ভূমিকা :
আল্লাহ মানব জাতিকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তিনি বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ ‘আমি মানুষ ও
জিনকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)।
তিনি মানুষকে দিয়েছেন স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মশক্তি। মানুষ ইচ্ছা করলে আল্লাহর বিধান মানতে পারে, আবার নাফরমানিও করতে পারে। শয়তানের প্ররোচনায় সে সৎপথ থেকে বিচ্যুত হ’তে পারে। তাই মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে এ ধরণীতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوْا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ ‘আমরা প্রত্যেক কওমের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এজন্য যে, তারা যেন বলে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূতকে বর্জন কর’ (নাহল ১৬/৩৬)। কিন্তু মানুষ যখন নবী-রাসূলগণের দেখানো পথ বাদ দিয়ে নিজেদের মত অনুসারে চলতে চায়, তখনই তারা অধঃপতনের অতল তলে নিমজ্জিত হয়। উম্মতে মুহাম্মাদীও তদ্রূপ রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে তারা আজ সর্বত্র নির্যাতিত, নিপীড়িত হচ্ছে। মুসলমানদের এ অবস্থার কতিপয় কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. সৎচরিত্রের অভাব : বর্তমান
বিশ্বে যে জিনিসের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সেটি হ’ল সৎচরিত্র। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ أَخْيَرِكُمْ أَحْسَنَكُمْ خُلُقًا ‘তোমাদের মধ্যে ঐ
ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার স্বভাব-চরিত্র সুন্দর’।[1]
তিনি
আরো বলেন, إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَىَّ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আমার কাছে অধিক প্রিয়, যার চরিত্র উত্তম’।[2]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ يُدْرِكُ بِحُسْنِ
خُلُقِهِ دَرَجَةَ قَائِمِ اللَّيْلِ وَصَائِمِ النَّهَارِ ‘ঈমানদার তার
উত্তম চরিত্রের দ্বারা রাত্রি জাগরণকারী ও দিনের বেলায় ছিয়াম পালনকারীর
মর্যাদা লাভ করবে’।[3]
উত্তম চরিত্র ইহকাল ও
পরকালে সফলতা লাভের মাধ্যম। চরিত্রবান লোকের ইহকাল ও পরকাল হয় সুখময়।
পক্ষান্তরে চরিত্রহীন লোকের দুনিয়া ও আখিরাতে কেবল ধ্বংস। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, مَا شَىْءٌ أَثْقَلُ فِى مِيزَانِ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ مِنْ خُلُقٍ حَسَنٍ وَإِنَّ اللهَ لَيَبْغَضُ الْفَاحِشَ
الْبَذِىءَ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের মীযানের পাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে
জিনিস রাখা হবে, তা হ’ল উত্তম চরিত্র। আর আল্লাহ তা‘আলা কর্কশভাষী
দুশ্চরিত্রকে ঘৃণা করেন’।[4]
২. কথা-কাজের অমিল : মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হ’ল কথা ও কাজে মিল থাকা। কথা-কর্মে মিল না থাকলে সে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। কেউ তাকে বিশ্বাস করে না এবং মূল্য দেয় না। যার কথা ও কাজের মিল নেই সে সবার কাছে ঘৃণিত ব্যক্তি।
কথা ও কাজের অমিলকে আল্লাহ তা‘আলা খুবই অপসন্দ করেন। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ، كَبُرَ مَقْتاً عِندَ اللهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না তা কেন বল? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক’ (ছফ ৬১/২-৩)।
ওসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
يُجَاءُ بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِى النَّارِ، فَتَنْدَلِقُ أَقْتَابُهُ فِى النَّارِ، فَيَطْحَنُ فِيْهَا كَطَحْنِ الْحِمَارِ بِرَحَاهُ، فَيَجْتَمِعُ أَهْلُ النَّارِ عَلَيْهِ، فَيَقُولُونَ أَىْ فُلاَنُ، مَا شَأْنُكَ أَلَيْسَ كُنْتَ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ قَالَ كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوْفِ وَلاَ آتِيهِ، وَأَنْهَاكُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ-
‘এক ব্যক্তিকে
ক্বিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে
করে তার নাড়িভুঁড়ি দ্রুত বের হয়ে যাবে। অতঃপর সে সেখানে ঘুরতে থাকবে,
যেমনভাবে গাধা (আটা পেষা) জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার নিকট
একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, হে অমুক ব্যক্তি! তোমার কি অবস্থা? তুমি কি
আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ হ’তে নিষেধ করতে না? সে বলবে, হ্যাঁ
আমি তোমাদেরকে ভাল কাজ করতে আদেশ করতাম, কিন্তু নিজেই তা করতাম না। আর
খারাপ কাজ হ’তে নিষেধ করতাম, কিন্তু আমি নিজেই তা করতাম’।[5]
৩. ধৈর্যহীনতা : মুসলিমের জন্য আবশ্যক হল ধৈর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। রাসূল (ছাঃ) অসীম ধৈর্যের অধিকারী ছিলেন। বিপদ-মুছীবত, দুঃখ-কষ্ট, অত্যাচার, ক্ষুধা, দারিদ্র্য অভাব সহ সবকিছু তিনি অকাতরে সহ্য করতেন। বিপদ-মুছীবতে ধৈর্য ধারণ করাই প্রকৃত ধৈর্য। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।
কিন্তু বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে, কেউ ধৈর্যের পরিচয় দিলে মানুষ তাকে কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করে। আর সে যত অধৈর্য তাকে বলা হয় সাহসী। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اسْتَعِينُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ، وَلاَ تَقُوْلُوْا لِمَنْ يُقْتَلُ فِيْ سَبيْلِ اللهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُوْنَ، وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفْ وَالْجُوْعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِيْنَ، الَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيْبَةٌ قَالُوْا إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বল না; বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা বুঝ না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ছবরকারীদেরকে। যখন তারা বিপদে পতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার দিকেই আমরা প্রত্যাবর্তনকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩-১৫৬)।
৪. বড়দের প্রতি সম্মান ও ছোটদের স্নেহ না করা : মুসলমানের কর্তব্য হ’ল বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা। কিন্তু আমরা সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে, অনেক যুবক ছেলে বড়দের সম্মান করা তো দূরের কথা তাদের প্রতি কোন সৌজন্যমূলক আচরণও করে না। ছোটদের তো তারা মানুষই মনে করে না। ইসলামের নির্দেশ হ’ল বড়দের যথাযথ সম্মান করা ও ছোটদের স্নেহ করা।
বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের অধিকার সম্পর্কে জানে না (সম্মান করে না) সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[6] সুতরাং যে আচরণ প্রদর্শন করলে উম্মতে মুহাম্মাদির অন্তর্ভুক্ত থাকা যায় না তা আবশ্যিকভাবে ত্যাগ করা সকল মুসলিমের কর্তব্য।
৫. দ্বীন থেকে সরে যাওয়া ও বিদ‘আতে নিপতিত হওয়া : বর্তমানে মানুষ বিজাতীয় সংস্কৃতি ও রসম-রেওয়াজের অনুসরণে দ্বীন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কেউবা শরী‘আত, তরীকত, মা‘রেফাত, হাকীকত ইত্যাদির কবলে পড়ে প্রকৃত দ্বীন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কেউবা ছূফী আক্বীদায় বিশ্বাসী হয়ে ঈমানহারা হয়ে পড়ছে। আবার যারা ঈমান বজায় রাখছে তারা বিভিন্ন মাযহাবী তাক্বলীদ ও বিদ‘আতী কাজ করে আমল বিনষ্ট করছে। অথচ এসবকেই তারা ভালকাজ ও দ্বীনী কাজ মনে করে আজীবন পালন করে যাচ্ছে। যেমন- ফরয ছালাতের পর দলবদ্ধভাবে মুনাজাত, শবেবরাত, শবে মি‘রাজ, ঈদে মীলাদুন্নবী, মীলাদ মাহফিল, ছালাতের আগে আরবীতে নিয়ত, সশব্দে দলবদ্ধভাবে যিকর করা, জুম‘আর দিন খুৎবার আগে বসে থেকে বাংলায় বয়ান, জুম‘আর দিন দ্বিতীয় আযান, ফাতেহা-ই ইয়াজদহম, কুলখানী, চল্লিশা, চেহলাম, ওরস ইত্যাদি অসংখ্য কর্ম তাদেরকে দ্বীনে হক থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এসব অবশ্যই বর্জনীয়।
বিদ‘আতীর পরিণাম ভয়াবহ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى
النَّارِ ‘প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম
জাহান্নাম’।[7] বিদ‘আতী মনে করে যে, সে সৎ আমল করছে। অথচ তা কবুল হবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً،
الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ
أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعاً- ‘তুমি বলে দাও আমরা কি তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত
আমলকারীদের সংবাদ দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়েছে অথচ
তারা ভাবে যে তারা সুন্দর আমল করে যাচ্ছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ
فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করে
যা এর মধ্যে নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[8]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিদ‘আত নিকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত, যার স্থান ইসলামে নেই।
৬. গোঁড়ামি :
মানুষ নিজের বুঝের উপরে অটল থাকতে চায়। সে যা ভাল মনে করে তাই করে। তার এই
গোঁড়ামি তাকে হক গ্রহণে বাধাগ্রস্ত করে। আমাদের প্রিয়নবী (ছাঃ) কোন বিষয়ে
গোঁড়ামি তথা বাড়াবাড়ি পসন্দ করতেন না। তিনি বলেন, هَلَكَ
الْمُتَنَطِّعُوْنَ ‘অতিরঞ্জনকারীরা ধ্বংস হয়েছে’।[9] এমনকি মহানবী (ছাঃ)
তাঁর নিজের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, لاَ
تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا
عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি
কর না, যেমন খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়ামকে নিয়ে করেছে। আমিতো আল্লাহর দাস
মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর দাস ও তাঁর রাসূলই বল’।[10]
মহানবী
মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন, صِنْفَانِ مِنْ أُمَّتِيْ لَنْ تَنَالَهُمَا
شَفَاعَتِيْ: إِمَامٌ ظَلُوْمٌ غَشُوْمٌ وَكُلُّ غَالٍ مَارِقٌ ‘আমার উম্মতের দুই শ্রেণীর লোক আমার সুফারিশ লাভ করতে পারবে না। অত্যাচারী রাষ্ট্রনেতা এবং প্রত্যেক বিপদগামী অতিরঞ্জনকারী’।[11] গোঁড়া ব্যক্তি কখনো পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلْإِيْمَانُ: الَصَّبْرُ وَالسَّمَاحَةُ ‘ঈমান হ’ল সহিষ্ণুতা ও উদারতার নামান্তর’।[12]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, গোঁড়ামি ঈমান-আমল ও দ্বীনের জন্য অনেক ক্ষতিকর। তাই সকলের উচিত গোঁড়ামি ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা।
৭. জিহাদের প্রকৃত অর্থ না বুঝা : জিহাদ হ’ল অন্যান্য ফরযের মতো একটি ফরয। গাড়ি ভাঙ্গচুর ও অগ্নিসংযোগ করা, জায়গা-অজায়গায় ককটেল ফাটানো এবং পেট্রোল বোমা মেরে গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করার নাম জিহাদ নয়। বরং ইসলামী রাষ্ট্রকে যালেমদের হাত থেকে রক্ষা করা জিহাদ, আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো জিহাদ। জিহাদ হবে দেশের প্রধানের অধীনে। আর জিহাদ ময়দানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বেসামরিক লোক হত্যা, ফসল নষ্ট করা, উপাসনালয় নষ্ট করা, জনগণের সহায় সম্পদ ধ্বংস করার নাম জিহাদ নয়।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উম্মতের উপরে আক্রমণ করে, আমার উম্মতের ভালমন্দ সকলকেই নির্বিচারে হত্যা করে। মুমিনকেও রেহাই দেয় না এবং যার সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ তার অঙ্গীকার রক্ষা করে না, সে আমার কেউ নয়, আমিও তার কেউ নই’।[13] অর্থাৎ সে আমার দলভুক্ত নয় এবং আমিও তার দলভুক্ত নই। একটি কথা এখানে উল্লেখ্য যে, রাজনীতি দিয়ে ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করা হিকমতের কাজ নয়; আম্বিয়াগণের তরীকাও তা নয়।
৮. অপসংস্কৃতির অনুসরণ :
আজকাল রাস্তায় এমন আকৃতি-প্রকৃতির কিছু মানুষ দেখা যায় যারা ছেলে না মেয়ে
বুঝা কঠিন। ছেলেরা টাখনুর নীচে কাপড় পরে। কানে দুল, হাতে চুড়ি, গলায় চেন
দিয়ে ঘাড় পর্যন্ত চুল রেখে চলে। এখন ছেলেরা হাতে বালা পরে মেয়ে সাজতে চায়।
অপরদিকে মহিলারা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট/সালোয়ার পরে। শালীন জামা-কাপড় পরা
বাদ দিয়ে পরে শার্ট, গেঞ্জি, টি-শার্ট ইত্যাদি। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেন,ثَلاَثَةٌ لاَ يَنْظُرُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِمْ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ وَالْمَرْأَةُ الْمُتَرَجِّلَةُ
وَالدَّيُّوثُ ‘তিন ব্যক্তির দিকে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন (রহমতের
দৃষ্টিতে) তাকাবেন না। ১. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ২. পুরুষের বেশ
ধারণকারিণী মহিলা এবং ৩. নিজ বাড়ীতে অশ্লীলতার সুযোগ দানকারী পুরুষ’।[14]
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) মেয়েদের সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
তিনি বলেন, كُلُّ عَيْنٍ زَانِيَةٌ وَالْمَرْأَةُ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ
فَمَرَّتْ بِالْمَجْلِسِ فَهِىَ زَانِيَةً. ‘প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচার করে
থাকে। আর মহিলা যদি সুগন্ধ ব্যবহার করে কোন (পুরুষদের) মজলিসের পাশ দিয়ে
অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিনী’।[15]
চুলের ভ্যারাইটি ছেলেমেয়ে সবার ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এখন ছেলেরা চুল রাখে নারিন কাটিং, স্পাইক, রোনাল্ডো কাটিং, পার্নেল কাটিং, সিনা কাটিং, বাটি কাটিং, ডন কাটিং, তেরে নাম কাটিং, লিওনেল কাটিং, দিলওয়ালে কাটিং ইত্যাদি। কারো চুল পিছনে আধ হাত পরিমাণ লম্বা আবার কারো সামনে লম্বা। এসবই বর্জনীয়।
এবার
আসি দাড়ি প্রসঙ্গে। একজন পুরুষকে চেনার আলামত হ’ল দাড়ি। দাড়ি কাট-ছাট না
করে ছেড়ে দেয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত। কিন্তু একেকজনের দাড়ি একেক
স্টাইলের। যেমন- খামচি কাটিং, চুটকি কাটিং, রুমি কাটিং, ডন কাটিং, কাপুর
কাট, ফ্রেঞ্চ কাট, চখরা-বখরা কাট ইত্যাদি। কারো আবার ইসলামের বিপরীত
ভ্যারাইটি মোচ। রাখোড়, ধাওয়ান, দাবাং ইত্যাদি স্টাইলের মোচ এখন সবার পসন্দ।
কিন্তু নবী করীম (ছাঃ) বলেন, جُزُّوا الشَّوَارِبَ وَأَرْخُوا اللُّحَى
خَالِفُوا الْمَجُوْسَ ‘গোফ ছেটে দাড়ি লম্বা করে অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা
কর’।[16]
বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ করে
মুসলমানরা দিন দিন ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। স্কুল-কলেজ এমনকি অনেক
মাদরাসার শিক্ষকদের জন্যও দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো হচ্ছে, যা বিজাতীয় আচরণ।
কোন মুসলিমের জন্য এটি বৈধ নয়।[17]
বিজাতিদের অনুকরণে পোষাক পরা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ)-কে হলুদ রঙের দু’টি কাপড় পরে থাকতে দেখে বললেন, إِنَّ هَذِهِ مِنْ ثِيَابِ الْكُفَّارِ فَلاَ تَلْبَسْهَا ‘এ ধরনের কাপড় কাফেরদের, তুমি তা পরিধান করো না’।[18] অন্যদের অনুকরণ সম্পর্কে মহানবী (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে অন্যের অনুকরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[19] কোন মুসলিমের উচিত নয় কোন বেদ্বীন কাফের-মুশরিকের অনুসরণ করা। কেননা যে ব্যক্তি যে দলের সাথে সাদৃশ্য রাখবে ক্বিয়ামতের দিন সে তাদের দলভুক্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’।[20] তাই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হ’ল সে রাসূল (ছাঃ)-এর পথ অনুসরণ করবে ও পবিত্র কুরআন-ছহীহ হাদীছ মেনে চলবে।
অতএব আসুন, আমরা যাবতীয় পাপ কাজ তথা শিরক-বিদ‘আত ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ ছেড়ে দিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক আমল করি। অবনতমস্তকে অহি-র বিধান মেনে নেই। আর আল্লাহর কাছে দো‘আ করি- يَا حَىُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ ‘হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্বচরাচরের ধারক! আমি আপনার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।[21] আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের উপরে অটল থাকার তাওফীক দিন-আমীন!।
আশিক বিল্লাহ বিন শফীকুল আলম
আল-জামি‘আতুল ইসলামিইয়াহ আল-আলামিইয়াহ, রাজশাহী।
[1]. বুখারী হা/৬০২৯।
[2]. বুখারী হা/৩৭৫৯; মিশকাত হা/৪৮৫৩।
[3]. আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/৫০৮২।
[4]. তিরমিযী হা/২০০২; মিশকাত হা/৪৮৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৭৬।
[5]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, ৯ম খন্ড, হা/৪৯১২ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘ভাল কাজের নির্দেশ’ অনুচ্ছেদ।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪৩; তিরমিযী হা/১৯১৯; মুসনাদে আহমাদ হা/৭০৭৩; ছহীহাহ হা/২১৯৬।
[7]. নাসাঈ হা/১৫৭৯, ছহীহ ইবনে খুযায়মা হা/১৭৮৫।
[8]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।
[9]. মুসলিম হা/২৬৭০; ছহীহুল জামে হা/৭০৩৯।
[10]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮৯৭।
[11]. ত্বাবারানী, ছহীহুল জামে হা/৩৭৯৮।
[12]. ত্বাবারানী, ছহীহুল জামে হা/২৭৯৫।
[13]. মুসলিম হা/১৮৪৮।
[14]. নাসাঈ হা/২৫৬২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭৩-৭৪।
[15]. আবু দাঊদ, তিরমিযী হা/২৭৮৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫৪০।
[16]. মুসলিম হা/২৬০।
[17]. মুসলিম হা/৪১৩।
[18]. মুসলিম হা/২০৭৭; মুসনাদে আহমাদ ২/১৬২।
[19]. তিরমিযী হা/২৬৯৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৯৪।
[20]. আবু দাউদ হা/৪০৩১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬১৪৯; মিশকাত হা/৪৩৪৭।
[21]. তিরমিযী হা/৩৫২৪, সনদ হাসান; মিশকাত হা/২৪৫৪।