ইসলাম আত্মার কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ
না করতে উৎসাহিত করেছে। নাফসকে ইলাহী ফরমানের দিকে নিবিষ্ট করার লক্ষ্যে
নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বলা হয় ‘জিহাদুন নাফস’ বা অন্তরের সংগ্রাম।
মূলতঃ এ জিহাদই হ’ল সর্বোত্তম জিহাদ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَفْضَلُ
الْجِهَادِ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِيْ ذَاتِ الله عَزَّ وَ جَلَّ
‘সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ হ’ল যে আল্লাহর জন্য স্বীয় কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে
জিহাদ করে’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,
أَفْضَلُ الْجِهَادِ أَنْ يُجَاهِدَ الرَّجُلُ نَفْسَهُ وَهَوَاهُ ‘কোন
ব্যক্তির স্বীয় নাফস ও কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করাই হ’ল সর্বোত্তম
জিহাদ’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইরশাদ
করেন,أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِالْمُؤْمِنِ؟ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى
أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَالْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ النَّاسُ مِنْ
لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي طَاعَةِ
اللهِ وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ الْخَطَايَا وَالذُّنُوبَ ‘আমি কি প্রকৃত
মুমিন সম্পর্কে তোমাদেরকে সংবাদ দিব না? যার অনিষ্ট থেকে মানুষের জান-মাল
নিরাপদে থাকে। প্রকৃত মুসলিম ঐ ব্যক্তি, যে ব্যক্তির জিহবা ও হাতের অনিষ্ট
থেকে অন্য মানুষ নিরাপত্তা লাভ করে। আর প্রকৃত মুজাহিদ হ’ল সে ব্যক্তি, যে
আল্লাহর আনুগত্যের জন্য স্বীয় প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে। আর প্রকৃত
মুহাজির হ’ল সে ব্যক্তি, যে যাবতীয় পাপ থেকে বিরত থাকে’।[3]
রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ لِلَّهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে স্বীয় নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, সেই প্রকৃত মুজাহিদ’।[4] আলোচ্য নিবন্ধে আমরা নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা পেশ করব ইনশাআল্লাহ।-
নাফস বা আত্মার প্রকারভেদ :
১. ‘নাফসে আম্মারাহ’ বা খারাপ কাজের নির্দেশ দানকারী আত্মা। নাফসে আম্মারার স্বভাবগত চাহিদা এটাই যে, মন্দ কামনা, শয়তানের অনুসরণ, কু-প্রবৃত্তির বাসনা চরিতার্থ করা, যাতে করে হারাম কাজ করা তার জন্য সহজতর হয়। আল্লাহ বলেন, وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ ‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না, নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ, কিন্তু সে নয়, যার প্রতি আমার পালনকর্তা অনুগ্রহ করেন; নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (ইউসুফ ১৬/৫৩)।
২. ‘নাফসে লাওওয়ামাহ’ বা ধিক্কার দানকারী আত্মা। এ প্রকারের আত্মায়ও মন্দ, শয়তানী কুমন্ত্রণা, কুপ্রবৃত্তির বাসনা ইত্যাদি জিনিসের উদয় হয়; তবে পরক্ষণেই এই নাফসের অধিকারী ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য নিজেকে অধিক ধিক্কার দেয়, তিরস্কার করে, অনুশোচনা প্রকাশ করে, অনুতপ্ত হয় ও লজ্জাবোধ করে। কেননা তাতে সামান্যতম হ’লেও ঈমানের জ্যোতি বিদ্যমান। আল্লাহ বলেন,لَا أُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ- ‘আমি শপথ করি ক্বিয়ামত দিবসের, আরও শপথ করি সেই আত্মার, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১-২)।
৩. নাফসে মুত্বমাইন্নাহ বা প্রশান্ত আত্মা। এই প্রকারের আত্মা আল্লাহর আনুগত্য ও যিকর দ্বারা মনে প্রশান্তি অনুভব করে। সকল প্রকার আনুগত্যের কর্মকান্ড সম্পাদন করে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ লাভ করে এবং সমস্ত অন্যায় ও সীমালংঘন থেকে সে পরিপূর্ণ রূপে মুক্ত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ، ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً، فَادْخُلِي فِي عِبَادِي، وَادْخُلِي جَنَّتِي- ‘হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি প্রশান্তচিত্তে তোমার পালনকর্তার দিকে ফিরে চলো। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (ফজর ৮৯/২৭-৩০)।
আল্লাহ বলেন, وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا، فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا، قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا، وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا- ‘শপথ প্রাণের এবং তাঁর, যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে, সে অবশ্যই সফলকাম হবে। আর যে নিজেকে কলুষিত করবে, সে নিশ্চয়ই ব্যর্থ-মনোরথ হবে’। (শামস ৯১/৭-১০)।
সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি তার আত্মার পরিশোধনে এবং আল্লাহর আনুগত্যে নিবিষ্ট হ’তে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।
নফস-এর বিরুদ্ধে জিহাদ :
নাফস বেশিরভাগ সময়েই খারাপ কর্মে নির্দেশনা দেয়। তবে নাফসের বিরোধিতা করে তাকে ছিরাতে মুস্তাক্বীমে পরিচালনার জন্যই আমাদেরকে ‘জিহাদুন নাফস’ চালিয়ে যেতে হবে। বিতাড়িত শয়তানের কুমন্ত্রণার ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া অনেক কঠিন। তথাপি নিয়মিতভাবে শয়তানের বিরুদ্ধাচরণ ও আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে এই জিহাদী মিশনে সফলতা লাভ করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
নাফসে আম্মারার উপর বিজয়ের মূল হাতিয়ার :
ইলমে দ্বীন হাছিলের মাধ্যমে অন্তর্নিহিত অজ্ঞতাকে ভূলুণ্ঠিত করে আমরা নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। কেননা অজ্ঞতাই অন্যায় কর্ম প্রশ্রয় দেয়ার ও তা সম্পাদন করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আর ‘ইলমে নাফে’ বা ধর্মীয় জ্ঞানই হ’ল মূল হাতিয়ার, যা খারাপ নির্দেশক নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। আর এই জ্ঞানের মেŠলিক উৎস হ’ল কুরআন মাজীদ ও ছহীহ হাদীছ সমূহ।
কিভাবে নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করব? :
নাফসের বিরুদ্ধে সদা সংগ্রাম অব্যাহত রাখা অতীব যরূরী। কিন্তু এই জিহাদ করার পথ ও পন্থা কি তা জানতে হবে। এক্ষণে আমরা নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদের কতিপয় পন্থা আলোচনা করব, যা আমাদেরকে কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিজয়ী হ’তে সাহায্য করবে।
১. ইলমে দ্বীন হাছিল করা :
ইলমে দ্বীন হাছিলের মাধ্যমে আমরা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রাসূলের নিকট অবতীর্ণ অহী-র সূচনা হয়েছিল ‘পড়’ নির্দেশের মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘পড়! তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ.
‘প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে কিছু লোক গভীরভাবে দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে বের হয়ে পড়ে না কেন? আর তারা সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে ফিরে এসে তাদেরকে সতর্ক করবে, যাতে তারা মুক্তি লাভ করতে পারে’ (তওবা ৯/১২২)।
আর এই ইলমে দ্বীনের প্রধান উৎস হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। আল্লাহ তা‘আলা আত্মার সৃষ্টিকর্তা, তিনি অবশ্যই অন্তরের বিষয়ে খবরাখবর রাখেন। আল্লাহ বলেন,
وَإِن تُبْدُواْ مَا فِي أَنفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اللهُ فَيَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
‘যদি তোমরা তোমাদের মনের কথা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ তোমাদের থেকে তার হিসাব নিবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)।
তিনি আল্লাহ বলেন, أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ ‘তিনি কি করে জানবেন না, যিনি সৃষ্টি করেছেন? তিনি সূক্ষ্মজ্ঞানী, সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত’ (মুলক ৬৭/১৪)।
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,قُلْ أَنزَلَهُ الَّذِي يَعْلَمُ السِّرَّ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ غَفُوراً رَّحِيماً ‘বলুন, একে (কুরআন) তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপন রহস্য সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (ফুরক্বান ২৫/৬)।
আল্লাহ বলেন, وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ ‘আর এ কথা জেনে রাখ যে, তোমাদের মনে যা রয়েছে, তা আল্লাহ জানেন। সুতরাং তাঁকেই ভয় কর। আর জেনে রাখ যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহিষ্ণু’ (বাক্বারা ২/২৩৫)। সুতরাং নাফসের স্রষ্টা অবশ্যই নাফস সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত, যিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ই জানেন। ভাল আত্মা ও খারাপ আত্মা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত। এজন্য তাঁরই প্রেরিত মহাগ্রন্থ কুরআন মাজীদ মানবাত্মার অন্যতম গাইড বুক হিসাবে বিবেচিত। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْراً ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) মধ্যে রয়েছে উত্তম নমুনা’ (আহযাব ৩৩/২১)।
আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক, আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর’ (হাশর ৫৯/৭)। কিতাবুল্লাহর অনুসরণ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুকরণের মাধ্যমে যখন আমরা ইলমে দ্বীন অর্জনে সচেষ্ট হব, তখন এতদুভয়ের সমন্বয়ে ইসলামের যাবতীয় বিধি-নিষেধ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী হয়ে দাওয়াত ও তাবলীগে আত্মনিয়োগ করতে পারব। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ ‘এটা এমন একটা কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই, আল্লাহভীরুদের জন্য এটি পথ প্রদর্শক’ (বাক্বারাহ ২/২)। আল্লাহ বলেন, إِنَّ هَـذَا الْقُرْآنَ يِهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ ‘এই কুরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল-সঠিক’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৯)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَا مِنَ الأَنْبِيَاءِ نَبِيٌّ إِلَّا أُعْطِيَ مَا مِثْلُهُ آمَنَ عَلَيْهِ الْبَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِي أُوتِيْتُ وَحْيًا أَوْحَاهُ اللهُ إِلَيَّ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَكْثَرَهُمْ تَابِعًا يَوْمَ القِيَامَةِ.
‘পূর্ববর্তী নবীদের যা দেয়া হয়েছিল, তাতে লোকেরা পূর্ণ
ঈমান আনয়ন করেনি; আর আমাকে যা প্রদান করা হয়েছে তা হ’ল অহী, যা আমার প্রতি
আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি যে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের
চেয়ে আমার বেশী অনুসরণকারী হবে’।[5]
২. আমলে ছালেহ :
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করে তাকে চলাফেরা ও আমলের ক্ষমতা দিয়েছেন। যাতে সে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে পৃথিবী আবাদ করার জন্য সেখানে বিচরণ করে। মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথে আহবান করেছেন। তাকে আমলে ছালেহের মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন তার সাক্ষাৎ লাভের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحاً فَمُلَاقِيهِ ‘হে মানুষ তোমাকে তোমার রবের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত কষ্ট স্বীকার করতে হবে। অতঃপর তাঁর সাক্ষাৎ পাবে’ (ইনশিক্বাক ৮৪/৬)। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘তোমাকে তোমার রবের সাক্ষাৎ পেতে অত্যন্ত সাধনার মাধ্যমে আমলে ছালেহ সম্পাদন করতে হবে। অতঃপর নেক কাজ করলে নেককার হিসাবে তাঁর সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে। আর বদ কাজ করলে বদকার হিসাবে তাঁর সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে’।[6] সুতরাং নিজেকে আমলে ছালেহ এর উপরে দৃঢ় রাখার মাধ্যমে নফসের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে।
৩. আল্লাহর দিকে আহবান করা :
তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে আল্লাহর দিকে আহবানের মাধ্যমে জিহাদে নিমগ্ন হওয়া। অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করা প্রত্যেকের ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ‘যখন তারা স্বজাতির কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, তখন যেন তাদেরকে সতর্ক করে, তাহ’লে তারা বাঁচতে পারবে’ (তওবা ৯/১২২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হ’লেও পৌঁছে দাও’।[7]
৪. ধৈর্যধারণ করা :
ধৈর্য একটি মহৎ গুণ। ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় আসে। ধৈর্যধারণ করাটাও নাফসের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হলে বিপদাপদে ধৈর্যশীল হ’তে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে ইলম হাছিলের ক্ষেত্রে, আমলে ছালেহ সম্পাদনের ক্ষেত্রে এবং দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে। তায়েফের জনগণকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরই কল্যাণের জন্য আহবান করেছিলেন। অথচ তিনি মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসলেন; কিন্তু ধৈর্যহারা হলেন না। বাতিলপন্থীরা অন্যায়ের উপর ধৈর্যধারণ করতে পারলে, হকপন্থীদের আরো বেশী ধৈর্যধারণ করা উচিত। অতএব জিহাদের ময়দানে টিকে থাকতে হ’লে অবশ্যই ধৈর্যের সাথে ইলম, আমল, দাওয়াত ও তাবলীগে নিবিষ্টচিত্তে মনোনিবেশ করতে হবে। অন্যথায় প্রকাশ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারে শামিল হ’তে হবে। আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِينَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ وَأَهْلِيهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَلَا ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِيْنُ ‘বলুন, ক্বিয়ামত দিবসে তারাই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা নিজেদের ও পরিবারবর্গের ক্ষতিসাধন করে। জেনে রেখ, এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি’ (যুমার ৩৯/১৫)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন, كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَايِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا
أَوْ مُوبِقُهَا ‘প্রত্যেক মানুষ সকালে উপনীত হয়ে তার আত্মাকে বিক্রয় করে।
এতে হয়তবা সে নিজেকে মুক্ত করে অথবা তাকে ধ্বংস করে’।[8]
ইমাম
নববী (রহঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর এ কথার ব্যাখ্যা হ’ল, প্রত্যেক মানুষ
বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পাদন করে। তাদের কেউ স্রেফ আল্লাহর আনুগত্যেই নিজের
জীবনকে উৎসর্গ করে। ফলে আল্লাহ তাকে আযাব থেকে মুক্ত করেন। আর কোন মানুষ
শয়তানের অনুসরণ করে, তার খেয়াল-খুশিমত জীবন পরিচালনা করে। ফলে সে শয়তানের
সাঙ্গ-পাঙ্গদের সঙ্গী হয়ে ধ্বংসে নিপতিত হয় এবং নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে’।[9]
আল্লাহ বলেন, وَالْعَصْرِ، إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ، إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ- ‘কালের কসম, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সত্যের এবং উপদেশ দেয় ধৈর্যের’ (আছর ১০৩/১-৩)।
ছবর তিন প্রকার- (১) বিপদে ছবর করা (২) পাপ থেকে ছবর করা অর্থাৎ বিরত থাকা (৩) আল্লাহর আনুগত্যে ছবর করা অর্থাৎ দৃঢ় থাকা। প্রথমটি ‘আম’ বা সাধারণ। দ্বিতীয়টি ‘হাসান’ বা সুন্দর এবং তৃতীয়টি ‘আহসান’ বা সবচেয়ে সুন্দর।[10] অতএব নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে যেকোন খারাপ ও পাপকর্ম হতে বিরত থেকে হক্বের উপরে নিজেকে দৃঢ় রাখার মাধ্যমে ধৈর্যধারণ করা।
জিহাদুন নাফস-এর ফলাফল :
নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের চূড়ান্ত ফলাফল হ’ল আললাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাত লাভ। আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নফসকে নিবৃত্ত রাখে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত’ (নাযি‘আত ৭৯/৪০-৪১)। তাছাড়াও নিম্নোক্ত ফলাফল লক্ষণীয়।
আত্মার অবদমন :
আত্মাকে
ভাল কাজ সমূহের মধ্যে নিবদ্ধ রাখাই হ’ল আত্মাকে মন্দ চাহিদা থেকে নিবৃত্ত
রাখার বড় হাতিয়ার। কেননা মানুষের আত্মা প্রবৃত্তির চাহিদায় এতই উদগ্রীব যে,
স্বর্ণের দু’টি পর্বত যদি তাকে দেয়া হয়, তবুও সে তৃতীয় আরেকটির জন্য
প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। সুতরাং মানুষের উচিত হ’ল তার কামনা-বাসনার আধিক্যের
লাগাম টেনে ধরে আত্মাকে অবদমন করা। এর ফলশ্রুতিতে আত্মাকে উৎকৃষ্টতর
গুণাবলীর প্রতি অভ্যস্ত করানো অনেকটাই সহজ হবে। আলী (রাঃ) বলতেন, ‘আত্মার
অবদমনের মাধ্যমেই জিহাদের ফলাফল অর্জিত হয়’।[11]
নেক ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা লাভ :
অন্যায়ের
বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে নেক ইচ্ছাশক্তি দৃঢ়তা লাভ করে। হযরত আলী (রাঃ)
থেকে বর্ণিত, مَنْ بَذَلَ جُهْدَ طَاقَتِهِ بَلَغَ كُنفَ اِرَادَتِهِ ‘যে
ব্যক্তি তার প্রচেষ্টার সামর্থ্যকে কাজে লাগায়, সে তার ইচ্ছাশক্তির
আশ্রয়স্থলে পৌছে যায়’।[12]
বুদ্ধি-কৌশলের পরিপক্কতা লাভ :
আত্মিক জিহাদের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তির পূর্ণতা হাছিল হয়। যখনই মানুষ আত্মিক জিহাদে প্রবৃত্ত হয় তখন তার মানবীয় বুদ্ধি-কৌশলের পরিপক্কতা হাছিল হয়। কেননা কু-প্রবৃত্তির
অনুসরণ মানুষের সুস্থ চিন্তাধারা হ্রাস করে
ফেলে। আলী (রাঃ) বলেন, ‘তুমি তোমার প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ কর, ক্রোধ
দমন কর, বদ অভ্যাস দূর কর, তাতে তোমার আত্মার উন্নয়ন ঘটবে, জ্ঞান বৃদ্ধি
পাবে এবং তোমার রবের পূর্ণ ছওয়াব অর্জন হবে’।[13]
কৃপানিধান রবের কৃপা অর্জন :
ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার ফলে নাফসে লাওওয়ামা থেকে কারো নাফস যখন নাফসে মুত্বমাইন্নায় উন্নীত হবে, তখন তার আত্মা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পাদিত যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করবে, রূহানী সজীবতায় তার মন সন্তুষ্ট থাকবে। ফলে কৃপানিধান রবের কৃপা অর্জনে সে সক্ষম হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্ম, তুমি সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে তোমার রবের দিকে ফিরে চলো। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (ফাজর ৮৯/২৭-৩০)।
পরিশেষে বলা যায় যে, নাফসের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা বড় ধরনের একটা সংগ্রাম। প্রতিটি মুসলমানকেই সর্বদা এই জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। যাতে করে পরকালে সফলতা অর্জন করা যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণভাবে নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
ইহ্সান ইলাহী যহীর
অনার্স (২য় বর্ষ), আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তিরমিযী; ত্বাবারানী, সিলসিলা ছহীহা হা/১৪৯১।
[2]. ছহীহুল জামে‘ হা/১০৯৯।
[3]. আহমাদ, সিলসিলা ছহীহা হা/৫৪৯।
[4]. আহমাদ হা/২২৮২৬; ইবনু হিববান হা/৪৬২৪।
[5]. বুখারী হা/৪৯৮১; মুসলিম ১/১৩৪; মিশকাত হা/৫৭৪৬।
[6]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৪/৪৮৮।
[7]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮।
[8]. মুসলিম হা/১/২০৩।
[9]. শারহু ছহীহ মুসলিম ৩/১০২।
[10]. তাফসীরুল কুরআন (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ মে ২০১৩), পৃঃ ৪৭০।
[11]. গুরারুল হিকাম হা/৪৬৫৫।
[12]. ঐ, হা/২৭৮৮।
[13]. ঐ, হা/৪৭৬০।