ভারত ভাগ হয়ে যাচ্ছে

ভারতের রাজধানী দিল্লীতে মুসলমানদের উপর গত ২৪-২৭শে ফেব্রুয়ারী চার দিনে চালানো রক্তাক্ত সহিংসতার বিষয়ে বিরোধী দল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘ভারত ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এতে কারও লাভ হচ্ছে না। কেবল ভারতেরই ক্ষতি হবে’। গত ৫ই মার্চ বৃহস্পতিবার ইতালী থেকে ফিরেই হিংসা বিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লী পরিদর্শনে যান রাহুল। তার সঙ্গে ছিলেন অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। সেখানে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের তান্ডবে পুড়ে যাওয়া ঘর-বাড়ী, ভাঙচুর ও লুটতরাজের চিহ্ন ও আশ্রয়হীন সংখ্যালঘুদের দেখে ভাষা হারিয়ে ফেলেন তিনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘৃণা ও হিংসা সব ধ্বংস করে দিয়েছে আমাদের। স্কুলে কোমলমতিরাও নিরাপদ নয় ভারতে। আমাদের ভবিষ্যৎকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে এখানে’।

রাহুল গান্ধীর সখেদ উচ্চারণ তার প্রপিতামহ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর (১৮৮৯-১৯৬৪ খৃ.) কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অবিভক্ত ভারতে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট কলিকাতায় হিন্দু-মুসলিম রক্তক্ষয়ী রায়টের জন্য প্রধানতঃ দায়ী করা হয় তাঁকে। যার ফলশ্রুতিতে এক বছর পর ১৪ ও ১৫ই আগস্টে পাকিস্তান ও ভারত নামে অখন্ড ভারত বিভক্ত হয়ে যায় (ভারত স্বাধীন হ’ল পৃ. ১৫৪-৫৬)। নেহেরুর নিকটতম বন্ধু মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে লিখিত আত্মজীবনীতে দুঃখ করে বলেন, নেহেরুকে কংগ্রেসের সভাপতি করাই ছিল আমার রাজনৈতিক জীবনের সবচাইতে বড় ভুল’ (ঐ, পৃ. ১৪৮)। আর ভারতের জাতির পিতা বলে খ্যাত মিঃ গান্ধীর (১৮৬৯-১৯৪৮) জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, গুজরাটের একজন সাধারণ আইনজীবী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল (১৮৭৫-১৯৫০)-কে অতিরিক্ত লাই দেওয়া। যাকে দেশ স্বাধীনের পর নেহেরু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসান। তিনিই বৃটিশের সাথে স্বাধীনতার শর্ত লঙ্ঘন করে কাশ্মীর, জুনাগড়, মানভাদর, হায়দরাবাদ প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্যগুলিকে জোর করে ভারতভুক্ত করে নেন। আর তারই সময়ে দিল্লীতে মুসলিম নিধন যজ্ঞ শুরু হয়। সেই সহিংসতা থামাতে গান্ধী দিল্লী আসেন এবং সব দলের নেতাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি অনশনে চলে যান। তখন তার জীবনাশঙ্কা দেখা দিলে নেতারা শান্ত হন এবং দাঙ্গা থেমে যায়। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল এতে খুশী হননি। তখন গান্ধী দিল্লীতে সর্বদলীয় প্রার্থনা সভা আহবান করেন। সেখানে উপস্থিত হাযার হাযার শান্তিপ্রিয় মানুষের সামনেই জনৈক কঠোর হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী নথুরাম গড্সে প্রকাশ্যে তাকে তিন তিনটা গুলি করে হত্যা করে। এতে জয়পুর, গোয়ালিয়র প্রভৃতি শহরে মিষ্টি বিতরণ করা হয় (ঐ, পৃ. ২২৪-২৬)। সেদিন ভারত স্বাধীন হ’লেও অখন্ডতা হারিয়েছিল চিরদিনের জন্য। এজন্য সেদিন দায়ী ছিলেন মূলতঃ নেহেরু ও প্যাটেল। আজও সম্ভবতঃ তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন মোদী ও অমিত শাহ।

কেন যেন কাকতালীয়ভাবে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীরব সমর্থনে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চে পুলিশ ও দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত অন্যূন ২ হাযার মুসলিম নারী-পুরুষের দগদগে রক্তাক্ত স্মৃতি পুনরায় ফিরে এল ২০২০ সালের শেষ ফেব্রুয়ারীতে একই মোদীর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে রাজধানী দিল্লীতে সুপরিকল্পিতভাবে অর্ধশতাধিক নিরীহ মুসলিম নর-নারী হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। গত শতাব্দীতে নেহেরু-প্যাটেলের মুসলিম বিদ্বেষী সংকীর্ণ অপরাজনীতির কারণে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল এবং কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে রক্ত ঝরার ব্যবস্থা হয়েছিল। আজও মোদী-অমিত শাহদের মুসলিম বিদ্বেষী সংকীর্ণ অপরাজনীতির কারণে ভারত পুনরায় বিভক্তির কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার সম্ভবতঃ আর দুই ভাগে নয়, বরং কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হবে। মুসলমানরা সাড়ে ছয়শো বছর অখন্ড ভারতবর্ষ শাসন করেছে। কোনদিন কাউকে ধর্মীয় পরিচয়ে নির্যাতন করেনি। অথচ এখন পাঁচ বছরের জন্য দিল্লীর ক্ষমতায় বসে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন মোদী সরকার। নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে বড় গুণ হ’ল, উদারতা ও সহনশীলতা। দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় নেতৃত্বে এই দু’টি গুণের বড়ই অভাব। যেকারণে আজ ভারতের সাথে প্রতিবেশী কোন দেশের সদ্ভাব নেই। নিজ দেশের ভিতরেও তাদের পরস্পরে সাপে-নেউলে অবস্থা।

২০১৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর ভারতে Citizenship Amendment Bill তথা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-‘ক্যাব’ কার্যকর হওয়ার পর থেকে গত প্রায় তিন মাস ধরে উক্ত আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ-আনেদালন চলছে। এরই মধ্যে বহিরাগত হেলমেটধারী সন্ত্রাসীদের তান্ডব চলেছে উত্তর-পূর্ব দিল্লীর মুছতফাবাদ, জাফরাবাদ, গাযিয়াবাদ প্রভৃতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায়। যেখানে বেছে বেছে কেবল মুসলিমদের উপর রক্তক্ষয়ী হামলা চালানো হয়েছে। যাতে অর্ধশতাধিক নিহত ও ৩ শতাধিক আহত হওয়া ছাড়াও ঘর-বাড়ী, মসজিদ-মাযারে অগ্নি সংযোগ করে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে সেখানে হিন্দু-মুসলিম একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে।  কিন্তু দিল্লী পুলিশ আক্রান্তদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। ১৩ হাযার ২০০ ফোন কলেও তারা সাড়া দেয়নি। কখনো কখনো সাড়া দিয়ে বলেছে, আমরা ৫ মিনিটের মধ্যে আসছি, কিন্তু আসেনি।

প্রশ্ন উঠছে, এই দাঙ্গা কি শুধুই নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আন্দোলনের পক্ষের আর বিপক্ষের সংঘর্ষ? নাকি এই দাঙ্গা নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বৃহত্তর বিতর্ক থেকে দৃষ্টি ফিরাবার প্রচেষ্টা? তাছাড়া দিল্লীর এই হত্যাযজ্ঞ কি হঠাৎ করেই শুরু হ’ল? না কি রাষ্ট্রের সরাসরি মদদে পূর্ব পরিকল্পনা মতে বাস্তবায়িত হ’ল?

লেখক দেবদাস চৌধুরীর মতে, এটি সংঘর্ষও নয়, দাঙ্গাও নয়। বরং সরাসরি রাষ্ট্রের মদদে সংঘবদ্ধ নির্যাতন, হত্যা ও লুণ্ঠন। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে মুসলিম নিধন চলেছে সেখানে। যাতে কোনভাবেই আরেকটি শাহীনবাগ তৈরী হ’তে না পারে। কলিকাতার সোহিনী গুপ্তের ভাষায়, শাহীনবাগ সারা দেশের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে উঠেছে। যখন দিল্লীর জাফরাবাদের রাস্তায় নারীরা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে রাস্তায় নামলেন। যা গোটা দেশকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই সরকার ভয় পাচ্ছে শাহীনবাগকে। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদকে অবশ্য মুসলমানদের প্রতিবাদ হিসাবেই দেখাতে চেষ্টা করছে বিজেপি। যদিও সেটি আদৌ ঠিক নয়’। কিন্তু বিজেপি এর দ্বারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। একদিকে মুসলিম নিধন ও বিতাড়নের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীদের তোষণ। অন্যদিকে বিরোধীদের দমন।

আমরা মনে করি, হিংসা কেবল হিংসা আনয়ন করে, শান্তি আনেনা। অতএব শাসক দলের উচিৎ যিদ পরিহার করে বাস্তববাদী হওয়া। আল্লাহর এই যমীনে আল্লাহর সকল বান্দার স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিৎ সেটাকে অক্ষুণ্ণ রাখা। ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা সর্বদা কল্যাণ বয়ে আনে। আমরা উপমহাদেশের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত কামনা করি।






উত্তরাঞ্চলকে বাঁচান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্কুল-মাদ্রাসা থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা কোর্স বাতিল করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জবাবদিহিতার অনুভূতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দর্শনীয় স্থানগুলি শিক্ষণীয় স্থান রূপে গড়ে তুলুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে ছায়েম অনুধাবন কর! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শান্তি ও সহিষ্ণুতার ধর্ম ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেউলিয়া হ’ল শ্রীলংকা! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
১লা বৈশাখ ও নারীর বস্ত্রহরণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আন্তঃধর্ম শান্তি সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কোয়ান্টাম মেথড : একটি শয়তানী ফাঁদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আসামে মুসলিম নিধন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.