9]. ইবনুল মুলাক্কিন, আত-তাওযীহ লি শরহিল জামি‘ আছ-ছাগীর ২৪/১৭০; ইবনুল জাওযী, মানাক্বিবে ওমর ইবনিল খাত্তাব, পৃ. ১৬৭।
[10]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/৪৮০।
[11]. ইমাম ইবনু আবীদ দুনিয়া, কিতাবুল ইয়াক্বীন পৃ. ৫২।
[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/৩৭৪।
[13]. ফতাহুল বারী ৩/১৩।
[14]. তাফসীরে ছাআ’লাবী ৩/২৫১।
[15]. আওযাহুত তাফাসীর ১/২৫৪।
[16]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৩/১৭৩।
[17]. যাদুল মা‘আদ, ১/৩২৯।
[18]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা, ৫/৩৩৪।
[19]. পবিত্র কুরআনে তিনটি সূরায় মোট ছয়টি আয়াতে ‘সাকীনাহ’র কথা আলোকপাত করা হয়েছে। এই ছয়টি আয়াতকে সাকীনাহর আয়াত বলা হয়। সেগুলো হ’ল সূরা বাক্বারাহ ২/২৪৮; সূরা তাওবাহ ৯/২৬, ৪০; সূরা ফাৎহ ৪৮/৪, ১৮, ২৬।
[20]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ২/৪৭১।
[21]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃষ্ঠা: ১৩৭।
[22]. ইমাম শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১/৩৪৫।
[23]. ছহীহুল বুখারী হা/৪৫৮২, মুসলিম হা/৮০০।
[24]. ইসমাঈল আস্ফাহানী, আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ ১/৩৯১।
[25]. দৈনিক ইনকিলাব, ১৬ জানুয়ারী ২০১৭।
[26]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৮/৪২৮।
[27]. আবূ হাতেম বুস্তী, রওযাতুল ‘উক্বালা, পৃ. ৮৫।