দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন তৎপরতা সবসময়ই চলছে। কারণ শিক্ষা গতিশীল। তাই একে যুগোপযোগী করার নিরন্তর প্রচেষ্টাই কাম্য। সেই সাথে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যও আছে। তবে শিক্ষা সমন্বয়ে স্থান, কাল, পাত্র বা অবস্থা মোটেই এড়িয়ে যাবার মতো নয়। এখানে মাদরাসা শিক্ষার কথা বলা যাক। মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ ও সাধারণ শিক্ষার সাথে সমন্বিত করার প্রচেষ্টা বেশ  পুরনো। ইতিমধ্যে এ প্রচেষ্টা যথেষ্ট সফল বলতে দ্বিধা নেই। কেননা মাদরাসার পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান শাখাসহ বেসিক ট্রেড কারিগরী ও কম্পিউটার সবই যুক্ত হয়েছে। প্রশংসনীয় এসব সংস্কারকে অনেকে মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ইতিপূর্বে এসব অভিযোগের ভিত্তিকে দুর্বল বলা হ’লেও ২০১৩ সালে পরিবর্ধিত সিলেবাসকে এ অভিযোগের শক্ত ভিত্তিই বলতে হবে।

মাদরাসার বর্তমান পাঠ্যক্রম অনুসারে অষ্টম শ্রেণীতে ৫০ নম্বর করে বাংলা ও ইংরেজীতে মোট একশ’ নম্বর বৃদ্ধি করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, বাড়তি নম্বর বাংলা ও ইংরেজী ২য় পত্রের জন্য অর্থাৎ ব্যাকরণ ও গ্রামারের উপর। স্কুলের জেএসসির তুলনায় ১০০ নম্বর বেশি পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হবে জেডিসি পরীক্ষার্থীদের। অতিরিক্ত নম্বরের পাঠ্যক্রম স্কুলের মতোই; বরং বেশি বলা যায়। কারণ স্কুলের পাঠ্যক্রমে ইংরেজীতে Translation নেই। কিন্তু জেডিসির ইংরেজী ২য় পত্রে Translation আছে। অন্যদিকে মাদরাসার দাখিল পরীক্ষার জন্য বাংলা ও ইংরেজীতে একশ’ করে অতিরিক্ত দুইশ’ নম্বর যোগ করা হয়েছে। দাখিলের ইংরেজী পাঠ্যক্রমে ২য় পত্রের পাঠ্যক্রমে স্কুলের পাঠ্যক্রমের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও তুলনামূলকভাবে কঠিন বলা যায়। এসএসসিতে ইংরেজী ২য় পত্রে Tag question আছে, যা তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু বোধগম্য নয় যে, সহজ প্রশ্নটি কেন মাদরাসার দাখিল পরীক্ষার ইংরেজী ২য় পত্রে রাখা হয়নি। বরং এখানেও Translation রাখা হয়েছে, যা থেকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের উপর হঠাৎ দুইশ’ নম্বর চাপিয়ে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হ’ল- যারা তিনটি ভাষায় দক্ষতার (আরবী, বাংলা, ইংরেজী) পরীক্ষা দিয়ে পূর্ব থেকেই ক্লান্ত। শুধু কি তাই, মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুটিন এতটাই বেশি যে, এই গুরুত্বপূর্ণ দুইশ’ নম্বরের পাঠদান করার মতো আলাদা ঘণ্টা যোগ করার সুযোগ নেই ক্লাস রুটিনে। বাড়তি শিক্ষক তো দূরের কথা। অথচ এ প্রসঙ্গে আমরা আগেও বলেছিলাম যে, স্কুলে Unseen যা ফালতু বলে বাদ দেয়া হয়েছে তা মাদরাসা থেকেও বিদায় করে তদস্থলে গ্রামার যোগ করে অতিরিক্ত ৫০ নম্বরের গ্রামার ও Composition সহ পঁচাত্তর নম্বর গ্রামার পাঠ্যক্রমে যোগ করলে ইংরেজী জ্ঞানার্জনে ঘাটতি থাকতে পারে না।

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় প্রগতিশীল মহল ঈর্ষাবোধ করে, এমনকি অনেকে বিশ্বাস করতে পারে না। অথচ বিভিন্নণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসার ছাত্ররা সাফল্যে পিছিয়ে থাকে না। গত বছর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় যে ছেলেটি প্রথম হয়েছিল সে মাদরাসা থেকে পাস করা। তাছাড়া কুরআনের তাফসীর বা কিরাআত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করছে মাদরাসার ছাত্ররা। কাজেই মাদরাসার ছাত্রদের প্রতিভাকে তাচ্ছিল্য করা অন্যায়। ঠিক তেমনি তাদের পেটে বেশি করে ইংরেজী ঢুকালেই বেশি যোগ্য হয়ে যাবে না। চীন, জাপান, জার্মান, ফ্রান্স এমনকি থাইল্যান্ডের মতো দেশ যারা ইংরেজীকে গুরুত্ব দেয় না, তাদের মর্যাদা আমাদের চাইতে ঢের বেশি। কাজেই বিদ্যার ভরাপেটে বাড়তি কিছু ঠেসে দিলে বদ হজমের আশঙ্কাটাও মনে থাকা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন কয়েক শিক্ষকের নাক সিটকানী রোধ করতে মাদরাসার পাঠ্যক্রম এতটা ভারী করা মোটেও ঠিক হয়নি। এ নিয়ে প্রতিবাদ তো দূরে থাক, সংবাদপত্রেও কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। অথচ পাকিস্তান আমলে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটি বই পাঠ্য করা হয়েছিল মেট্রিকের পাঠ্যক্রমে (SSC)। এতে বেড়ে ছিল ৫০ নম্বর। কিন্তু তৎকালীন ছাত্ররা দেশ জুড়ে এমন প্রতিবাদমুখর হয়েছিল যে, কর্তৃপক্ষ শেষে সিদ্ধান্তটি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

মাদরাসার ছাত্ররা প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি, সম্ভবত জঙ্গী হবার ভয়ে। কিন্তু পাঠ্যক্রম ও নম্বর বৃদ্ধিটা দাখিলেও ৮ম শ্রেণীর মতো একশতে সীমিত রাখার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ কে না জানে মাদরাসাগুলি (ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও) ছাত্র সংকটে ভুগছে। এর কারণও সবাই জানে, ইসলামের প্রতি অহেতুক হীনমন্যতা, ধর্মীয় অনাসক্তি, ইসলামী চালচলনে অনভ্যস্ত সমাজ প্রভৃতি কারণে মাদরাসায় ছাত্রস্বল্পতা প্রকট। মেধাবী ছাত্রের স্বল্পতা আরও প্রকট। এসবের পেছনে ভৌত অবকাঠামোর দৈন্যদশাও একটা কারণ। মাদরাসা ও স্কুল সহঅবস্থানে এবং সমমর্যাদায় থাকা উচিত। কিন্তু চেহারা দেখলেই বুঝা যায় কত অবহেলার শিকার মাদরাসাগুলি। অধিকাংশ মাদরাসা এখনো টিনের ঘরেই পাঠদান করে। এর কারণ সামাজিক ও সরকারী অবহেলা সমান্তরাল। এহেন দূরবস্থার মাঝে পাঠ্যক্রম ভারী করলে ছাত্রসংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? ইংরেজী ভাষা শিক্ষা যেমন দক্ষতা ও মর্যাদার ব্যাপার, তেমনি আরবীও জাতিসংঘের ভাষা হিসাবে সমান গুরুত্ব বহন করে। এ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে মাদরাসার ছাত্ররা কি মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে না? কারিগরিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বা শিল্পকলার উপর সমমানের সনদ অর্জনে তো সাধারণ স্কুলের মতো দুইশত নম্বরের ইংরেজী বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কারিগরিতে মাত্র ৬০ নম্বর ইংরেজী পড়তে হয়।

মাদরাসার পাঠ্যক্রমে অতিরিক্ত ইংরেজী চাপানো অযৌক্তিক। তাই অন্তত দাখিল পর্যায়ে ইংরেজী ও বাংলায় একশ’ না করে পঞ্চাশ নম্বর করে বাড়লেও এসএসসির তুলনায় একশ’ নম্বর বেশি হয়। তবুও না হয় সেটা মেনে নেয়া যায়। এতে যদি প্রগতিশীলতা ফুটো হয়ে যায় তাহলে বলতে হয় যা স্কুলের পাঠ্যক্রমে নেই তা কেন মাদরাসার ‘হুযূরদের’ জন্য চাপানো হ’ল। স্কুলে ৮ম বা নবম কোথাও Translation নেই। স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ইংরেজী ২য় পত্রে গ্রামারের সংজ্ঞা নেই। কিন্তু মাদরাসায় ৮ম এর ২য় পত্রে গ্রামারের সংজ্ঞা রাখা হয়েছে। ফলে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের গ্রামারের সমস্ত অংশের সংজ্ঞা উদাহরণসহ মুখস্ত করতে হচ্ছে, যার আয়তন সিলেবাসের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু নম্বর মাত্র দশ। এসব কারণে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মাদরাসার পাঠ্যক্রমে অতিরিক্ত নম্বর অন্যায়ভাবে বাড়ানো হয়েছে। কাজেই এসব বাড়তি ঝামেলা থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের হালকা করা সময়ের দাবি। তাই নিমণলিখিত প্রস্তাবগুলি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি।

(১) দাখিলের ইংরেজী ২য় পত্রে Translation বাদ দিয়ে Tag question যুক্ত করা হোক।

(২) SSC-তে ইংরেজী ২য় পত্র Story writing-এর বিকল্প বা or আছে Summary বা Precise লেখা। এটা পরীক্ষার্থীর জন্য সুবিধা হ’লেও দাখিলের ইংরেজী প্রশ্নে ঐ সুযোগ রাখা হয়নি। সঙ্গত কারণেই মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের এ সুযোগ দেয়া হোক।

(৩) SSC-তে Story লেখার জন্য ২০ নম্বর দেয়া হয়। কিন্তু দাখিলের জন্য ১০ নম্বর। কাজেই দাখিলের ২য় পত্রে গল্প সমাপ্তিকরণে ২০ নম্বর করা হোক।

(৪) স্কুলে Seen Passage-এর মান ৫০ কিন্তু মাদরাসায় ২০ নম্বর। অভিন্ন পাঠের মানও অভিন্ন হবে এটাই সঙ্গত। তাই স্কুলের মতো Unseen বাদ দিয়ে মাদরাসার দাখিল পরীক্ষার ইংরেজী ১ম পত্রের মান ৫০ করা হোক। বাংলাতেও ৫০ নম্বর কমিয়ে SSC-এর মোট নম্বরের সাথে ব্যবধান ১০০ নম্বর (বেশি) রাখা হোক ২০০ থেকে কমিয়ে।

(৫) আর যদি নম্বর না কমানোর বিধানই বহাল থাকে তবে বাংলা ১ম পত্রের মত ইংরেজী ১ম পত্র (দাখিল) Seen এবং Unseen এর উপর প্রশ্ন সীমাবদ্ধ রাখা হোক। ৪০+৪০=৮০ এবং vocabulary ২০ মোট ১০০।

(৬) মাদরাসার ৮ম শ্রেণীতে (জেডিসি) প্রামারের সংজ্ঞা সংক্রান্ত প্রশ্ন বাদ দেয়া হোক। এর পরিবর্তে Letter দেয়া হোক। নবম শ্রেণীর ১ম পত্রে দরখাস্তের বদলে চিঠি হলেই ভালো হয়।

(৭) আরবী ১ম ও ২য় পত্রে ২৫ নম্বর করে নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্ন রাখা হোক।

মেধা যাচাইয়ের জন্য বেশি নম্বরের পরীক্ষা নেয়া অত্যাবশ্যক নয়। ইংরেজী ১ম পত্রে (দাখিল) চিঠি, দরখাস্ত ও Paragraph রাখার তেমন আবশ্যকতা নেই। ২য় পত্রে এসব রয়েছে। তা মেধা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শুধু নম্বরের বোঝা নয়, প্রশ্নমানের বোঝাও ভারী করা হয়েছে। অর্ধেক বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের পাশাপাশি আরবী দুই পত্রে নৈর্ব্যক্তিক বাদ দেয়া হয়েছে। যা পাসের গতিকে শ­থ করবে নিঃসন্দেহে। কাজেই এক সাথে এত চাপে ফেললে নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।

\ সংকলিত \






ভূমিকম্পের টাইম বোমার ওপর ঢাকা : এখনই সচেতন হ’তে হবে - কামরুল হাসান দর্পণ
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৪র্থ কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
উত্তম মৃত্যুর কিছু নিদর্শন ও আমাদের করণীয় - ইহসান ইলাহী যহীর
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান (শেষ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি (শেষ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
দাওয়াত ও সংগঠন - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.